দুদক আইন সংশোধন-সরকার কি আমলাদের ভয় পায়? by জায়েদুল আহসান
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তে সরকারের পূর্বানুমতির বিধানসংবলিত দুর্নীতি দমন কমিশন আইন (সংশোধিত) গত ২৪ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করেছে। সাত বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এ কাজটি গোপনে করতে চেয়েও পারেনি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে
সেই কাজটি করতে চাইছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ পাস করা হয়েছিল, যেন এ প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। আইনটি পাস করা ও এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই লেখায় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাসের প্রেক্ষাপটটি ছিল এ রকম: আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সেই ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের কথা বলে আসছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পরপর দুটি সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার রাখেনি। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে শুরু করে সুধী সমাজ ওই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরে। অবশেষে ২০০৩ সালের ১০ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন আইন বিল হিসেবে সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস হয়। অন্তত কাগজে-কলমে হলেও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়। যে আইনের অধীনে দুর্নীতি দমন ব্যুরো কাজ করত, তা ছিল সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। ২০০৩-এর জুলাই থেকে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইন পাসের আগ পর্যন্ত সময়ে সরকার নানাভাবে জনমত যাচাইয়ের কাজটি করে। সভা, সেমিনার ও মতবিনিময়ের আয়োজন করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরার সুযোগ পায়।
২০০৩ সালে যে বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল, তাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে কারও অনুমতি নিতে হবে, এমন কথা বলা ছিল না। কিন্তু বিলটি পাস হওয়ার কিছুদিন আগে আইন মন্ত্র্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি বিধান যুক্ত করে, যাতে বলা ছিল দুর্নীতির তদন্ত করতে গেলে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ অনুসরণ করা হবে। আর এই আইনের সেকশন ৬-এর সাব সেকশন ৫-এ বলা আছে, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে দেওয়া চার্জশিট আদালত গ্রহণ করবেন না। বিএনপি সরকার কয়েক মাস বিলটি নিয়ে জনমত যাচাই করে শেষ মুহূর্তে কাউকে না জানিয়ে এমন একটি ধারা জুড়ে দিয়েছিল, যাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীন চরিত্রটি নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমি তখন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এ কর্মরত ছিলাম। একটি প্রকৃত দুর্নীতি দমন কমিশন গড়ে উঠুক সে প্রত্যাশা থেকে ও একজন সাংবাদিক হিসেবে বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর থেকেই বিলটির ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতাম। বিলটি পাস করার জন্য যেদিন সংসদে উত্থাপন করা হবে তার আগের দিন জানতে পারি, সরকার গোপনে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ অনুসরণ করার বিধান সংযুক্ত করেছে। ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার-এ সরকারের এই গোপন উদ্যোগ নিয়ে আমার Last minute change dents anti-graft body’s independent face (http://www.thedailystar. net/2004/02/17/d4021701044.htm) শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই দিন সকালে তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, তিনি শেষ মুহূর্তের এই পরিবর্তনের কথা জানতেনই না। মওদুদ বলেছেন, আমলারা গোপনে ওই ধারা সংযুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি ওই প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদককে অভিনন্দনও জানান। সেদিনই সন্ধ্যায় সংসদে আইনটি পাস হয় এবং এর আগে আইন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমদ ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর সেকশন ৬-এর সাব সেকশন ৫ ও ৬ বিল থেকে প্রত্যাহারের জন্য সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তিনি যুক্তি দেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে সরকারের অনুমতি নিতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হবে। তাঁর এই সংশোধনী প্রস্তাবসহ ওই দিন বিলটি পাস হয়। পরবর্তী সময়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জানিয়েছিলেন, দাতা সংস্থা এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক দ্য ডেইলি স্টার-এর ওই রিপোর্ট দেখে সরকারের ওপর নাখোশ হয়েছিল। আইনমন্ত্রীর কাছে রিপোর্টটি সঠিক কি না, তা জানতেও চেয়েছিল। যেসব কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীন চরিত্রটি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকার কাদের স্বার্থে আইনটিকে সেই পুরোনো ধাঁচে নিয়ে যেতে চাইছে, তা সহজেই অনুমেয়। ব্যারিস্টার মওদুদ ২০০৪ সালে যখন আমলাদের ওপর দায় চাপিয়েছিলেন, তখন তাঁর কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে, এখন মনে হচ্ছে তাঁর কথাই ঠিক ছিল। কিন্তু এবার তো আমলারা গোপনে কোনো ধারা সংযুক্ত করার চেষ্টা করেননি, সরকারের মন্ত্রিপরিষদ নিজেই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তে সরকারের পূর্বানুমতির বিধান সংযুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
এবার দেখা যাক, আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনের আগে এ নিয়ে জনগণকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল: তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার দেওয়া পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানেই বলা আছে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদের বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা, পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দপ্তরে গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।
সরকারি কর্মকাণ্ডে দুর্নীতির পথ বন্ধ করার কথা বলে তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি স্ববিরোধী পদক্ষেপ। এ দেশে দুর্নীতি করে কারা, নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ নয়, ক্ষমতায় থাকা কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, আমলা আর তাঁদের সহায়তায় কিছু ব্যবসায়ী ছাড়া দুর্নীতি করার সুযোগ তো আর কারও নেই। টিআইবি বলছে, বর্তমান সরকারের আনা সংশোধনী প্রস্তাবটি সব নাগরিকের সমান অধিকারের সংবিধান প্রদত্ত অঙ্গীকারের পরিপন্থী। জনপ্রতিনিধিসহ অন্য সব খাত ও পেশার নাগরিকদের থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের আলাদা মাপকাঠিতে বিবেচনার কোনো যুক্তি নেই। তা ছাড়া এই সংশোধনী সরকারের ওপর দুদকের নির্ভরশীলতা বাড়াবে। এতে দুদকের স্বাধীনতা খর্ব হবে এবং এটিকে অকার্যকর করে তুলবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান তো হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হবে। কমিশন কাউকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করবে, অথচ তিনি দুর্নীতিবাজ কি না, সেটার জন্য সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এ ব্যাপারে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হওয়া উচিত। তাঁর এই দুঃখের কথা কে শোনে?
যে আইনটির মাধ্যমে দুদক গঠিত হয়েছে, তাতে কমিশন কতটা স্বাধীন ছিল বা কতটা সফল হয়েছে, সেই যুক্তিতর্ক আপাতত দূরে থাক, কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আলাদা আলাদা চোখে দেখার কারণ কী? সরকার ক্ষমতায় এসেই এই কমিশনের চরিত্র পরিবর্তনের জন্য কেন উঠেপড়ে লাগল? সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, সরকার কি আমলাদের ভয় পাচ্ছে? কেন সেই দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে ফিরে যাওয়া হচ্ছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া কিছুই করা যেত না। দুর্নীতি যে-ই করুক, সমান দৃষ্টিতে দেখা উচিত। আমলাদের তুষ্ট করার এই উদ্যোগের ফলাফল কখনোই শুভ হবে না—এটা বোঝার মতো বিজ্ঞ লোকজন নিশ্চয়ই এ সরকারের মধ্যে অনেক আছেন। এখনো সময় আছে সরকারের অবস্থান থেকে সরে আসার, সংসদে বিলটি উত্থাপনের আগে যেন আবারও সংশোধনী প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করা হয়।
জায়েদুল আহসান: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাসের প্রেক্ষাপটটি ছিল এ রকম: আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সেই ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের কথা বলে আসছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পরপর দুটি সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার রাখেনি। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে শুরু করে সুধী সমাজ ওই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরে। অবশেষে ২০০৩ সালের ১০ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন আইন বিল হিসেবে সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস হয়। অন্তত কাগজে-কলমে হলেও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়। যে আইনের অধীনে দুর্নীতি দমন ব্যুরো কাজ করত, তা ছিল সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। ২০০৩-এর জুলাই থেকে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইন পাসের আগ পর্যন্ত সময়ে সরকার নানাভাবে জনমত যাচাইয়ের কাজটি করে। সভা, সেমিনার ও মতবিনিময়ের আয়োজন করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরার সুযোগ পায়।
২০০৩ সালে যে বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল, তাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে কারও অনুমতি নিতে হবে, এমন কথা বলা ছিল না। কিন্তু বিলটি পাস হওয়ার কিছুদিন আগে আইন মন্ত্র্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি বিধান যুক্ত করে, যাতে বলা ছিল দুর্নীতির তদন্ত করতে গেলে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ অনুসরণ করা হবে। আর এই আইনের সেকশন ৬-এর সাব সেকশন ৫-এ বলা আছে, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে দেওয়া চার্জশিট আদালত গ্রহণ করবেন না। বিএনপি সরকার কয়েক মাস বিলটি নিয়ে জনমত যাচাই করে শেষ মুহূর্তে কাউকে না জানিয়ে এমন একটি ধারা জুড়ে দিয়েছিল, যাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীন চরিত্রটি নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমি তখন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এ কর্মরত ছিলাম। একটি প্রকৃত দুর্নীতি দমন কমিশন গড়ে উঠুক সে প্রত্যাশা থেকে ও একজন সাংবাদিক হিসেবে বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর থেকেই বিলটির ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতাম। বিলটি পাস করার জন্য যেদিন সংসদে উত্থাপন করা হবে তার আগের দিন জানতে পারি, সরকার গোপনে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ অনুসরণ করার বিধান সংযুক্ত করেছে। ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার-এ সরকারের এই গোপন উদ্যোগ নিয়ে আমার Last minute change dents anti-graft body’s independent face (http://www.thedailystar. net/2004/02/17/d4021701044.htm) শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই দিন সকালে তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, তিনি শেষ মুহূর্তের এই পরিবর্তনের কথা জানতেনই না। মওদুদ বলেছেন, আমলারা গোপনে ওই ধারা সংযুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি ওই প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদককে অভিনন্দনও জানান। সেদিনই সন্ধ্যায় সংসদে আইনটি পাস হয় এবং এর আগে আইন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমদ ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর সেকশন ৬-এর সাব সেকশন ৫ ও ৬ বিল থেকে প্রত্যাহারের জন্য সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তিনি যুক্তি দেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে সরকারের অনুমতি নিতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হবে। তাঁর এই সংশোধনী প্রস্তাবসহ ওই দিন বিলটি পাস হয়। পরবর্তী সময়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জানিয়েছিলেন, দাতা সংস্থা এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক দ্য ডেইলি স্টার-এর ওই রিপোর্ট দেখে সরকারের ওপর নাখোশ হয়েছিল। আইনমন্ত্রীর কাছে রিপোর্টটি সঠিক কি না, তা জানতেও চেয়েছিল। যেসব কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীন চরিত্রটি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকার কাদের স্বার্থে আইনটিকে সেই পুরোনো ধাঁচে নিয়ে যেতে চাইছে, তা সহজেই অনুমেয়। ব্যারিস্টার মওদুদ ২০০৪ সালে যখন আমলাদের ওপর দায় চাপিয়েছিলেন, তখন তাঁর কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে, এখন মনে হচ্ছে তাঁর কথাই ঠিক ছিল। কিন্তু এবার তো আমলারা গোপনে কোনো ধারা সংযুক্ত করার চেষ্টা করেননি, সরকারের মন্ত্রিপরিষদ নিজেই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তে সরকারের পূর্বানুমতির বিধান সংযুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
এবার দেখা যাক, আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনের আগে এ নিয়ে জনগণকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল: তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার দেওয়া পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানেই বলা আছে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদের বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা, পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দপ্তরে গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।
সরকারি কর্মকাণ্ডে দুর্নীতির পথ বন্ধ করার কথা বলে তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি স্ববিরোধী পদক্ষেপ। এ দেশে দুর্নীতি করে কারা, নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ নয়, ক্ষমতায় থাকা কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, আমলা আর তাঁদের সহায়তায় কিছু ব্যবসায়ী ছাড়া দুর্নীতি করার সুযোগ তো আর কারও নেই। টিআইবি বলছে, বর্তমান সরকারের আনা সংশোধনী প্রস্তাবটি সব নাগরিকের সমান অধিকারের সংবিধান প্রদত্ত অঙ্গীকারের পরিপন্থী। জনপ্রতিনিধিসহ অন্য সব খাত ও পেশার নাগরিকদের থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের আলাদা মাপকাঠিতে বিবেচনার কোনো যুক্তি নেই। তা ছাড়া এই সংশোধনী সরকারের ওপর দুদকের নির্ভরশীলতা বাড়াবে। এতে দুদকের স্বাধীনতা খর্ব হবে এবং এটিকে অকার্যকর করে তুলবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান তো হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হবে। কমিশন কাউকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করবে, অথচ তিনি দুর্নীতিবাজ কি না, সেটার জন্য সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এ ব্যাপারে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হওয়া উচিত। তাঁর এই দুঃখের কথা কে শোনে?
যে আইনটির মাধ্যমে দুদক গঠিত হয়েছে, তাতে কমিশন কতটা স্বাধীন ছিল বা কতটা সফল হয়েছে, সেই যুক্তিতর্ক আপাতত দূরে থাক, কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আলাদা আলাদা চোখে দেখার কারণ কী? সরকার ক্ষমতায় এসেই এই কমিশনের চরিত্র পরিবর্তনের জন্য কেন উঠেপড়ে লাগল? সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, সরকার কি আমলাদের ভয় পাচ্ছে? কেন সেই দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে ফিরে যাওয়া হচ্ছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া কিছুই করা যেত না। দুর্নীতি যে-ই করুক, সমান দৃষ্টিতে দেখা উচিত। আমলাদের তুষ্ট করার এই উদ্যোগের ফলাফল কখনোই শুভ হবে না—এটা বোঝার মতো বিজ্ঞ লোকজন নিশ্চয়ই এ সরকারের মধ্যে অনেক আছেন। এখনো সময় আছে সরকারের অবস্থান থেকে সরে আসার, সংসদে বিলটি উত্থাপনের আগে যেন আবারও সংশোধনী প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করা হয়।
জায়েদুল আহসান: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।
No comments