ফতোয়ার শিকার-হেনার কাছে দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা by কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা
কিছু ঘটনার দায় সবাইকে নিতে হয়। আমরা যারাই বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশকে ভালোবাসি, শরীয়তপুরের হেনা বেগমকে নিপীড়ন ও হত্যার দায় আমাদের সবার ওপরে আসে। সমাজকে আমরা কেমন হতে দিচ্ছি, এ দায় সবার আগে এবং সবার ওপরে প্রত্যেকের বিবেকের।
গত মাসের শেষ থেকে কাজে ইতালির উত্তরাঞ্চলের মিলান শহরে ছিলাম। পত্রিকা না দেখার অনীহাজনিত স্বভাবগত বিচ্যুতি ভালো অজুহাত পেয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে কাজে বেরোনোর মুখে হোটেলের রিসেপশনে অ্যালেক্স বলেন, তাঁদের একটি দৈনিকে বাংলাদেশে একটি মেয়ের শরিয়া আইনে বেত্রাঘাত ও মৃত্যুর খবর এসেছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে বাংলাদেশ শরিয়া আইনে চলা ইসলামি রাষ্ট্র নয়, তবে দেশের সমাজে ধর্মের নামে এমন অপরাধ ঘটার দুর্বিনীত অপ্রতিরোধ্যতা আছে।
সেদিন ভেবে রেখেছিলাম, কাজ থেকে ফিরে দেশের কাগজ দেখব, কিন্তু ফিরতে অনেক রাত হয়। পরদিন ভেনিসে বেড়াতে যাওয়ার গোছগাছে মন ভুলে যায়। নিজের কাজ এবং বেড়ানোর আত্মকেন্দ্রিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা অন্য সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। তারপর ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে ই-মেইল খুলতেই ফেসবুকে হেনার নাম সবার আগে এসে দাঁড়ায়।
হেনার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। মিলান শহরে ৮ ফেব্রুয়ারি শেষ রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে হোটেলের আরামদায়ক ঘরে বসে আমার নিজের ১৪ বছর বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। সেটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব-শঙ্কার বয়স, নানা বিভ্রান্তি হাতড়ে জীবনকে জানা ও বোঝার চেষ্টার বয়স। চারপাশে বড় যাঁরা, তাঁদের কাছ থেকে জীবনকে চেনার বয়স—এমন ভাবার অধিকার পাওয়ার বয়স যে ভয়ের কিছু নেই। সামনে যে জীবন অপেক্ষা করছে, তার ওপর বিশ্বাস আর আস্থা জন্মানোর বয়স। ভরসা পাওয়ার বয়স যে মানুষ হয়ে জন্মানো বিশেষ আনন্দ আর সৌভাগ্যের বিষয়।
জীবনকে ভালোবাসা সবাইকে জড়িয়ে হয়। গড়ে ওঠার বয়সে মন ভরসা চায় যে, সামনে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ হবে। অনেক অনেক প্রিয় মানুষ চারপাশে থাকবে, যাদের সঙ্গে সম্মিলিত স্রোতে নিজের যা দেওয়ার আছে দিয়ে আর পেয়ে জীবন পূর্ণ হয়ে সফল হবে।
হেনা সে সাহস পায়নি। তার স্বপ্ন—যা অমূল্য—নিষ্ঠুরভাবে মুচড়ে, ভেঙেচুরে গেছে। যখন সে প্রথম শুনল, আত্মীয়-পরিজন, চেনা-অচেনা অনেক মানুষের সামনে তাকে ১০০ ঘা বেত খেতে হবে, তার কেমন লেগেছিল ভাবতে গেলে মনটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে যায়। শারীরিক আঘাতের ভয়, নাকি জনসমক্ষে বেআবরু হয়ে একান্ততা আর সম্মান হারানোর ভয়—কোনটা তার ছোট্ট মনকে কীভাবে বিভ্রান্ত করেছিল, তা কেউ কোনো দিন আর জানবে না।
তার যৌন নির্যাতন যাঁর হাতে হয়েছিল, তিনি বয়স্ক মানুষ, হেনার নিকটাত্মীয়। তাঁর কাছে হেনা সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার ছিল। পরিবার, আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে যদি নিরাপদ বোধ করা না যায়, ১৪ বছরের শিশু তবে কার সহায়তা প্রত্যাশা করবে? তারপর তাকে মুখোমুখি হতে হলো প্রবল পরাক্রান্ত বৈরী এক সামাজিক কর্তৃপক্ষের। এমন কথা শুনতে হলো যে তার যৌন নিপীড়নের দায়দায়িত্ব তারই নিজের—সে চরম অপরাধের শিকার নয়, নিজেই অপরাধী! চারপাশের বড়রা কেউ তাকে রক্ষা করার ভরসা দিতে পারেনি। হেনা কি ভেবেছিল, মৃত্যু এর চেয়ে করুণাময় হবে?
ধর্ম যাঁরা মানেন, যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা তো বলেন, ঈশ্বর মানুষের পরম বান্ধব। হেনাকে সে বন্ধুর পরিচয় পেতে দেওয়া হয়নি। ঈশ্বরের স্বকল্পিত ঠিকাদারি নেওয়া ক্ষুদ্র কিছু মানুষ তাকে দেখিয়েছে যে ধর্ম ন্যায়বিচার নয়, সংকীর্ণ স্বার্থ ও অবিচারের হাতকে শক্তিশালী করে। হেনা যে এই চরম ভুল ধারণা নিয়ে চলে গেল, তার দায় প্রত্যেক ধর্মভীরু ও মানবদরদি মানুষের ওপর বর্তায়।
হেনার পরিবার রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার চায়। হেনা একাধিক চরম অপরাধের শিকার। এর কোনোটিই প্রিয় বাংলাদেশে অপ্রতুল নয়। একই সময়ে অন্যান্য এলাকায় একই রকম ফতোয়া ও শাস্তির কথা কাগজে আসছে। শিশু-কিশোরীর যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা এত বেশি যে বিশেষ কোনো সময়ের ঢেউ না এলে তা খবর ও মনোযোগের সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যায়। আর পুলিশ-প্রশাসনের বিচ্যুতি-গাফিলতিকে নতুন বা ব্যতিক্রমী কিছু ভাবার কোনো সুযোগই নেই।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখন হেনার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। আইনের কণ্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে। এই ক্ষোভ ও সজাগ হওয়া যেমন হেনার জন্য, তেমনি নিজের জন্যও। ভবিষ্যতে নিজের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পরিসরের জন্য।
ছোট্ট সেই মেয়েটি আমাদের দায়দায়িত্ব আর ভালোবাসার স্পর্শের বাইরে চলে গেছে। তার কাছে শুধুই ক্ষমা চাইতে পারি। আর মানুষের এই সম্মিলিত শক্তি সজাগ পাহারায় জেগে থাকুক, যেন আরেকজনের জন্য এবং নিজের জন্য অদূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন আবার এমন অক্ষমতার অনুভূতি না হয়। এই দায় এবং দায়িত্ব প্রত্যেকের। সার্বক্ষণিক।
কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনা: সাংবাদিক।
সেদিন ভেবে রেখেছিলাম, কাজ থেকে ফিরে দেশের কাগজ দেখব, কিন্তু ফিরতে অনেক রাত হয়। পরদিন ভেনিসে বেড়াতে যাওয়ার গোছগাছে মন ভুলে যায়। নিজের কাজ এবং বেড়ানোর আত্মকেন্দ্রিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা অন্য সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। তারপর ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে ই-মেইল খুলতেই ফেসবুকে হেনার নাম সবার আগে এসে দাঁড়ায়।
হেনার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। মিলান শহরে ৮ ফেব্রুয়ারি শেষ রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে হোটেলের আরামদায়ক ঘরে বসে আমার নিজের ১৪ বছর বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। সেটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব-শঙ্কার বয়স, নানা বিভ্রান্তি হাতড়ে জীবনকে জানা ও বোঝার চেষ্টার বয়স। চারপাশে বড় যাঁরা, তাঁদের কাছ থেকে জীবনকে চেনার বয়স—এমন ভাবার অধিকার পাওয়ার বয়স যে ভয়ের কিছু নেই। সামনে যে জীবন অপেক্ষা করছে, তার ওপর বিশ্বাস আর আস্থা জন্মানোর বয়স। ভরসা পাওয়ার বয়স যে মানুষ হয়ে জন্মানো বিশেষ আনন্দ আর সৌভাগ্যের বিষয়।
জীবনকে ভালোবাসা সবাইকে জড়িয়ে হয়। গড়ে ওঠার বয়সে মন ভরসা চায় যে, সামনে নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ হবে। অনেক অনেক প্রিয় মানুষ চারপাশে থাকবে, যাদের সঙ্গে সম্মিলিত স্রোতে নিজের যা দেওয়ার আছে দিয়ে আর পেয়ে জীবন পূর্ণ হয়ে সফল হবে।
হেনা সে সাহস পায়নি। তার স্বপ্ন—যা অমূল্য—নিষ্ঠুরভাবে মুচড়ে, ভেঙেচুরে গেছে। যখন সে প্রথম শুনল, আত্মীয়-পরিজন, চেনা-অচেনা অনেক মানুষের সামনে তাকে ১০০ ঘা বেত খেতে হবে, তার কেমন লেগেছিল ভাবতে গেলে মনটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে যায়। শারীরিক আঘাতের ভয়, নাকি জনসমক্ষে বেআবরু হয়ে একান্ততা আর সম্মান হারানোর ভয়—কোনটা তার ছোট্ট মনকে কীভাবে বিভ্রান্ত করেছিল, তা কেউ কোনো দিন আর জানবে না।
তার যৌন নির্যাতন যাঁর হাতে হয়েছিল, তিনি বয়স্ক মানুষ, হেনার নিকটাত্মীয়। তাঁর কাছে হেনা সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার ছিল। পরিবার, আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে যদি নিরাপদ বোধ করা না যায়, ১৪ বছরের শিশু তবে কার সহায়তা প্রত্যাশা করবে? তারপর তাকে মুখোমুখি হতে হলো প্রবল পরাক্রান্ত বৈরী এক সামাজিক কর্তৃপক্ষের। এমন কথা শুনতে হলো যে তার যৌন নিপীড়নের দায়দায়িত্ব তারই নিজের—সে চরম অপরাধের শিকার নয়, নিজেই অপরাধী! চারপাশের বড়রা কেউ তাকে রক্ষা করার ভরসা দিতে পারেনি। হেনা কি ভেবেছিল, মৃত্যু এর চেয়ে করুণাময় হবে?
ধর্ম যাঁরা মানেন, যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা তো বলেন, ঈশ্বর মানুষের পরম বান্ধব। হেনাকে সে বন্ধুর পরিচয় পেতে দেওয়া হয়নি। ঈশ্বরের স্বকল্পিত ঠিকাদারি নেওয়া ক্ষুদ্র কিছু মানুষ তাকে দেখিয়েছে যে ধর্ম ন্যায়বিচার নয়, সংকীর্ণ স্বার্থ ও অবিচারের হাতকে শক্তিশালী করে। হেনা যে এই চরম ভুল ধারণা নিয়ে চলে গেল, তার দায় প্রত্যেক ধর্মভীরু ও মানবদরদি মানুষের ওপর বর্তায়।
হেনার পরিবার রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার চায়। হেনা একাধিক চরম অপরাধের শিকার। এর কোনোটিই প্রিয় বাংলাদেশে অপ্রতুল নয়। একই সময়ে অন্যান্য এলাকায় একই রকম ফতোয়া ও শাস্তির কথা কাগজে আসছে। শিশু-কিশোরীর যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা এত বেশি যে বিশেষ কোনো সময়ের ঢেউ না এলে তা খবর ও মনোযোগের সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যায়। আর পুলিশ-প্রশাসনের বিচ্যুতি-গাফিলতিকে নতুন বা ব্যতিক্রমী কিছু ভাবার কোনো সুযোগই নেই।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখন হেনার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। আইনের কণ্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে। এই ক্ষোভ ও সজাগ হওয়া যেমন হেনার জন্য, তেমনি নিজের জন্যও। ভবিষ্যতে নিজের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পরিসরের জন্য।
ছোট্ট সেই মেয়েটি আমাদের দায়দায়িত্ব আর ভালোবাসার স্পর্শের বাইরে চলে গেছে। তার কাছে শুধুই ক্ষমা চাইতে পারি। আর মানুষের এই সম্মিলিত শক্তি সজাগ পাহারায় জেগে থাকুক, যেন আরেকজনের জন্য এবং নিজের জন্য অদূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন আবার এমন অক্ষমতার অনুভূতি না হয়। এই দায় এবং দায়িত্ব প্রত্যেকের। সার্বক্ষণিক।
কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনা: সাংবাদিক।
No comments