বাংলা সন ও পহেলা বৈশাখ by ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য
২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ভাষা এবং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নববর্ষকে কেন্দ্র করে আবেগময় বক্তব্য প্রদান ও প্রবন্ধ রচনা করা আজকাল অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কিন্তু একুশ অন্তর্হিত হলে যেমন বিশুদ্ধ বাংলা চর্চা এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকে ভুলে যান,
তেমনি বাংলা নববর্ষ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাংলা সংস্কৃতি এবং বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথাও অনেকে বিস্মৃত হতে থাকেন। অথচ বাংলা নামক দেশে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের জন্য যেমন অধিকতর কর্মসংস্থান প্রয়োজন, তেমনি সবার প্রয়োজন বাঙালির সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা রাখা। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদার মনুষ্যত্ববোধ গড়ে ওঠার জন্যও এর সঠিক তথ্য অন্বেষণ ও প্রচার করা অত্যাবশ্যক। বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে অনেকে মহামতি আকবরের নাম উল্লেখ করেন। অসাম্প্রদায়িক হুসেন শাহ এবং রাজা শশাঙ্কের নামও উচ্চারণ করেন অনেকেই। এমনকি হিজরি সনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার কথাটিও বেশ জোরেশোরেই উচ্চারিত হয়। তবে এসব ধারণা সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করার মতো গবেষকের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় এ সম্পর্কে বলেন_
*প্রামাণিক ইতিহাস গ্রন্থ আইন-ই-আকবরী বা আকবরনামায় অথবা সমসাময়িক অন্যান্য ঐতিহাসিকের লেখা কোনো গ্রন্থে আকবর কর্তৃক হিজরিকে সৌর বছরে রূপান্তরিত করার কোনো প্রমাণ নেই।
*আকবরের আমলে শুধু যে হিজরি সনই ব্যবহৃত হতো এমন নয়, হিন্দুরা শকান্দ, বিক্রম সংবৎ প্রভৃতি আর মুসলমানরা ফারসি পঞ্জিকা করতেন ব্যবহার।
*কৃষকরা নির্দিষ্ট কোনো তারিখে নয়, নির্দিষ্ট একটি ঋতুতে ফসল কাটে, তাই হিজরিকে সৌর সংবতে পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন তাদের নেই। আর এ কারণেই হিজরি বাংলা সন কিংবা আকবরকে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে উপস্থাপন করার তথ্যকে তিনি কাল্পনিক বলে মনে করেন।
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য একজন ফোকলোর গবেষক ও সংগীত সংগ্রাহক। এতদঞ্চলের মাস, তারিখ সম্পর্কেও তাঁর রয়েছে বিশেষ অভিজ্ঞতা। এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত 'বঙ্গাব্দের উৎস কথা' গ্রন্থের লেখক সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলা মাস এবং বছর নিয়ে বেশ কাজ করেছেন। তাঁরা দুজন যথাক্রমে সুলতান হুসেন শাহ ও রাজা শশাঙ্ককে বাংলা অব্দ সৃষ্টির কৃতিত্ব প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু যেসব যুক্তি ও প্রমাণ কোনো বিতর্কিত বা অনাবিষ্কৃত বিষয়কে সন্দেহাতীতভাবে সঠিক বলে উপস্থাপন করতে পারে, তাঁদের রচনায় সে ধরনের কোনো যুক্তি বা প্রমাণ প্রত্যক্ষগোচর নয়। কাজেই অযথা বাঙালির কৃতিত্বকে আমরা অন্যের হাতে তুলে দিতে আগ্রহী নই। সন শব্দটি আরবি এবং সাল শব্দটি ফারসি হওয়ায় আকবর এবং হিজরি সনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি পুনঃ উচ্চারণ করার প্রয়াস পান সাল-তারিখের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক পলাশবরণ পাল। কিন্তু বঙ্গাব্দ যেসব মাস ও ঋতু দ্বারা গঠিত, সেগুলোর নাম এবং উৎস এ মতের পক্ষে সমর্থন প্রদান করে না। উদ্ভবকাল থেকেই যে বঙ্গাব্দের সঙ্গে সন বা সাল শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে এমন তথ্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কাজেই আকবর ও হিজরির সঙ্গে বঙ্গাব্দের সম্পর্কের তথ্যটিকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া যথেষ্ট কষ্টকর।
বাংলা বছরের পঞ্জিকায় যে ১২টি মাস বর্তমান, তার ১১টিই নক্ষত্রের নামে নামাঙ্কিত। এ ক্ষেত্রে 'বৈশাখ' বিশাখা নক্ষত্রের নামে, 'জ্যৈষ্ঠ' জ্যাষ্ঠা নক্ষত্রের নামে, 'আষাঢ়' আষাঢ়ার নামে এবং এরূপ শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র যথাক্রমে শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদা, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, পৌষী, মঘা, ফাল্গুনী ও চিত্রার নামে অঙ্কিত হয়েছে। যে মাসটি নক্ষত্রের নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, সেটি হচ্ছে অগ্রহায়ণ; আর এই নামটির সঙ্গেই মিশে আছে বাংলার কিছু ইতিহাস, কিছু স্মৃতি এবং কিছু বিস্মৃত হয়ে যাওয়া তথ্য।
'অগ্র' শব্দের অর্থ প্রথম, আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ বছর। বছরের প্রথম বা অগ্রে অবস্থান করার কারণে নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন একমাত্র মাসটির নাম হচ্ছে অগ্রহায়ণ। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ মতান্তরে ১৫০০ বছর আগে প্রণীত শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় মাস হিসেবে অগ্রহায়ণ মাসটির উদ্ধৃতি রয়েছে (১০ম অধ্যায় : ৩৫ নম্বর শ্লোক)। অবশ্য সেখানে প্রিয় ঋতু হিসেবে বর্ণিত আছে বসন্তকালের নাম। বাংলার এই মাস ও ঋতগুলো যে বহুপূর্বকাল থেকে ভারতবর্ষে প্রচলিত, উপযুক্ত তথ্য মূলত তারই পরিচায়ক।
বাংলা বর্ষপঞ্জিতে 'বৈশাখ'-এর প্রথম মাস হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ইতিহাসও খুব অর্বাচীন নয়। আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটার আগেই আমরা এর ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছি। যদিও মধ্যযুগের বিরাট অংশজুড়ে অগ্রহায়ণ-বন্দনা দৃশ্যমান, তবু শেষের দিকের বিভিন্ন গান ও কাব্যে বৈশাখ দিয়ে বর্ষ শুরুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ হয়েছে। উল্লেখ্য, অগ্রহায়ণ মাসে ধান তোলার পর আনন্দসূচক উৎসব নবান্ন, পৌষ মাসে সেই ধান থেকে পিঠা তৈরি উপলক্ষে পৌষ পার্বণ, মাঘে মাঘী পূর্ণিমা এবং ফাল্গুনে হোলি তথা বসন্তোৎসব শেষ করে নিজেদের হিসাব-নিকাশ ও মহাজনের দেনা-পাওনা চৈত্র মাসের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এসে যেত। আর সম্ভবত এ কারণেই সব ব্যস্ততা, টেনশনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে চৈত্র-সংক্রান্তির পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম মাস হিসেবে যাত্রা শুরু করল। মুসলমানরা যেহেতু ফারসি ও আরবি পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন, তাই মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলে অব্দ শব্দটি সন বা সাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল।
আকবর বাংলা অব্দের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও তাঁর সময় থেকে 'বৈশাখ' মাস বাংলা বছরের প্রথম হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে করা যেত। কিন্তু ওই সময় বা তার অনেক পরে রচিত বাংলা সাহিত্যে, বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখের উল্লেখ না থাকায়, এ রকম ধারণা করারও কোনো সুযোগ নেই। বস্তুত বাংলা অব্দ বা সন বাঙালির হাতেই জন্ম এবং ঐতিহ্যের আরো অনেক কিছুর মতো বৈশাখ মাস থেকে বাংলা সনের গণনার বিষয়টিও বহু বাঙালির সম্মিলিত চেষ্টার ফসল। কোনো রাজা কিংবা বাদশাহর সিংহাসনে আরোহণ, কিংবা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির জন্মদিন অথবা ধর্মীয় কোনো আচার-অনুষ্ঠানের স্মারক হিসেবে তার উৎপত্তি লাভ ঘটেনি। ছড়া-ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, হাডুডু-দাঁড়িয়াবান্ধা-গোল্লাছুট, কিংবা বাউল-ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার মতোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার উৎপত্তি ও বিকাশ। কোনো রাজা বা বাদশাহর রাজ পণ্ডিত অথবা ইতিহাসে বিস্মৃত হওয়া কোনো বিজ্ঞ জ্যোতিষীমণ্ডলীর অবদানের কথাও অবশ্য এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে কৃতজ্ঞচিত্তেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
*প্রামাণিক ইতিহাস গ্রন্থ আইন-ই-আকবরী বা আকবরনামায় অথবা সমসাময়িক অন্যান্য ঐতিহাসিকের লেখা কোনো গ্রন্থে আকবর কর্তৃক হিজরিকে সৌর বছরে রূপান্তরিত করার কোনো প্রমাণ নেই।
*আকবরের আমলে শুধু যে হিজরি সনই ব্যবহৃত হতো এমন নয়, হিন্দুরা শকান্দ, বিক্রম সংবৎ প্রভৃতি আর মুসলমানরা ফারসি পঞ্জিকা করতেন ব্যবহার।
*কৃষকরা নির্দিষ্ট কোনো তারিখে নয়, নির্দিষ্ট একটি ঋতুতে ফসল কাটে, তাই হিজরিকে সৌর সংবতে পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন তাদের নেই। আর এ কারণেই হিজরি বাংলা সন কিংবা আকবরকে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে উপস্থাপন করার তথ্যকে তিনি কাল্পনিক বলে মনে করেন।
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য একজন ফোকলোর গবেষক ও সংগীত সংগ্রাহক। এতদঞ্চলের মাস, তারিখ সম্পর্কেও তাঁর রয়েছে বিশেষ অভিজ্ঞতা। এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত 'বঙ্গাব্দের উৎস কথা' গ্রন্থের লেখক সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলা মাস এবং বছর নিয়ে বেশ কাজ করেছেন। তাঁরা দুজন যথাক্রমে সুলতান হুসেন শাহ ও রাজা শশাঙ্ককে বাংলা অব্দ সৃষ্টির কৃতিত্ব প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু যেসব যুক্তি ও প্রমাণ কোনো বিতর্কিত বা অনাবিষ্কৃত বিষয়কে সন্দেহাতীতভাবে সঠিক বলে উপস্থাপন করতে পারে, তাঁদের রচনায় সে ধরনের কোনো যুক্তি বা প্রমাণ প্রত্যক্ষগোচর নয়। কাজেই অযথা বাঙালির কৃতিত্বকে আমরা অন্যের হাতে তুলে দিতে আগ্রহী নই। সন শব্দটি আরবি এবং সাল শব্দটি ফারসি হওয়ায় আকবর এবং হিজরি সনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি পুনঃ উচ্চারণ করার প্রয়াস পান সাল-তারিখের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক পলাশবরণ পাল। কিন্তু বঙ্গাব্দ যেসব মাস ও ঋতু দ্বারা গঠিত, সেগুলোর নাম এবং উৎস এ মতের পক্ষে সমর্থন প্রদান করে না। উদ্ভবকাল থেকেই যে বঙ্গাব্দের সঙ্গে সন বা সাল শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে এমন তথ্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কাজেই আকবর ও হিজরির সঙ্গে বঙ্গাব্দের সম্পর্কের তথ্যটিকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া যথেষ্ট কষ্টকর।
বাংলা বছরের পঞ্জিকায় যে ১২টি মাস বর্তমান, তার ১১টিই নক্ষত্রের নামে নামাঙ্কিত। এ ক্ষেত্রে 'বৈশাখ' বিশাখা নক্ষত্রের নামে, 'জ্যৈষ্ঠ' জ্যাষ্ঠা নক্ষত্রের নামে, 'আষাঢ়' আষাঢ়ার নামে এবং এরূপ শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র যথাক্রমে শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদা, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, পৌষী, মঘা, ফাল্গুনী ও চিত্রার নামে অঙ্কিত হয়েছে। যে মাসটি নক্ষত্রের নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, সেটি হচ্ছে অগ্রহায়ণ; আর এই নামটির সঙ্গেই মিশে আছে বাংলার কিছু ইতিহাস, কিছু স্মৃতি এবং কিছু বিস্মৃত হয়ে যাওয়া তথ্য।
'অগ্র' শব্দের অর্থ প্রথম, আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ বছর। বছরের প্রথম বা অগ্রে অবস্থান করার কারণে নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন একমাত্র মাসটির নাম হচ্ছে অগ্রহায়ণ। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ মতান্তরে ১৫০০ বছর আগে প্রণীত শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় মাস হিসেবে অগ্রহায়ণ মাসটির উদ্ধৃতি রয়েছে (১০ম অধ্যায় : ৩৫ নম্বর শ্লোক)। অবশ্য সেখানে প্রিয় ঋতু হিসেবে বর্ণিত আছে বসন্তকালের নাম। বাংলার এই মাস ও ঋতগুলো যে বহুপূর্বকাল থেকে ভারতবর্ষে প্রচলিত, উপযুক্ত তথ্য মূলত তারই পরিচায়ক।
বাংলা বর্ষপঞ্জিতে 'বৈশাখ'-এর প্রথম মাস হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ইতিহাসও খুব অর্বাচীন নয়। আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটার আগেই আমরা এর ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছি। যদিও মধ্যযুগের বিরাট অংশজুড়ে অগ্রহায়ণ-বন্দনা দৃশ্যমান, তবু শেষের দিকের বিভিন্ন গান ও কাব্যে বৈশাখ দিয়ে বর্ষ শুরুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ হয়েছে। উল্লেখ্য, অগ্রহায়ণ মাসে ধান তোলার পর আনন্দসূচক উৎসব নবান্ন, পৌষ মাসে সেই ধান থেকে পিঠা তৈরি উপলক্ষে পৌষ পার্বণ, মাঘে মাঘী পূর্ণিমা এবং ফাল্গুনে হোলি তথা বসন্তোৎসব শেষ করে নিজেদের হিসাব-নিকাশ ও মহাজনের দেনা-পাওনা চৈত্র মাসের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এসে যেত। আর সম্ভবত এ কারণেই সব ব্যস্ততা, টেনশনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে চৈত্র-সংক্রান্তির পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম মাস হিসেবে যাত্রা শুরু করল। মুসলমানরা যেহেতু ফারসি ও আরবি পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন, তাই মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলে অব্দ শব্দটি সন বা সাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল।
আকবর বাংলা অব্দের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও তাঁর সময় থেকে 'বৈশাখ' মাস বাংলা বছরের প্রথম হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে করা যেত। কিন্তু ওই সময় বা তার অনেক পরে রচিত বাংলা সাহিত্যে, বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখের উল্লেখ না থাকায়, এ রকম ধারণা করারও কোনো সুযোগ নেই। বস্তুত বাংলা অব্দ বা সন বাঙালির হাতেই জন্ম এবং ঐতিহ্যের আরো অনেক কিছুর মতো বৈশাখ মাস থেকে বাংলা সনের গণনার বিষয়টিও বহু বাঙালির সম্মিলিত চেষ্টার ফসল। কোনো রাজা কিংবা বাদশাহর সিংহাসনে আরোহণ, কিংবা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির জন্মদিন অথবা ধর্মীয় কোনো আচার-অনুষ্ঠানের স্মারক হিসেবে তার উৎপত্তি লাভ ঘটেনি। ছড়া-ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, হাডুডু-দাঁড়িয়াবান্ধা-গোল্লাছুট, কিংবা বাউল-ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার মতোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার উৎপত্তি ও বিকাশ। কোনো রাজা বা বাদশাহর রাজ পণ্ডিত অথবা ইতিহাসে বিস্মৃত হওয়া কোনো বিজ্ঞ জ্যোতিষীমণ্ডলীর অবদানের কথাও অবশ্য এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে কৃতজ্ঞচিত্তেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
No comments