বাংলা নববর্ষ উদযাপন : ঐকমত্যের এক স্রোতস্বিনী by এমাজউদ্দীন আহমদ
পহেলা বৈশাখ আমাদের নিজস্ব সম্পদ। নিজস্ব উৎসব। আমাদের জাতীয় উৎসব। ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মতোই পহেলা বৈশাখকে আমরা উদ্যাপন করি জাতীয়ভাবে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে। মুসলমান হিসেবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে যেভাবে আমরা গ্রহণ করি,
অনুজতুল্য নিমচন্দ্র ভৌমিক ঠিক তেমনিভাবে গ্রহণ করেন তাঁদের শারদীয় দুর্গাপূজাকে। বন্ধু রোজারিও যেমন পালন করে থাকেন যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর বা বড়দিন, তেমনি আন্তরিকভাবে পালন করে থাকেন সন্তানতুল্য রবীন্দ্রলাল চাকমা বৌদ্ধ পূর্ণিমাকে। পহেলা বৈশাখ কিন্তু সবাইকে একসূত্রে গেঁথে জড়ো করে এক বটবৃক্ষের নিচে, পরম প্রশান্তি ভরা স্বস্তিতে। সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব তুলে, সব সংস্কারের জাল ছিন্ন করে, সবাইকে এক স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত করে পহেলা বৈশাখ সবাইকে কাছে টানে। বাংলা নববর্ষের মহিমা এমনই।
সমাজজীবনে ধর্মীয় চেতনার পাশাপাশি জাতীয় চেতনা সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে চলে অনেকটা তেল ও পানির মতো। একসঙ্গে থেকেও এক এবং অভিন্ন হয় না। মিলেমিশে এক হয়ে যায় না। প্রতিটি সমাজে তাই দেখা গেছে, ধর্মভিত্তিক বিভাজন সত্ত্বেও জাতীয়তার সর্বগ্রাসী প্রভাবে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা এক পঙ্ক্তিতে দাঁড়িয়ে একাত্মতা অনুভব করে। জাতীয় স্বার্থের তীর ঘেঁষে সবাই এক হয়ে বিনির্মাণ করে জাতীয় জীবনের অন্তরঙ্গ একত্ব। সুদৃঢ় হয় জাতীয় ঐক্য। এই প্রক্রিয়া কিন্তু আপনা-আপনি কার্যকর হয় না। সমাজজীবনের কিছু উপাদান এই মিলনক্ষেত্র রচনা করে। জনগণের ভাষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সমজাতীয় জীবনবোধ, বিশেষ করে অন্যদের থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র ভাবধারা ও স্বাতন্ত্র্য_এসবই হলো এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আমাদের দেশে জনমনে সংস্কৃতির পেলব প্রভাব যেভাবে সমাজব্যাপী এক ঐক্যানুভূতি সৃষ্টি করেছে, তার প্রতিফলন ঘটেছে পহেলা বৈশাখের হৃদয়গ্রাহী আবেদনে। তাই পহেলা বৈশাখের তীর ঘেঁষে এ দেশে সৃষ্টি হয়েছে ঐকমত্যের এক স্রোতস্বিনী। এই স্রোতস্বিনী আরো বেগবতী ও খরস্রোতা হয়ে কালে ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলোর মিলনের পথও প্রশস্ত হবে। তাই পহেলা বৈশাখের উৎসবকে জাতীয় পর্যায়ে আরো প্রাণবন্ত করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে এ দেশে।
পহেলা বৈশাখের আবেদন এই সমাজে আরো একটি কারণে প্রবল এবং তা হলো, গ্রামীণ জীবন থেকে পহেলা বৈশাখের জাতীয় পর্যায়ে উত্তরণ। পহেলা বৈশাখ এ সমাজে গ্রামেই পালিত হতো প্রথমে। কৃষিসভ্যতায় লালিত মানুষের কাজকর্মের সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছে কৃষিকাজের নানা প্রকরণের সঙ্গে মিলেমিশে। কিভাবে, কখন, কোন প্রক্রিয়ায় ভূমি কর্ষণ করলে ভালো ফসল লাভ করা যায়, কখন ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দেয়, কিভাবে খরা, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী, ঘূর্ণিবার্তা, শিলাবৃষ্টির প্রভাবে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে_এ বিষয়ে গ্রামীণ জনসাধারণের রয়েছে প্রত্যক্ষ পরিচিতি। ফসল উঠলে এবং সুফসলের মৌসুম এলে গ্রামীণ জীবনে নেমে আসে আনন্দের ঝরনাধারা। এই দুইয়ে মিলে যে জীবনের মিথষ্ক্রিয়া, গ্রামই তা ভালো করে চেনে। চেনে বলেই গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়ে থাকে ছোটখাটো আনন্দমেলায়, ছোটখাটো পার্বণে, কোনো কোনো আচার-অনুষ্ঠানে। চৈত্রের খরতাপে দগ্ধ মেদিনী কিছুটা স্নিগ্ধ হয় বৈশাখের প্রথম ঝড়ের সঙ্গে প্রথম বর্ষণে। এই বৃষ্টি গ্রামীণ জনগণের কাছে যেমন এক নতুন অভিজ্ঞতা, তেমনি একটি প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশার আংশিক পূর্ণতার রূপ বৈশাখী মেলা। এই মেলায় নগরসভ্যতার চাকচিক্য ভরা হাজারো পণ্য মেলে না। মেলে গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী। তাই এসব মেলায় প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনার যেমন আনন্দ থাকে, তেমনি থাকে পরস্পরের মেলামেশার সুযোগ, ভাবের আদান-প্রদানের সম্ভাবনা। সর্বোপরি সবার সঙ্গে মিলেমিশে কিছুক্ষণ কাটানোর অন্তরঙ্গ পরিবেশ। গ্রামীণ জীবন থেকে এখন বৈশাখী মেলার বিস্তৃতি ঘটেছে শহরে-নগরে-মহানগরীতে। লক্ষ্য প্রায় অভিন্ন। তাই রাজধানী ঢাকায়ও দেখা যায়, বৈশাখের প্রথম দিনে নগরসভ্যতার সঙ্গে ভীষণভাবে সংশ্লিষ্ট উঁচু মার্গের ব্যক্তিরাও ছোট ছেলেটি বা মেয়েটির হাত ধরে ছুটে যান বৈশাখী মেলায়। ছুটে যান পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সের নরনারী-শিশু-কিশোর কিছুক্ষণের জন্য, প্রাণভরে কয়েকটি মুহূর্ত উপভোগের জন্য। মোট কথা, গ্রামীণ জীবনের স্তর পেরিয়ে শহর-নগর ছাপিয়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আজ যে স্তরে উপনীত হয়েছে, তা সত্য সত্যই জাতীয় সম্প্রদায় ছাড়িয়ে, গোষ্ঠীর ঊধর্ে্ব উঠে, সব বিভিন্নতা মাড়িয়ে, পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে রূপান্তরিত হয়েছে সর্বসাধারণের মিলনতিথিরূপে।
বাংলা নববর্ষে অন্যান্য সম্প্রদায়ের আচারবিরোধী কোনো মুসলমানি আচারের জায়গা নেই। যদিও বাংলা বছরের জন্ম হয়েছে দিলি্লর মুসলমান সম্রাট আকবরের আমলে, ইসলামী উত্তরাধিকার বহন করে, তাঁরই নির্দেশে। এর আগে এই অঞ্চলে প্রবর্তিত ছিল হিজরি সাল। ৫৯৮ হিজরি মোতাবেক ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে যেমন মুসলিম শাসনের সূচনা হয়, তেমনি হিজরি সাল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯৬৩ হিজরিতে মোগল বাদশাহ আকবর মসনদে অধিষ্ঠিত হন। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে চান্দ্র বছর হিজরির পরিবর্তে একটি সৌর সাল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে তখনকার দিনের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে দায়িত্ব দেন ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, হিজরি সালের অবয়বকে ঠিক রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের পরিবর্তে ৩৬৫ দিন ধার্য করে ১৪৮৫ সালে বাদশাহ আকবরের কাছে পেশ করেন। আকবর তা অনুমোদন করলে চলতি হিজরি মোতাবেক ৯৬৩ সাল থেকে বাংলা বছরের সূচনা হয়। হিজরি সালের প্রথম দিন পহেলা মহররমের বদলে বাংলা সালের সূচনা হয় পহেলা বৈশাখ থেকে। ফলে হিজরি সালের সৌর রূপ বাংলা সাল ইসলামী উত্তরাধিকার ধারণ করে পথপরিক্রমা শুরু করে। অন্যদিকে বাংলা বছরে হিন্দুত্বের কোনো সংস্কারও জড়িত নেই, যদিও স্থানীয় প্রভাবে প্রকৃতির বৈরী সব দৈত্য-দানার মুখোশ, খানা-খাদ্যের বিভিন্ন রূপ, কৃষিজ সংস্কৃতির হরেক রকম উপাদানের সংযোগ ঘটেছে দীর্ঘকালীন পরিসরে। দরিদ্র কৃষকের খাদ্য পান্তা ভাত, গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত রং-বেরঙের পরিচ্ছদ, গ্রামীণ-সংস্কৃতির বিভিন্ন অভিব্যক্তি তথা সময়ই সংযোজন করেছে পহেলা বৈশাখের উৎসবে। এভাবে বাংলা সাল বাংলাদেশের বাইরের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হলেও এর জন্মলগ্নে কোনো বাঙালির অবদান ছাড়াই, সব বাঙালির কাছে তা হয়ে উঠেছে এক সর্বজনীন মহোৎসব।
কোনো কোনো মহল থেকে অবশ্য পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালাকে অনৈসলামিক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কোনো কোনো মহলকে পহেলা বৈশাখের উৎসবকে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে এর সমালোচনায় মুখর হতে দেখা যাচ্ছে। শুধু তাদের জন্য বলতে চাই, কোনো জনপদে ধর্মীয় চেতনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই জনপদের সব সম্প্রদায়ের জনসমষ্টির মিলিত হওয়ার সম্ভাবনাময় সুযোগ। এসব সুযোগের সূত্র ধরেই গড়ে ওঠে মহামিলনের মহান সূত্র, যা সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। সব বিভেদ ভুলে, সব সন্দেহ-অবিশ্বাস ও সংকীর্ণতা ছাড়িয়ে ঐক্যবোধই জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত করে। বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পহেলা বৈশাখই একমাত্র দিন, যেদিন সবাই সমবেত হতে পারছি ঐক্যের উপত্যকায়, মহামিলনের বিস্তীর্ণ মোহনায়।
উৎসব সব সময়ই আনন্দের। তা যদি সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তাহলে তা হয়ে ওঠে মহা-আনন্দের। জরাজীর্ণ পুরনো সব জঞ্জাল সরিয়ে, সবার প্রত্যাশা ধারণ করে, পহেলা বৈশাখের আবেদন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পেঁৗছে দিচ্ছে নির্মল এক আনন্দের বার্তা। তাই পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠেছে জাতির ঐক্যের প্রতীকস্বরূপ এক আনন্দঘন মহোৎসব। জাতীয় জীবনে সুষম শান্তির এক মহান অভিব্যক্তি। এই ধরনের উৎসব জাতীয় পর্যায়ে সব অনৈক্য, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সব বিভাজন দূর করতে পারে, যদি সূচারুরূপে-সুপরিকল্পিতভাবে এর ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হয়।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সমাজজীবনে ধর্মীয় চেতনার পাশাপাশি জাতীয় চেতনা সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে চলে অনেকটা তেল ও পানির মতো। একসঙ্গে থেকেও এক এবং অভিন্ন হয় না। মিলেমিশে এক হয়ে যায় না। প্রতিটি সমাজে তাই দেখা গেছে, ধর্মভিত্তিক বিভাজন সত্ত্বেও জাতীয়তার সর্বগ্রাসী প্রভাবে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা এক পঙ্ক্তিতে দাঁড়িয়ে একাত্মতা অনুভব করে। জাতীয় স্বার্থের তীর ঘেঁষে সবাই এক হয়ে বিনির্মাণ করে জাতীয় জীবনের অন্তরঙ্গ একত্ব। সুদৃঢ় হয় জাতীয় ঐক্য। এই প্রক্রিয়া কিন্তু আপনা-আপনি কার্যকর হয় না। সমাজজীবনের কিছু উপাদান এই মিলনক্ষেত্র রচনা করে। জনগণের ভাষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সমজাতীয় জীবনবোধ, বিশেষ করে অন্যদের থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র ভাবধারা ও স্বাতন্ত্র্য_এসবই হলো এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আমাদের দেশে জনমনে সংস্কৃতির পেলব প্রভাব যেভাবে সমাজব্যাপী এক ঐক্যানুভূতি সৃষ্টি করেছে, তার প্রতিফলন ঘটেছে পহেলা বৈশাখের হৃদয়গ্রাহী আবেদনে। তাই পহেলা বৈশাখের তীর ঘেঁষে এ দেশে সৃষ্টি হয়েছে ঐকমত্যের এক স্রোতস্বিনী। এই স্রোতস্বিনী আরো বেগবতী ও খরস্রোতা হয়ে কালে ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলোর মিলনের পথও প্রশস্ত হবে। তাই পহেলা বৈশাখের উৎসবকে জাতীয় পর্যায়ে আরো প্রাণবন্ত করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে এ দেশে।
পহেলা বৈশাখের আবেদন এই সমাজে আরো একটি কারণে প্রবল এবং তা হলো, গ্রামীণ জীবন থেকে পহেলা বৈশাখের জাতীয় পর্যায়ে উত্তরণ। পহেলা বৈশাখ এ সমাজে গ্রামেই পালিত হতো প্রথমে। কৃষিসভ্যতায় লালিত মানুষের কাজকর্মের সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছে কৃষিকাজের নানা প্রকরণের সঙ্গে মিলেমিশে। কিভাবে, কখন, কোন প্রক্রিয়ায় ভূমি কর্ষণ করলে ভালো ফসল লাভ করা যায়, কখন ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দেয়, কিভাবে খরা, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী, ঘূর্ণিবার্তা, শিলাবৃষ্টির প্রভাবে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে_এ বিষয়ে গ্রামীণ জনসাধারণের রয়েছে প্রত্যক্ষ পরিচিতি। ফসল উঠলে এবং সুফসলের মৌসুম এলে গ্রামীণ জীবনে নেমে আসে আনন্দের ঝরনাধারা। এই দুইয়ে মিলে যে জীবনের মিথষ্ক্রিয়া, গ্রামই তা ভালো করে চেনে। চেনে বলেই গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়ে থাকে ছোটখাটো আনন্দমেলায়, ছোটখাটো পার্বণে, কোনো কোনো আচার-অনুষ্ঠানে। চৈত্রের খরতাপে দগ্ধ মেদিনী কিছুটা স্নিগ্ধ হয় বৈশাখের প্রথম ঝড়ের সঙ্গে প্রথম বর্ষণে। এই বৃষ্টি গ্রামীণ জনগণের কাছে যেমন এক নতুন অভিজ্ঞতা, তেমনি একটি প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশার আংশিক পূর্ণতার রূপ বৈশাখী মেলা। এই মেলায় নগরসভ্যতার চাকচিক্য ভরা হাজারো পণ্য মেলে না। মেলে গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী। তাই এসব মেলায় প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনার যেমন আনন্দ থাকে, তেমনি থাকে পরস্পরের মেলামেশার সুযোগ, ভাবের আদান-প্রদানের সম্ভাবনা। সর্বোপরি সবার সঙ্গে মিলেমিশে কিছুক্ষণ কাটানোর অন্তরঙ্গ পরিবেশ। গ্রামীণ জীবন থেকে এখন বৈশাখী মেলার বিস্তৃতি ঘটেছে শহরে-নগরে-মহানগরীতে। লক্ষ্য প্রায় অভিন্ন। তাই রাজধানী ঢাকায়ও দেখা যায়, বৈশাখের প্রথম দিনে নগরসভ্যতার সঙ্গে ভীষণভাবে সংশ্লিষ্ট উঁচু মার্গের ব্যক্তিরাও ছোট ছেলেটি বা মেয়েটির হাত ধরে ছুটে যান বৈশাখী মেলায়। ছুটে যান পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সের নরনারী-শিশু-কিশোর কিছুক্ষণের জন্য, প্রাণভরে কয়েকটি মুহূর্ত উপভোগের জন্য। মোট কথা, গ্রামীণ জীবনের স্তর পেরিয়ে শহর-নগর ছাপিয়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আজ যে স্তরে উপনীত হয়েছে, তা সত্য সত্যই জাতীয় সম্প্রদায় ছাড়িয়ে, গোষ্ঠীর ঊধর্ে্ব উঠে, সব বিভিন্নতা মাড়িয়ে, পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে রূপান্তরিত হয়েছে সর্বসাধারণের মিলনতিথিরূপে।
বাংলা নববর্ষে অন্যান্য সম্প্রদায়ের আচারবিরোধী কোনো মুসলমানি আচারের জায়গা নেই। যদিও বাংলা বছরের জন্ম হয়েছে দিলি্লর মুসলমান সম্রাট আকবরের আমলে, ইসলামী উত্তরাধিকার বহন করে, তাঁরই নির্দেশে। এর আগে এই অঞ্চলে প্রবর্তিত ছিল হিজরি সাল। ৫৯৮ হিজরি মোতাবেক ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে যেমন মুসলিম শাসনের সূচনা হয়, তেমনি হিজরি সাল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯৬৩ হিজরিতে মোগল বাদশাহ আকবর মসনদে অধিষ্ঠিত হন। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে চান্দ্র বছর হিজরির পরিবর্তে একটি সৌর সাল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে তখনকার দিনের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে দায়িত্ব দেন ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, হিজরি সালের অবয়বকে ঠিক রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের পরিবর্তে ৩৬৫ দিন ধার্য করে ১৪৮৫ সালে বাদশাহ আকবরের কাছে পেশ করেন। আকবর তা অনুমোদন করলে চলতি হিজরি মোতাবেক ৯৬৩ সাল থেকে বাংলা বছরের সূচনা হয়। হিজরি সালের প্রথম দিন পহেলা মহররমের বদলে বাংলা সালের সূচনা হয় পহেলা বৈশাখ থেকে। ফলে হিজরি সালের সৌর রূপ বাংলা সাল ইসলামী উত্তরাধিকার ধারণ করে পথপরিক্রমা শুরু করে। অন্যদিকে বাংলা বছরে হিন্দুত্বের কোনো সংস্কারও জড়িত নেই, যদিও স্থানীয় প্রভাবে প্রকৃতির বৈরী সব দৈত্য-দানার মুখোশ, খানা-খাদ্যের বিভিন্ন রূপ, কৃষিজ সংস্কৃতির হরেক রকম উপাদানের সংযোগ ঘটেছে দীর্ঘকালীন পরিসরে। দরিদ্র কৃষকের খাদ্য পান্তা ভাত, গ্রামীণ জীবনে ব্যবহৃত রং-বেরঙের পরিচ্ছদ, গ্রামীণ-সংস্কৃতির বিভিন্ন অভিব্যক্তি তথা সময়ই সংযোজন করেছে পহেলা বৈশাখের উৎসবে। এভাবে বাংলা সাল বাংলাদেশের বাইরের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হলেও এর জন্মলগ্নে কোনো বাঙালির অবদান ছাড়াই, সব বাঙালির কাছে তা হয়ে উঠেছে এক সর্বজনীন মহোৎসব।
কোনো কোনো মহল থেকে অবশ্য পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালাকে অনৈসলামিক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কোনো কোনো মহলকে পহেলা বৈশাখের উৎসবকে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে এর সমালোচনায় মুখর হতে দেখা যাচ্ছে। শুধু তাদের জন্য বলতে চাই, কোনো জনপদে ধর্মীয় চেতনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই জনপদের সব সম্প্রদায়ের জনসমষ্টির মিলিত হওয়ার সম্ভাবনাময় সুযোগ। এসব সুযোগের সূত্র ধরেই গড়ে ওঠে মহামিলনের মহান সূত্র, যা সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। সব বিভেদ ভুলে, সব সন্দেহ-অবিশ্বাস ও সংকীর্ণতা ছাড়িয়ে ঐক্যবোধই জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত করে। বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পহেলা বৈশাখই একমাত্র দিন, যেদিন সবাই সমবেত হতে পারছি ঐক্যের উপত্যকায়, মহামিলনের বিস্তীর্ণ মোহনায়।
উৎসব সব সময়ই আনন্দের। তা যদি সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তাহলে তা হয়ে ওঠে মহা-আনন্দের। জরাজীর্ণ পুরনো সব জঞ্জাল সরিয়ে, সবার প্রত্যাশা ধারণ করে, পহেলা বৈশাখের আবেদন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পেঁৗছে দিচ্ছে নির্মল এক আনন্দের বার্তা। তাই পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠেছে জাতির ঐক্যের প্রতীকস্বরূপ এক আনন্দঘন মহোৎসব। জাতীয় জীবনে সুষম শান্তির এক মহান অভিব্যক্তি। এই ধরনের উৎসব জাতীয় পর্যায়ে সব অনৈক্য, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সব বিভাজন দূর করতে পারে, যদি সূচারুরূপে-সুপরিকল্পিতভাবে এর ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হয়।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments