অভিনন্দন মিসর-জালিমের বিদায়, জনতার জয় এবং অরক্ষিত বিপ্লব by রবার্ট ফিস্ক
হঠাৎ সবার বুক ফেটে বেরিয়ে এল গান। তারা হাসল, তারা কাঁদল, তারা প্রার্থনা করল, হাঁটু গেড়ে বসে চুমু খেল ময়লা রাস্তাটায়। এবং তারা নাচল, খোদার কাছে শুকরিয়া জানাল। তিনি তাদের ঘাড় থেকে হোসনি মোবারককে খালাস করেছেন। এক মহান মুহূর্ত, কোনো অলৌকিক শক্তিতে, সাহসের বলে তারা মিসরকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে।
তাই তারা কাঁদছে, অশ্রুতে ভিজে গেছে তাদের পোশাক। প্রত্যেক নর-নারী যেন নববিবাহিতের মতো খুশি, যেন এই আনন্দ দিয়েই তারা স্বৈরাচারের কয়েক দশকের সব দুঃখ-কষ্ট, সব নিপীড়ন, অপমান আর রক্তদান ঢেকে দেবে। চিরকালের জন্য এ ঘটনা পরিচিত হবে ২৫ জানুয়ারির মিসর বিপ্লব হিসেবে—ওই দিনেই গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়। চিরকালের জন্য এ ঘটনা মানুষের উত্থানের প্রতীক হয়ে গেল।
অবশেষে বুড়ো ভামটা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা উপরাষ্ট্রপতির কাছে না দিয়ে দিয়েছে সামরিক পরিষদের কাছে; একজন ফিল্ড মার্শাল ও এক দঙ্গল ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কাছে। লাখ লাখ অহিংস বিপ্লবীর মেজাজের সঙ্গে এটা বেমানান। গণতন্ত্রপন্থীরা যা কিছুর জন্য লড়েছে, জীবন দিয়েছে, সেনাপতিরাই এখন সেসবের রক্ষাকর্তা। এমনকি সেনারাও আজ খুশি। নাইল নদীর তীরে টেলিভিশন স্টেশনের চারপাশের অটুট সেনা প্রহরা ফুঁড়ে মোবারকের বিদায়ের সংবাদ বাইরের জনবিক্ষোভে পৌঁছে গেল। খবরটা পাওয়ামাত্র এক তরুণ সেনা কর্মকর্তার মুখ আনন্দে ভেসে গেল। সারা দিন ধরেই বিক্ষোভকারীরা সেনাদের বুঝিয়েছে যে তারা তাদের ভাই। দেখি, তারা কেমন ভাই।
মিসরীয়দের কাছে এই বিপ্লব কী অর্থ বহন করে? অটুট ইচ্ছাশক্তি, অসীম সাহসিকতা নিয়ে তারা মোবারকের কুখ্যাত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মোকাবিলা করেছে। তারা উপলব্ধি করেছে, এক জগদ্দল স্বৈরশাসককে উচ্ছেদ কেবল কথা আর ফেসবুক দিয়ে হয় না, এর জন্য পুলিশ-সেনাদের গুলি ও টিয়ারগ্যাসের বিরুদ্ধে শুধু শরীর আর পাথর দিয়ে যুদ্ধও করতে হয়। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি নিয়ে জীবন-মরণ লড়াই করে তারা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, যার নাম বিপ্লব।
মন্দ ও অভিশপ্ত আরব জনগণ, পশ্চিমের বর্ণবাদী প্রবঞ্চনার শিকার আরব জনগণ, ইসরায়েলিদের চোখে পশ্চাৎপদ আরব জনগণ আজ উঠে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকা ও ইসরায়েল যে বর্বর শাসনের মদদ দিয়ে এসেছে, তাকে তারা ফেলে দিয়েছে। যে ব্যক্তিটি বার্ষিক এক বিলিয়ন ডলারের মূল্যে তাঁর দেশ ও মানুষকে বেচে দিয়েছেন, যাঁকে পাশ্চাত্যের শাসকেরা আদর করে ‘উদার’ নেতা বলে সম্বোধন করেন, সেই ব্যক্তিটিকে তারা ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। কেবল পূর্ব ইউরোপীয়রাই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায় না, আরবরাও পারে।
অথচ এই ব্যক্তিটিই মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগের এক ঘোরগ্রস্ত মুহূর্তে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি তাঁর ‘সন্তানদের’ ‘সন্ত্রাসবাদের’ কবল থেকে বাঁচাতে এখনো ক্ষমতায় থাকতে চান। তাঁর এই অন্তিম ভাষণ আরও মূল্যবান করে তুলেছে গত শুক্রবারের বিজয়কে। গত বৃহস্পতিবার রাতে মিসরের গণতন্ত্রকামী নর-নারীরা মোবারককে জুতা দেখিয়ে জবাব দিয়ে দিয়েছে। এই জরাগ্রস্ত নেতা জনগণকে মনে করতেন নাবালক, তাদের কোনো রাজনৈতিক বা নৈতিক মর্যাদা নেই। অথচ তাঁকে স্রেফ পালিয়ে যেতে হয়েছে লোহিত সমুদ্রতীরের পশ্চিমা স্টাইলের বিনোদনকেন্দ্র শারম আল-শেখে।
মিসরীয় বিপ্লব এখন তাহলে সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত। এদিকে মোবারকের ক্ষমতার ধ্বংসস্তূপে ফিল্ড মার্শাল, জেনারেল আর ব্রিগেডিয়াররা ক্ষমতার কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে। পরশু রাতে সেনাবাহিনীর তরফে পরস্পরবিরোধী বার্তাগুলো সেটাই প্রকাশ করে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওয়াশিংটনের মাধ্যমে তাদের পছন্দের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমানকে প্রেসিডেন্ট করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে ইসরায়েল। এদিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল তানতাবি চান সেনাপ্রধান জেনারেল সামি আনানই দেশ চালান।
বর্তমান ব্যবস্থার ভেতরে রয়েছে জেনারেলদের যোগাযোগ-জাল। যদিও এটা আসলে মাকড়সার জাল, যার মধ্যে বসে প্রতিদ্বন্দ্বী সেনা কর্মকর্তারা ৩০ বছর ধরে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়েছেন, ভোগ করেছেন বিশেষ সুবিধা। সেনাবাহিনীর ভেতরে যে বিষাক্ত ক্ষমতার টানাটানি শুরু হয়েছে, তার কাছে বৃদ্ধ স্বৈরশাসক কিংবা লাখো-কোটি মিসরীয়র চাওয়া-পাওয়ার মূল্য কম।
সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সবাই পুরোনো ব্যবস্থার লোক, ক্ষমতা ও বিত্তের মোহে নিমজ্জিত। মোবারকের গত সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট একজন জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী একজন জেনারেল, উপপ্রধানমন্ত্রী জেনারেল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জেনারেল। মোবারক নিজে ছিলেন বিমানবাহিনীর প্রধান। সেনাবাহিনীই নাসেরকে ক্ষমতায় এনেছিল। তারাই সমর্থন দিয়েছিল আনোয়ার সাদাতকে। জেনারেল মোবারকের পেছনেও ছিল তারা। ১৯৫২ সালে স্বৈরতন্ত্র চালু করেছিল সেনাবাহিনীই। অথচ প্রতিবাদীরা ভাবছে, এই সেনাবাহিনীই গণতন্ত্র কায়েমের কারিকাশক্তি হবে। দেখা যাক।
দুঃখ যে, মিসরই সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীই মিসর। কিংবা হয়তো তা নয়, কিন্তু সেনাবাহিনী সেটাই ভাবে। অতএব তারা চায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণ করতে। অবশ্য সামরিক বার্তাগুলোয় তারা নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছাটাকে ‘জনগণকে রক্ষা’ শব্দ দিয়ে ঢেকে রেখেছে, কিন্তু মানুষ তাদের তোয়াক্কা করেনি। শুক্রবার তারা লাখে লাখে জড়ো হয়ে কায়রোর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে। তাহরির চত্বরের উপচানো ঢল সংসদ ভবন ছাপিয়ে নাইল নদীর তীরের টেলিভিশন ও বেতারকেন্দ্র পার হয়ে অভিজাত এলাকা হেলিওপলিসের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছায়। এদিকে আলেকজান্দ্রিয়ায় লাখো মানুষ আরেকটি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ঘেরাও করে। কায়রোর বাণিজ্যিক এলাকার তালাত হাব চত্বরও জনতার দখলে চলে যায়। এদিন সকালে তাহরির চত্বরে মিছিল নিয়ে আসেন কায়রোর তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
বৃহস্পতিবার রাতে মোবারকের গা-জ্বালা করা ভাষণের পর অস্বাভাবিক রকম শৃঙ্খলা আর রসিকতার মেজাজে শুক্রবারের বিক্ষোভ শুরু হয়। মোবারক গং যদি ভেবে থাকে যে প্রেসিডেন্টের আত্মঘাতী বক্তৃতার পর গণতন্ত্রকামীরা সহিংসতায় ফেটে পড়বে, তবে তারা ভুল ভেবেছে। মিসরীয় বিপ্লবের ভিত যারা গেড়েছে, সেই তরুণ-তরুণীরা বরং ধৈর্যশীল আচরণ করেছে। অনেক দেশেই এ ধরনের ঘটনার পর সরকারি ভবনগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। অথচ গত পরশু তাহরির চত্বরে তারা কবিতা পড়েছে। সে রকম অবস্থাতেই খবর আসে, খলনায়ক পালিয়েছে।
কিন্তু কবিতা দিয়েই বিপ্লব জয়ী হবে না। মিসরের ভবিষ্যৎ এখন শ খানেক সেনা কর্মকর্তার হাতে। তাঁরা মোবারকের প্রতি আনুগত্য ছেড়েছেন। শুক্রবার সকালে এক সামরিক বার্তায় ‘মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচনের’ দাবি করা হয়। পাশাপাশি জানানো হয়, মিসরীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলো ‘জনগণের দাবির প্রতি দায়বদ্ধ’ এবং তারা চায় ‘স্বাভাবিক জীবনে ফিরে’ যাক। সাধারণ মানুষের ভাষায় এর অনুবাদ হলো, বিপ্লবীরা ঘরে ফিরে যাক, সেই সুযোগে জেনারেলদের কায়েমি মহল নতুন সরকারের মন্ত্রীর পদগুলো ভাগাভাগি করে নিক। এ ধরনের ঘটনাকে ‘ক্যুদেতা’ বা প্রতিবিপ্লব বলা হয়।
মোবারকের পতনের পর কায়রোয় তাঁর প্রাসাদের সামনের কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে বসানো হয় বালুর বস্তা এবং তার পেছনে থাকে মেশিনগান। মোবারকের পতনের সংবাদ আসার আগেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সব সেনার কাছে জনগণের দেখভাল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। মিসরের তৃতীয় বাহিনীর এক লেফটেন্যান্টকে দেখলাম, বিক্ষোভকারীদের সহায়তা করছে। খুবই উচ্চশিক্ষিত এবং ইংরেজিতে তুখোড় এই তরুণ সেনা ভাবছেন, কায়রোর বিক্ষোভই হয়তো গণতন্ত্র অর্জনের সেরা পথ। তাঁকে শুধালাম, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘাত হলে আপনি কি গুলি করবেন? ‘আমাকে অনেকেই এই প্রশ্ন করেছে’ বলে তিনি জানালেন, ‘আমি তাদের বলেছি, নিজের বাবা-মা-পরিবারকে আমি গুলি করতে পারব না। তোমরা আমার বাবার মতো, ভাইয়ের মতো, তোমরা আমার পরিবার। আমার বন্ধুরাও আজ এখানে।’ কিন্তু যদি গুলি করার হুকুম আসে? তাঁর জবাব, ‘আমি নিশ্চিত এ রকম কিছু ঘটবে না। মিসরের অন্য সব বিপ্লবই ছিল রক্তাক্ত। এখানে আমি রক্তপাত চাই না।’
সেনা যুবকটি ভালোই ইতিহাস জানেন। ১৭৯৮ সালে কায়রোর মিসরীয়রা নেপোলিয়নের বাহিনীর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে তারা রাজতন্ত্রকে মোকাবিলা করে, ১৯১৯ ও ১৯৫২ সালে তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান করে। ১৯৭৭ সালে বিদ্রোহ করে আনোয়ার সাদাতের বিরুদ্ধে এবং ১৯৮৬ সালে মোবারকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সে সময় এমনকি পুলিশরাও সরকারকে ত্যাগ করেছিল। গত সপ্তাহে তাহরির চত্বরে চার সেনা চাকরি ছেড়ে জনতার সঙ্গে মিশে যান। একজন এই তাহরিরেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তলার অবস্থা এমন, কিন্তু ওপরে মোবারকের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপে শকুনের মতো কামড়াকামড়ি করছেন জেনারেলরা। তাঁরাও ভীত, বিপ্লব যদি তাঁদের সেনাদের ভেতরেও সংক্রমিত হয়!
ওমর সুলেইমান তাঁর প্রেসিডেন্টের মতোই বালসুলভ বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি বিক্ষোভকারীদের বাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন। এক বিক্ষোভকারীর ভাষায়, তিনি জনগণকে ভেড়ার পাল ভেবেছেন। তিনি বলেছেন রেডিও ও টেলিভিশন নাকি মানুষকে উসকিয়েছে, বিপ্লবের পেছনে নাকি ‘বিদেশিদের হাত’ রয়েছে ইত্যাদি। তিনি আরেক বৃদ্ধ, যিনি ভেবেছেন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপ্লবকে থামিয়ে দেবেন। বিপ্লব থামবে না, কিন্তু তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাধ ধূলিসাৎ হলো।
এভাবেই ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হঠাৎ সেনারা যুদ্ধ ছেড়ে সংগীতে ফেটে পড়েছিল। কিন্তু সেই শান্তি ডেকে এনেছিল আরও মানব বিপর্যয়। আজ যে মিসরীয়রা তিন সপ্তাহের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে, বিপ্লবকে সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে তাদের। ভেতরের ও বাইরের শত্রুরা বিপ্লবের ফল ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে। সত্যিকার গণতন্ত্র পেতে চাইলে রুখে দিতে হবে এদের। সেনাবাহিনী জনগণকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরবে কে?
১২ ফেব্রুয়ারি
ব্রিটেনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং আরব বিশেষজ্ঞ।
অবশেষে বুড়ো ভামটা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা উপরাষ্ট্রপতির কাছে না দিয়ে দিয়েছে সামরিক পরিষদের কাছে; একজন ফিল্ড মার্শাল ও এক দঙ্গল ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কাছে। লাখ লাখ অহিংস বিপ্লবীর মেজাজের সঙ্গে এটা বেমানান। গণতন্ত্রপন্থীরা যা কিছুর জন্য লড়েছে, জীবন দিয়েছে, সেনাপতিরাই এখন সেসবের রক্ষাকর্তা। এমনকি সেনারাও আজ খুশি। নাইল নদীর তীরে টেলিভিশন স্টেশনের চারপাশের অটুট সেনা প্রহরা ফুঁড়ে মোবারকের বিদায়ের সংবাদ বাইরের জনবিক্ষোভে পৌঁছে গেল। খবরটা পাওয়ামাত্র এক তরুণ সেনা কর্মকর্তার মুখ আনন্দে ভেসে গেল। সারা দিন ধরেই বিক্ষোভকারীরা সেনাদের বুঝিয়েছে যে তারা তাদের ভাই। দেখি, তারা কেমন ভাই।
মিসরীয়দের কাছে এই বিপ্লব কী অর্থ বহন করে? অটুট ইচ্ছাশক্তি, অসীম সাহসিকতা নিয়ে তারা মোবারকের কুখ্যাত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মোকাবিলা করেছে। তারা উপলব্ধি করেছে, এক জগদ্দল স্বৈরশাসককে উচ্ছেদ কেবল কথা আর ফেসবুক দিয়ে হয় না, এর জন্য পুলিশ-সেনাদের গুলি ও টিয়ারগ্যাসের বিরুদ্ধে শুধু শরীর আর পাথর দিয়ে যুদ্ধও করতে হয়। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি নিয়ে জীবন-মরণ লড়াই করে তারা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, যার নাম বিপ্লব।
মন্দ ও অভিশপ্ত আরব জনগণ, পশ্চিমের বর্ণবাদী প্রবঞ্চনার শিকার আরব জনগণ, ইসরায়েলিদের চোখে পশ্চাৎপদ আরব জনগণ আজ উঠে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকা ও ইসরায়েল যে বর্বর শাসনের মদদ দিয়ে এসেছে, তাকে তারা ফেলে দিয়েছে। যে ব্যক্তিটি বার্ষিক এক বিলিয়ন ডলারের মূল্যে তাঁর দেশ ও মানুষকে বেচে দিয়েছেন, যাঁকে পাশ্চাত্যের শাসকেরা আদর করে ‘উদার’ নেতা বলে সম্বোধন করেন, সেই ব্যক্তিটিকে তারা ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। কেবল পূর্ব ইউরোপীয়রাই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায় না, আরবরাও পারে।
অথচ এই ব্যক্তিটিই মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগের এক ঘোরগ্রস্ত মুহূর্তে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি তাঁর ‘সন্তানদের’ ‘সন্ত্রাসবাদের’ কবল থেকে বাঁচাতে এখনো ক্ষমতায় থাকতে চান। তাঁর এই অন্তিম ভাষণ আরও মূল্যবান করে তুলেছে গত শুক্রবারের বিজয়কে। গত বৃহস্পতিবার রাতে মিসরের গণতন্ত্রকামী নর-নারীরা মোবারককে জুতা দেখিয়ে জবাব দিয়ে দিয়েছে। এই জরাগ্রস্ত নেতা জনগণকে মনে করতেন নাবালক, তাদের কোনো রাজনৈতিক বা নৈতিক মর্যাদা নেই। অথচ তাঁকে স্রেফ পালিয়ে যেতে হয়েছে লোহিত সমুদ্রতীরের পশ্চিমা স্টাইলের বিনোদনকেন্দ্র শারম আল-শেখে।
মিসরীয় বিপ্লব এখন তাহলে সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত। এদিকে মোবারকের ক্ষমতার ধ্বংসস্তূপে ফিল্ড মার্শাল, জেনারেল আর ব্রিগেডিয়াররা ক্ষমতার কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে। পরশু রাতে সেনাবাহিনীর তরফে পরস্পরবিরোধী বার্তাগুলো সেটাই প্রকাশ করে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওয়াশিংটনের মাধ্যমে তাদের পছন্দের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমানকে প্রেসিডেন্ট করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে ইসরায়েল। এদিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল তানতাবি চান সেনাপ্রধান জেনারেল সামি আনানই দেশ চালান।
বর্তমান ব্যবস্থার ভেতরে রয়েছে জেনারেলদের যোগাযোগ-জাল। যদিও এটা আসলে মাকড়সার জাল, যার মধ্যে বসে প্রতিদ্বন্দ্বী সেনা কর্মকর্তারা ৩০ বছর ধরে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়েছেন, ভোগ করেছেন বিশেষ সুবিধা। সেনাবাহিনীর ভেতরে যে বিষাক্ত ক্ষমতার টানাটানি শুরু হয়েছে, তার কাছে বৃদ্ধ স্বৈরশাসক কিংবা লাখো-কোটি মিসরীয়র চাওয়া-পাওয়ার মূল্য কম।
সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সবাই পুরোনো ব্যবস্থার লোক, ক্ষমতা ও বিত্তের মোহে নিমজ্জিত। মোবারকের গত সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট একজন জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী একজন জেনারেল, উপপ্রধানমন্ত্রী জেনারেল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জেনারেল। মোবারক নিজে ছিলেন বিমানবাহিনীর প্রধান। সেনাবাহিনীই নাসেরকে ক্ষমতায় এনেছিল। তারাই সমর্থন দিয়েছিল আনোয়ার সাদাতকে। জেনারেল মোবারকের পেছনেও ছিল তারা। ১৯৫২ সালে স্বৈরতন্ত্র চালু করেছিল সেনাবাহিনীই। অথচ প্রতিবাদীরা ভাবছে, এই সেনাবাহিনীই গণতন্ত্র কায়েমের কারিকাশক্তি হবে। দেখা যাক।
দুঃখ যে, মিসরই সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীই মিসর। কিংবা হয়তো তা নয়, কিন্তু সেনাবাহিনী সেটাই ভাবে। অতএব তারা চায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণ করতে। অবশ্য সামরিক বার্তাগুলোয় তারা নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছাটাকে ‘জনগণকে রক্ষা’ শব্দ দিয়ে ঢেকে রেখেছে, কিন্তু মানুষ তাদের তোয়াক্কা করেনি। শুক্রবার তারা লাখে লাখে জড়ো হয়ে কায়রোর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে। তাহরির চত্বরের উপচানো ঢল সংসদ ভবন ছাপিয়ে নাইল নদীর তীরের টেলিভিশন ও বেতারকেন্দ্র পার হয়ে অভিজাত এলাকা হেলিওপলিসের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছায়। এদিকে আলেকজান্দ্রিয়ায় লাখো মানুষ আরেকটি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ঘেরাও করে। কায়রোর বাণিজ্যিক এলাকার তালাত হাব চত্বরও জনতার দখলে চলে যায়। এদিন সকালে তাহরির চত্বরে মিছিল নিয়ে আসেন কায়রোর তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
বৃহস্পতিবার রাতে মোবারকের গা-জ্বালা করা ভাষণের পর অস্বাভাবিক রকম শৃঙ্খলা আর রসিকতার মেজাজে শুক্রবারের বিক্ষোভ শুরু হয়। মোবারক গং যদি ভেবে থাকে যে প্রেসিডেন্টের আত্মঘাতী বক্তৃতার পর গণতন্ত্রকামীরা সহিংসতায় ফেটে পড়বে, তবে তারা ভুল ভেবেছে। মিসরীয় বিপ্লবের ভিত যারা গেড়েছে, সেই তরুণ-তরুণীরা বরং ধৈর্যশীল আচরণ করেছে। অনেক দেশেই এ ধরনের ঘটনার পর সরকারি ভবনগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। অথচ গত পরশু তাহরির চত্বরে তারা কবিতা পড়েছে। সে রকম অবস্থাতেই খবর আসে, খলনায়ক পালিয়েছে।
কিন্তু কবিতা দিয়েই বিপ্লব জয়ী হবে না। মিসরের ভবিষ্যৎ এখন শ খানেক সেনা কর্মকর্তার হাতে। তাঁরা মোবারকের প্রতি আনুগত্য ছেড়েছেন। শুক্রবার সকালে এক সামরিক বার্তায় ‘মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচনের’ দাবি করা হয়। পাশাপাশি জানানো হয়, মিসরীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলো ‘জনগণের দাবির প্রতি দায়বদ্ধ’ এবং তারা চায় ‘স্বাভাবিক জীবনে ফিরে’ যাক। সাধারণ মানুষের ভাষায় এর অনুবাদ হলো, বিপ্লবীরা ঘরে ফিরে যাক, সেই সুযোগে জেনারেলদের কায়েমি মহল নতুন সরকারের মন্ত্রীর পদগুলো ভাগাভাগি করে নিক। এ ধরনের ঘটনাকে ‘ক্যুদেতা’ বা প্রতিবিপ্লব বলা হয়।
মোবারকের পতনের পর কায়রোয় তাঁর প্রাসাদের সামনের কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে বসানো হয় বালুর বস্তা এবং তার পেছনে থাকে মেশিনগান। মোবারকের পতনের সংবাদ আসার আগেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সব সেনার কাছে জনগণের দেখভাল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। মিসরের তৃতীয় বাহিনীর এক লেফটেন্যান্টকে দেখলাম, বিক্ষোভকারীদের সহায়তা করছে। খুবই উচ্চশিক্ষিত এবং ইংরেজিতে তুখোড় এই তরুণ সেনা ভাবছেন, কায়রোর বিক্ষোভই হয়তো গণতন্ত্র অর্জনের সেরা পথ। তাঁকে শুধালাম, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘাত হলে আপনি কি গুলি করবেন? ‘আমাকে অনেকেই এই প্রশ্ন করেছে’ বলে তিনি জানালেন, ‘আমি তাদের বলেছি, নিজের বাবা-মা-পরিবারকে আমি গুলি করতে পারব না। তোমরা আমার বাবার মতো, ভাইয়ের মতো, তোমরা আমার পরিবার। আমার বন্ধুরাও আজ এখানে।’ কিন্তু যদি গুলি করার হুকুম আসে? তাঁর জবাব, ‘আমি নিশ্চিত এ রকম কিছু ঘটবে না। মিসরের অন্য সব বিপ্লবই ছিল রক্তাক্ত। এখানে আমি রক্তপাত চাই না।’
সেনা যুবকটি ভালোই ইতিহাস জানেন। ১৭৯৮ সালে কায়রোর মিসরীয়রা নেপোলিয়নের বাহিনীর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে তারা রাজতন্ত্রকে মোকাবিলা করে, ১৯১৯ ও ১৯৫২ সালে তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান করে। ১৯৭৭ সালে বিদ্রোহ করে আনোয়ার সাদাতের বিরুদ্ধে এবং ১৯৮৬ সালে মোবারকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সে সময় এমনকি পুলিশরাও সরকারকে ত্যাগ করেছিল। গত সপ্তাহে তাহরির চত্বরে চার সেনা চাকরি ছেড়ে জনতার সঙ্গে মিশে যান। একজন এই তাহরিরেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তলার অবস্থা এমন, কিন্তু ওপরে মোবারকের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপে শকুনের মতো কামড়াকামড়ি করছেন জেনারেলরা। তাঁরাও ভীত, বিপ্লব যদি তাঁদের সেনাদের ভেতরেও সংক্রমিত হয়!
ওমর সুলেইমান তাঁর প্রেসিডেন্টের মতোই বালসুলভ বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি বিক্ষোভকারীদের বাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন। এক বিক্ষোভকারীর ভাষায়, তিনি জনগণকে ভেড়ার পাল ভেবেছেন। তিনি বলেছেন রেডিও ও টেলিভিশন নাকি মানুষকে উসকিয়েছে, বিপ্লবের পেছনে নাকি ‘বিদেশিদের হাত’ রয়েছে ইত্যাদি। তিনি আরেক বৃদ্ধ, যিনি ভেবেছেন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপ্লবকে থামিয়ে দেবেন। বিপ্লব থামবে না, কিন্তু তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাধ ধূলিসাৎ হলো।
এভাবেই ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হঠাৎ সেনারা যুদ্ধ ছেড়ে সংগীতে ফেটে পড়েছিল। কিন্তু সেই শান্তি ডেকে এনেছিল আরও মানব বিপর্যয়। আজ যে মিসরীয়রা তিন সপ্তাহের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে, বিপ্লবকে সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে তাদের। ভেতরের ও বাইরের শত্রুরা বিপ্লবের ফল ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে। সত্যিকার গণতন্ত্র পেতে চাইলে রুখে দিতে হবে এদের। সেনাবাহিনী জনগণকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরবে কে?
১২ ফেব্রুয়ারি
ব্রিটেনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং আরব বিশেষজ্ঞ।
No comments