স্মরণ-বেলাল হোসেনের জন্য শোকগাথা by শহিদুল ইসলাম রিপন

রাষ্ট্র-রাজনীতি এই দুর্ঘটনার-মৃত্যুর, এই দুস্থ পরিবারটির দায় নেবে না। সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর কোনো তৎপরতাও চোখে পড়ে না। তাহলে কি বহ্নি আর বেলালের পরিবারের জন্য কিছুই করার নেই? ১৬ জুলাই ২০১১। শনিবার। বিকেল ৪টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পড়ে আছে চারটি মৃতদেহ।


প্রথমটি কোনো বাসার দোতলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত গৃহপরিচারিকার। দ্বিতীয়টি সেনপাড়ায় বাসের চাকায় পিষ্ট গার্মেন্টকর্মীর। তৃতীয়টি পান্থপথে হাসপাতালে অসুস্থ মাকে দেখে ফেরার সময় নির্মাণাধীন ভবন থেকে পতিত ইটের আঘাতে নিহত কলেজছাত্রের। চতুর্থটি আগারগাঁওয়ে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় মরে যাওয়া 'সময়' টেলিভিশনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক বেলাল হোসেনের। রাজধানীর আর দশটা সড়ক দুর্ঘটনার মতো বেলালেরটিও প্রায় একই কাহিনী। একইভাবে, একই রকম ধ্বনিতে আকাশ-মাটি বিদীর্ণ করে হাহাকার করেছে তার স্বজনরাও।
উচ্চশিক্ষা আর একটু বেশি রোজগার, একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় উত্তর বাংলার মঙ্গাপীড়িত নদীবিধৌত পলিমাটি, সবুজ-শ্যামল ছবির মতো গ্রাম আর সততা ও সারল্যের ভুবন থেকে, নাড়িছেঁড়া শিশুর মতো, হেঁচকা টানে বিচ্ছিন্ন করে, নিয়তি বেলালকেও নিয়ে এসেছিল ইট-পাথরের অমানবিক নির্দয় এই শহরে। চাটুকারিতার বাঁকা পথে নয়, বরং সততা, একাগ্রতা আর নিষ্ঠার শক্তিতে নিষিক্ত হয়ে। তিনি ছিলেন বিনম্র, লাজুক। আমিত্ব বা অহম জাহির করার দোষমুক্ত। তার কোনো সহকর্মী_ তা সে যতই মিথ্যুক আর নিন্দুকই হোক না কেন_ বেলালের সঙ্গে ঝগড়া বা মনকষাকষির একটি ঘটনারও প্রমাণ দিতে পারবে না। বন্ধুরা মজা করেও তাকে রাগাতে পারত না কখনোই।
প্রায় একই ধরনের পটভূমিতে, অভিন্ন জীবনাভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের কারণে কিছু সময় আমরা কাছাকাছি এসেছিলাম। তখন না বলেও অনেক কিছু বলা হতো, হৃদয়ের কান পেতে শোনা হতো আরও বেশি। এই নৈকট্যবোধই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে আমাকে লিখতে বসিয়েছে।
যে মানুষটি এতদিন দুর্ঘটনার খবর টেলিভিশন-কাগজের শ্রোতা-পাঠককে জানিয়েছে, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, আজ সে নিজেই খবর! বেপরোয়া মিনিবাসটি ধাক্কা দেওয়ার পর তিনি যখন রাস্তায় পড়ে ছটফটাচ্ছেন, তখন বাসযাত্রী-পথচারীরা যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে দুর্ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে সটকে পড়ছিল। সেই পাথর সময়ে এগিয়ে এলো সবুজ নামের এক যুবক। আহতদের নিয়ে প্রথমে গেলেন পাশের প্রবীণ হিতৈষী হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা অপারগতা জানালে ওই হাসপাতালেরই অ্যাম্বুলেন্সে করে সোহরাওয়ার্দীতে নেওয়া হলো বেলালকে। ইমার্জেন্সির ডাক্তাররা এমন একটা ভাব করলেন_ যেন পড়ে গিয়ে সামান্য আঁচড় লেগেছে, সিরিয়াস কিছু নয়। ইনজেকশন আর স্যালাইন ফুঁড়ে তাকে ফেলে রাখা হলো এক পাশে। খানিক বাদে আবার তারাই বলল_ সিরিয়াস এই পেশেন্ট এখানে কেন, আমাদের কিচ্ছু করার নেই, এক্ষুণি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
বেচারা সবুজ অগত্যা অ্যাম্বুলেন্সে বেলালকে উঠিয়ে রওনা দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যেতে যেতে বেলালের পকেট থেকে পাওয়া ভিজিটিং কার্ড দেখে ফোন দিলেন মুজতবা দনিশ, রাশেদা শিমুলসহ ক'জন সহকর্মীকে। এভাবেই সাংবাদিকরা খবর পেলেন। জড়ো হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নিউমার্কেটের কাছাকাছি গিয়ে শেষবারের মতো কথা বলেছিলেন বেলাল_ আমার বুকে খুব পেইন হচ্ছে, একটু তাড়াতাড়ি করুন। কিন্তু যানজটের এই শহরে কোনো কিছুই তাড়াতাড়ি করার উপায় নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা বলেছিলেন, পেশেন্ট আর নেই। নিজের তৎপরতাকে ব্যর্থ হতে দেখে আফসোস করছিলেন সবুজ। এত দৌড়াদৌড়ি করলাম... সোহরাওয়ার্দীর ডাক্তাররা যদি ওরকম না করত, যদি এক ঘণ্টা আগে আনা যেত... হয়তো বাঁচানো যেত। ব্যর্থতার গল্গানি নিয়ে ভীরু-পলায়নপর মানুষে ভরা এই শহরের রাস্তায় হাঁটা শুরু করলেন সাহসী, স্বেচ্ছাসেবী সবুজ।
দুর্ঘটনার সময় বেলালের সঙ্গে ছিল প্রায় দুই বছর বয়সী কন্যা বহ্নি। ছিল শ্যালক-শ্যালিকা। তারা খানিকটা আহত হলেও প্রায় অক্ষত রয়েছে শিশু বহ্নি। হাসপাতাল চত্বরে বেলালের সহকর্মীদের কোল থেকে কোলে ঘুরেছে সে। এতটুকু কাঁদেনি। বড় হয়ে দুঃসহ এই দিনের গল্প শুনবে বহ্নি। তবে কোনো স্মৃতিই_ না তার বাবার, না দুর্ঘটনার_ থাকবে না তার। বেলালের মৃত্যু আর বহ্নির বেঁচে থাকা দেখে দু'একজন কৌতূহলী মানুষ বলছিল_ সৃষ্টিকর্তার কী লীলাখেলা! কী অলৌকিক কাণ্ড! আমি এর মধ্যে অলৌকিকত্ব দেখিনি। সন্তানের পিতা হিসেবে সত্তার গভীরে অনুভব করেছি জীবনের বিনিময়ে হলেও আত্মজাকে, প্রিয়জনকে বাঁচানোর চিরন্তন আকুতিকে। দুর্ঘটনাটা চোখে দেখিনি, তবে আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছিলাম_ যতক্ষণ চিন্তা ও শক্তি কাজ করেছে, বেলাল বহ্নিকে বাঁচানোর কথা ভেবেছে। নিজের কথা একবারও মনে পড়েনি বলেই বহ্নিদের নিরাপদে রেখে একটি বেপরোয়া বাসের সমূহ ধাক্কা একাই বুক পেতে নিয়েছে। জানাজা শেষে, রাতে ঘরে ফিরে নিজের সন্তানের দিকে তাকাতে, আদর করতে কুণ্ঠা ও অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। মনে হচ্ছিল, বহ্নির জন্য যদি আজ কিছু না করি তো এমনই আরেকটি দুর্ঘটনায় আমি মারা গেলে কী হবে আমার মেয়েটির!
দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয় আর সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয় তার পরিবারটি। রাষ্ট্র-রাজনীতি এই দুর্ঘটনার-মৃত্যুর, এই দুস্থ পরিবারটির দায় নেবে না। সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর কোনো তৎপরতাও চোখে পড়ে না। তাহলে কি বহ্নি আর বেলালের পরিবারের জন্য কিছুই করার নেই? নিশ্চয় রয়েছে। আমরা, তার সহকর্মীরা, সৎ উপার্জনের কিছু অংশ একত্র করে পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারি। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই, দুর্ঘটনায় মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নিহত সাংবাদিক বেলালের পরিবারটির অর্থনৈতিক দুর্দশার কিছুটা দায়ভার আমাদেরও।

শহিদুল ইসলাম রিপন : সাংবাদিক
shahidulislamripon@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.