পিকেটারদের ধাওয়া খেয়ে প্রাণ গেল গাড়িচালকের-হরতালে ঢাকাসহ কিছু স্থানে সহিংসতা

বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ডাকা হরতাল গতকাল রাজধানীতে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন সহিংসতা ঘটেছে। সাভারে পিকেটারদের বেপরোয়া আচরণের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয় এক গাড়িচালককে।


রাজশাহীতে সংঘর্ষে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু, সাংবাদিক, পুলিশসহ ২০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা শাখার সভাপতি এম ইলিয়াস আলীর নিজ জেলা সিলেটে পুলিশের সঙ্গে নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পুলিশ শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হন। পুলিশ ৩৮ জনকে আটক করে।
চট্টগ্রামেও পুলিশের সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এতে পাঁচ বিএনপিকর্মী আহত ও ২০ কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। চট্টগ্রামে পিকেটাররা বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৫ থেকে ২০টি যানবাহন ভাঙচুর করে। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন। হবিগঞ্জেও পিকেটারদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচজন আহত হয়েছেন। কালের কণ্ঠের কার্যালয়, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
ঢাকায় নিরুত্তাপ হরতাল : রাজধানীতে বিক্ষিপ্তভাবে হাতবোমার বিস্ফোরণ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে গতকাল রবিবার হরতাল পালিত হয়। রাজপথে আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। সক্রিয় ছিলেন একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের রাজপথে দেখা যায়নি। ঢাকায় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল অবরুদ্ধ। সকাল থেকেই পুলিশ কার্যালয়টি ঘিরে রাখে।
পুলিশ সুত্র জানায়, হরতালের পক্ষের মিছিল থেকে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আবুল বাশারসহ ৩১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে কোতোয়ালি থানায় ২৬, বনানীতে এক, নিউ মার্কেটে এক ও পল্টন থানায় তিনজন রয়েছেন। অন্যান্য থানায় আটকের ঘটনা ঘটলেও পরে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হরতালের সময় ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে থাকলেও কাউকে সাজা দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
ওয়ারী থানার ওসি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, জনসাধারণের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করায় আবুল বাশারকে আটক করা হয়। কোতোয়ালি থানার ওসি মো. সালাহ উদ্দিন খান বলেন, নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন ছাত্রদল নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়। এদিকে গত শনিবার রাতে উত্তরার আবদুল্লাহ পুর এলাকায় গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় সাবেক ছাত্রদল সভাপতি আজিজুল বারী হেলালকে এক নম্বর আসামি করে আরো ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।
এদিকে গতকাল রাজধানীতে হরতাল চলাকালে বিক্ষিপ্তভাবে হাতবোমার বিস্ফোরণের ঘটনা ছাড়া বড় কোনো দুর্ঘটনা চোখে পড়েনি। পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরই বেশি চোখে পড়েছে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে একটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সকাল পৌনে ১১টার দিকে কার্যালয়ের কয়েক শ গজের মধ্যে ফকিরাপুল কাঁচা বাজারের কাছে তিনটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ছাত্রদলের একটি মিছিল দলীয় কার্যালয়ের দিকে আসার সময় হঠাৎ এসব বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পুলিশ এগোলে মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুপুর ২টায় একই স্থানে আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে।
এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়েও তিনটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। তবে কারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তা জানা যায়নি। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মহাখালীর আমতলী কাঁচা বাজারের সামনে একটি টেম্পোতে (চট্ট মেট্রো-ছ ১১-০৪৫৪) ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয় তিন-চারজন পিকেটার। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুরান ঢাকায় হরতাল চলাকালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমানসহ ২৬ জন নেতা-কর্মীকে আটক করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। একই অভিযোগে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবুল বাশারকে আটক করেছে ওয়ারী থানার পুলিশ। পিকেটাররা রায়সাহেব বাজারের মোড়ে একটি বাস ভাঙচুর এবং ধোলাখাল এলাকায় দুটি লেগুনাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এদিকে হরতালের বিপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। হরতালে সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে লঞ্চ চলাচল ছিল স্বাভাবিক। তবে যাত্রী না থাকায় অনেক লঞ্চ টার্মিনাল ত্যাগ করেনি বলে জানা যায়। মহাখালী থেকে টঙ্গী, গাজীপুরে যাত্রীবাহী কিছু বাস চলাচল করতে দেখা গেলেও দুরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়েও দূরপাল্লার সব গাড়ির কাউন্টার বন্ধ দেখা যায়।
হরতাল চলাকালে রাজধানীতে ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীসহ বেশির ভাগ জোটের নেতা-কর্মীদের মাঠে দেখা যায়নি। তবে দিন শেষে এক ব্র্রিফিংয়ে জোটের নেতারা অভিযোগ করেন, তাঁদের নেতা-কর্মীরা রাজপথে নামার চেষ্টা করলেও পুলিশ ধাওয়া করে অথবা লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।
সাভার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, পিকেটারদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়েই মারা গেছেন আবদুর রশিদ নামের এক প্রাইভেটকারের চালক। আবদুর রশিদ (৩৬) রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার অভিরাম গ্রামের মো. গোলাম মোস্তফার ছেলে। সাভার পৌর এলাকার রাজাবাড়ী মহল্লার মজিদ খানের বাড়িতে তিনি ছয় বছরের এক ছেলে সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়ায় থাকতেন।
আশরাফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি নিহত আবদুর রশিদের চাচাতো ভাই। প্রাইভেটকারটি আবদুর রশিদ মাস দুয়েক আগে কিনেন। কয়েক দিন আগে গাড়িটিতে কিছু সমস্যা দেখা দিলে গ্যারেজে দিয়ে গাড়িটি মেরামত করানো হয়। মেরামতের পর গতকাল সকাল ৯টার দিকে আবদুর রশিদ গাড়ি চালিয়ে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ম্যাঙ্কম গার্মেন্টে কর্মরত এক বন্দুর সঙ্গে দেখা করতে যান। ফেরার পথে সকাল পৌনে ১০টার দিকে রাজফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এলে হরতাল সমর্থক একদল পিকেটার তাঁর গাড়ি উদ্দেশ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। গাড়ি ও আত্মরক্ষায় আবদুর রশিদ দ্রুত সরে পড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়কের পাশে একটি কড়ই গাছের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খায়। এতে গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং আবদুর রশিদ মাথায় ও বুকে আঘাত পেয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে লাশ ও গাড়ি উদ্ধার করে সাভার মডেল থানায় নিয়ে আসে।
আশরাফুল ইসলাম আরো জানান, তিনি আবদুর রশিদের সহযোগিতায় গাড়ি চালানো শিখে ওই গাড়িটি ভাড়ায় চালাতেন। গতকাল মর্মান্তিক এ খবর পেয়ে তিনি এবং রশিদের স্ত্রী শিল্পী বেগম ছুটে যান সাভার থানায়। স্বামীর লাশ দেখে শিল্পী বেগম থানায় কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক ব্যক্তি জানান, সকাল সাড়ে ৯টার পর ৩০-৪০ জনের একদল হরতাল সমর্থক রাজফুলবাড়িয়া এলাকায় ও এর আশপাশে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে টায়ারে আগুন জ্বেলে আতঙ্ক সৃষ্টি ও চলাচলরত যানবাহনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর চালাতে থাকে। এ সময় সাভারের হেমায়েতপুরের দিক থেকে দ্রুতগতিতে একটি কালো রঙের প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ ১১-৮৭৯৩) সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল। পিকেটাররা তাঁর গাড়িতে হামলা চালানোর জন্য সামনে চলে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাইভেটকারের চালক দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়কের পাশের গাছে সজোরে আছড়ে পড়ে। লোকজন ছুটে গিয়ে দেখে দুমড়েমুছড়ে যাওয়া গাড়িতে চালক নিথর অবস্থায় পড়ে আছেন। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে।
সাভার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, পিকেটারদের গাড়ির সামনে চলে আসার পর এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি জানান।
সাভারে হত্যা মামলা : সাভারের রাজফুলবাড়িয়ায় পিকেটারদের ধাওয়ায় প্রাইভেট কারচালকের মৃত্যুর ঘটনায় ১৬ জন বিএনপি নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো ২০-২৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে জনসাধারণের চলাচলে বাধা প্রদান এবং ধাওয়া করে হত্যার অভিযোগে মামলাটি (নং-৭০) করেছেন প্রাইভেট কারচালক আবদুর রশিদের স্ত্রী শিল্পী বেগম।
মামলায় অভিযুক্ত আসামিরা হলেন সাভার থানা বিএনপির সভাপতি ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন সরকার ও তাঁর ভাই বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ সরকার, আয়ুব আলী, শাহজাহান বেপারী, রেজাউল করিম, মো. সাইদুর রহমান, আব্বাস খান, আলমগীর হোসেন, মো. মাসুদ, ফারুক মিয়া, রাজু আহম্মেদ, মোশারফ হোসেন মশা, শামীম খান, শাহজাহান মিয়া, জালাল উদ্দিন এবং আনোয়ার মাস্টার। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরো ২০-২৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
সাভার মডেল থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এ ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
সাভার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সালাম মিয়া জানান, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
রাজশাহী অফিস জানায়, হরতালের সমর্থনে গতকাল সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বিএনপি নেতা-কর্মীরা মিজানুর রহমান মিনুর নেতৃত্বে নগরীর রাজারহাতা এলাকা থেকে একটি মিছিল বের করেন। মিছিলটি মালোপাড়া পার হয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের প্রথমে কথাকাটাকাটি ও পরে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ মিনুসহ বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর লাঠিপেটা করে। এরপর পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ বেধে যায়। বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন অলিগলির মধ্যে আশ্রয় নিয়ে পুলিশের ওপরও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিলে কয়েকটি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। পুলিশের লাঠিপেটায় বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনু, এনটিভির ক্যামেরাম্যান শরিফুজ্জামান রয়েলসহ অন্তত ১৭ জন বিএনপি নেতা-কর্মী আহত হন। অন্যদিকে পিকেটারদের ছুরিকাঘাতে ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে পুলিশের কনস্টেবল আনিসুর রহমানসহ অন্তত তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। সকাল ৭টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুলিশ বিএনপির মহানগর দলীয় কার্যালয়ের মধ্যে মিজানুর রহমান মিনুসহ দলের নেতা-কর্মীদের অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ সংঘর্ষের জন্য মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রোকনুজ্জামান রোকনকে দায়ী করে অবিলম্বে তাঁকে অপসারণের দাবি জানান মিজানুর রহমান মিনু।
এদিকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ও জেলা সভাপতি নাদিম মোস্তফার নেতৃত্বে নগরীর সোনাদিঘি মোড় থেকে হরতালের সমর্থনে বিএনপি নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে দল ক্ষমতায় গেলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসি রোকনুজ্জামানকে দেখে নেওয়া হবে বলে হুমকি দেন নাদিম মোস্তফা।
নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি খান মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, পিকেটিং করার সময় পুলিশ নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির পাঁচ নেতা-কর্মীকে আটক করে। আটককৃতরা হলেন নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি পিয়াল হায়দার আবু, ২১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত আলী, মহানগর যুবদল নেতা মাসুদ পারভেজ, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ও শফিক।
এ ছাড়া হরতাল চলাকালে নগরীর কোট হরগ্রাম এলাকায় একটি কোচসহ তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
কালের কণ্ঠের সিলেট অফিস জানায়, দুপুরে নগরের চারটি স্থানে হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সকাল ১০টায় জিন্দাবাজার এলাকায় মিছিল করতে চাইলে জেলা ও মহানগর বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাধা দেয় পুলিশ। এ ছাড়া চৌহাট্টা এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল মিছিল করতে চাইলে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। সকাল সাড়ে ১১টায় জিন্দাবাজারের সিটি সেন্টার এলাকায় পুলিশ মিছিলে বাধা দিলে বিএনপি নেতারা সেখানে অবস্থান নেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জিন্দাবাজারে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম মিছিল করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এর একপর্যায়ে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে হরতাল সমর্থকরা ইটপাটকেল ছুড়লে সংঘর্ষ বেধে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটার পাশাপাশি ২৩টি রাবার বুলেট ও ১৬টি কাদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। সংঘর্ষে সাত পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচটি মোটরসাইকেল আটক করে পুলিশ।
সিলেট নগর পুলিশের উপকমিশনার এজাজ আহমেদ বলেন, শহরতলির টুকের বাজার এলাকার তেমুখী পয়েন্টে র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ২০টি ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে। র‌্যাব ৯-এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মোফাজ্জল হোসেন সাংবাদিকদের জানান, র‌্যাব সেখানে টহল দিচ্ছিল। তেমুখী পয়েন্ট অতিক্রম করার সময় জনতার মধ্য থেকে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া হয়।
কোতোয়ালি থানার ওসি আতাউর রহমান জানান, বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ মিছিল থেকে ২৫ জনকে আটক করেছে।
বিশ্বনাথ থেকে সংবাদদাতা জানান, ইলিয়াস আলীর নিজ উপজেলা বিশ্বনাথে র‌্যাব পুলিশের সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। দুপুরের পর শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। এতে ৪০ জনের বেশি লোক আহত হয়। আহতদের মধ্যে সাতজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। গুরুতর আহত এক পুলিশ সদস্যকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ১১ জনকে আটক করেছে।
পুলিশ জানায়, সকালে উপজেলা সদরে পিকেটাররা একটি সংবাদপত্রবাহী অটোরিকশা ও ওষুধের দোকান ভাঙচুর করেছে। এ সময় তারা একটি খাবারের দোকানে আগুন দেয়। এ ছাড়া বিয়ানীবাজার থেকে হরতাল চলাকালে পুলিশ দুজনকে আটক করে। বিশ্বনাথে পুলিশ সাতটি মোটরসাইকেল জব্দ করে। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলার দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা যায়।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দুপুর ১২টার দিকে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধুলিয়াখাল-মিরপুর সড়কের গোপায়া এলাকায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা রাস্তা অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ অবরোধ তুলে নিতে বললে শুরু হয় সংঘর্ষ। এতে কমপক্ষে পাঁচজন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দুটি রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে যুবদলকর্মী কফিল আহমেদ (২৮), ছাত্রদলকর্মী শিপন মিয়াসহ (১৮) কমপক্ষে পাঁচজন আহত হন। পুলিশ এ ঘটনায় ছাত্রদলকর্মী সুজন মিয়াকে (২৫) আটক করে।
এদিকে দুপুর ১টায় পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শরিফ উল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক মুকুল আচার্যের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র জি কে গউছের পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে আসতেই একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি পৌর ভবনে হামলা চালায়। তারা নির্বাহী প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজনের কার্যালয়ও চারটি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুর করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পৌর পরিষদ গতকাল বিকেল ৫টায় জরুরি সভা করে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানায়। গ্রেপ্তারের পূর্ব পর্যন্ত হবিগঞ্জ পৌরসভায় অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা করা হয়।
এদিকে শনিবার হবিগঞ্জে পুলিশ ও বিএনপি সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনায় হবিগঞ্জ সদর থানায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ ১১১ জনকে মূল আসামি ও অজ্ঞাতপরিচয় ৫০০ জনকে আসামি করে এ মামলা করে। আসামিরা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। গতকালই শিল্পকলা একাডেমীর এক কর্মচারী ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপির ৩৫ জনকে মূল আসামি এবং বিএনপির অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৩০ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করে দ্রুত বিচার আইনে সদর থানায় অপর একটি মামলা দায়ের করেছেন। তদন্তের স্বার্থে আসামিদের নাম প্রকাশ করতে অপারগতা জানিয়েছে পুলিশ।
সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত পুলিশ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃত জুয়েল মিয়া, আরিফ আহমেদ রিপন, সুমন মিয়া, সোহাগ, নূর আলম, আওলাদ ও মদরিছকে গতকাল থানা থেকে কোর্টে প্রেরণ করা হয়। এ সময় আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
সাতক্ষীরা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গতকাল সকাল ১০টার দিকে কলারোয়ায় হরতাল সমর্থক সালাম নামের এক ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করলে একদল যুবক পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এদিকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হরতালবিরোধী মিছিল বের করলে উপজেলা পোস্ট অফিসের সামনে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। তব পুলিশ লাঠিপেটায় দুই পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত ১৬ জন আহত হয়েছে। এর আগে ক্ষমতাসীন দলের কিছু কর্মী বিএনপি নেতা সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবের বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে।
হরতাল চলাকালে ওরেন্টভুক্ত আসামি কেড়াগাছি ইউপির চেয়ারম্যান আরশাফ হোসেন ও সদস্য আবদুস সামাদকে পুলিশ আটক করে। এ ঘটনায় গতকাল রবিবার কলারোয়া থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে।
সাতক্ষীরা শহরে শনিবার বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা ও পৌর বিএনপির ৭৯ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করে সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শনিবার বিকেলে সাতক্ষীরা শহরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতারাসহ ৭৯ জনকে আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা দায়ের করে।
চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, হরতাল সমর্থকরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করে। পুলিশ এসব ঘটনায় ২০ জনকে আটক করেছে। নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ বারবার বিভিন্ন জায়গায় বাধা দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সঙ্ঘাতে বিএনপির পাঁচ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। মহানগর বিএনপির নেতা সৈয়দ আহমদসহ ২০ থেকে ২৫ জনকে আটক করা হয়েছে। সোমবারের হরতালে পুলিশ বাধা দিলে বিএনপির কর্মীদের প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। ইলিয়াস আলীকে ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত আমাদের এ আন্দোলন চলবে।'

No comments

Powered by Blogger.