সরল গরল-প্রধান বিচারপতির প্রতি ১০ বিচারপতির অনাস্থা! by মিজানুর রহমান খান
মন্ত্রিসভার রদবদলের মতো আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগও চমকপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যা অনেকের কল্পনার বাইরে, তা-ই এবার ঘটছে। প্রধান বিচারপতি হতে রাতের অন্ধকারে মন্ত্রীপাড়ায় তদবিরের কথা আমরা জানি। জোট সরকারের আমলে মন্ত্রীর বাড়িতে কর্মরত বিচারকদের পার্টির কথাও অজানা নয়।
এমনকি সেখানকার অভাবনীয় ঘটনাবলিকে কোনো একটি রায়ে মূর্ত করার চিন্তাও শুনেছিলাম। কিন্তু এবারের পদস্খলন কিংবা পচন প্রকাশ্যে এসেছে। আপিল বিভাগের আইন অমান্য করে কয়েকজন বিচারক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধাচরণ করছেন। তাঁরা যদি কোনো লিখিত নীতিমালা প্রণয়ন ও তাঁর আওতায় প্রতিকারপ্রার্থী হতেন, তাহলে আমরা বাধিত হতাম।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে নাকচ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের জ্যেষ্ঠতার দাবি। সেটা মেনেই তাঁরা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের মতো আচরণ করছেন। প্রকাশ্যে তদবির ও ধরাধরির মাধ্যমে তাঁরা প্রধান বিচারপতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। অথচ জোট সরকারের আমলে বাদ পড়া সুপ্রিম কোর্টের এই ১০ জন বিচারকের জন্য আমরা অশ্রুপাত করেছিলাম। কারণ, বিএনপি আমলে তাঁরা যখন হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক ছিলেন, তখন তাঁদের স্থায়ীকরণে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি তা অগ্রাহ্য করে।
তারপর নয় মণ ঘি পুড়ল। রাধাও নাচল। বেশ কয়েক বছর ধরে ওই ঘটনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানি চলল। হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ; আবার হাইকোর্ট, আবার আপিল বিভাগ। এ রকম কয়েক রাউন্ড চলল। সুপ্রিম কোর্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে একটা দোস্তি অবশ্য বজায় রাখলেন। তাঁরা গোপনীয়তা বজায় রাখলেন। প্রধান বিচারপতি আদৌ সুপারিশ দিয়েছিলেন কি না, দিয়ে থাকলেও কী কারণ দেখিয়ে তিনি সে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, তা জনগণকে জানতে দেওয়া হলো না। তবুও আমরা নতুন রায়কে স্বাগত জানালাম। কারণ, আমরা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে প্রধান বিচারপতির ওপর ভরসা রাখাকে শ্রেয়তর মনে করেছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের সংবিধানসম্মত অপার ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে মুঠো আলগা করতে অনাগ্রহী থাকবেন। তাই আমরা সেদিনের বাদ পড়া ১০ বিচারকের পক্ষে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরিণতি যে এমন ভয়ংকর হবে, তা আমরা ভাবতে পারিনি। ১০ বিচারকের অনেকে আমাদের শ্রদ্ধেয়। কিন্তু তাঁরা জ্যেষ্ঠতার প্রশ্নে এতটাই উতলা হবেন, যাতে কিনা তাঁরা বিচারিক ঐতিহ্য, আপিল বিভাগের আইন অমান্য করার মতো জায়গায় নিজেদের নামাবেন, তা আমরা কল্পনা করতে পারিনি।
কী উপায়ে তাঁরা চাকরি ফিরে পেলেন, তা চকিতে রোমন্থন করে দেখতে পারি। অতিরিক্ত ১০ বিচারক আশা করেছিলেন, তাঁদের চাকরি ফিরে পেলেই চলবে না। জ্যেষ্ঠতাও চাই। তাঁদের এই প্রত্যাশা অবশ্যই বৈধ ও যৌক্তিক মনে করেছি। তাই আমরা যখন জানলাম, হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ তাঁদের জ্যেষ্ঠতা দিয়েছেন, তাতে অবাক হইনি। ওই ১০ বিচারক চাকরি হারানোর পর জোট সরকার ইতিহাসের অমার্জনীয় দলীয়করণ করেছিল। এমনকি ৩৫-৩৬ বছর বয়সী তরুণকেও তারা বিচারক নিয়োগ করে। ফলে জ্যেষ্ঠতার নীতির যে ঐতিহ্য, তাতে আসলে পেরেক ঠোকা হয়। এমনিতেই অনেক অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ ও যোগ্যতাসম্পন্ন আইনজীবী বহুকাল আগেই বেঞ্চ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। ধরাধরি করে তাঁরা বিচারক হতে চান না। জোট সরকার জ্যেষ্ঠতার মাপকাঠি অনেকটাই বিপন্ন করে। কিন্তু আমরা আইনগত ও সাংবিধানিক দিকটি দেখব। কারণ, সবাই আপিল বিভাগ মানবেন, না মানলে শাস্তি দেবেন আর সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা সুপ্রিম কোর্টের আইন মানবেন না, তা কেউ আশা করবেন না।
১০ জন অতিরিক্ত বিচারক যখন হাইকোর্টের রায়ে জ্যেষ্ঠতা পেলেন, তখন মুখ্যত এর প্রতিবাদ করলেন জোট আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারকেরা। তাঁরা আমাদের গভীর লজ্জায় ফেললেন। কারণ, তাঁরা এই নিয়োগ ঠেকাতে বলে বসলেন যে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ লাগবে, এমন কথা সংবিধানে নেই। প্রায় ২৮ জন বিচারক হলফনামা দিয়ে হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলেন। তাঁদের একটি যুক্তি অবশ্য সংবিধান সমর্থন করল। সেটা হলো জ্যেষ্ঠতার প্রশ্ন। আপিল বিভাগ তাই যথার্থই তাঁদের জ্যেষ্ঠতা নাকচ করেন। তাঁরা নতুন নিয়োগপত্র পান। এতে তাঁদের আগের নিয়োগের ধারাবাহিকতা সব অর্থে মুছে যায়।
আমাদের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ মানে অনধিক ১১ নয়। সব পরিস্থিতিতে ১১ জন থাকবেন। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগে রহস্যজনক বিলম্ব ঘটছে। গত দুই বছরে অবসরে যেতে যেতে আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা ৪-এ নেমেছে। বিচারকাজে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। এরপর আমাদের কানে নানা খবর ভেসে এল। কাকে রেখে কাকে আনা হবে, সেই হিসাব-নিকাশ চলছে। এর প্রতিটির কারণ বিচারবহির্ভূত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিংবা সুপ্রিম কোর্টের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। আছে দলবাজির কুটুম্বিতা। ফলে সুপ্রিম কোর্টের সার্বভৌমত্ব বেআব্রু হয়ে পড়ছে।
আগামী ১৮ মে প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন। সুতরাং এরপর কে প্রধান বিচারপতি হবেন, তা নিয়েই হয়তো চলছে ধুন্দুমার হিসাব। বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান থেকেও নেই। বিচারপতি এম এ মতিন ও তাঁকে ডিঙিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর অতিক্রান্ত দুজন ছুটিতে যান। বিচারপতি এম এ মতিন অবসরে গেছেন। এখন আছেন বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান। তাঁর অবসরের তারিখ নভেম্বরে। তিনি বিচারকাজে অংশ নেন না। তাঁর বেদনা বোধগম্য। কিন্তু তাঁর বর্তমান অবস্থান সম্ভবত গ্রহণযোগ্য হওয়ার নয়। প্রতিবাদের এই ভাষা আদর্শস্থানীয় নয়। এই প্রেক্ষাপটে আমরা শুনি যে আপিল বিভাগে আরোহণে ধুমসে তদবির চলছে। কে কাকে রেখে ওপরে উঠবেন, তারই দৌড়।
যদি বিচারপতি নঈমকে প্রধান বিচারপতি করা হয়, তাহলে সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কম। তাঁর পরের দুজন বিচারপতি এম এম হোসেন ও এস কে সিনহা। তাঁদের যাঁকেই প্রধান বিচারপতি করা হোক, তাঁরা আগামী নির্বাচনের আগে কেউ অবসরে যাচ্ছেন না। তাঁরা অবসরে যাবেন যথাক্রমে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে। বিচারপতি এস কে সিনহার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেন, তাঁকে করলে দুটো লাভ। বিএনপি আগামী মেয়াদে সরকারে এলেও তারা কোনো প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুযোগ পাবে না। বিপরীত যুক্তি হচ্ছে, তিনি সংখ্যালঘু। তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলে তা আওয়ামী লীগের জন্য ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। তা ছাড়া তাঁকে প্রধান বিচারপতি করতে হলে বিচারপতি এম এম হোসেনকে ডিঙাতে হবে।
খুবই খুশি হতাম, যদি একজন সংখ্যালঘুকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমরা পেতাম। পাকিস্তানে ২০০৭ সালের সংকটকালে ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ‘অকার্যকর’ ঘোষিত হন। তখন বিচারপতি রানা ভগবানদাস প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পান। কর্নেলিয়াস ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
তাই হিসাবটা এ রকম শুনছিলাম। যদি ওই ১০ জনের মধ্য থেকে আপিল বিভাগে চলতি সাতটি শূন্যপদ পূরণ করা হয়, তাহলে তাঁদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতিও করা যায়। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বিরোধী দল ‘না’ করেছে। তাই বিকল্প খোঁজা হচ্ছে আর কার ব্যাপারে বিএনপি নমনীয় হতে পারে।
আওয়ামী লীগের একদল আইনজীবী প্রধানমন্ত্রীর জন্য ১২ পৃষ্ঠার একটি বিবেচনাপত্র তৈরি করেছেন। সন্দেহাতীতভাবে এটা একান্তভাবে দলীয়। এর যুক্তি: আপিল বিভাগ গঠনে দূরদর্শী দলীয় পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এর একটি হলো, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান উপদেষ্টা পদে দলীয় ঘরানায় তিনটি বিকল্প তৈরি করা। সুপ্রিম কোর্ট সার্বভৌম কি না, তাঁর জবাবদিহি বিতর্ক, তাঁর স্বাধীনতা, তাঁর নিরপেক্ষতা—এসব দেখে-শুনে এখন আরও পানসে মনে হয়।
ওই বিবেচনাপত্রে বলা হয়েছে: ‘শতভাগ আওয়ামী লীগের সমর্থক মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি মো. শামসুল হুদা মানিককে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া যায়। বিচারপতি এম এম হোসেনকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রথমে বিচারপতি মমতাজ এবং পরে বিচারপতি মানিককে প্রধান বিচারপতি করা হলেও বিচারপতি এম এম হোসেনকেও প্রধান বিচারপতি করা যেতে পারে। বিরোধী দল একজনের বিষয়ে আপত্তি দিলে অন্যজন হবেন। এভাবে প্রধান উপদেষ্টার জন্য তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি থাকবেন।’ ওই ১০ জন বিদ্যমান জ্যেষ্ঠতার তালিকায় প্রায় ৫০ জনের নিচে রয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের শূন্যপদ পূরণে চারজনের নাম সুপারিশ করেছেন। তাঁরা হলেন: হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া (অবসর ২০১৮), বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা (অবসর ২০১৭), বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (অবসর ২০২১) ও বিচারপতি মো. ইমান আলী (অবসর ২০২৩)।
ওই চারজন সম্পর্কে এই বিবেচনাপত্রের মূল্যায়ন: ‘বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া মধ্যপন্থী। টি এইচ খানের জুনিয়র ছিলেন। তাঁকে নিয়োগ দিলে বিচারপতি মোমিনুর রহমানকে নিয়ে তিনি সক্রিয় হবেন। তবে নাজমুন আরা নিরপেক্ষ থাকবেন। যদিও তাঁর ছেলে কোকোর বন্ধু। বিচারক পদে তাঁর স্থায়ীকরণের ফাইল বিদেশে পাঠিয়ে বেগম জিয়ার সই আনা হয়েছিল। সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিএনপিপন্থী। তাঁর শ্বশুর বিএনপির সাংসদ পদপ্রার্থী হন। এক-এগারোর সময় শেখ হাসিনাকে তিনি প্রতিকার দেননি। বিচারপতি ইমান আলী জামায়াতপন্থী। এ দুজনকে নিয়োগদান সমীচীন হবে না।’
গত ১০ জানুয়ারি ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি’র প্যাডে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়। তার শিরোনাম জুতসই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সুপ্রিম কোর্টকে রক্ষা করুন। এক ডজনের বেশি ‘আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ’ভুক্ত আইনজীবী এক জরুরি সভায় কার্যত প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং ১০ বিচারকের সপক্ষে বক্তব্য দেন। বিষয়টি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে অনেককে। একজন বললেন, ওই প্রেস রিলিজ আমরা দিইনি। ওটা বিএনপির অপপ্রচার। বললাম, তাহলে সেটা লিখে দিন। করজোড়ে বললেন, প্লিজ! সামনে সমিতির ইলেকশন। আম-ছালা দুই-ই যাবে।
আমাদের কথা হলো, আপিল বিভাগে যদি ১১ জন বিচারক না লাগে, তাহলে আইনে সংশোধনী আনা হোক। প্রধান বিচারপতি আইন মানছেন না বা অগ্রাহ্য করছেন এবং কেউ কিছু বলছেন না, সেটা ভালো নয়। জনগণের চোখে এটা প্রশ্ন তৈরি করে। সে কারণে এত দিন বাদে সাতজনের পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক চারজনকে সুপারিশ করাও একটা খটকা। আমরা কিন্তু মনে করি না যে, মেধা ও যোগ্যতা বাদ দিয়ে জ্যেষ্ঠতা মানতে হবে। আবার বোধগম্য কারণ ছাড়াই জ্যেষ্ঠতা অগ্রাহ্য হবে, সেটাও ঠিক নয়। তবে পরিহাস কেমন করুণ হয়ে উঠেছে দেখুন।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি যখন অন্যদের ডিঙালেন, তখন এই ১০ আওয়ামী বিচারক সন্তুষ্টই ছিলেন। এবার তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ প্রধান বিচারপতি তাঁদের ডিঙিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে আমরা ঈদুল ফিতরের সময় প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনায় যোগ দিতে গণভবনে দেখে বিষণ্ন হয়েছিলাম। তখন আমরা এর প্রতিবাদ দেখিনি। এবার এই ১০ জন ঐতিহ্যকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন বললেও কম বলা হবে। তাঁদের দায়ের করা মামলায়ই আমরা আপিল বিভাগের কাছ থেকে বিচারক নিয়োগে একটা যা-ই হোক আইন পেয়েছি। তাতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির পরামর্শ প্রাধান্য পাবে। এটা এখন আইন। এটা মানতে অন্যদের মতো এই ১০ জনও বাধ্য। কিন্তু তাঁরা তদবিরে বের হলেন। সবচেয়ে আতঙ্কজনক হলো, তাঁরা আইনমন্ত্রীর বাসভবনে গেছেন। প্রধান বিচারপতির সুপারিশ অমান্য করতে আইনমন্ত্রীর বাসভবনে তদবির করার এমনতর নজির হয়তো এই প্রথম। ২ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘১০ বিচারপতির একটি প্রতিনিধিল আইনমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাঁদের মধ্যে বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, বিচারপতি মো. শামসুল হুদা, বিচারপতি এম এ হাই, বিচারপতি ফারুক আহমেদ, বিচারপতি মো. নিজামুল হক (যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান) ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম আছে। সংক্ষুব্ধ বিচারপতিরা ৩১ জানুয়ারি ২০১০ আইনমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন।’ আইনমন্ত্রী বিচারকদের আহ্বানে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারতেন। তিনি হয়তো বিশ্বের প্রথম হতভাগ্য আইনমন্ত্রী, যিনি প্রেসকে বলতে পেরেছেন, ‘বিচারপতিরা তাঁর বাসায় এসেছিলেন। তাঁরা ব্যাপারটি (আপিল বিভাগে নিয়োগ) পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন।’ এর মানে দাঁড়াল এই, যে বিচারপতিদের কারণে আমরা দুই বছর আগে প্রধান বিচারপতির সুপারিশের কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসনের অর্জন দেখেছিলাম, তাঁদের অভিবাদন জানিয়েছিলাম। এখন তাঁরাই তা বিসর্জন দিলেন। প্রত্যাখ্যান করলেন।
এখন আমরা কোথায় যাব? যদি প্রধান উপদেষ্টার মুলোটা না থাকত, তাহলে আমরা প্রধান বিচারপতির সুপারিশ বড়ই নিশ্চিন্তে সমর্থন করতে পারতাম। সব মিলিয়ে এখন পরিস্থিতি যা চলছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটা গণ-অশ্রুপাতের আয়োজন করা ছাড়া আমরা তো প্রতিবাদের আর কোনো ভাষা পাই না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে নাকচ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের জ্যেষ্ঠতার দাবি। সেটা মেনেই তাঁরা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের মতো আচরণ করছেন। প্রকাশ্যে তদবির ও ধরাধরির মাধ্যমে তাঁরা প্রধান বিচারপতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। অথচ জোট সরকারের আমলে বাদ পড়া সুপ্রিম কোর্টের এই ১০ জন বিচারকের জন্য আমরা অশ্রুপাত করেছিলাম। কারণ, বিএনপি আমলে তাঁরা যখন হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক ছিলেন, তখন তাঁদের স্থায়ীকরণে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি তা অগ্রাহ্য করে।
তারপর নয় মণ ঘি পুড়ল। রাধাও নাচল। বেশ কয়েক বছর ধরে ওই ঘটনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানি চলল। হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ; আবার হাইকোর্ট, আবার আপিল বিভাগ। এ রকম কয়েক রাউন্ড চলল। সুপ্রিম কোর্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে একটা দোস্তি অবশ্য বজায় রাখলেন। তাঁরা গোপনীয়তা বজায় রাখলেন। প্রধান বিচারপতি আদৌ সুপারিশ দিয়েছিলেন কি না, দিয়ে থাকলেও কী কারণ দেখিয়ে তিনি সে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, তা জনগণকে জানতে দেওয়া হলো না। তবুও আমরা নতুন রায়কে স্বাগত জানালাম। কারণ, আমরা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে প্রধান বিচারপতির ওপর ভরসা রাখাকে শ্রেয়তর মনে করেছিলাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের সংবিধানসম্মত অপার ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে মুঠো আলগা করতে অনাগ্রহী থাকবেন। তাই আমরা সেদিনের বাদ পড়া ১০ বিচারকের পক্ষে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরিণতি যে এমন ভয়ংকর হবে, তা আমরা ভাবতে পারিনি। ১০ বিচারকের অনেকে আমাদের শ্রদ্ধেয়। কিন্তু তাঁরা জ্যেষ্ঠতার প্রশ্নে এতটাই উতলা হবেন, যাতে কিনা তাঁরা বিচারিক ঐতিহ্য, আপিল বিভাগের আইন অমান্য করার মতো জায়গায় নিজেদের নামাবেন, তা আমরা কল্পনা করতে পারিনি।
কী উপায়ে তাঁরা চাকরি ফিরে পেলেন, তা চকিতে রোমন্থন করে দেখতে পারি। অতিরিক্ত ১০ বিচারক আশা করেছিলেন, তাঁদের চাকরি ফিরে পেলেই চলবে না। জ্যেষ্ঠতাও চাই। তাঁদের এই প্রত্যাশা অবশ্যই বৈধ ও যৌক্তিক মনে করেছি। তাই আমরা যখন জানলাম, হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ তাঁদের জ্যেষ্ঠতা দিয়েছেন, তাতে অবাক হইনি। ওই ১০ বিচারক চাকরি হারানোর পর জোট সরকার ইতিহাসের অমার্জনীয় দলীয়করণ করেছিল। এমনকি ৩৫-৩৬ বছর বয়সী তরুণকেও তারা বিচারক নিয়োগ করে। ফলে জ্যেষ্ঠতার নীতির যে ঐতিহ্য, তাতে আসলে পেরেক ঠোকা হয়। এমনিতেই অনেক অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ ও যোগ্যতাসম্পন্ন আইনজীবী বহুকাল আগেই বেঞ্চ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। ধরাধরি করে তাঁরা বিচারক হতে চান না। জোট সরকার জ্যেষ্ঠতার মাপকাঠি অনেকটাই বিপন্ন করে। কিন্তু আমরা আইনগত ও সাংবিধানিক দিকটি দেখব। কারণ, সবাই আপিল বিভাগ মানবেন, না মানলে শাস্তি দেবেন আর সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা সুপ্রিম কোর্টের আইন মানবেন না, তা কেউ আশা করবেন না।
১০ জন অতিরিক্ত বিচারক যখন হাইকোর্টের রায়ে জ্যেষ্ঠতা পেলেন, তখন মুখ্যত এর প্রতিবাদ করলেন জোট আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারকেরা। তাঁরা আমাদের গভীর লজ্জায় ফেললেন। কারণ, তাঁরা এই নিয়োগ ঠেকাতে বলে বসলেন যে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ লাগবে, এমন কথা সংবিধানে নেই। প্রায় ২৮ জন বিচারক হলফনামা দিয়ে হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলেন। তাঁদের একটি যুক্তি অবশ্য সংবিধান সমর্থন করল। সেটা হলো জ্যেষ্ঠতার প্রশ্ন। আপিল বিভাগ তাই যথার্থই তাঁদের জ্যেষ্ঠতা নাকচ করেন। তাঁরা নতুন নিয়োগপত্র পান। এতে তাঁদের আগের নিয়োগের ধারাবাহিকতা সব অর্থে মুছে যায়।
আমাদের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ মানে অনধিক ১১ নয়। সব পরিস্থিতিতে ১১ জন থাকবেন। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগে রহস্যজনক বিলম্ব ঘটছে। গত দুই বছরে অবসরে যেতে যেতে আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা ৪-এ নেমেছে। বিচারকাজে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। এরপর আমাদের কানে নানা খবর ভেসে এল। কাকে রেখে কাকে আনা হবে, সেই হিসাব-নিকাশ চলছে। এর প্রতিটির কারণ বিচারবহির্ভূত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিংবা সুপ্রিম কোর্টের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। আছে দলবাজির কুটুম্বিতা। ফলে সুপ্রিম কোর্টের সার্বভৌমত্ব বেআব্রু হয়ে পড়ছে।
আগামী ১৮ মে প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন। সুতরাং এরপর কে প্রধান বিচারপতি হবেন, তা নিয়েই হয়তো চলছে ধুন্দুমার হিসাব। বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান থেকেও নেই। বিচারপতি এম এ মতিন ও তাঁকে ডিঙিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর অতিক্রান্ত দুজন ছুটিতে যান। বিচারপতি এম এ মতিন অবসরে গেছেন। এখন আছেন বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমান। তাঁর অবসরের তারিখ নভেম্বরে। তিনি বিচারকাজে অংশ নেন না। তাঁর বেদনা বোধগম্য। কিন্তু তাঁর বর্তমান অবস্থান সম্ভবত গ্রহণযোগ্য হওয়ার নয়। প্রতিবাদের এই ভাষা আদর্শস্থানীয় নয়। এই প্রেক্ষাপটে আমরা শুনি যে আপিল বিভাগে আরোহণে ধুমসে তদবির চলছে। কে কাকে রেখে ওপরে উঠবেন, তারই দৌড়।
যদি বিচারপতি নঈমকে প্রধান বিচারপতি করা হয়, তাহলে সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কম। তাঁর পরের দুজন বিচারপতি এম এম হোসেন ও এস কে সিনহা। তাঁদের যাঁকেই প্রধান বিচারপতি করা হোক, তাঁরা আগামী নির্বাচনের আগে কেউ অবসরে যাচ্ছেন না। তাঁরা অবসরে যাবেন যথাক্রমে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে। বিচারপতি এস কে সিনহার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেন, তাঁকে করলে দুটো লাভ। বিএনপি আগামী মেয়াদে সরকারে এলেও তারা কোনো প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুযোগ পাবে না। বিপরীত যুক্তি হচ্ছে, তিনি সংখ্যালঘু। তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলে তা আওয়ামী লীগের জন্য ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। তা ছাড়া তাঁকে প্রধান বিচারপতি করতে হলে বিচারপতি এম এম হোসেনকে ডিঙাতে হবে।
খুবই খুশি হতাম, যদি একজন সংখ্যালঘুকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমরা পেতাম। পাকিস্তানে ২০০৭ সালের সংকটকালে ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ‘অকার্যকর’ ঘোষিত হন। তখন বিচারপতি রানা ভগবানদাস প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পান। কর্নেলিয়াস ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
তাই হিসাবটা এ রকম শুনছিলাম। যদি ওই ১০ জনের মধ্য থেকে আপিল বিভাগে চলতি সাতটি শূন্যপদ পূরণ করা হয়, তাহলে তাঁদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতিও করা যায়। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বিরোধী দল ‘না’ করেছে। তাই বিকল্প খোঁজা হচ্ছে আর কার ব্যাপারে বিএনপি নমনীয় হতে পারে।
আওয়ামী লীগের একদল আইনজীবী প্রধানমন্ত্রীর জন্য ১২ পৃষ্ঠার একটি বিবেচনাপত্র তৈরি করেছেন। সন্দেহাতীতভাবে এটা একান্তভাবে দলীয়। এর যুক্তি: আপিল বিভাগ গঠনে দূরদর্শী দলীয় পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এর একটি হলো, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান উপদেষ্টা পদে দলীয় ঘরানায় তিনটি বিকল্প তৈরি করা। সুপ্রিম কোর্ট সার্বভৌম কি না, তাঁর জবাবদিহি বিতর্ক, তাঁর স্বাধীনতা, তাঁর নিরপেক্ষতা—এসব দেখে-শুনে এখন আরও পানসে মনে হয়।
ওই বিবেচনাপত্রে বলা হয়েছে: ‘শতভাগ আওয়ামী লীগের সমর্থক মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি মো. শামসুল হুদা মানিককে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া যায়। বিচারপতি এম এম হোসেনকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রথমে বিচারপতি মমতাজ এবং পরে বিচারপতি মানিককে প্রধান বিচারপতি করা হলেও বিচারপতি এম এম হোসেনকেও প্রধান বিচারপতি করা যেতে পারে। বিরোধী দল একজনের বিষয়ে আপত্তি দিলে অন্যজন হবেন। এভাবে প্রধান উপদেষ্টার জন্য তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি থাকবেন।’ ওই ১০ জন বিদ্যমান জ্যেষ্ঠতার তালিকায় প্রায় ৫০ জনের নিচে রয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের শূন্যপদ পূরণে চারজনের নাম সুপারিশ করেছেন। তাঁরা হলেন: হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া (অবসর ২০১৮), বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা (অবসর ২০১৭), বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (অবসর ২০২১) ও বিচারপতি মো. ইমান আলী (অবসর ২০২৩)।
ওই চারজন সম্পর্কে এই বিবেচনাপত্রের মূল্যায়ন: ‘বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া মধ্যপন্থী। টি এইচ খানের জুনিয়র ছিলেন। তাঁকে নিয়োগ দিলে বিচারপতি মোমিনুর রহমানকে নিয়ে তিনি সক্রিয় হবেন। তবে নাজমুন আরা নিরপেক্ষ থাকবেন। যদিও তাঁর ছেলে কোকোর বন্ধু। বিচারক পদে তাঁর স্থায়ীকরণের ফাইল বিদেশে পাঠিয়ে বেগম জিয়ার সই আনা হয়েছিল। সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিএনপিপন্থী। তাঁর শ্বশুর বিএনপির সাংসদ পদপ্রার্থী হন। এক-এগারোর সময় শেখ হাসিনাকে তিনি প্রতিকার দেননি। বিচারপতি ইমান আলী জামায়াতপন্থী। এ দুজনকে নিয়োগদান সমীচীন হবে না।’
গত ১০ জানুয়ারি ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি’র প্যাডে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়। তার শিরোনাম জুতসই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সুপ্রিম কোর্টকে রক্ষা করুন। এক ডজনের বেশি ‘আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ’ভুক্ত আইনজীবী এক জরুরি সভায় কার্যত প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং ১০ বিচারকের সপক্ষে বক্তব্য দেন। বিষয়টি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে অনেককে। একজন বললেন, ওই প্রেস রিলিজ আমরা দিইনি। ওটা বিএনপির অপপ্রচার। বললাম, তাহলে সেটা লিখে দিন। করজোড়ে বললেন, প্লিজ! সামনে সমিতির ইলেকশন। আম-ছালা দুই-ই যাবে।
আমাদের কথা হলো, আপিল বিভাগে যদি ১১ জন বিচারক না লাগে, তাহলে আইনে সংশোধনী আনা হোক। প্রধান বিচারপতি আইন মানছেন না বা অগ্রাহ্য করছেন এবং কেউ কিছু বলছেন না, সেটা ভালো নয়। জনগণের চোখে এটা প্রশ্ন তৈরি করে। সে কারণে এত দিন বাদে সাতজনের পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক চারজনকে সুপারিশ করাও একটা খটকা। আমরা কিন্তু মনে করি না যে, মেধা ও যোগ্যতা বাদ দিয়ে জ্যেষ্ঠতা মানতে হবে। আবার বোধগম্য কারণ ছাড়াই জ্যেষ্ঠতা অগ্রাহ্য হবে, সেটাও ঠিক নয়। তবে পরিহাস কেমন করুণ হয়ে উঠেছে দেখুন।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি যখন অন্যদের ডিঙালেন, তখন এই ১০ আওয়ামী বিচারক সন্তুষ্টই ছিলেন। এবার তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ প্রধান বিচারপতি তাঁদের ডিঙিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে আমরা ঈদুল ফিতরের সময় প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনায় যোগ দিতে গণভবনে দেখে বিষণ্ন হয়েছিলাম। তখন আমরা এর প্রতিবাদ দেখিনি। এবার এই ১০ জন ঐতিহ্যকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন বললেও কম বলা হবে। তাঁদের দায়ের করা মামলায়ই আমরা আপিল বিভাগের কাছ থেকে বিচারক নিয়োগে একটা যা-ই হোক আইন পেয়েছি। তাতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির পরামর্শ প্রাধান্য পাবে। এটা এখন আইন। এটা মানতে অন্যদের মতো এই ১০ জনও বাধ্য। কিন্তু তাঁরা তদবিরে বের হলেন। সবচেয়ে আতঙ্কজনক হলো, তাঁরা আইনমন্ত্রীর বাসভবনে গেছেন। প্রধান বিচারপতির সুপারিশ অমান্য করতে আইনমন্ত্রীর বাসভবনে তদবির করার এমনতর নজির হয়তো এই প্রথম। ২ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘১০ বিচারপতির একটি প্রতিনিধিল আইনমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাঁদের মধ্যে বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, বিচারপতি মো. শামসুল হুদা, বিচারপতি এম এ হাই, বিচারপতি ফারুক আহমেদ, বিচারপতি মো. নিজামুল হক (যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান) ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম আছে। সংক্ষুব্ধ বিচারপতিরা ৩১ জানুয়ারি ২০১০ আইনমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন।’ আইনমন্ত্রী বিচারকদের আহ্বানে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারতেন। তিনি হয়তো বিশ্বের প্রথম হতভাগ্য আইনমন্ত্রী, যিনি প্রেসকে বলতে পেরেছেন, ‘বিচারপতিরা তাঁর বাসায় এসেছিলেন। তাঁরা ব্যাপারটি (আপিল বিভাগে নিয়োগ) পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন।’ এর মানে দাঁড়াল এই, যে বিচারপতিদের কারণে আমরা দুই বছর আগে প্রধান বিচারপতির সুপারিশের কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসনের অর্জন দেখেছিলাম, তাঁদের অভিবাদন জানিয়েছিলাম। এখন তাঁরাই তা বিসর্জন দিলেন। প্রত্যাখ্যান করলেন।
এখন আমরা কোথায় যাব? যদি প্রধান উপদেষ্টার মুলোটা না থাকত, তাহলে আমরা প্রধান বিচারপতির সুপারিশ বড়ই নিশ্চিন্তে সমর্থন করতে পারতাম। সব মিলিয়ে এখন পরিস্থিতি যা চলছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটা গণ-অশ্রুপাতের আয়োজন করা ছাড়া আমরা তো প্রতিবাদের আর কোনো ভাষা পাই না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments