চরাচর-চড়ক উৎসব by ফখরে আলম

সন্ন্যাসীকে উদোম শরীরে মাটিতে শুইয়ে তাঁর পিঠে ফোটানো হলো লোহার মোটা বড়শি। এরপর তাঁকে গামছা আর দড়ির সাহায্য ঝোলানো হলো চড়কগাছে। সন্ন্যাসী শূন্যে ঘুরতে থাকলেন। এই হচ্ছে চড়ক পূজা। শত শত বছর ধরে চৈত্রসংক্রান্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।


এমন চড়ক পূজা নিষিদ্ধ হলেও হিন্দু সম্প্র্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষ আজও চড়ক পূজায় প্রার্থনায় মত্ত হয়। ১৮৬৫ সালে আইন করে নৃশংস এই বড়শিবিদ্ধ চড়ক পূজা নিষিদ্ধ করা হয়। চড়ক একটি ব্রত। চৈত্র মাসের শেষ দিন শিবভক্ত বানরাজা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে নাচগানে আত্মহারা হয়ে শরীরের রক্ত বের করে তাঁর ছেলের উদ্দেশে নিবেদন করেন। বানরাজার রক্ত উপহার পেয়ে শিব খুশি হয়েছিলেন। এ কাহিনী অনেক আগের। এরপর থেকে শৈব সম্প্র্রদায়ের ভক্তরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন শিবকে পাওয়ার জন্য চড়ক উৎসবে আত্মহারা হয়। চড়ক পূজা ঘিরে আয়োজন করা হয় শিবের গীত, বাজনা ও হরগৌরী নৃত্য। বরিশালের জুসখোলা, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর, পাবনার পূর্ণানন্দ যোগাশ্রম, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, ঝিনাইদহের মহেশপুরে চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। একটি লাইটপোস্টের মতো কাঠই হচ্ছে চড়কগাছ। এই গাছটি পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির দিন ঢাকঢোল বাজিয়ে শিবের গান গেয়ে পানির ভেতর থেকে তুলে আনা হয় চড়কগাছ। এরপর চড়কগাছ মাটিতে পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি ও কাঠ বাঁধা হয়। এরপর সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শি ফুটিয়ে চড়কগাছে ঝুলিয়ে পাক ঘোরানো হয়। ঝিনাইদহের ফতেপুর গ্রামে চড়ক পূজা উপলক্ষে চড়কমেলা বসে। এখানকার চড়ক উৎসবের ২০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। অতীতে কলকাতা আদালতের জজ অমূল্য কুমার চট্টোপাধ্যায়, ইঞ্জিনিয়ার নগেন্দ্রনাথ মুখার্জি, ফটিক মুখার্জি, দাশু মুখার্জি চড়ক উৎসবের মূল আয়োজক ছিলেন। বর্তমানে এলাকার অবস্থাসম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায় চড়ক পূজার আয়োজন করে। সন্ন্যাসী অবনিশ কালা, নিতাই মিস্ত্রি, দোলে মিস্ত্রি, মেগা সন্ন্যাসী_এঁরাই দীর্ঘদিন চড়কে পাক খেয়েছেন। এখন নতুন প্রজন্মের সন্ন্যাসীরা চড়কে উঠে শিবকে খুঁজে পান। চৈত্রসংক্রান্তির দিন ফতেপুরের ঐতিহাসিক চড়ক পূজায় হাজার হাজার মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে। জেগে ওঠে ফতেপুরসহ আশপাশের ১০ গ্রাম। জেগে ওঠে ভক্তরা। জেগে ওঠে বাংলার অতীত ঐতিহ্য।
ফখরে আলম

No comments

Powered by Blogger.