দাহকালের কথা-খেলা by মাহমুদুজ্জামান বাবু
আমাদের কি মনে পড়ছে, সেই যে কিশোর বয়সে পাঠ করা গল্পটির কথা? একদল বালক খেলার আমোদে এক পুকুরে ঢিল ছুড়ছিল বিরামহীন। পুকুরে, জলের গভীরে শান্তিতে জীবন যাপন করা নানা রকমের মাছ ও ব্যাঙের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কিছুক্ষণ পরই। শেষে ব্যাঙের দলনেতা জলের ওপর মাথা তুলে বলেছিল, হে বালকবৃন্দ!
ঢিল ছোড়াটা তোমাদের জন্য আনন্দের হলেও আমাদের জন্য তা মৃত্যুযন্ত্রণার। এই আনন্দ থামাও!...আমাদের কিশোর মানসে, যাতে অন্যের সর্বনাশ করে নিজের তুষ্টি বা স্বার্থ চরিতার্থ করার বাসনার ভ্রূণ না জন্মায়, সম্ভবত সে কারণেই হিতোপদেশ-ছোঁয়া গল্পটি পড়ানো হয়েছিল। তাতে খুব কাজ হয়েছে—এমন জোরালো দাবি করার নিজস্ব স্বর এখন নিজের কাছেই অচেনা লাগে। চারপাশের বিশ্ব ও বাংলাদেশ দেখে দেখে কেবলই দীর্ঘশ্বাস জমছে চেতনায়। শুভবোধ এখন পলাতকপ্রায়। মৌলবাদীদের পরিকল্পিত হামলায় রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, অকালপ্রয়াত বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের ‘শুভেচ্ছা’ কবিতায় লেখা ছিল ‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।/ ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালী গান, ভালো থেকো।/ ...ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল/ ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল/ ভালো থেকো নাও, মধুমাখা গাঁও, ভালো থেকো।...’ হুমায়ুন আজাদ কিশোর কবিতা হিসেবেই ‘শুভেচ্ছা’ লিখেছেন। আড়িয়ল বিল এলাকার কিশোরেরা কেমন আছে? আর আড়িয়ল বিল নিজে?
আরও অনেকের মতো মাঝেমধ্যে গানের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেশের বাইরে আমিও গেছি, যাই। অন্য দেশের বিমানবন্দর নিকটবর্তী হওয়ার অনেক আগে থেকেই পাসপোর্ট ও আয়োজকদের নিমন্ত্রণপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে স্নায়ু টানটান হতে থাকে। কারণ, এই দেশগুলোর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের খুব একটা সুনজরে দেখে না। ফলে উড়ন্ত বিমানে বসেই নিজে নিজে প্রশ্নোত্তর পর্ব আয়োজন করি। আর ইংরেজি ভাষাটা যেহেতু আমার প্রতিদিনের কথোপকথনের প্রধান বাহন নয়, স্বভাবতই ওতে আমি অপটু। তখন একমাত্র উপায় আয়োজকদের পাঠানো ইংরেজিতে লেখা চিঠি। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সামনে বাড়িয়ে দাও। ভাই, পড়ে দেখেন। এখানে সব লেখা আছে। তো, কাগজপত্র গুছিয়ে আকাশের বিমানে বসে আছি। বিমানের পরিচালক ঘোষণাও দিয়েছেন যে আমরা এখনই বিমানবন্দরে নামব। বিমান আর নামে না। কারণ কী? জানালা দিয়ে শহর দেখি। ছুটে চলা ব্যস্ততা দেখি। মেঘ ছুঁই ছুঁই দালানকোঠা দেখি। বিমান কেবলই চক্কর দিতে থাকে আকাশে। কিছুক্ষণ পর ঘোষণা শুনি, বিমানবন্দরে জ্যাম লেগেছে। ট্রাফিক জ্যাম! শুনে চোখ গোল করে জানালা দিয়ে নিচে দেখি। না, কোথাও জ্যামের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। যদিও নিচে, বিমানবন্দরজুড়ে অগণিত বিমান, কিন্তু সেগুলো তো নিশ্চল! আসলে জ্যামটা আকাশেই লাগে। ওড়া ও নামার সময়। পৃথিবীর বড় দেশগুলোর বড় বড় বিমানবন্দরে মিনিটে তিনটা করে বিমান ওড়ে অথবা নামে—এমনই শুনেছি। সত্যি-মিথ্যা জানি না, কিন্তু জ্যামে তো পড়েছিলাম নিজেই কয়েকবার।
ক্ষমতাসীন সরকার আড়িয়ল বিল এলাকায় নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করতে চাইছে, তথ্যটি জানার পর আমার প্রবল অনুসন্ধিৎসা জেগেছিল সত্যটি জানতে যে, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইদানীং জ্যাম লাগছে কি না! দেশে এখন তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর। গণমাধ্যমে বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের যে মতামত গত কয়েক দিন প্রচারিত হয়েছে, তাতে জানা যাচ্ছে, এসব বিমানবন্দরের যতটুকু ধারণক্ষমতা, তার পুরোটা কখনোই ব্যবহূত হয়নি, হচ্ছে না। খোদ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু, এখনো সেখানে ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক যাত্রী এই বিমানবন্দর দিয়ে যায়-আসে। (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি)। জানা যাচ্ছে এও যে, যেকোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টি বিমান যদি ওঠা-নামা করে, তাহলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানবন্দরের তালিকায় পড়বে। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের ওঠা-নামাসহ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে প্রতি ঘণ্টায় বিমান ওঠা-নামা করছে ১০টি। কী দাঁড়াল? স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানবন্দরের তালিকায় এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নাম তোলা যাচ্ছে? আধুনিক একটি বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তার কথা সরকার চড়া স্বরে বলছে। আধুনিক মানে কী? দেশের বাইরে থেকে এসে যাঁরা ঢাকার বিমানবন্দরে নামেন, তাঁরা জানেন, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও হেলাফেলায় পাঁচ মিনিটের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে একেকজন যাত্রীর বেলায় প্রায় ২০ মিনিট সময় অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। দক্ষ জনবল, আধুনিক প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার ও বিমানবন্দরের বিস্তৃতি ঘটিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেহারা বদলে দেওয়া খুব দুরূহ কাজ? মোটেই না।
প্রধানমন্ত্রী আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করার ঘোষণা দিলেন ঠিকই, কিন্তু তার আগেই অযথা জল ঘোলা করল সরকার। আড়িয়ল বিল রক্ষার দাবিতে আন্দোলনরত নারী-পুরুষ সহিংস হলেন, মার খেলেন, পুলিশের একজন এসআই নিরুপায় মরে গেলেন, পুলিশ ফাঁড়ি ও বন্দুক লুট হলো, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হলো, পাঁচ হাজার লোকের নামে মামলা হলো, বিল রক্ষা কমিটির নেতা গ্রেপ্তার হলেন আর বিরোধী দল হরতাল পালন করলেও তাঁদের সম্পর্কে একটি কথা বলেনি। ক্ষমতায় থাকার ও ক্ষমতায় যাওয়ার এই রাজনীতি নামের খেলার ক্রীড়নক কেবলই সাধারণ মানুষ। দল ও এই রাজনীতিকেরা সবুজের পক্ষে নেই, লাল সূর্যের পক্ষে নেই, প্রগতির পক্ষে নেই, মানুষের পক্ষে নেই? যদি তা-ই না হবে, তবে সব মানুষের চাওয়ার সঙ্গে তাঁদের চাওয়া মেলে না কেন? হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘যখন তাদের দেখি অন্ধ হয়ে আসে দুই চোখ।/ ভয় পাই কোনো দিন দেখতে পাবো না হায় মেঘ পাতা সবুজ শিশির।/ আমার সামনে থেকে মুছে যায় গাছপালা রোদ শিশু, জোনাকীর সামান্য আলোক।/ চর পড়ে নদী জুড়ে, ছাইয়ে ঢাকে ধানক্ষেত মধুমতি মেঘনার তীর।...(রাজনীতিবিদগণ)’। আমরা তবে শুধুই ক্রীড়নক?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী
che21c@yahoo.com
আরও অনেকের মতো মাঝেমধ্যে গানের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেশের বাইরে আমিও গেছি, যাই। অন্য দেশের বিমানবন্দর নিকটবর্তী হওয়ার অনেক আগে থেকেই পাসপোর্ট ও আয়োজকদের নিমন্ত্রণপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে স্নায়ু টানটান হতে থাকে। কারণ, এই দেশগুলোর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের খুব একটা সুনজরে দেখে না। ফলে উড়ন্ত বিমানে বসেই নিজে নিজে প্রশ্নোত্তর পর্ব আয়োজন করি। আর ইংরেজি ভাষাটা যেহেতু আমার প্রতিদিনের কথোপকথনের প্রধান বাহন নয়, স্বভাবতই ওতে আমি অপটু। তখন একমাত্র উপায় আয়োজকদের পাঠানো ইংরেজিতে লেখা চিঠি। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সামনে বাড়িয়ে দাও। ভাই, পড়ে দেখেন। এখানে সব লেখা আছে। তো, কাগজপত্র গুছিয়ে আকাশের বিমানে বসে আছি। বিমানের পরিচালক ঘোষণাও দিয়েছেন যে আমরা এখনই বিমানবন্দরে নামব। বিমান আর নামে না। কারণ কী? জানালা দিয়ে শহর দেখি। ছুটে চলা ব্যস্ততা দেখি। মেঘ ছুঁই ছুঁই দালানকোঠা দেখি। বিমান কেবলই চক্কর দিতে থাকে আকাশে। কিছুক্ষণ পর ঘোষণা শুনি, বিমানবন্দরে জ্যাম লেগেছে। ট্রাফিক জ্যাম! শুনে চোখ গোল করে জানালা দিয়ে নিচে দেখি। না, কোথাও জ্যামের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। যদিও নিচে, বিমানবন্দরজুড়ে অগণিত বিমান, কিন্তু সেগুলো তো নিশ্চল! আসলে জ্যামটা আকাশেই লাগে। ওড়া ও নামার সময়। পৃথিবীর বড় দেশগুলোর বড় বড় বিমানবন্দরে মিনিটে তিনটা করে বিমান ওড়ে অথবা নামে—এমনই শুনেছি। সত্যি-মিথ্যা জানি না, কিন্তু জ্যামে তো পড়েছিলাম নিজেই কয়েকবার।
ক্ষমতাসীন সরকার আড়িয়ল বিল এলাকায় নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করতে চাইছে, তথ্যটি জানার পর আমার প্রবল অনুসন্ধিৎসা জেগেছিল সত্যটি জানতে যে, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইদানীং জ্যাম লাগছে কি না! দেশে এখন তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর। গণমাধ্যমে বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের যে মতামত গত কয়েক দিন প্রচারিত হয়েছে, তাতে জানা যাচ্ছে, এসব বিমানবন্দরের যতটুকু ধারণক্ষমতা, তার পুরোটা কখনোই ব্যবহূত হয়নি, হচ্ছে না। খোদ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু, এখনো সেখানে ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক যাত্রী এই বিমানবন্দর দিয়ে যায়-আসে। (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি)। জানা যাচ্ছে এও যে, যেকোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টি বিমান যদি ওঠা-নামা করে, তাহলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানবন্দরের তালিকায় পড়বে। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের ওঠা-নামাসহ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে প্রতি ঘণ্টায় বিমান ওঠা-নামা করছে ১০টি। কী দাঁড়াল? স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানবন্দরের তালিকায় এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নাম তোলা যাচ্ছে? আধুনিক একটি বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তার কথা সরকার চড়া স্বরে বলছে। আধুনিক মানে কী? দেশের বাইরে থেকে এসে যাঁরা ঢাকার বিমানবন্দরে নামেন, তাঁরা জানেন, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও হেলাফেলায় পাঁচ মিনিটের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে একেকজন যাত্রীর বেলায় প্রায় ২০ মিনিট সময় অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। দক্ষ জনবল, আধুনিক প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার ও বিমানবন্দরের বিস্তৃতি ঘটিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেহারা বদলে দেওয়া খুব দুরূহ কাজ? মোটেই না।
প্রধানমন্ত্রী আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করার ঘোষণা দিলেন ঠিকই, কিন্তু তার আগেই অযথা জল ঘোলা করল সরকার। আড়িয়ল বিল রক্ষার দাবিতে আন্দোলনরত নারী-পুরুষ সহিংস হলেন, মার খেলেন, পুলিশের একজন এসআই নিরুপায় মরে গেলেন, পুলিশ ফাঁড়ি ও বন্দুক লুট হলো, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হলো, পাঁচ হাজার লোকের নামে মামলা হলো, বিল রক্ষা কমিটির নেতা গ্রেপ্তার হলেন আর বিরোধী দল হরতাল পালন করলেও তাঁদের সম্পর্কে একটি কথা বলেনি। ক্ষমতায় থাকার ও ক্ষমতায় যাওয়ার এই রাজনীতি নামের খেলার ক্রীড়নক কেবলই সাধারণ মানুষ। দল ও এই রাজনীতিকেরা সবুজের পক্ষে নেই, লাল সূর্যের পক্ষে নেই, প্রগতির পক্ষে নেই, মানুষের পক্ষে নেই? যদি তা-ই না হবে, তবে সব মানুষের চাওয়ার সঙ্গে তাঁদের চাওয়া মেলে না কেন? হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘যখন তাদের দেখি অন্ধ হয়ে আসে দুই চোখ।/ ভয় পাই কোনো দিন দেখতে পাবো না হায় মেঘ পাতা সবুজ শিশির।/ আমার সামনে থেকে মুছে যায় গাছপালা রোদ শিশু, জোনাকীর সামান্য আলোক।/ চর পড়ে নদী জুড়ে, ছাইয়ে ঢাকে ধানক্ষেত মধুমতি মেঘনার তীর।...(রাজনীতিবিদগণ)’। আমরা তবে শুধুই ক্রীড়নক?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী
che21c@yahoo.com
No comments