উচ্চশিক্ষা-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বড় গৌরব, বড় পতন by মোহীত উল আলম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে বাংলাদেশ হতো না। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের দুপুর সাড়ে ১২টায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় ছাত্রসভায় যদি ছাত্রছাত্রীরা জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘অমর একুশে’ হতো না এবং বাংলাদেশও ঘটনাপরম্পরায় জন্ম নিত না।
ওই দিনও আসলে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার সূত্রপাত না হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ, তার আগের রাত ২০ ফেব্রুয়ারি আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে নবাবপুরে ছাত্রলীগের কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে ভোট পড়ে ১১টি, আর ভাঙার পক্ষে তিনটি। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি মোহাম্মদ তোয়াহা ভোটদানে বিরত ছিলেন। কিন্তু (ভাষাসৈনিক) আবদুল মতিনের বক্তব্য ছিল, ভোটাভুটির মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারণ না করে পরের দিন অনুষ্ঠেয় ছাত্রসভার কাছে উভয় মতামত পেশ করা হোক। তারা যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই অনুসরণ করা হবে। বলা বাহুল্য, কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রছাত্রীরা বিপুল করতালির মাধ্যমে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে রাস্তায় নেমে আসেন। শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এসে জমায়েত হন। তার পরের ঘটনা ইতিহাস। অমর একুশে থেকে পর্যায়ক্রমে ঘটনাপরম্পরায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।
ঠিক এ গৌরবময় ঐতিহ্যের পাশাপাশি আরেকটি ছবি: রিডার্স ডাইজেস্ট-এর সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যায় এশিয়ার প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। শুনেছি আরও কিছু সংস্থার জরিপে বিশ্বের প্রথম ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকাভুক্ত হয়নি।
ব্যাপারটি আসলে তেমন কিছুই নয়, আমরা বলতে পারি। রিডার্স ডাইজেস্ট বা এমনতরো পত্রিকা ও সংস্থাগুলো পশ্চিমা গুনিনদের পেট বাঁচানোর উপায় করে দিতে, এ রকম নানা সমীক্ষা বের করে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সর্বক্ষণ হীনম্মন্যতা তৈরি করতে ব্যস্ত।
কিন্তু এ প্রশ্নটিও আবার মনে জাগতে পারে, আসলে তাই তো, এশিয়ার ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাবি নেই কেন?
এ প্রশ্নটির উত্তর সবার জানা, মেধাশক্তি ও পেশিশক্তির যুদ্ধের মধ্যে পড়ে এ অবস্থা হয়েছে ঢাবির। তবু একটু ব্যাখ্যা করছি।
গত বছর ঢাবির ইংরেজি বিভাগে একটি মৌখিক পরীক্ষার বহিঃসদস্য হিসেবে পরীক্ষা নিতে কলাভবনে যাই। তিন দিনের পরীক্ষা। প্রথম দিন উপস্থিত থেকে আমি আর যাইনি। কারণ দেখি কি করিডর দিয়ে মুহুর্মুহু মিছিল যাচ্ছে নানা রকম স্লোগান দিয়ে। কী একটা কারণে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংক্ষুব্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল। স্লোগানের চিৎকারে আমাদের পরীক্ষা পরিচালনা করতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছিল। মনে পড়ল, ঠিক যে অবস্থার কারণে ৩৫-৩৬ বছর আগে বীতরাগ হয়ে আমি ঢাবি ছেড়েছিলাম, সে কারণগুলো এখনো বজায় আছে।
সপ্তাহ খানেক আগে একটি জাতীয় পত্রিকার সমীক্ষায় দেখলাম, গত ৯০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এত কম গবেষণাকর্ম হয়েছে যে এবং ঢাবির ছাপাখানা থেকে এত কম প্রকাশনা হয়েছে যে, যাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ও পাঠ্যরীতির মর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
দেশের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম বিপর্যস্ত দশা হলো কেন?
আমি যে কথাটা বলতে চাইছি সেটি হচ্ছে, অসামঞ্জস্যমূলক একটি প্রেক্ষাপটের কথা। জিনিসটা এ রকম, লেখার প্রথম পরিচ্ছেদে ঢাবির যে গৌরবজনক ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছি, সেটা একটা দেশপ্রেমিক রাজনীতির পরিচায়কমূলক মেটাফর বা ভাবমূর্তি। যে ভাবমূর্তি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আমলে ঢাবির সঙ্গে প্রায় একই সময় জন্মগ্রহণকারী এবং ঢাবির মতোই একটি দেশের রাজধানীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও, ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এমনভাবে ঐতিহাসিক কোনো কথা বলা যাবে না যে ভারতের রাজনৈতিক পরাধীনতার অবসানের ক্ষেত্রে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সরাসরি একক কোনো অবদান ছিল। এমনকি পাকিস্তানের রাজনীতিতে করাচি বা লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকা সম্পর্কে আমরা অবগত নই। অথচ অন্যদিকে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আইয়ুবের সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং পরিশেষে স্বাধীনতা অর্জন এগুলোর কোনো পর্যায় থেকে ঢাবিকে আলাদা করা যাবে না। এমনকি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসানের বেলায় সরাসরি ভূমিকা ছিল ঢাবির শিক্ষার্থীদের প্রাগ্রসর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভকাল থেকে শেষ অবধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ছিলেন দখলদার বাহিনীর আক্রোশের প্রধান শিকার। তাই মুক্তিযুদ্ধের যেকোনো বিবরণীতে ঢাবির অত্যুজ্জ্বল ভূমিকার কথা জানা যায়। এই যে ইতিহাসগতভাবে একটি দেশ ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তুল্যমূল্য পরিচয়—এমনটি আমার জানার মধ্যে নেই যে পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সঙ্গে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নয়, আমেরিকার ইতিহাসের সঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নয়। যে বোলনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলে পরিচিত, তার সঙ্গেও ইতালির ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত নয়। এই যে এখন মিসরে মোবারকবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে, টিভিতে দেখিনি বা কোথাও পড়িনি যে মিসরের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর নেতৃত্ব দিচ্ছে, বা প্রতিবাদস্বরূপ এর উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সিউল বা সৌল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে পুলিশের সঙ্গে খানিকটা ধস্তাধস্তি করতে দেখা যায়।
কিন্তু জগতের বহু নির্মম সত্যের মধ্যে একটি হলো সময়, সময়ের সদ্ব্যবহার কিংবা সময়ের ক্ষয়। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না—এ প্রাচীন কথাটি এ জন্য এখানে এসে যাচ্ছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় সে যতই আমাদের গলার মহামূল্যবান হার হোক না কেন, সেও আর সবকিছুর মতো সময়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে বন্দী।
ছাত্ররা যখন রাজনীতির মিছিল বের করতে ব্যস্ত, যখন তারা পরস্পর মারামারিতে ব্যস্ত, যখন তারা রাজনৈতিক দলগুলোর আহ্বানে হরতাল পালনে ব্যস্ত, যখন ক্যাম্পাসে লাশ পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকে আর এ রকম চলতে থাকে বলে শিক্ষকেরাও যখন দলীয় রাজনীতির বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে গবেষণা ও পাঠবিমুখ অলস, সুযোগসন্ধানী এবং একটি নিম্নতর শ্রেণীতে পরিণত হন; ফলে পরীক্ষার চাপ থাকে না, পড়াশোনার ঘোরের মধ্যে থাকতে হয় না বলে শিক্ষার্থীরাও হয়ে পড়ে পাঠাগারবিমুখ ও আড্ডাবাজ; তখন জানতে হবে পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়িগুলো ঠিকই সময় বাজিয়ে যাচ্ছে—সেখানে পাঠাগার রয়েছে ব্যস্ত, শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত ও শিক্ষকেরা জ্ঞানসাধনায় নিরন্তর ব্যস্ত। তখন হয়তো আমরা রিডার্স ডাইজেস্ট দেখে বিরক্ত এবং অবাক হব যে এটা কী করে সম্ভব, যে হংকং শহরটার কিনা দেশের পরিচয় ভালোভাবে দাঁড়ায়নি, শহরটা এখন চীন দেশের হলেও ব্রিটিশ কায়দায় চলে, সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কী করে এশিয়ার মধ্যে প্রথম হয়? কী করে চীন বা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম কাতারে থাকে? চীনের তো নিয়ন্ত্রিত সমাজ আর মালয়েশিয়ার নেই কোনো বিস্তৃত সভ্যতার ইতিহাস!
ঢাবির সমস্যাটা এখানে, বড় গৌরব, বড় পতন, একই মুদ্রার দুই পিঠ। এমন কেন হলো?
এখানে দলীয় রাজনৈতিক শিক্ষার চরিত্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণানির্ভর শিক্ষার চরিত্রের মধ্যে যে মৌলিক দ্বান্দ্বিক সংকট বিরাজ করছে, তাই আসলে ঢাবি বা বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও সংকটমূলক চরিত্রকে রূপ দিচ্ছে। থিয়োরেটিক্যাল রাজনীতি নয়, দলীয় রাজনীতির শিক্ষা হচ্ছে আদর্শের চেয়ে নেতা বড়। সংসদের যেকোনো অধিবেশনে সাংসদদের বক্তব্য শুনলে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাস্তব রাজনীতির চারিত্র হচ্ছে গণতন্ত্রভিত্তিক নয়, নিউক্লিয়াস নেতৃত্বভিত্তিক। সাধারণভাবে মানুষ ক্ষুধা বোঝে, যৌনতা বোঝে, স্বার্থ বোঝে, কিন্তু তারা নেতা খোঁজে। সাধারণভাবে মানুষ শক্তি, টাকা ও নেতার পূজারি। দলীয় রাজনীতি মানুষের এ মনোগত চাহিদাটা মেটায়। নিজের সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নিক, নিজের চিন্তাটা অন্য কেউ করুক, এর চেয়ে স্বস্তি মানুষ আর কিছুতে পায় না। এ জন্য মানুষ আধ্যাত্মিকতার পথে হাঁটে আর হাঁটে রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে। একজনের পেছনে হেঁটে যাওয়ার মতো সহজ কাজ পৃথিবীতে আর হয় না। ছাত্র হলে তো আর কথা নেই। ছাত্ররা স্বাধীনচেতা, এটা হলো একটা মিথ বা অকর্ষিত ধারণা। আমার ধারণা, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আর শিক্ষক এক ধরনের ভেড়ার পাল। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ নেতৃত্বনির্ভরতার ফায়দা পুরোপুরিভাবে নিচ্ছে। দলীয় রাজনৈতিক শিক্ষার পক্ষে জ্ঞানের তথা তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বিত সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হওয়া কঠিন হয়।
কিন্তু যে কারণে একটি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত প্রস্তুত, সে জ্ঞানের চর্চা ও গবেষণাকর্মের প্রথম শর্ত হলো, তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা। এখানে এ কথা বললে চলবে না যে, আড়িয়ল বিলে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে ভালো হবে, এখানে দেখা হবে যে ওই জায়গায় বিমানবন্দর করতে গেলে মাটির ক্ষমতা আছে কি না, পরিবেশগতভাবে সেটি ঠিক হবে কি না এবং অর্থনৈতিকভাবে সেটি প্রার্থিত হবে কি না।
তথ্য ও তত্ত্বের চর্চা করা খুবই কঠিন একটা কাজ। পাঠাগার ও গবেষণাগারে এবং নিজের পাঠকক্ষে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের অনেক ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়, যে পরিশ্রম করার উদ্দীপনা ঢাবি দিতে পারছে না বলে প্রতীয়মান হয়। অথবা উল্টোভাবে, সে পরিশ্রম করার আগ্রহ ঢাবির লোকদের নেই বলে সে উদ্দীপনাটা অনুপস্থিত। এ কথাটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য।
অনেকে বলেন, ঢাবির হূত গৌরব ফিরিয়ে আনা দরকার। তাঁরা হূত গৌরব বলতে সংগ্রামী দেশপ্রেমমূলক রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, ওই ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজে মনোনিবেশ করলেই কেবল সে হারানো গৌরবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো যাবে। আরও লক্ষ করলে দেখা যাবে, ১৯৯১ সাল থেকে যখন বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করল, তখন থেকে আসলে জাতীয়ভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অনেকাংশে কমে গেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ছাত্রসংগঠনগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকার দরকার হয়নি। এটা আসলে বাংলাদেশের আধুনিকায়নের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উন্নতি।
অর্থাৎ, দেশ যত তথ্য ও জ্ঞাননির্ভর, তথা মেধাভিত্তিক সমাজ হয়ে উঠবে, ততই হাত তুলে স্লোগানসর্বস্ব ছাত্ররাজনীতি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। তখন হয়তো ঢাবি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাতারে উঠে আসবে।
তবে ঢাবির জন্য এ সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। কেননা, একদিকে তার আছে গৌরবান্বিত অতীত, অন্যদিকে ওই অতীতেরই একটি প্রলম্বিত ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে তার এখনো সখ্য চলছে যে রাজনৈতিক ধারার বর্তমানে প্রধান চারিত্র হচ্ছে জ্ঞানবিমুখতা, জ্ঞানসখ্য নয়।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1953@yahoo.com
ঠিক এ গৌরবময় ঐতিহ্যের পাশাপাশি আরেকটি ছবি: রিডার্স ডাইজেস্ট-এর সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যায় এশিয়ার প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। শুনেছি আরও কিছু সংস্থার জরিপে বিশ্বের প্রথম ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকাভুক্ত হয়নি।
ব্যাপারটি আসলে তেমন কিছুই নয়, আমরা বলতে পারি। রিডার্স ডাইজেস্ট বা এমনতরো পত্রিকা ও সংস্থাগুলো পশ্চিমা গুনিনদের পেট বাঁচানোর উপায় করে দিতে, এ রকম নানা সমীক্ষা বের করে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সর্বক্ষণ হীনম্মন্যতা তৈরি করতে ব্যস্ত।
কিন্তু এ প্রশ্নটিও আবার মনে জাগতে পারে, আসলে তাই তো, এশিয়ার ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাবি নেই কেন?
এ প্রশ্নটির উত্তর সবার জানা, মেধাশক্তি ও পেশিশক্তির যুদ্ধের মধ্যে পড়ে এ অবস্থা হয়েছে ঢাবির। তবু একটু ব্যাখ্যা করছি।
গত বছর ঢাবির ইংরেজি বিভাগে একটি মৌখিক পরীক্ষার বহিঃসদস্য হিসেবে পরীক্ষা নিতে কলাভবনে যাই। তিন দিনের পরীক্ষা। প্রথম দিন উপস্থিত থেকে আমি আর যাইনি। কারণ দেখি কি করিডর দিয়ে মুহুর্মুহু মিছিল যাচ্ছে নানা রকম স্লোগান দিয়ে। কী একটা কারণে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংক্ষুব্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল। স্লোগানের চিৎকারে আমাদের পরীক্ষা পরিচালনা করতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছিল। মনে পড়ল, ঠিক যে অবস্থার কারণে ৩৫-৩৬ বছর আগে বীতরাগ হয়ে আমি ঢাবি ছেড়েছিলাম, সে কারণগুলো এখনো বজায় আছে।
সপ্তাহ খানেক আগে একটি জাতীয় পত্রিকার সমীক্ষায় দেখলাম, গত ৯০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এত কম গবেষণাকর্ম হয়েছে যে এবং ঢাবির ছাপাখানা থেকে এত কম প্রকাশনা হয়েছে যে, যাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ও পাঠ্যরীতির মর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
দেশের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম বিপর্যস্ত দশা হলো কেন?
আমি যে কথাটা বলতে চাইছি সেটি হচ্ছে, অসামঞ্জস্যমূলক একটি প্রেক্ষাপটের কথা। জিনিসটা এ রকম, লেখার প্রথম পরিচ্ছেদে ঢাবির যে গৌরবজনক ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছি, সেটা একটা দেশপ্রেমিক রাজনীতির পরিচায়কমূলক মেটাফর বা ভাবমূর্তি। যে ভাবমূর্তি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আমলে ঢাবির সঙ্গে প্রায় একই সময় জন্মগ্রহণকারী এবং ঢাবির মতোই একটি দেশের রাজধানীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও, ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এমনভাবে ঐতিহাসিক কোনো কথা বলা যাবে না যে ভারতের রাজনৈতিক পরাধীনতার অবসানের ক্ষেত্রে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সরাসরি একক কোনো অবদান ছিল। এমনকি পাকিস্তানের রাজনীতিতে করাচি বা লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকা সম্পর্কে আমরা অবগত নই। অথচ অন্যদিকে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আইয়ুবের সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসান থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং পরিশেষে স্বাধীনতা অর্জন এগুলোর কোনো পর্যায় থেকে ঢাবিকে আলাদা করা যাবে না। এমনকি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসানের বেলায় সরাসরি ভূমিকা ছিল ঢাবির শিক্ষার্থীদের প্রাগ্রসর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভকাল থেকে শেষ অবধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ছিলেন দখলদার বাহিনীর আক্রোশের প্রধান শিকার। তাই মুক্তিযুদ্ধের যেকোনো বিবরণীতে ঢাবির অত্যুজ্জ্বল ভূমিকার কথা জানা যায়। এই যে ইতিহাসগতভাবে একটি দেশ ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তুল্যমূল্য পরিচয়—এমনটি আমার জানার মধ্যে নেই যে পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সঙ্গে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নয়, আমেরিকার ইতিহাসের সঙ্গে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নয়। যে বোলনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলে পরিচিত, তার সঙ্গেও ইতালির ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত নয়। এই যে এখন মিসরে মোবারকবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে, টিভিতে দেখিনি বা কোথাও পড়িনি যে মিসরের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর নেতৃত্ব দিচ্ছে, বা প্রতিবাদস্বরূপ এর উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সিউল বা সৌল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে পুলিশের সঙ্গে খানিকটা ধস্তাধস্তি করতে দেখা যায়।
কিন্তু জগতের বহু নির্মম সত্যের মধ্যে একটি হলো সময়, সময়ের সদ্ব্যবহার কিংবা সময়ের ক্ষয়। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না—এ প্রাচীন কথাটি এ জন্য এখানে এসে যাচ্ছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় সে যতই আমাদের গলার মহামূল্যবান হার হোক না কেন, সেও আর সবকিছুর মতো সময়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে বন্দী।
ছাত্ররা যখন রাজনীতির মিছিল বের করতে ব্যস্ত, যখন তারা পরস্পর মারামারিতে ব্যস্ত, যখন তারা রাজনৈতিক দলগুলোর আহ্বানে হরতাল পালনে ব্যস্ত, যখন ক্যাম্পাসে লাশ পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকে আর এ রকম চলতে থাকে বলে শিক্ষকেরাও যখন দলীয় রাজনীতির বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে গবেষণা ও পাঠবিমুখ অলস, সুযোগসন্ধানী এবং একটি নিম্নতর শ্রেণীতে পরিণত হন; ফলে পরীক্ষার চাপ থাকে না, পড়াশোনার ঘোরের মধ্যে থাকতে হয় না বলে শিক্ষার্থীরাও হয়ে পড়ে পাঠাগারবিমুখ ও আড্ডাবাজ; তখন জানতে হবে পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়িগুলো ঠিকই সময় বাজিয়ে যাচ্ছে—সেখানে পাঠাগার রয়েছে ব্যস্ত, শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত ও শিক্ষকেরা জ্ঞানসাধনায় নিরন্তর ব্যস্ত। তখন হয়তো আমরা রিডার্স ডাইজেস্ট দেখে বিরক্ত এবং অবাক হব যে এটা কী করে সম্ভব, যে হংকং শহরটার কিনা দেশের পরিচয় ভালোভাবে দাঁড়ায়নি, শহরটা এখন চীন দেশের হলেও ব্রিটিশ কায়দায় চলে, সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কী করে এশিয়ার মধ্যে প্রথম হয়? কী করে চীন বা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম কাতারে থাকে? চীনের তো নিয়ন্ত্রিত সমাজ আর মালয়েশিয়ার নেই কোনো বিস্তৃত সভ্যতার ইতিহাস!
ঢাবির সমস্যাটা এখানে, বড় গৌরব, বড় পতন, একই মুদ্রার দুই পিঠ। এমন কেন হলো?
এখানে দলীয় রাজনৈতিক শিক্ষার চরিত্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণানির্ভর শিক্ষার চরিত্রের মধ্যে যে মৌলিক দ্বান্দ্বিক সংকট বিরাজ করছে, তাই আসলে ঢাবি বা বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও সংকটমূলক চরিত্রকে রূপ দিচ্ছে। থিয়োরেটিক্যাল রাজনীতি নয়, দলীয় রাজনীতির শিক্ষা হচ্ছে আদর্শের চেয়ে নেতা বড়। সংসদের যেকোনো অধিবেশনে সাংসদদের বক্তব্য শুনলে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাস্তব রাজনীতির চারিত্র হচ্ছে গণতন্ত্রভিত্তিক নয়, নিউক্লিয়াস নেতৃত্বভিত্তিক। সাধারণভাবে মানুষ ক্ষুধা বোঝে, যৌনতা বোঝে, স্বার্থ বোঝে, কিন্তু তারা নেতা খোঁজে। সাধারণভাবে মানুষ শক্তি, টাকা ও নেতার পূজারি। দলীয় রাজনীতি মানুষের এ মনোগত চাহিদাটা মেটায়। নিজের সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নিক, নিজের চিন্তাটা অন্য কেউ করুক, এর চেয়ে স্বস্তি মানুষ আর কিছুতে পায় না। এ জন্য মানুষ আধ্যাত্মিকতার পথে হাঁটে আর হাঁটে রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে। একজনের পেছনে হেঁটে যাওয়ার মতো সহজ কাজ পৃথিবীতে আর হয় না। ছাত্র হলে তো আর কথা নেই। ছাত্ররা স্বাধীনচেতা, এটা হলো একটা মিথ বা অকর্ষিত ধারণা। আমার ধারণা, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আর শিক্ষক এক ধরনের ভেড়ার পাল। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ নেতৃত্বনির্ভরতার ফায়দা পুরোপুরিভাবে নিচ্ছে। দলীয় রাজনৈতিক শিক্ষার পক্ষে জ্ঞানের তথা তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বিত সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হওয়া কঠিন হয়।
কিন্তু যে কারণে একটি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত প্রস্তুত, সে জ্ঞানের চর্চা ও গবেষণাকর্মের প্রথম শর্ত হলো, তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা। এখানে এ কথা বললে চলবে না যে, আড়িয়ল বিলে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে ভালো হবে, এখানে দেখা হবে যে ওই জায়গায় বিমানবন্দর করতে গেলে মাটির ক্ষমতা আছে কি না, পরিবেশগতভাবে সেটি ঠিক হবে কি না এবং অর্থনৈতিকভাবে সেটি প্রার্থিত হবে কি না।
তথ্য ও তত্ত্বের চর্চা করা খুবই কঠিন একটা কাজ। পাঠাগার ও গবেষণাগারে এবং নিজের পাঠকক্ষে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের অনেক ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়, যে পরিশ্রম করার উদ্দীপনা ঢাবি দিতে পারছে না বলে প্রতীয়মান হয়। অথবা উল্টোভাবে, সে পরিশ্রম করার আগ্রহ ঢাবির লোকদের নেই বলে সে উদ্দীপনাটা অনুপস্থিত। এ কথাটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য।
অনেকে বলেন, ঢাবির হূত গৌরব ফিরিয়ে আনা দরকার। তাঁরা হূত গৌরব বলতে সংগ্রামী দেশপ্রেমমূলক রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, ওই ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজে মনোনিবেশ করলেই কেবল সে হারানো গৌরবের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো যাবে। আরও লক্ষ করলে দেখা যাবে, ১৯৯১ সাল থেকে যখন বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করল, তখন থেকে আসলে জাতীয়ভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অনেকাংশে কমে গেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ছাত্রসংগঠনগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকার দরকার হয়নি। এটা আসলে বাংলাদেশের আধুনিকায়নের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উন্নতি।
অর্থাৎ, দেশ যত তথ্য ও জ্ঞাননির্ভর, তথা মেধাভিত্তিক সমাজ হয়ে উঠবে, ততই হাত তুলে স্লোগানসর্বস্ব ছাত্ররাজনীতি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। তখন হয়তো ঢাবি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাতারে উঠে আসবে।
তবে ঢাবির জন্য এ সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। কেননা, একদিকে তার আছে গৌরবান্বিত অতীত, অন্যদিকে ওই অতীতেরই একটি প্রলম্বিত ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে তার এখনো সখ্য চলছে যে রাজনৈতিক ধারার বর্তমানে প্রধান চারিত্র হচ্ছে জ্ঞানবিমুখতা, জ্ঞানসখ্য নয়।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1953@yahoo.com
No comments