এ তামাশার শেষ কোথায় by লুৎফর রহমান রনো

আইন সবার জন্য সমান। নাগরিকের কাছে এই সাংবিধানিক বাণীটি সুনিশ্চিত হলে তবেই সুশাসন বলা যাবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা যখন আসীন হন, তখন তাঁরা বলেন সুশাসনের কথা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা, দারিদ্র্য বিমোচনের কথা এবং এমন অজস্র আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাও শোনান।


যদিও ওসব কথার এতটুকুও বাস্তবায়ন হয় না। তবুও জনসাধারণ এ বিষয়টা ভেবে দেখে, কোন দল বা গোষ্ঠীর কী রকম সদিচ্ছা প্রকাশ পায়। আইন সবার জন্য সমান_এ কথার কিছুটাও যদি প্রতিষ্ঠিত হতো, তবে দেশের অনেকটা বদলে যেত; বিশেষ করে গরিব মানুষের মুখে দানাপানির নিশ্চয়তা হয়ে যেত। কারণ, গরিবের দানাপানির যে অধিকার বা যেটুকু প্রাপ্য, সেটুকু ধনীদের বাড়তি বিলাসিতায় ব্যয় হয়ে যায়। বেহিসাবি ভোগ-বিলাস বলি কিংবা প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন সঞ্চয়ে গিয়ে গরিবের রক্তই জমা হয়।
ইটখোলার শ্রমিক ও কলেজছাত্র লিমনের পায়ে যে গুলি ছুড়েছে র‌্যাব সদস্য, সে গুলিটি কিনে আনতে গরিবের ঘামের টাকাই ব্যয় করছে সরকার। কিন্তু ধনীর টাকা ব্যয় করা তো দূরে থাক, তাকে আরো ধনী, আরো সম্পদশালী, আরো দুই-চারটা ব্যাংকের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার বা রাষ্ট্রের একচোখা আইন। লিমন সন্ত্রাসী নয়_এ কথা তার গ্রামবাসী, পরে দেশবাসীও বলছে। কিন্তু র‌্যাব তাকে চিহ্নিত করল সন্ত্রাসী বলে। র‌্যাব সদস্যরা সন্ত্রাস-দুর্নীতি-জঙ্গি দূর করে মানবতা প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছে উন্নত বিশ্বের উন্নত পুলিশের দেশ হিসেবে খ্যাত যুক্তরাজ্য থেকে। এ কি প্রশিক্ষণের পরিণাম? চোর চোর নয়, ডাকাত অপরাধী নয়, ধনী-দস্যু হলেও ধরা পড়ে না। জনগণের টাকায় কেনা হয় গুলি-বন্দুক। দেশের নিরাপত্তা ও দশের (সব নাগরিক) জানমাল রক্ষার্থে তা ব্যবহার হবে। কিন্তু কেউ কখনো শুনেছে কি লিমনের মতো ছেলে কারো জানমালের জন্য হুমকি; বরং ছেলেটির জন্য হুমকি খোদ র‌্যাব বাহিনী। শেয়ারবাজারে ৩০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সব লুট করে নিয়ে গেল চিহ্নিত রাঘব বোয়ালরা। অথচ এটাকে লুটপাট ইত্যাদি না বলে বলা হচ্ছে 'কারসাজি', 'কেলেঙ্কারি'! কেন? প্রতারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করাকে যদি দস্যুতা বা লুটপাট বলা না হয়, তবে কি ছিনতাইকারী একটি মোবাইল ফোনসেট বা ঘড়ি অথবা হাজার দুয়েক টাকা কেড়ে নিলে সেটি ছিনতাই বা ডাকাতি হবে? আর সেইবা বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের ছোড়া গুলিতে পঙ্গু হবে কেন? বাহ্! বাহ্! আমাদের সুশাসন আর মানবাধিকারের কী নাক্ষত্রিক নজির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে!
এসব কথা অন্যভাবে আমরা আগেও লিখেছি। প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থায় সরকার বা রাষ্ট্রক্ষমতা শুধু ধনীদের জানমালের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত হয়। গরিবের সঙ্গে কেবলই প্রতারণা আর মিথ্যাচার। ওরা গণতন্ত্রের গিনিপিগ। এরা ভোটার, জনতা, গণমানুষ। এরা সভা-মিছিলের শক্তি ও শোভাবর্ধনকারী পোষ্য জীববিশেষ। মানুষ মনে করলে নিশ্চয়ই মানবতা প্রতিষ্ঠিত হতো এবং নিরীহ লিমনকে পঙ্গু করেও দর্পভরে হাঁটতে পারত না অপরাধী। দীর্ঘদিন ধরে (বিচারবহির্ভূত কথাটা অবান্তর) র‌্যাবের খুন-খারাবি, গুম, পঙ্গু করা ইত্যাদি অত্যাচার চলছে, কিন্তু ভুল করে একবারও তারা কোনো শিল্পপতি বা মন্ত্রী, সংসদ সদস্যের ভাই-ছেলে-ভাতিজাকে গুলি করেনি। ভুল করে পশুর মতো গুলি করে মেরে ফেলে যায় গ্রাম বা বস্তির ছেলেদের। ভুল কি শুধু গরিবের আঙিনায়ই ঘটে? অর্থাৎ অপরাধী-সন্ত্রাসীরা বাস করে দরিদ্র পল্লীতে, তাই না? তাহলে সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, আরেকটি বাহিনী গঠন করে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হোক। যাদের কাজ হবে কেবল ধনীপল্লীর চোর, ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের ধরা। তবেই না হবে আইনের চোখে সবাই সমান। তবেই না দুর্নীতি রোধ হবে। আর জাপানের সাহায্য নিয়ে যে পদ্মা সেতু তৈরির স্বপ্ন আমরা দেখছি। এমন একটি করে সেতু প্রতিবছর আমরা তৈরি করতে পারব যদি ধনীদের বা ক্ষমতাসীনদের লুটপাট, দুর্নীতি রোধ করা যায়।
আহা! দেশবাসী কত যে নিরীহ আর আত্মভোলা। রাষ্ট্রের ফাঁকিটুকু বুঝেও তারা নিশ্চুপ থাকে। আবার প্রতারণার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে দিন গুনতে থাকে দিন বদলাবে সে আশায়। অথচ জনগণ জানে না, কস্মিনকালেও তাদের দিন বদলাবে না। প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে সুশাসন আর মানবতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। গরিবের দিন ঘুরবে না। আইলায় ভাঙা বেড়িবাঁধ শক্তভাবে তৈরি হবে না। লবণাক্ত পানিতে ফসলি জমি নষ্ট হবে, রোধ করা যাবে না। এসব হতেই থাকবে। আর অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলা। আঙুলের চুটকিতেই হাজার কোটি টাকা জমা হয়ে যাচ্ছে ভাণ্ডারে। এ যেন তামাশাভরা এক দেশ ও সমাজব্যবস্থা। জয়, ধনী, দুর্বৃত্তদের জয়।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.