মিসর-পরিবর্তন ও মুসলিম ব্রাদারহুড by তারিক রামাদান
তিউনিসিয়ায় গণবিক্ষোভ শুরু হলে কে ভেবেছিল এত তাড়াতাড়ি জিনে এল আবেদিন বেন আলীর পতন ঘটবে? কে ভেবেছিল কিছুদিনের মধ্যেই মিসরে এমন অভূতপূর্ব বিক্ষোভ দেখা যাবে? একটি বাধা সরে গেছে। কোনো কিছুই আর আগের মতো হবে না। মিসর যে কেন্দ্রীয় ও প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে, তাতে অন্যান্য দেশও মিসরকে অনুসরণ করার সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর কী হবে ইসলামপন্থীদের ভূমিকা?
আরব দুনিয়ায় ইসলামপন্থীদের উপস্থিতির দোহাই দিয়ে দশকের পর দশক ধরে জঘন্য স্বৈরাচারীদের প্রতি পশ্চিমাদের আনুকূল্যের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আর এসব স্বৈরাচারী শাসকেই তাঁদের ইসলামপন্থী প্রতিপক্ষকে অশুভ শক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই দলটি মিসরের প্রথম সুসংগঠিত গণ-আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী, যার রাজনৈতিক প্রভাবসহকারে উপস্থিতি ছিল।
৬০ বছরেরও অধিককাল ব্রাদারহুড অবৈধ ছিল, তবে একে বরদাশত করা হতো। অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রায় প্রতিটিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জোর সামর্থ্য দলটি দেখিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী সমিতি, পৌরসভা, সংসদসহ যেসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, সেখানেই তাদের এমন স্বাক্ষর দেখা গেছে। তাহলে ব্রাদারহুডকে কি মিসরের উদীয়মান শক্তি মনে করা যায়? জবাব ইতিবাচক হলে এমন এক সংগঠনের কাছ থেকে আমরা কী-ই বা আশা করতে পারি?
পশ্চিমা দুনিয়ায় সাধারণভাবে রাজনৈতিক ইসলাম আর বিশেষভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে ভাসা ভাসা বিশ্লেষণই আশা করতে পারি। তবে ইসলামপন্থা শুধু ভিন্ন কতগুলো প্রবণতা ও দলাদলির সমাবেশ নয়, বরং সময় ও ঐতিহাসিক রূপান্তরের প্রতিক্রিয়ায় এর বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা দিকও আবির্ভূত হয়েছে।
১৯৩০-এর দশকে ব্রাদারহুডের যাত্রা শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক, উপনিবেশবাদবিরোধী ও অহিংস আন্দোলন হিসেবে, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্বকালে জায়নবাদী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল-বান্নার ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ের লেখালেখিতে উপনিবেশবাদ-বিরোধিতা দেখা যায়। জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিবাদী সরকারেরও তীব্র সমালোচনা তাঁর লেখায় রয়েছে। মিসরে বল প্রয়োগের বিষয়টি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যদিও তিনি মনে করতেন, জায়নবাদী স্ট্যার্ন ও ইরগুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের প্রতিরোধে ফিলিস্তিনে বল প্রয়োগ করা ন্যায্য। ব্রিটিশ সংসদীয় আদল অনেকটা ইসলামি আদর্শের কাছাকাছি বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল।
আল-বান্নার উদ্দেশ্য ছিল ক্রমশ সংস্কারের মাধ্যমে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা, যার সূচনা হবে জনশিক্ষা ও ব্যাপক বিস্তৃত সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে। ব্রিটিশ দখলদারদের নির্দেশে ১৯৪৯ সালে মিসরীয় সরকারের দ্বারা তিনি আততায়িত হন। ১৯৫২ সালে গামাল আবদেল নাসেরের বিপ্লবের পর তাঁর এই আন্দোলন সহিংস দমননীতির মুখে পতিত হয়।
তখন কয়েকটি স্পষ্ট প্রবণতার আবির্ভাব ঘটে। কারাবন্দিত্ব ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে র্যাডিকেল হয়ে ওঠা কিছু সদস্য (যাঁরা শেষ পর্যন্ত সংগঠনটি ত্যাগ করে চলে যান) সিদ্ধান্তে পৌঁছান, যেকোনো মূল্যে, এমনকি বল প্রয়োগের সাহায্যে রাষ্ট্রকে উৎখাত করতে হবে। বাদবাকিরা দলটির ধীরে ধীরে সংস্কারের পথে আগানোর আদি অবস্থানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন।
আজকের মুসলিম ব্রাদারহুড এসব বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গির সমাবেশ। কিন্তু এই আন্দোলনের নেতৃত্ব (প্রতিষ্ঠাকালীন প্রজন্মের সদস্যদের বয়স এখন অনেক) নবীন সদস্যদের আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না। এই নবীন সদস্যরা দুনিয়ার প্রতি অনেক খোলা মনের, তীব্রভাবে অভ্যন্তরীণ সংস্কার চায় আর তুরস্কের দৃষ্টান্ত তাদের খুব আকর্ষণ করে। দলটির ঐক্যবদ্ধ চেহারার আড়ালে বিরুদ্ধ মত ক্রিয়াশীল। সামনের দিনে এই আন্দোলন কোন দিকে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না।
হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে আনার জনতরঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুড নেতৃত্ব দিচ্ছে না। তরুণদের তৈরি এই অভ্যুত্থান স্বৈরতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যানকারী নারী ও পুরুষের জাগরণ। মুসলিম ব্রাদারহুড ও সাধারণভাবে ইসলামপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে না। কোনো সন্দেহ নেই যে মোবারকের বিদায়ের পর তারা গণতান্ত্রিক উত্তরণে অংশগ্রহণের আশা রাখে। কিন্তু কেউ বলতে পারে না, দলটির কোন অংশ প্রাধান্যে চলে আসবে। এই আন্দোলনের অগ্রাধিকার নির্ধারণও এ কারণে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সৌদি গোঁড়া অথবা তুর্কি পথের অনুসারীদের মধ্যে যেকোনোটিই আসতে পারে। ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক চিন্তায় গত ২০ বছরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
মিসরীয় জনগণের গণতন্ত্র ও মুক্তির স্বপ্ন সফল হোক, তা সহজে হতে দেবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিংবা ইসরায়েল। কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনা এমনই যে বর্তমানের সংস্কার আন্দোলনের ওপর মিসরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে মার্কিন সংস্থাগুলোর থাকবে কড়া নজরদারি (ইতিমধ্যে তা চলছে)। মিসরের সেনাবাহিনী সময় নিচ্ছে এবং মধ্যস্থতাকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
মোহাম্মদ এলবারাদির পেছনে দাঁড়িয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুড। তাঁকে সমর্থন করার মাধ্যমে ব্রাদারহুড নেতৃত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে, রাজনৈতিক দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশিত করে দেওয়ার এখনো সময় আসেনি। কেননা, এতে পশ্চিমা দুনিয়া অথবা মিসরীয়রাও আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারে। সতর্কতা অবলম্বনই এখন গুরুত্বপূর্ণ।
গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকার মানে সব রাজনৈতিক শক্তি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান আর আইনের শাসনকে শ্রদ্ধা করে (নির্বাচনের আগে-পরে সব সময়) পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অবশ্যই মুসলিম ব্রাদারহুডের পূর্ণ অংশীদারি থাকতে হবে। আর মিসরে যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় (অবশ্য বিদেশি শক্তিগুলোর আকাঙ্ক্ষা কেউ সংজ্ঞায়িত করতে পারে না), তাতে অংশীদার হবে ব্রাদারহুড।
দমন-পীড়ন কিংবা নির্যাতন করে ব্রাদারহুডকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। শরিয়াহ-বিষয়ক বোঝাপড়া থেকে শুরু করে স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা আর সমতার প্রতি পক্ষপাতের নানা জটিল বিষয়ের চিন্তা বিকশিত করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিতর্ক ও ভাববিনিময়ের প্রবল প্রভাব পড়েছে। নির্যাতন ও স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে নয়, কেবল চিন্তার বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা এমন সমাধানে পৌঁছাতে পারি, যা জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তুরস্কের দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত।
পশ্চিমা দুনিয়া এখনো ‘ইসলামি হুমকি’র কথা বলে তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও স্বৈরতন্ত্রকে খোলাখুলি সমর্থনের ন্যায্যতা দিয়ে চলেছে। মোবারকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যতই বেড়েছে, ইসরায়েলি সরকার ততই ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে মিসরীয় জান্তাকে সমর্থন করে যাওয়ার জন্য। দেখেশুনে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপ।
উভয় মনোভাবেই স্পষ্ট যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপরীতে শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক নীতির ফাঁপা বুলির বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। যে স্বৈরাচার তেল পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় আর ইসরায়েলকে উপনিবেশবাদ চালু রাখতে দেয়, সে-ই যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ। জনগণের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি যাঁরা এসব চলতে দিতেন না, তাঁদের চেয়ে সেইসব স্বৈরাচারই তাদের প্রিয়।
বিপজ্জনক ইসলামপন্থীদের বক্তব্য তুলে ধরে জনগণের স্বর না শোনার ন্যায্যতা দেওয়া যেমন স্বল্পমেয়াদি দাওয়াই, তেমনি অযৌক্তিকও। বুশ ও ওবামা উভয়ের আমলেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে কমেছে। ইউরোপের ব্যাপারেও একই কথা খাটে। মার্কিনি ও ইউরোপীয়রা তাদের নীতির পুনর্মূল্যায়ন না করলে এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য শক্তি শিগগিরই হয়তো কৌশলগত মৈত্রীর বিশদ কাঠামো নিয়ে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করবে।
ইসরায়েল এখন আরব স্বৈরাচারদের বন্ধু ও সংরক্ষক। হয়তো ইসরায়েলের সরকার ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে, এসব স্বৈরাচার ইসরায়েলের অন্ধ ঔপনিবেশিক নীতির প্রতি অনুগত।
আঞ্চলিক পরিসরে মোবারকের পদত্যাগের প্রভাব হবে ব্যাপক। তবু ঠিক কী প্রভাব পড়বে, তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না। তিউনিসিয়া ও মিসর বিপ্লবের পর রাজনৈতিক বার্তাটি বেশ স্পষ্ট—অহিংস গণবিক্ষোভে সবই সম্ভব এবং কোনো স্বৈরাচারী সরকার আর নিরাপদ ও সুরক্ষিত নয়।
ঐতিহাসিক যুগান্তরের চাপ অনুভব করছেন প্রেসিডেন্ট আর বাদশাহরা। আলজেরিয়া, ইয়েমেন ও মৌরিতানিয়ায় অসন্তোষের বিস্তার ঘটেছে। জর্ডান, সিরিয়া, এমনকি সৌদি আরবের দিকেও দৃষ্টি ফেরানো যায়। বিক্ষুব্ধ জনগণকে নিবৃত্ত করার জন্য সংস্কারের ঘোষণা এসেছে। মনে হচ্ছে, সেখানে ভয় ও নাজুকতার সাধারণ বোধ কাজ করছে। এসব দেশের শাসকেরা জানেন, মিসরের পতন ঘটলে তাঁদেরও একই ভাগ্য বরণের ঝুঁকি থেকে যায়।
এই অস্থিতিশীল অবস্থা একদিকে যেমন উদ্বেগজনক, অন্যদিকে তেমনি সম্ভাবনাময়। আরব দুনিয়া জেগে উঠছে মর্যাদা ও আশাবাদসহকারে। সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য এসব পরিবর্তন আশা জাগায় আর যারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত হিসাব-নিকাশের কাছে গণতান্ত্রিক আদর্শকে বিসর্জন দেয়, তাদের জন্য সমস্যা। মিসরের মুক্তি মনে হয় শুরুটা করে দিচ্ছে। এরপর কে? যদি জর্ডান ও ইয়েমেন একই পথে যায়, আর মুসলিম দুনিয়ার হূৎপিণ্ড সৌদি আরবেও একই ঘটনা ঘটে, তাহলে রিয়াদ বেশ কঠিন অবস্থায় পড়বে, আরও খোলা রাজনৈতিক ব্যবস্থা অভিমুখে বিবর্তিত না হয়ে আর উপায় থাকবে না।
দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের একটি অংশ এই পরিবর্তনকে, মুসলিম দুনিয়ার কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় এই বিপ্লবকে স্বাগত জানাবে। শেষ পর্যন্ত যেসব গণতান্ত্রিক শক্তি জায়গা দিতে পারে অহিংস সব রাজনৈতিক শক্তিকে, তারাই পারে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে—যে শান্তি ফিলিস্তিনিদের মর্যাদার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল।
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
তারিক রামাদান: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কনটেমপরারি ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক।
৬০ বছরেরও অধিককাল ব্রাদারহুড অবৈধ ছিল, তবে একে বরদাশত করা হতো। অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রায় প্রতিটিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জোর সামর্থ্য দলটি দেখিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন, পেশাজীবী সমিতি, পৌরসভা, সংসদসহ যেসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, সেখানেই তাদের এমন স্বাক্ষর দেখা গেছে। তাহলে ব্রাদারহুডকে কি মিসরের উদীয়মান শক্তি মনে করা যায়? জবাব ইতিবাচক হলে এমন এক সংগঠনের কাছ থেকে আমরা কী-ই বা আশা করতে পারি?
পশ্চিমা দুনিয়ায় সাধারণভাবে রাজনৈতিক ইসলাম আর বিশেষভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে ভাসা ভাসা বিশ্লেষণই আশা করতে পারি। তবে ইসলামপন্থা শুধু ভিন্ন কতগুলো প্রবণতা ও দলাদলির সমাবেশ নয়, বরং সময় ও ঐতিহাসিক রূপান্তরের প্রতিক্রিয়ায় এর বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা দিকও আবির্ভূত হয়েছে।
১৯৩০-এর দশকে ব্রাদারহুডের যাত্রা শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক, উপনিবেশবাদবিরোধী ও অহিংস আন্দোলন হিসেবে, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্বকালে জায়নবাদী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল-বান্নার ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সময়ের লেখালেখিতে উপনিবেশবাদ-বিরোধিতা দেখা যায়। জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিবাদী সরকারেরও তীব্র সমালোচনা তাঁর লেখায় রয়েছে। মিসরে বল প্রয়োগের বিষয়টি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যদিও তিনি মনে করতেন, জায়নবাদী স্ট্যার্ন ও ইরগুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের প্রতিরোধে ফিলিস্তিনে বল প্রয়োগ করা ন্যায্য। ব্রিটিশ সংসদীয় আদল অনেকটা ইসলামি আদর্শের কাছাকাছি বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল।
আল-বান্নার উদ্দেশ্য ছিল ক্রমশ সংস্কারের মাধ্যমে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা, যার সূচনা হবে জনশিক্ষা ও ব্যাপক বিস্তৃত সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে। ব্রিটিশ দখলদারদের নির্দেশে ১৯৪৯ সালে মিসরীয় সরকারের দ্বারা তিনি আততায়িত হন। ১৯৫২ সালে গামাল আবদেল নাসেরের বিপ্লবের পর তাঁর এই আন্দোলন সহিংস দমননীতির মুখে পতিত হয়।
তখন কয়েকটি স্পষ্ট প্রবণতার আবির্ভাব ঘটে। কারাবন্দিত্ব ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে র্যাডিকেল হয়ে ওঠা কিছু সদস্য (যাঁরা শেষ পর্যন্ত সংগঠনটি ত্যাগ করে চলে যান) সিদ্ধান্তে পৌঁছান, যেকোনো মূল্যে, এমনকি বল প্রয়োগের সাহায্যে রাষ্ট্রকে উৎখাত করতে হবে। বাদবাকিরা দলটির ধীরে ধীরে সংস্কারের পথে আগানোর আদি অবস্থানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন।
আজকের মুসলিম ব্রাদারহুড এসব বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গির সমাবেশ। কিন্তু এই আন্দোলনের নেতৃত্ব (প্রতিষ্ঠাকালীন প্রজন্মের সদস্যদের বয়স এখন অনেক) নবীন সদস্যদের আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না। এই নবীন সদস্যরা দুনিয়ার প্রতি অনেক খোলা মনের, তীব্রভাবে অভ্যন্তরীণ সংস্কার চায় আর তুরস্কের দৃষ্টান্ত তাদের খুব আকর্ষণ করে। দলটির ঐক্যবদ্ধ চেহারার আড়ালে বিরুদ্ধ মত ক্রিয়াশীল। সামনের দিনে এই আন্দোলন কোন দিকে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না।
হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে আনার জনতরঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুড নেতৃত্ব দিচ্ছে না। তরুণদের তৈরি এই অভ্যুত্থান স্বৈরতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যানকারী নারী ও পুরুষের জাগরণ। মুসলিম ব্রাদারহুড ও সাধারণভাবে ইসলামপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে না। কোনো সন্দেহ নেই যে মোবারকের বিদায়ের পর তারা গণতান্ত্রিক উত্তরণে অংশগ্রহণের আশা রাখে। কিন্তু কেউ বলতে পারে না, দলটির কোন অংশ প্রাধান্যে চলে আসবে। এই আন্দোলনের অগ্রাধিকার নির্ধারণও এ কারণে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সৌদি গোঁড়া অথবা তুর্কি পথের অনুসারীদের মধ্যে যেকোনোটিই আসতে পারে। ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক চিন্তায় গত ২০ বছরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
মিসরীয় জনগণের গণতন্ত্র ও মুক্তির স্বপ্ন সফল হোক, তা সহজে হতে দেবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিংবা ইসরায়েল। কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনা এমনই যে বর্তমানের সংস্কার আন্দোলনের ওপর মিসরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে মার্কিন সংস্থাগুলোর থাকবে কড়া নজরদারি (ইতিমধ্যে তা চলছে)। মিসরের সেনাবাহিনী সময় নিচ্ছে এবং মধ্যস্থতাকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
মোহাম্মদ এলবারাদির পেছনে দাঁড়িয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুড। তাঁকে সমর্থন করার মাধ্যমে ব্রাদারহুড নেতৃত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে, রাজনৈতিক দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশিত করে দেওয়ার এখনো সময় আসেনি। কেননা, এতে পশ্চিমা দুনিয়া অথবা মিসরীয়রাও আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারে। সতর্কতা অবলম্বনই এখন গুরুত্বপূর্ণ।
গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকার মানে সব রাজনৈতিক শক্তি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান আর আইনের শাসনকে শ্রদ্ধা করে (নির্বাচনের আগে-পরে সব সময়) পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অবশ্যই মুসলিম ব্রাদারহুডের পূর্ণ অংশীদারি থাকতে হবে। আর মিসরে যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় (অবশ্য বিদেশি শক্তিগুলোর আকাঙ্ক্ষা কেউ সংজ্ঞায়িত করতে পারে না), তাতে অংশীদার হবে ব্রাদারহুড।
দমন-পীড়ন কিংবা নির্যাতন করে ব্রাদারহুডকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। শরিয়াহ-বিষয়ক বোঝাপড়া থেকে শুরু করে স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা আর সমতার প্রতি পক্ষপাতের নানা জটিল বিষয়ের চিন্তা বিকশিত করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিতর্ক ও ভাববিনিময়ের প্রবল প্রভাব পড়েছে। নির্যাতন ও স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে নয়, কেবল চিন্তার বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা এমন সমাধানে পৌঁছাতে পারি, যা জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তুরস্কের দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত।
পশ্চিমা দুনিয়া এখনো ‘ইসলামি হুমকি’র কথা বলে তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও স্বৈরতন্ত্রকে খোলাখুলি সমর্থনের ন্যায্যতা দিয়ে চলেছে। মোবারকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যতই বেড়েছে, ইসরায়েলি সরকার ততই ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে মিসরীয় জান্তাকে সমর্থন করে যাওয়ার জন্য। দেখেশুনে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপ।
উভয় মনোভাবেই স্পষ্ট যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপরীতে শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক নীতির ফাঁপা বুলির বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। যে স্বৈরাচার তেল পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় আর ইসরায়েলকে উপনিবেশবাদ চালু রাখতে দেয়, সে-ই যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ। জনগণের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি যাঁরা এসব চলতে দিতেন না, তাঁদের চেয়ে সেইসব স্বৈরাচারই তাদের প্রিয়।
বিপজ্জনক ইসলামপন্থীদের বক্তব্য তুলে ধরে জনগণের স্বর না শোনার ন্যায্যতা দেওয়া যেমন স্বল্পমেয়াদি দাওয়াই, তেমনি অযৌক্তিকও। বুশ ও ওবামা উভয়ের আমলেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে কমেছে। ইউরোপের ব্যাপারেও একই কথা খাটে। মার্কিনি ও ইউরোপীয়রা তাদের নীতির পুনর্মূল্যায়ন না করলে এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য শক্তি শিগগিরই হয়তো কৌশলগত মৈত্রীর বিশদ কাঠামো নিয়ে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করবে।
ইসরায়েল এখন আরব স্বৈরাচারদের বন্ধু ও সংরক্ষক। হয়তো ইসরায়েলের সরকার ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে, এসব স্বৈরাচার ইসরায়েলের অন্ধ ঔপনিবেশিক নীতির প্রতি অনুগত।
আঞ্চলিক পরিসরে মোবারকের পদত্যাগের প্রভাব হবে ব্যাপক। তবু ঠিক কী প্রভাব পড়বে, তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না। তিউনিসিয়া ও মিসর বিপ্লবের পর রাজনৈতিক বার্তাটি বেশ স্পষ্ট—অহিংস গণবিক্ষোভে সবই সম্ভব এবং কোনো স্বৈরাচারী সরকার আর নিরাপদ ও সুরক্ষিত নয়।
ঐতিহাসিক যুগান্তরের চাপ অনুভব করছেন প্রেসিডেন্ট আর বাদশাহরা। আলজেরিয়া, ইয়েমেন ও মৌরিতানিয়ায় অসন্তোষের বিস্তার ঘটেছে। জর্ডান, সিরিয়া, এমনকি সৌদি আরবের দিকেও দৃষ্টি ফেরানো যায়। বিক্ষুব্ধ জনগণকে নিবৃত্ত করার জন্য সংস্কারের ঘোষণা এসেছে। মনে হচ্ছে, সেখানে ভয় ও নাজুকতার সাধারণ বোধ কাজ করছে। এসব দেশের শাসকেরা জানেন, মিসরের পতন ঘটলে তাঁদেরও একই ভাগ্য বরণের ঝুঁকি থেকে যায়।
এই অস্থিতিশীল অবস্থা একদিকে যেমন উদ্বেগজনক, অন্যদিকে তেমনি সম্ভাবনাময়। আরব দুনিয়া জেগে উঠছে মর্যাদা ও আশাবাদসহকারে। সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য এসব পরিবর্তন আশা জাগায় আর যারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত হিসাব-নিকাশের কাছে গণতান্ত্রিক আদর্শকে বিসর্জন দেয়, তাদের জন্য সমস্যা। মিসরের মুক্তি মনে হয় শুরুটা করে দিচ্ছে। এরপর কে? যদি জর্ডান ও ইয়েমেন একই পথে যায়, আর মুসলিম দুনিয়ার হূৎপিণ্ড সৌদি আরবেও একই ঘটনা ঘটে, তাহলে রিয়াদ বেশ কঠিন অবস্থায় পড়বে, আরও খোলা রাজনৈতিক ব্যবস্থা অভিমুখে বিবর্তিত না হয়ে আর উপায় থাকবে না।
দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের একটি অংশ এই পরিবর্তনকে, মুসলিম দুনিয়ার কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় এই বিপ্লবকে স্বাগত জানাবে। শেষ পর্যন্ত যেসব গণতান্ত্রিক শক্তি জায়গা দিতে পারে অহিংস সব রাজনৈতিক শক্তিকে, তারাই পারে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে—যে শান্তি ফিলিস্তিনিদের মর্যাদার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল।
ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
তারিক রামাদান: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কনটেমপরারি ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক।
No comments