শেকড়ের ডাক-আজ চৈত্রসংক্রান্তি না পহেলা বৈশাখ by ফরহাদ মাহামুদ
সামরিক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেবের ফরমানবলে বাংলাদেশে নতুন বাংলা সন চালু হয়েছিল। বাঙালি মুসলমানের জীবনে, বিশেষ করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বাংলা সনের কোনো প্রয়োগ নেই। তাই আমরা সানন্দচিত্তে তা মেনে নিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাসী হিন্দুদের পূজা-আচার-অর্চনা এই পঞ্জিকা দিয়ে চলে না।
পূজা-অর্চনার শুদ্ধতার জন্য তারা চিরাচরিত পঞ্জিকাকেই অনুসরণ করে। সে অর্থে বিশ্বাসী হিন্দুদের আজ চড়ক পূজা ও চৈত্রসংক্রান্তি। শুধু বিশ্বাসী হিন্দু নয়, গত বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নবপ্রবর্তিত ২ বৈশাখে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়েছে। অনেক মুসলমান ব্যবসায়ীও হালখাতা উৎসব করেছেন চিরাচরিত পঞ্জিকা অনুযায়ী। তাই আজ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আজ চৈত্রসংক্রান্তি না পহেলা বৈশাখ?
পঞ্জিকা সংস্কার কমিটিতে বেশ কয়েক বিশিষ্টজন জড়িত ছিলেন। তাঁদের কারো কারো সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা বলে থাকেন, চিরাচরিত পঞ্জিকা বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। তদুপরি ইংরেজি সালের সঙ্গে একটি সামঞ্জস্য আনার জন্য এটি করা হয়েছে। মেনে নিলাম চিরাচরিত পঞ্জিকা বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। এখন যেটি করা হয়েছে সেটি কি বিজ্ঞানসম্মত? বিশাখা নক্ষত্রের নামে যে বৈশাখ, তা কি এই পঞ্জিকা মেনে উদয় হয়? এ ক্ষেত্রে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার জনক মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি যেসব মতামত দিয়েছিল, তা ছিল বরং বেশি বিজ্ঞানসম্মত। পঞ্জিকাকে বিজ্ঞানসম্মত করতে হলে তাদের সেটি মেনেই সংস্কার করা উচিত ছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, সিদ্ধার্থ শংকর রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সেই সংস্কার প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তিনি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
আসলে আল্লাহ, গড, ঈশ্বর বা ভগবানের উদ্দেশে নিবেদিত মানুষের সব প্রার্থনা একান্তই বিশ্বাসের ব্যাপার। এখানে সব কিছুই বিজ্ঞান মেনে চলে না। যেমন আমরা বৈজ্ঞানিক নই_এই অজুহাতে হিজরি সনের কোনো কিছুই পরিবর্তন আনতে পারব না। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে ফলাফল ভয়াবহ রূপ নেবে। ইসলাম ধর্মের অনেক তথ্যকেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। প্রকৃত বিজ্ঞান তো সৃষ্টিকর্তা, ভগবান, দেবদেবীর অস্তিত্বকেই স্বীকার করে না। বৈজ্ঞানিক নয় বলে কি এসব বই-পুস্তক বা শিক্ষাক্রম থেকে বাদ দেওয়া কি সম্ভব? কারো সাহস থাকলে সে রকম কিছু করে দেখতে পারেন। কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দুরা প্রতিবাদ করতে পারবে না, করলেও তা হবে খুবই দুর্বল_তাই অতিসহজেই এ কাজটি আমরা করতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস, এ কাজটি আমাদের সংবিধানেরও পরিপন্থী। কারণ, সংবিধান কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করাকে সমর্থন করে না।
এ ছাড়া নববর্ষ উদ্যাপন ছিল বাংলার সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাঙালি সংস্কৃতির অবশিষ্ট অভিন্ন উৎসবগুলোর মধ্যে প্রধানতম। তাও এখন বিভক্ত হয়ে গেল। বাঙালি মুসলমানরা নববর্ষ উদ্যাপন করছে ১৪ এপ্রিল। আর বাঙালি হিন্দু, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী, এমনকি অনেক মুসলমানও নববর্ষ উদ্যাপন করেছে ১৫ এপ্রিল। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক গোলাম মুরশিদের আশঙ্কাটি আমার কাছে অত্যন্ত যথার্থ মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'কেবল একটি মাত্র বিভেদের অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে বাংলা নববর্ষের দিগন্তে। একতরফাভাবে বাংলাদেশ যেভাবে বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার করেছে, তা সম্ভবত বাংলা সনকে আর হিন্দু-মুসলমানের অভিন্ন উৎসবে থাকতে দেবে না। ...যেদিন এসব দুই বাংলায় দুই দিনে পালন হবে, সেদিনই এই সনের অখণ্ড বাঙালিত্ব খণ্ডিত হবে।'
পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতি আর বাঙালি হিন্দুদের সংস্কৃতি আলাদা করার বহু চেষ্টা করেছিল। এর কারণ ছিল একটাই_ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে অতীতে ধর্মনির্ভর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের নববর্ষ পালনের বিরোধিতা থেকে। নিকট অতীতে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলাও তারই একটি প্রমাণ। আমার মনে হয়, সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অতীতে তারা খুব একটা সফল হতে পারেনি। ছায়ানটের অনুষ্ঠান তারা বন্ধ করতে পারেনি, উত্তরোত্তর তার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে এবং নববর্ষ পালন বাংলার অন্যতম বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পঞ্জিকা সংস্কারের মাধ্যমে আমরা প্রকারান্তরে পাকিস্তানপন্থীদের সেই আরাধ্য কাজটিই করে দিয়েছি। বাংলা নববর্ষের অখণ্ডতাকে খণ্ডিত করেছি।
হিন্দুরা কেন এ দিবস পালন করতে পারবে না? কারণ, এর সঙ্গে তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ, সামাজিক জীবন এমনভাবে জড়িত যে ফরমানের বলে নয়, আকাশের সঙ্গে মিল রেখেই তাদের পঞ্জিকা নির্ধারণ করতে হবে। হিন্দুদের বর্ষপঞ্জিতে 'পঞ্চাঙ্গ' খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে বার, নক্ষত্র, তিথির পাশাপাশি রয়েছে ২৭টি 'যোগ' ও ১১টি 'করণ'। এসবের বিচার-বিশ্লেষণ করেই তাদের এগোতে হবে। যাবতীয় গণনা চন্দ্র ও সূর্যের চলমান ক্রান্ত্যংশ থেকে নিতে হবে। আর তা না হলে তা দৃক্সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হবে না এবং বিশ্বাসী হিন্দুদের পূজা-অর্চনার শুদ্ধতা থাকবে না। এ ছাড়া কোষ্ঠীবিচার হিন্দুদের জীবনে এখনো যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বৈদিক যুগ থেকে তাঁরা যেভাবে পঞ্জিকা নির্ধারণ ও ধর্মীয় রীতিনীতি পরিচালনা করে এসেছেন, তার সঙ্গে সংগতিহীনভাবে কোনো পরিবর্তন করা হলে তাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, হতে পারে না।
সম্প্রতি কারো কারো লেখায় আমরা দেখতে পাই, সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন। ভাবখানা এমন যেন তার আগে এ দেশে কোনো সন গণনা ছিল না। হিন্দুদের পূজা-অর্চনা তখন পঞ্জিকা মেনে চলেনি। দ্বিতীয়ত, কট্টর কারো কারো মধ্যে এমন একটি ভাবও দেখা যায়, মুসলমানের তৈরি সন নিয়ে হিন্দুদের এত বাড়াবাড়ি কেন? কেউ কেউ এমনও বলেছেন, পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের দেখাদেখি এখানকার হিন্দুরা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করছে। (প্রসঙ্গটিতে ইতিমধ্যেই একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব 'ইন' করে গেছে।) বাস্তবতা হলো, নিষ্ঠাবান হিন্দুর পক্ষে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হিসেবে বেছে নেওয়ার কোনো উপায়ই নেই। তা বুঝতে হলে একটু পেছন ফিরে তাকাতেই হবে।
ভারতীয় পঞ্জিকা মূলত হিন্দু পঞ্জিকা। মুসলমানরা এ দেশে আসার বহু আগ থেকেই এখানে পঞ্জিকার প্রচলন ছিল। শংকর বালকৃষ্ণ দীক্ষিতের মতে, হিন্দু পঞ্জিকা সৃষ্টির তিনটি যুগ রয়েছে। এক. বৈদিক যুগ (অবর্ণিত প্রাচীনকাল থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ); দুই. বেদান্ত-জ্যোতিষ যুগ (১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং সিদ্ধান্ত-জ্যোতিষ যুগ (৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত)। সেই তুলনায় সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) তো সেদিনের। আর তিনি বাংলা সনও প্রবর্তন করেননি। (তিনি নিজে বাঙালি ছিলেন না, বাংলা জানতেনও না। আসলে বাংলা সন বলে কিছু ছিলই না। ইংরেজ শাসনামলে দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যখন গ্রেগরি পঞ্জিকা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন আমাদের পঞ্জিকা আলাদা করে বোঝানোর জন্য এর সঙ্গে বাংলা যোগ করা হয়।) সম্রাট আকবরের সময় ভারতবর্ষে জানা মতে ৪০ ধরনের পঞ্জিকার প্রচলন ছিল। সারা দুনিয়ার মতোই এখানেও প্রধান প্রধান প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব পঞ্জিকা ছিল। আকবরের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট উদার। তিনি যেমন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের নানা উপাদান নিয়ে 'দিন-ই-ইলাহি' নামে নতুন ধর্মের অবতারণা করেছিলেন, তেমনি প্রচলিত হিন্দু পঞ্জিকার ওপর ভিত্তি করেই একটি নতুন সন-প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। খাজনা আদায় ও শাসনকাজ পরিচালনার সুবিধার্থে সারা ভারতবর্ষের জন্য তিনি একটি অভিন্ন সন-প্রথার প্রচলন করেছিলেন মাত্র। আর হিজরির সঙ্গে মিল রেখে সূচনাকাল বা সূচনাবর্ষ নির্ধারণ করা হলেও হিন্দু পঞ্জিকার সঙ্গে এর কোনো বিরোধ ঘটেনি। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পঞ্জিকা প্রবর্তন তাদের সেই পঞ্জিকার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠানাদি শেষ না করে তারা বর্ষবরণে আসতে পারেন না।
কেন এ পরিবর্তন
ধর্মীয়, সামাজিক, প্রশাসনিক, দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নানা কারণে পঞ্জিকা প্রণীত হয়। আধুনিককালে আন্তর্জাতিক প্রয়োজনও তৈরি হয়েছে। বাংলা সন বলতে আমরা যে পঞ্জিকা পাই, তার কোনো প্রয়োগ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের জীবনে আছে কি? আইন করা সত্ত্বেও তা কি আমাদের প্রশাসনিক কাজে বাংলা সন ব্যবহৃত হচ্ছে? প্রাত্যহিক জীবনে গ্রেগরি পঞ্জিকার সঙ্গে আমরা এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে 'আজ বাংলা মাসের কত তারিখ' প্রশ্ন করা হলে আমরা আকাশ থেকে পড়ি। তাহলে কেন একে অস্ত্রোপচার করা হলো? আমার জীবনে যেহেতু এর কোনো প্রয়োগ নেই, সে কারণে ১৪ তারিখে কেন ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখে বাংলা নববর্ষ হলেও আমার কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু যে বাঙালি হিন্দুদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে এর বিশদ প্রয়োগ আছে তারা শুদ্ধতা ছাড়া একে কিভাবে মেনে নেবে?
আমরা কোনো অশনিসংকেত দেখতে চাই না। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে মুখে অসাম্প্রদায়িক হতে চাই না। আমরা অবশিষ্ট অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতির আর বিভাজন চাই না। আমরা চাই পহেলা বৈশাখ সমগ্র বাঙালির জন্য একটাই থাকুক।
লেখক : সাংবাদিক
fmahmud53@yahoo.com
পঞ্জিকা সংস্কার কমিটিতে বেশ কয়েক বিশিষ্টজন জড়িত ছিলেন। তাঁদের কারো কারো সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা বলে থাকেন, চিরাচরিত পঞ্জিকা বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। তদুপরি ইংরেজি সালের সঙ্গে একটি সামঞ্জস্য আনার জন্য এটি করা হয়েছে। মেনে নিলাম চিরাচরিত পঞ্জিকা বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। এখন যেটি করা হয়েছে সেটি কি বিজ্ঞানসম্মত? বিশাখা নক্ষত্রের নামে যে বৈশাখ, তা কি এই পঞ্জিকা মেনে উদয় হয়? এ ক্ষেত্রে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার জনক মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি যেসব মতামত দিয়েছিল, তা ছিল বরং বেশি বিজ্ঞানসম্মত। পঞ্জিকাকে বিজ্ঞানসম্মত করতে হলে তাদের সেটি মেনেই সংস্কার করা উচিত ছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, সিদ্ধার্থ শংকর রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সেই সংস্কার প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তিনি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
আসলে আল্লাহ, গড, ঈশ্বর বা ভগবানের উদ্দেশে নিবেদিত মানুষের সব প্রার্থনা একান্তই বিশ্বাসের ব্যাপার। এখানে সব কিছুই বিজ্ঞান মেনে চলে না। যেমন আমরা বৈজ্ঞানিক নই_এই অজুহাতে হিজরি সনের কোনো কিছুই পরিবর্তন আনতে পারব না। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে ফলাফল ভয়াবহ রূপ নেবে। ইসলাম ধর্মের অনেক তথ্যকেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। প্রকৃত বিজ্ঞান তো সৃষ্টিকর্তা, ভগবান, দেবদেবীর অস্তিত্বকেই স্বীকার করে না। বৈজ্ঞানিক নয় বলে কি এসব বই-পুস্তক বা শিক্ষাক্রম থেকে বাদ দেওয়া কি সম্ভব? কারো সাহস থাকলে সে রকম কিছু করে দেখতে পারেন। কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দুরা প্রতিবাদ করতে পারবে না, করলেও তা হবে খুবই দুর্বল_তাই অতিসহজেই এ কাজটি আমরা করতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস, এ কাজটি আমাদের সংবিধানেরও পরিপন্থী। কারণ, সংবিধান কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করাকে সমর্থন করে না।
এ ছাড়া নববর্ষ উদ্যাপন ছিল বাংলার সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাঙালি সংস্কৃতির অবশিষ্ট অভিন্ন উৎসবগুলোর মধ্যে প্রধানতম। তাও এখন বিভক্ত হয়ে গেল। বাঙালি মুসলমানরা নববর্ষ উদ্যাপন করছে ১৪ এপ্রিল। আর বাঙালি হিন্দু, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী, এমনকি অনেক মুসলমানও নববর্ষ উদ্যাপন করেছে ১৫ এপ্রিল। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক গোলাম মুরশিদের আশঙ্কাটি আমার কাছে অত্যন্ত যথার্থ মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'কেবল একটি মাত্র বিভেদের অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে বাংলা নববর্ষের দিগন্তে। একতরফাভাবে বাংলাদেশ যেভাবে বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার করেছে, তা সম্ভবত বাংলা সনকে আর হিন্দু-মুসলমানের অভিন্ন উৎসবে থাকতে দেবে না। ...যেদিন এসব দুই বাংলায় দুই দিনে পালন হবে, সেদিনই এই সনের অখণ্ড বাঙালিত্ব খণ্ডিত হবে।'
পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতি আর বাঙালি হিন্দুদের সংস্কৃতি আলাদা করার বহু চেষ্টা করেছিল। এর কারণ ছিল একটাই_ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে অতীতে ধর্মনির্ভর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের নববর্ষ পালনের বিরোধিতা থেকে। নিকট অতীতে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলাও তারই একটি প্রমাণ। আমার মনে হয়, সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অতীতে তারা খুব একটা সফল হতে পারেনি। ছায়ানটের অনুষ্ঠান তারা বন্ধ করতে পারেনি, উত্তরোত্তর তার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে এবং নববর্ষ পালন বাংলার অন্যতম বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পঞ্জিকা সংস্কারের মাধ্যমে আমরা প্রকারান্তরে পাকিস্তানপন্থীদের সেই আরাধ্য কাজটিই করে দিয়েছি। বাংলা নববর্ষের অখণ্ডতাকে খণ্ডিত করেছি।
হিন্দুরা কেন এ দিবস পালন করতে পারবে না? কারণ, এর সঙ্গে তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ, সামাজিক জীবন এমনভাবে জড়িত যে ফরমানের বলে নয়, আকাশের সঙ্গে মিল রেখেই তাদের পঞ্জিকা নির্ধারণ করতে হবে। হিন্দুদের বর্ষপঞ্জিতে 'পঞ্চাঙ্গ' খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে বার, নক্ষত্র, তিথির পাশাপাশি রয়েছে ২৭টি 'যোগ' ও ১১টি 'করণ'। এসবের বিচার-বিশ্লেষণ করেই তাদের এগোতে হবে। যাবতীয় গণনা চন্দ্র ও সূর্যের চলমান ক্রান্ত্যংশ থেকে নিতে হবে। আর তা না হলে তা দৃক্সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হবে না এবং বিশ্বাসী হিন্দুদের পূজা-অর্চনার শুদ্ধতা থাকবে না। এ ছাড়া কোষ্ঠীবিচার হিন্দুদের জীবনে এখনো যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বৈদিক যুগ থেকে তাঁরা যেভাবে পঞ্জিকা নির্ধারণ ও ধর্মীয় রীতিনীতি পরিচালনা করে এসেছেন, তার সঙ্গে সংগতিহীনভাবে কোনো পরিবর্তন করা হলে তাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, হতে পারে না।
সম্প্রতি কারো কারো লেখায় আমরা দেখতে পাই, সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন। ভাবখানা এমন যেন তার আগে এ দেশে কোনো সন গণনা ছিল না। হিন্দুদের পূজা-অর্চনা তখন পঞ্জিকা মেনে চলেনি। দ্বিতীয়ত, কট্টর কারো কারো মধ্যে এমন একটি ভাবও দেখা যায়, মুসলমানের তৈরি সন নিয়ে হিন্দুদের এত বাড়াবাড়ি কেন? কেউ কেউ এমনও বলেছেন, পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের দেখাদেখি এখানকার হিন্দুরা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করছে। (প্রসঙ্গটিতে ইতিমধ্যেই একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাব 'ইন' করে গেছে।) বাস্তবতা হলো, নিষ্ঠাবান হিন্দুর পক্ষে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হিসেবে বেছে নেওয়ার কোনো উপায়ই নেই। তা বুঝতে হলে একটু পেছন ফিরে তাকাতেই হবে।
ভারতীয় পঞ্জিকা মূলত হিন্দু পঞ্জিকা। মুসলমানরা এ দেশে আসার বহু আগ থেকেই এখানে পঞ্জিকার প্রচলন ছিল। শংকর বালকৃষ্ণ দীক্ষিতের মতে, হিন্দু পঞ্জিকা সৃষ্টির তিনটি যুগ রয়েছে। এক. বৈদিক যুগ (অবর্ণিত প্রাচীনকাল থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ); দুই. বেদান্ত-জ্যোতিষ যুগ (১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং সিদ্ধান্ত-জ্যোতিষ যুগ (৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত)। সেই তুলনায় সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) তো সেদিনের। আর তিনি বাংলা সনও প্রবর্তন করেননি। (তিনি নিজে বাঙালি ছিলেন না, বাংলা জানতেনও না। আসলে বাংলা সন বলে কিছু ছিলই না। ইংরেজ শাসনামলে দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যখন গ্রেগরি পঞ্জিকা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন আমাদের পঞ্জিকা আলাদা করে বোঝানোর জন্য এর সঙ্গে বাংলা যোগ করা হয়।) সম্রাট আকবরের সময় ভারতবর্ষে জানা মতে ৪০ ধরনের পঞ্জিকার প্রচলন ছিল। সারা দুনিয়ার মতোই এখানেও প্রধান প্রধান প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব পঞ্জিকা ছিল। আকবরের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট উদার। তিনি যেমন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের নানা উপাদান নিয়ে 'দিন-ই-ইলাহি' নামে নতুন ধর্মের অবতারণা করেছিলেন, তেমনি প্রচলিত হিন্দু পঞ্জিকার ওপর ভিত্তি করেই একটি নতুন সন-প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। খাজনা আদায় ও শাসনকাজ পরিচালনার সুবিধার্থে সারা ভারতবর্ষের জন্য তিনি একটি অভিন্ন সন-প্রথার প্রচলন করেছিলেন মাত্র। আর হিজরির সঙ্গে মিল রেখে সূচনাকাল বা সূচনাবর্ষ নির্ধারণ করা হলেও হিন্দু পঞ্জিকার সঙ্গে এর কোনো বিরোধ ঘটেনি। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পঞ্জিকা প্রবর্তন তাদের সেই পঞ্জিকার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠানাদি শেষ না করে তারা বর্ষবরণে আসতে পারেন না।
কেন এ পরিবর্তন
ধর্মীয়, সামাজিক, প্রশাসনিক, দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নানা কারণে পঞ্জিকা প্রণীত হয়। আধুনিককালে আন্তর্জাতিক প্রয়োজনও তৈরি হয়েছে। বাংলা সন বলতে আমরা যে পঞ্জিকা পাই, তার কোনো প্রয়োগ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের জীবনে আছে কি? আইন করা সত্ত্বেও তা কি আমাদের প্রশাসনিক কাজে বাংলা সন ব্যবহৃত হচ্ছে? প্রাত্যহিক জীবনে গ্রেগরি পঞ্জিকার সঙ্গে আমরা এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে 'আজ বাংলা মাসের কত তারিখ' প্রশ্ন করা হলে আমরা আকাশ থেকে পড়ি। তাহলে কেন একে অস্ত্রোপচার করা হলো? আমার জীবনে যেহেতু এর কোনো প্রয়োগ নেই, সে কারণে ১৪ তারিখে কেন ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখে বাংলা নববর্ষ হলেও আমার কিছু যাবে-আসবে না। কিন্তু যে বাঙালি হিন্দুদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে এর বিশদ প্রয়োগ আছে তারা শুদ্ধতা ছাড়া একে কিভাবে মেনে নেবে?
আমরা কোনো অশনিসংকেত দেখতে চাই না। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে মুখে অসাম্প্রদায়িক হতে চাই না। আমরা অবশিষ্ট অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতির আর বিভাজন চাই না। আমরা চাই পহেলা বৈশাখ সমগ্র বাঙালির জন্য একটাই থাকুক।
লেখক : সাংবাদিক
fmahmud53@yahoo.com
No comments