চারদিক-বনে ফাগুন মনে আগুন by আশরাফুল হক
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে\
তব অবগুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে\
আজি খুলিয়ো হূদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ বসন্ত। অবশ্য নগরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গাছগুলোর ধুলোয় ধূসর পাতারা সে কথা বলছে না। সত্যি, নগরজীবন থেকে আর সব ঋতুর মতো বসন্তও হারিয়ে গেছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রেখে দিন-তারিখ গুনে দেখুন, আজ পয়লা ফাল্গুন। বসন্তের শুরু। তবে নগরজীবনের বসন্তে ফুল-পাখি তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু বিশাল বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে বসন্ত মানেই টকটকে লাল পলাশ-শিমুল। পাতাশূন্য গাছগুলো থেকে সত্যি যেন আগুন ঝরে। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য! কী রকম উদাস বাতাস, যাকে বলে বসন্ত বাতাস—মনের মধ্যে কেমন জানি একটা হাহাকার জাগাত, যা প্রকাশের ভাষা নেই। শুধু শচীন দেব বর্মণ থেকে কেউ কেউ গেয়ে উঠবেন—
কী করি
আমি কী করি
বনে ফাগুন, মনে আগুন...
তেমন উদাস বাতাস নগরে নেই। এখানকার ফাগুনে আগুন নেই। এখানে ফাল্গুনের রাতের আঁধার নেই, পূর্ণিমা নেই। তবু বসন্তকাল। যাকে নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের হাজারো কল্পনা, হাজারো সৃষ্টি। বিশেষ করে, রবীন্দ্রনাথ যতভাবে বসন্তকে উপস্থাপন করেছেন তাঁর গানে কবিতায়, গল্প, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, নিবন্ধে ও চিঠিতে; তাতে মুগ্ধ মন-প্রাণ। ফলে নাগরিক ব্যস্ততায়ও বসন্তকে স্বাগত জানাতেই হয়। তাই পরস্পরকে পয়লা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন নাগরিকেরা, হয়তো মুঠোফোনে।
এই নগরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা উদ্যানগুলোতে ঢুঁ মারলে দেখা পাবেন ফাল্গুনের। সেখানকার গাছে গাছে কিছু ফুল আছে। একটু উৎকর্ণ হলে পাখির ডাকও শুনতে পাওয়া যায়। তবে আজ এ নগরের রাজপথ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, বইমেলা এমনকি ব্যস্ততম করপোরেট অফিসগুলো পর্যন্ত আপনাকে বসন্তের আগমনী বার্তা জানাবে বাসন্তী রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি-ফতোয়া। এই বাসন্তী রং যেন বলছে, ‘মধুর বসন্ত এসেছে’। অথবা রং দেখে আপনিই হয়তো আপন মনে রবীন্দ্রনাথ থেকে আওড়াবেন—
বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী,
দিক প্রান্তে, বনবনান্তে,
শ্যাম প্রান্তরে, আম্রছায়ে,
সরোবর তীরে, নদীনীরে,...
বসন্তকে ঘিরে বাঙালির রয়েছে বেশ কয়েকটি উৎসব। এসবের মধ্যে ফাল্গুনী পূর্ণিমা, গাজন, চড়ক পূজা, দোলযাত্রা, চৈত্রসংক্রান্তি অন্যতম। তবে বর্তমানে নানা প্রতিকূলতা ও গ্রামেগঞ্জে নগরায়ণের বিস্তার ঘটায় এসব উৎসব আর আগের মতো ঘটা করে পালিত হয় না। তবে এখনকার বসন্তে নগরজীবনের অন্যতম প্রধান উৎসব একুশের বইমেলা। এ ছাড়া আজ চারুকলার বকুলতলায় ও ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে বসন্ত উৎসবে মেতে উঠবে নাগরিকেরা। এর আয়োজক জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ।
ফাল্গুন তথা বসন্তের আরেকটি বড় অনুষঙ্গ ভালোবাসা। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে (ভ্যালেন্টাইন ডে) যে ভালোবাসার আয়োজনে আমরা মেতে উঠি, বাংলাদেশে এর ইতিহাস বেশি দিনের নয়। এ দেশে এর শুরু গত শতকের শেষ দশকের প্রথম দিকে। এর আগে এ অঞ্চলের মানুষ যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার দিন বলতে পয়লা ফাল্গুনকেই বুঝত। রবীন্দ্রনাথসহ প্রায় সব বাঙালি কবির গান আর কবিতা আমাদের সে কথাই বলে।
যা হোক, বসন্ত এসে গেছে। বাসন্তী পূর্ণিমায় সব চরাচর যখন থইথই করবে, আমাদের হয়তো বনে যাওয়া হবে না, বসন্তের মাতাল সমীরণে গা-ভাসানো হবে না—আমরা হয়তো ঘরের কোণেই পড়ে রইব। তবু মনে তো বসন্তের দোলা লাগবেই।
No comments