স্মরণ-বাবাকে মনে পড়ে by স্বপ্না রেজা

বাবা আসফউদেদৗলা রেজা। দৈনিক ইত্তেফাক-এর সাবেক বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক। গতকাল ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান পরলোকে। তাঁর অবর্তমানে তাঁর সম্পর্কে সহকর্মী, সহযোগী আর রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে আমরা অনেক স্মৃতিচারণা শুনে আসছি।


এখনো সবাই বাবাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। বাবার সততা, সাহসিকতা, মানবতা বা দেশপ্রেম সম্পর্কে নতুন করে আমার বলার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে ‘সাংবাদিক বাবার’ মূল্যায়নের ধৃষ্টতা আমার নেই। তিনি আমার জ্ঞানের চেয়ে অনেক অনেক বড়। বাবাকে নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। যেগুলো আমাদের বেঁচে থাকার এবং মূল্যবোধ তৈরিতে বড় অবলম্বন হয়ে আছে আজও। আজ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করব। সেই সঙ্গে বাবার প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এই স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে করতে চাই।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। বিকেল আনুমানিক চারটা। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় একটি জেট বিমান। মা হোসেনা আসফউদেদৗলা লতার চাকরির সুবাদে মতিঝিলের পীরজঙ্গি মাজারের কাছে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে তখন আমাদের পরিবারের বসবাস। সেই সময় বাবা আসফউদেদৗলা রেজার সংকটময় মুহূর্তের পরম নির্ভরতার জীবনসঙ্গিনী ছিলেন মা লতা। জেট বিমান উড়ে যেতেই একদল আলবদর আর রাজাকার আমাদের দোতলা বাসায় হুড়মুড় করে উঠে আসে। উল্লেখ্য, আমাদের বাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল এবং প্রচুর ওষুধপত্র আমাদের বাসা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে সরবরাহ করা হতো। বালিশের খোলের মধ্যে টেপ ভরে তা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে নেওয়া হতো। অভিনেত্রী আয়েশা আকতার, মিনারা জামান এবং আরও অনেকে এই কাজ করতেন। বাবার ছদ্মনাম ছিল আলী হামজা। রাজাকার-আলবদররা আমাদের বাসার বন্ধ দরজায় আঘাত করতে থাকে। প্রচণ্ড আঘাতে দরজার লক ভেঙে ফেলে। ঘরে ঢুকে পড়ে দশ-বারোজন রাজাকার-আলবদর। তাদের কারোর কারোর মুখ লাল মাফলার দিয়ে ঢাকা। বাসায় তখন আমরা ভাইবোন, চাচা, মামা, খালা, ফুফু, নানি আর মা-বাবা। বাবার পরনে লুঙ্গি। খালি গা। নানি বাবাকে জড়িয়ে আছেন। দরজা ভেঙে ওরা ঘরে ঢুকেই বাবার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে। নানি প্রাণপণে বাবাকে জাপ্টে ধরে থাকেন। আর চিৎকার করে বলেন, আমার রেজাকে তোমরা মেরো না! আমি তখন ছোট্ট এক শিশু। ওদের একজনের পা ধরে কাঁদতে থাকি, আমার আব্বাকে তোমরা মেরো না! আমাকে লাথি মেরে ফেলে দেয় কয়েক গজ দূরে। ওদের কারোর হাতে থাকা লোহার রড ইতিমধ্যে বাবার পিঠে আঘাত হানে। মা ওদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। ওদের সঙ্গে থাকা রেলওয়ের এক বিহারি স্টাফ আশফাক। আরও আছে স্থানীয় মুন্নাফ। বাকিরা অপরিচিত। উগ্র মুন্নাফ বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তখন মরিয়া হয়ে আছে। মা অনর্গল উর্দুতে ওদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। মায়ের কথা আর প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে ওদের সঙ্গে আসা এক পাঞ্জাবি মা আর নানিকে আশ্বস্ত করে ওদের নিয়ে বেরিয়ে যায়। যদিও ওরা বাবাকে ছাড়া যেতে নাছোড়বান্দা ছিল। ওরা বেরিয়ে সমস্ত এলাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। বাসার পাশে মাঠ তখন ভরে যায় লাশ আর লাশে। মা লতা সিদ্ধান্ত নেন, এ বাসায় আর এক মুহূর্ত নয়। বাবা বাসা ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না। মা বুঝতে পেরেছিলেন, ওরা আবার আক্রমণ চালাবে। ওরা বাবাকে মেরে ফেলবে। রাতের আঁধার নেমে আসতেই একটি জিপে মা আমাদের সবাইকে নিয়ে রওনা দেন। কাকরাইলের একটি ছয়তলা বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় আমাদের আশ্রয় হয়। খুব সতর্কতা আর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে আমাদের এই আশ্রয় হয়। যেদিন আমরা রাতে শাহজাহানপুরের বাসা ছাড়লাম, সেদিন মধ্যরাতে ওরা আবার আমাদের শাহজাহানপুরের বাসায় আক্রমণ চালায়। বাবাকে না পেয়ে সমস্ত ঘর তছনছ করে। লুটপাট করে। আশপাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমাদের খোঁজ জানতে চায়। কিন্তু খোঁজ পায় না। বাবাকে মা গৃহবন্দী করে ফেলেন। শোবার ঘর থেকেও বাবা বেরোতে পারতেন না। বাইরের সমস্ত কাজ মা সারতেন। মায়ের কারণেই বাবা রক্ষা পান। ১০ ডিসেম্বর আমরা খবর পেলাম, সিরাজ কাকাকে (শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন) আলবদর-রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। খবরটি বাবা আর মাকে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়। তাঁরা ভেঙে পড়েন।
অতঃপর ষোলোই ডিসেম্বর দেশ বিজয়ের মুখ দেখলে মা বাবাকে গৃহবন্দী থেকে মুক্ত করে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার চার-পাঁচ দিন পর শাহজাহানপুরের বাসায় আমরা ফিরে আসি। যেসব মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাসায় যাতায়াত করতেন, তাঁরা একদিন মুন্নাফকে ধরে নিয়ে আসে বাসায়। সবাই তাকে মারধর করে। ক্রোধ আর ঘৃণায় ছোট্ট শিশু আমারও জিদ হয় ওকে মারার।
কারণ, মুন্নাফ আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল। আমাকে লাথি মেরেছিল। আমি বাবার রেজরের বক্স থেকে ব্লেড নিয়ে মুন্নাফকে ঘিরে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে ঢুকে মুন্নাফের শরীরে ব্লেড দিয়ে আঁচড় দিয়েছি। আমি প্রতিশোধস্পৃহায় তখন অদম্য। আমি এখন আমার সন্তানকে শেখাই, রাজাকাররা তার নানাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, মাকে আঘাত করেছিল। কোনো দিন ওদের ক্ষমা নেই। মায়ের বুদ্ধি আর কৌশলের কারণে সেদিন বাবাকে আমরা হারাইনি। আজ মা আর বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা আছে। আছে গর্বিত স্মৃতি।

No comments

Powered by Blogger.