বিশেষ সাক্ষাৎকার-খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চাই সরকারের বাজারবান্ধব হস্তক্ষেপ by মোস্তফা কামাল মুজেরী
ড. মোস্তফা কামাল মুজেরী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সিরডাপ ও ইউএনডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। ২০১০ সালে বিআইডিএসের মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ ও আহসান হাবীব
প্রথম আলো বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজার-পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মোস্তফা কামাল মুজেরী খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দেশের জনগণের জীবনযাপনের ওপর বৈরী প্রভাব ফেলে। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের আয়ের ৬০ শতাংশের মতো খরচ করে খাদ্যপণ্যের পেছনে। খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়লে এসব গরিব মানুষের প্রকৃত আয় অনেক কমে যায়।
প্রথম আলো ডিসেম্বরে আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। খাদ্যদ্রব্যের দাম বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। আরো বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এতে আমাদের মুদ্রাস্ফীতি-পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী আগের ডিসেম্বরের তুলনায় গত ডিসেম্বরের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে চলে গেছে। কিন্তু খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখন এতটা নয়, ৪ শতাংশের কম। বর্তমানের মূল্যস্ফীতি মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতি দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে যে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে; বিশেষ করে, চাল ও গমের মতো আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্যের ব্যাপারে, তা উদ্বেগজনক।
প্রথম আলো আমাদের আমদানি মোট চাহিদার ১ থেকে ২ শতাংশ। তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে দাম বাড়ার সম্পর্কটা কীভাবে হলো?
মোস্তফা কামাল মুজেরী আমদানি করা চালের পরিমাণ খুব বেশি না হলেও মনে রাখা দরকার, যেকোনো পণ্যমূল্য নির্ধারিত হয় তার প্রান্তিক অবস্থার ওপর। কোনো কারণে উৎপাদনে ঘাটতি থাকলে, ঘাটতির পরিমাণ কম হলেও তা মূল্যের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়ার দুই ধরনের প্রভাব পড়ে।
বিশ্বায়িত দুনিয়ায় তথ্য খুব দ্রুত জানা যায়। ঢাকার বাজারে কী হচ্ছে, তা সঙ্গে সঙ্গে তেঁতুলিয়া থেকে জানা যায়। একইভাবে বিশ্ববাজারে চালের জোগান, মূল্য, ফিউচার মার্কেটে চালের মূল্য ইত্যাদি তথ্য আদান-প্রদান অনেক দ্রুত ও উন্নত হওয়ার কারণে বাজারে কোথায় কী ঘটছে, তা সবাই তাড়াতাড়ি জানতে পারছে এবং সেই অনুযায়ী কী করলে লাভ হবে, সেটা করতে পারছে।
প্রথম আলো এ বছর চালের উৎপাদন ভালো, সংকট তৈরি হওয়ার কথা নয়। তার পরও কেন দাম বাড়ছে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অনেকগুলো ফ্যাক্টর এখানে কাজ করছে। কিছু দেশীয়, কিছু বৈদেশিক। চালের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, ফড়িয়া বা ভোক্তা যাঁকেই জিজ্ঞাসা করুন না যে নতুন ফসল আসার আগে চালের দাম কমবে কি না, আমার তো মনে হয় ৯০ শতাংশই বলবেন, দাম বাড়বে। চালের দাম শিগগিরই কমার কোনো সম্ভাবনা নেই—এমন ধারণা ব্যাপক বিস্তৃত ও সমাজের গভীরে ঢুকে আছে।
নব্বইয়ের দশকে চালের বাজার অনেক উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর বেসরকারি আমদানিকারকেরা বেশির ভাগ চাল আমদানি করত। বেশির ভাগই আসত ভারত থেকে। তিন বছর ধরে ভারতে চালের দাম বেড়ে গেছে। তারা রপ্তানিও বন্ধ রেখেছে। ফলে আমাদের অন্য উৎস খুঁজতে হচ্ছে। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে আমদানি যতটা সহজ ছিল, অন্য জায়গার ক্ষেত্রে ততটা নয়। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাত আগের ভূমিকা কতটুকু পালন করতে পারবে, তা বলা মুশকিল। আমাদের আমদানির উৎসকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে হবে। ২০০৮ সালের কথা মনে পড়ে। আমাদের টাকা থাকা সত্ত্বেও কোথাও চাল পাচ্ছিলাম না।
আমদানির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করবে, আর যদি বিশেষ প্রয়োজন হয় সরকার আমদানি করবে—এই ভূমিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। যখন আন্তর্জাতিক খাদ্যদ্রব্যের বাজার অস্থিতিশীল আছে এবং এই অস্থিতিশীলতা খুব যে তাড়াতাড়ি দূর হবে, তা নয়। কাজেই সরকারের ভূমিকা আমদানি ক্ষেত্রে বড় করতে হবে। চালের মজুদ নিয়ে সরকারি হিসাব পাই, কিন্তু বেসরকারি খাতের নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই।
প্রথম আলো সরকার তো সম্প্রতি মজুদবিরোধী আইন পুনর্বহাল করল। সরকার তো বলছে, এর মাধ্যমে মজুদের হিসাব জানা যাবে।
মোস্তফা কামাল মুজেরী নব্বইয়ের দশকে ভারতের ওপর বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন দেখেছিলাম। সেখানে তারা বলেছিল, বেসরকারি খাত ভারতের চাল উৎপাদনের ৫০-৬০ ভাগ মজুদ করে রাখে, যা অত্যন্ত বড় পরিমাণ। হতে পারে বাংলাদেশেও একই রকম মজুদের হার। তাই এ তথ্য আমাদের জানা জরুরি।
সরকার মজুদদারি নিয়ে যে আইন পুনর্বহাল করল, তার কতটুকু সুফল পাওয়া যাবে, বলা মুশকিল। বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে গুদামজাত বা মজুদ করা কোনো অবৈধ কাজ নয়। ঠিকঠাকমতো চলা বাজারের অপরিহার্য শর্ত হলো, কার্যকর মজুদব্যবস্থা। আমাদের প্রায় ৫৫ শতাংশ চাল হয় বোরো মৌসুমে। এ চাল সারা বছর ধরে খেতে হবে। এই বণ্টনের কাজ তো গুদাম ছাড়া হবে না। মজুদদারিবিরোধী আইন বাস্তবায়নও খুব কঠিন। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।
প্রথম আলো আমনের মৌসুমে সরকারি ঋণ, প্রবাসী-আয়, সঞ্চয়পত্র ভাঙাসহ নানা খাত থেকে গ্রামে টাকা বেশি গেছে। এর বড় অংশ চাল মজুদে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যেহেতু গ্রামে এখন উৎপাদনশীল বা লাভজনক ব্যবসার সুযোগ কম এবং পাশাপাশি পূর্বাভাস ছিল চালের দাম বাড়ছে, ফলে ওই টাকাটা যৌক্তিকভাবেই এ খাতে যাওয়ার সুযোগ আছে।
মোস্তফা কামাল মুজেরী হাওরাঞ্চলে যে চাল উৎপাদিত হয়, তার একটা বড় অংশ বাজারে চলে আসে। এবার বন্যায় কিন্তু হাওরের ফসল মার গেছে। এগুলো হয়তো বড় ফ্যাক্টর নয়, কিন্তু ছোট ছোট অনেক ফ্যাক্টর আছে, যেগুলো উৎপাদন বেশি হলেও বাজারে সরবরাহে প্রভাব ফেলেছে।
একটু আগে যে বলছিলাম, মূল্য প্রত্যাশার কথা। আজ বিক্রি না করে এক মাস পর বিক্রি করলে একটু বেশি দাম পাব—এই প্রত্যাশা থাকলে চালের দাম তো অবশ্যই বাড়বে। এ কারণে সবাই চেষ্টা করবে চাল ধরে রাখতে। এখন যে বাস্তবতা বিরাজ করছে, তাতে মজুদ করার প্রবণতা তৈরির সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এবং গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে গ্রামে পণ্যমজুদ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঋণ বেশি গেছে। বিভিন্ন খাতের ঋণ এ মজুদে চলে যেতে পারে। গত কয়েক মাসে শেয়ারবাজারে যেমন নানা জায়গা থেকে টাকা এল, সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গেল, সেখানে একটা বুদ্বুদ তৈরি হওয়ার পর কী দুরবস্থা হয়ে গেল। বর্তমান বাজার-পরিস্থিতি ও প্রত্যাশা অনেককে চাল মজুদ করতে উৎসাহ জোগাতে পারে।
প্রথম আলো এই সরকার আসার প্রথম ছয় মাসে কমতে কমতে ধানের মণ ৩০০-৪০০ টাকা ও চাল ২০ টাকা কেজি হয়ে যায়। তার পর থেকে ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। চালের বাজার এমন চরম আচরণ করছে কেন?
মোস্তফা কামাল মুজেরী যদি এমন হয় সবাই আশায় আশায় চাল ধরে রাখে, তাহলে বোরো ফসল এলে চালের বাজারেও বড় ধরনের দরপতন হতেই পারে। তবে চালের ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারের মতো পরিস্থিতি হবে না। চাল তো একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। চালের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই একটা পর্যায়ে ধরে রাখার চেষ্টা থাকবে।
চালের বাজারে আগের চেয়ে অস্থিরতার মাত্রা অনেক বেশি। দামের গতি-প্রকৃতির ওপর দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, আগে দামের ওঠানামা ছিল মৌসুমি। ধান কাটার পর কমত, মরা মৌসুমে বাড়ত। এখন দামের গ্রাফ দেখলে সেই মৌসুমি চরিত্র আর ততটা পাওয়া যায় না। একটি বৃত্তাকার বিন্যাস হচ্ছে। ২০০৯ সালের মে-জুনের দিকে দাম অনেক কমে গিয়েছিল। তার পর থেকে ক্রমান্বয়ে দাম কমবেশি বেড়েই চলেছে। এর একটা কারণ, আমাদের চালের বাজারের প্রকৃতি মৌসুমি চরিত্র থেকে সরে গিয়ে মজুদ বা ব্যবসায় এর প্রভাব অনেক বেশি পড়ছে।
কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে কবওয়েব তত্ত্বের কথা বলা হয়। কবওয়েব মানে হলো যখন দাম বেশি হতো তখন কৃষকেরা অনেক বেশি উৎপাদন করতেন, পরের মৌসুমে দেখা গেল দাম কমে গেল, তখন কৃষকেরা আর আগ্রহী হতেন না। ফলে আবার দাম বাড়ত। মাকড়সার জালের মতো ওঠানামা হতো। এখন চালের বাজারে কৃষিপণ্যের সেই প্রকৃতি আর নেই। চালের বাজার বা উৎপাদন একটা রূপান্তরকালীন সময়ের মধ্যে আছে, একটা সমন্বয়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। মনে হয়, চালের বাজারের অস্থিরতা খুব তাড়াতাড়ি দূর হবে না।
প্রথম আলো এই রূপান্তরকালীন সময়ে উৎপাদন বা উৎপাদনের খরচ আসলে নির্ধারক ফ্যাক্টর না হয়ে ব্যবসায়ীদের ভূমিকাই নির্ধারক হচ্ছে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী উদাহরণ দিয়ে বলি, আমনের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, সরকার সিদ্ধান্ত নিল, আর চাল কিনবে না বরং আমদানি করবে; যাতে বাজারে চালের পরিমাণ বেশি থাকে। সিদ্ধান্তটা ভালো ছিল। কিন্তু তখন সরকার একটা সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করে দেয় ২৯ টাকায়। এটা সবাই জানে। তার ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সবাই জেনে গেল, সরকার তো ২৯ টাকায় কিনতে রাজি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার কিনল না। এটা নির্ধারণ সরকারের জন্য ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এর ফলে দামের একটা প্রবাহ তৈরি হয়ে গেল।
প্রথম আলো উৎপাদন খরচ যেখানে ২১ টাকা, সেখানে বিক্রি হচ্ছে ৩৭-৪০ টাকায়। এমন লাভের প্রক্রিয়া কি যৌক্তিক?
মোস্তফা কামাল মুজেরী সরকারের ২৯ টাকা আমনের ক্রয়মূল্যের কথাও যদি বলি, তাহলে আমাদের চালের দাম ২৯ বা ৩০ টাকায় বেশি হওয়া উচিত নয়, যেখানে ৪০ টাকা যুক্তিসংগত হয় না। দেশের জনগণের; বিশেষ করে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে চালের বর্তমান মূল্যকে বেশি বলতেই হবে। চালের দাম বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের আয় একইভাবে সমন্বিত করতে পারে না, অর্থাৎ তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
প্রথম আলো দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা বাড়ানো, আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প বাজার অনুসন্ধান, সেটাও তো হচ্ছে। তার পরও তো দাম কমছে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সরকারের করণীয় কী?
মোস্তফা কামাল মুজেরী এ অবস্থায় সরকারের প্রধান করণীয় হলো, চাল গুদামজাত করলে লাভ হবে—এই ধারণার পরিবর্তন। এর একটা উপায় হচ্ছে, সরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়িয়ে দ্রুত বাজারে ছাড়া। সরকার সত্যিকার অর্থেই বাজারে চালের পরিমাণ বাড়াচ্ছে—এই বার্তা সবার কাছে পৌঁছানো দরকার। তাহলে মজুদদারেরা ভাবতে উৎসাহিত হবে, চাল ধরে রেখে আর অতিরিক্ত মুনাফা করা যাবে না।
তা ছাড়া বাজারের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা দরকার। যেমন—আমাদের বাজারের তথ্যব্যবস্থা জোরদার করা, বাজারের গতিশীলতাকে রক্ষা করা এবং বাজারে ন্যায্য লেনদেনের বিধিবিধান থাকা দরকার। বাজারের নিয়মগুলো যদি নিশ্চিত করা যায়, ঠিকমতো নজরদারি করা যায়, তাহলে কেউ অতিরিক্ত মজুদদারি করে বাজার অস্থিতিশীল করার পরিবেশ তৈরি করতে পারবে না।
সরকার যে কাজগুলো করছে, সে বার্তাগুলো যেভাবে যাওয়া দরকার, সেভাবে যাচ্ছে না। শুরু থেকে বলা হচ্ছে টিসিবিকে শক্তিশালী করা হবে, যাতে একে দিয়ে প্রয়োজনে বাজারে হস্তক্ষেপ করানো যায়। এখনো হয়নি সেটা। সরকারের সিদ্ধান্তে একটা দীর্ঘসূত্রতা আছে। ফলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকার তো এ রকম বলেই, কিন্তু কিছু করে না। তাই সরকারকে এখন কাজ করে দেখাতে হবে।
প্রথম আলো চাল ছাড়াও চিনি, ভোজ্যতেল, গম বা দুধের দাম—সবকিছুই বাড়ছে। সেসব খাদ্যপণ্যের ব্যাপারে সরকার আর কী করতে পারে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি হস্তক্ষেপকারী ভূমিকা নিতে হবে। সরকারের সামর্থ্য সীমিত, সবকিছু বিশ্ববাজার থেকে এনে অবারিতভাবে ভর্তুকি দিয়ে চালাতে পারবে না। চালের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা গেলে অন্যান্য পণ্যদামেও অস্থিতিশীলতা কমে আসবে। খাদ্যের দাম বাড়লে গরিব জনগোষ্ঠী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকারকে সামর্থ্য অনুযায়ী বাছাই করে ভর্তুকি দিতে হবে।
প্রথম আলো দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আমাদের কী করা উচিত?
মোস্তফা কামাল মুজেরী এ সময়ে এসে আমার মনে হয়, নব্বইয়ের দশকে খাদ্যনিরাপত্তা কৌশলে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। আগে আমরা বলতাম স্বনির্ভরতার কথা। নব্বইয়ে বলা হলো সেলফ রিলায়েন্স অর্থাৎ যদি টাকা থাকে, তাহলে আমদানি করেই চাহিদা মেটাতে পারব, উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর না দিলেও চলে। এখন হয়তো স্বনির্ভরতার ব্যাপারে আমাদের নতুন করে ভাবা দরকার। আমার মনে হয়, চালের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন-পরিস্থিতির দিকে সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে এবং আরও বেশি বাজারবান্ধব হস্তক্ষেপ করতে হবে। বাজার স্থিতিশীল করতে হস্তক্ষেপ করার সামর্থ্য সরকারের থাকতে হবে এবং প্রয়োজনমতো এর ব্যবহার করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তফা কামাল মুজেরী ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ ও আহসান হাবীব
প্রথম আলো বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজার-পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মোস্তফা কামাল মুজেরী খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দেশের জনগণের জীবনযাপনের ওপর বৈরী প্রভাব ফেলে। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের আয়ের ৬০ শতাংশের মতো খরচ করে খাদ্যপণ্যের পেছনে। খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়লে এসব গরিব মানুষের প্রকৃত আয় অনেক কমে যায়।
প্রথম আলো ডিসেম্বরে আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। খাদ্যদ্রব্যের দাম বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। আরো বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এতে আমাদের মুদ্রাস্ফীতি-পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী আগের ডিসেম্বরের তুলনায় গত ডিসেম্বরের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে চলে গেছে। কিন্তু খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখন এতটা নয়, ৪ শতাংশের কম। বর্তমানের মূল্যস্ফীতি মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতি দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে যে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে; বিশেষ করে, চাল ও গমের মতো আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্যের ব্যাপারে, তা উদ্বেগজনক।
প্রথম আলো আমাদের আমদানি মোট চাহিদার ১ থেকে ২ শতাংশ। তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে দাম বাড়ার সম্পর্কটা কীভাবে হলো?
মোস্তফা কামাল মুজেরী আমদানি করা চালের পরিমাণ খুব বেশি না হলেও মনে রাখা দরকার, যেকোনো পণ্যমূল্য নির্ধারিত হয় তার প্রান্তিক অবস্থার ওপর। কোনো কারণে উৎপাদনে ঘাটতি থাকলে, ঘাটতির পরিমাণ কম হলেও তা মূল্যের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়ার দুই ধরনের প্রভাব পড়ে।
বিশ্বায়িত দুনিয়ায় তথ্য খুব দ্রুত জানা যায়। ঢাকার বাজারে কী হচ্ছে, তা সঙ্গে সঙ্গে তেঁতুলিয়া থেকে জানা যায়। একইভাবে বিশ্ববাজারে চালের জোগান, মূল্য, ফিউচার মার্কেটে চালের মূল্য ইত্যাদি তথ্য আদান-প্রদান অনেক দ্রুত ও উন্নত হওয়ার কারণে বাজারে কোথায় কী ঘটছে, তা সবাই তাড়াতাড়ি জানতে পারছে এবং সেই অনুযায়ী কী করলে লাভ হবে, সেটা করতে পারছে।
প্রথম আলো এ বছর চালের উৎপাদন ভালো, সংকট তৈরি হওয়ার কথা নয়। তার পরও কেন দাম বাড়ছে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অনেকগুলো ফ্যাক্টর এখানে কাজ করছে। কিছু দেশীয়, কিছু বৈদেশিক। চালের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, ফড়িয়া বা ভোক্তা যাঁকেই জিজ্ঞাসা করুন না যে নতুন ফসল আসার আগে চালের দাম কমবে কি না, আমার তো মনে হয় ৯০ শতাংশই বলবেন, দাম বাড়বে। চালের দাম শিগগিরই কমার কোনো সম্ভাবনা নেই—এমন ধারণা ব্যাপক বিস্তৃত ও সমাজের গভীরে ঢুকে আছে।
নব্বইয়ের দশকে চালের বাজার অনেক উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর বেসরকারি আমদানিকারকেরা বেশির ভাগ চাল আমদানি করত। বেশির ভাগই আসত ভারত থেকে। তিন বছর ধরে ভারতে চালের দাম বেড়ে গেছে। তারা রপ্তানিও বন্ধ রেখেছে। ফলে আমাদের অন্য উৎস খুঁজতে হচ্ছে। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে আমদানি যতটা সহজ ছিল, অন্য জায়গার ক্ষেত্রে ততটা নয়। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাত আগের ভূমিকা কতটুকু পালন করতে পারবে, তা বলা মুশকিল। আমাদের আমদানির উৎসকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে হবে। ২০০৮ সালের কথা মনে পড়ে। আমাদের টাকা থাকা সত্ত্বেও কোথাও চাল পাচ্ছিলাম না।
আমদানির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করবে, আর যদি বিশেষ প্রয়োজন হয় সরকার আমদানি করবে—এই ভূমিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। যখন আন্তর্জাতিক খাদ্যদ্রব্যের বাজার অস্থিতিশীল আছে এবং এই অস্থিতিশীলতা খুব যে তাড়াতাড়ি দূর হবে, তা নয়। কাজেই সরকারের ভূমিকা আমদানি ক্ষেত্রে বড় করতে হবে। চালের মজুদ নিয়ে সরকারি হিসাব পাই, কিন্তু বেসরকারি খাতের নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই।
প্রথম আলো সরকার তো সম্প্রতি মজুদবিরোধী আইন পুনর্বহাল করল। সরকার তো বলছে, এর মাধ্যমে মজুদের হিসাব জানা যাবে।
মোস্তফা কামাল মুজেরী নব্বইয়ের দশকে ভারতের ওপর বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন দেখেছিলাম। সেখানে তারা বলেছিল, বেসরকারি খাত ভারতের চাল উৎপাদনের ৫০-৬০ ভাগ মজুদ করে রাখে, যা অত্যন্ত বড় পরিমাণ। হতে পারে বাংলাদেশেও একই রকম মজুদের হার। তাই এ তথ্য আমাদের জানা জরুরি।
সরকার মজুদদারি নিয়ে যে আইন পুনর্বহাল করল, তার কতটুকু সুফল পাওয়া যাবে, বলা মুশকিল। বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে গুদামজাত বা মজুদ করা কোনো অবৈধ কাজ নয়। ঠিকঠাকমতো চলা বাজারের অপরিহার্য শর্ত হলো, কার্যকর মজুদব্যবস্থা। আমাদের প্রায় ৫৫ শতাংশ চাল হয় বোরো মৌসুমে। এ চাল সারা বছর ধরে খেতে হবে। এই বণ্টনের কাজ তো গুদাম ছাড়া হবে না। মজুদদারিবিরোধী আইন বাস্তবায়নও খুব কঠিন। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।
প্রথম আলো আমনের মৌসুমে সরকারি ঋণ, প্রবাসী-আয়, সঞ্চয়পত্র ভাঙাসহ নানা খাত থেকে গ্রামে টাকা বেশি গেছে। এর বড় অংশ চাল মজুদে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যেহেতু গ্রামে এখন উৎপাদনশীল বা লাভজনক ব্যবসার সুযোগ কম এবং পাশাপাশি পূর্বাভাস ছিল চালের দাম বাড়ছে, ফলে ওই টাকাটা যৌক্তিকভাবেই এ খাতে যাওয়ার সুযোগ আছে।
মোস্তফা কামাল মুজেরী হাওরাঞ্চলে যে চাল উৎপাদিত হয়, তার একটা বড় অংশ বাজারে চলে আসে। এবার বন্যায় কিন্তু হাওরের ফসল মার গেছে। এগুলো হয়তো বড় ফ্যাক্টর নয়, কিন্তু ছোট ছোট অনেক ফ্যাক্টর আছে, যেগুলো উৎপাদন বেশি হলেও বাজারে সরবরাহে প্রভাব ফেলেছে।
একটু আগে যে বলছিলাম, মূল্য প্রত্যাশার কথা। আজ বিক্রি না করে এক মাস পর বিক্রি করলে একটু বেশি দাম পাব—এই প্রত্যাশা থাকলে চালের দাম তো অবশ্যই বাড়বে। এ কারণে সবাই চেষ্টা করবে চাল ধরে রাখতে। এখন যে বাস্তবতা বিরাজ করছে, তাতে মজুদ করার প্রবণতা তৈরির সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এবং গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে গ্রামে পণ্যমজুদ খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঋণ বেশি গেছে। বিভিন্ন খাতের ঋণ এ মজুদে চলে যেতে পারে। গত কয়েক মাসে শেয়ারবাজারে যেমন নানা জায়গা থেকে টাকা এল, সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গেল, সেখানে একটা বুদ্বুদ তৈরি হওয়ার পর কী দুরবস্থা হয়ে গেল। বর্তমান বাজার-পরিস্থিতি ও প্রত্যাশা অনেককে চাল মজুদ করতে উৎসাহ জোগাতে পারে।
প্রথম আলো এই সরকার আসার প্রথম ছয় মাসে কমতে কমতে ধানের মণ ৩০০-৪০০ টাকা ও চাল ২০ টাকা কেজি হয়ে যায়। তার পর থেকে ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। চালের বাজার এমন চরম আচরণ করছে কেন?
মোস্তফা কামাল মুজেরী যদি এমন হয় সবাই আশায় আশায় চাল ধরে রাখে, তাহলে বোরো ফসল এলে চালের বাজারেও বড় ধরনের দরপতন হতেই পারে। তবে চালের ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারের মতো পরিস্থিতি হবে না। চাল তো একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। চালের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই একটা পর্যায়ে ধরে রাখার চেষ্টা থাকবে।
চালের বাজারে আগের চেয়ে অস্থিরতার মাত্রা অনেক বেশি। দামের গতি-প্রকৃতির ওপর দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, আগে দামের ওঠানামা ছিল মৌসুমি। ধান কাটার পর কমত, মরা মৌসুমে বাড়ত। এখন দামের গ্রাফ দেখলে সেই মৌসুমি চরিত্র আর ততটা পাওয়া যায় না। একটি বৃত্তাকার বিন্যাস হচ্ছে। ২০০৯ সালের মে-জুনের দিকে দাম অনেক কমে গিয়েছিল। তার পর থেকে ক্রমান্বয়ে দাম কমবেশি বেড়েই চলেছে। এর একটা কারণ, আমাদের চালের বাজারের প্রকৃতি মৌসুমি চরিত্র থেকে সরে গিয়ে মজুদ বা ব্যবসায় এর প্রভাব অনেক বেশি পড়ছে।
কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে কবওয়েব তত্ত্বের কথা বলা হয়। কবওয়েব মানে হলো যখন দাম বেশি হতো তখন কৃষকেরা অনেক বেশি উৎপাদন করতেন, পরের মৌসুমে দেখা গেল দাম কমে গেল, তখন কৃষকেরা আর আগ্রহী হতেন না। ফলে আবার দাম বাড়ত। মাকড়সার জালের মতো ওঠানামা হতো। এখন চালের বাজারে কৃষিপণ্যের সেই প্রকৃতি আর নেই। চালের বাজার বা উৎপাদন একটা রূপান্তরকালীন সময়ের মধ্যে আছে, একটা সমন্বয়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। মনে হয়, চালের বাজারের অস্থিরতা খুব তাড়াতাড়ি দূর হবে না।
প্রথম আলো এই রূপান্তরকালীন সময়ে উৎপাদন বা উৎপাদনের খরচ আসলে নির্ধারক ফ্যাক্টর না হয়ে ব্যবসায়ীদের ভূমিকাই নির্ধারক হচ্ছে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী উদাহরণ দিয়ে বলি, আমনের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, সরকার সিদ্ধান্ত নিল, আর চাল কিনবে না বরং আমদানি করবে; যাতে বাজারে চালের পরিমাণ বেশি থাকে। সিদ্ধান্তটা ভালো ছিল। কিন্তু তখন সরকার একটা সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করে দেয় ২৯ টাকায়। এটা সবাই জানে। তার ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সবাই জেনে গেল, সরকার তো ২৯ টাকায় কিনতে রাজি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার কিনল না। এটা নির্ধারণ সরকারের জন্য ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এর ফলে দামের একটা প্রবাহ তৈরি হয়ে গেল।
প্রথম আলো উৎপাদন খরচ যেখানে ২১ টাকা, সেখানে বিক্রি হচ্ছে ৩৭-৪০ টাকায়। এমন লাভের প্রক্রিয়া কি যৌক্তিক?
মোস্তফা কামাল মুজেরী সরকারের ২৯ টাকা আমনের ক্রয়মূল্যের কথাও যদি বলি, তাহলে আমাদের চালের দাম ২৯ বা ৩০ টাকায় বেশি হওয়া উচিত নয়, যেখানে ৪০ টাকা যুক্তিসংগত হয় না। দেশের জনগণের; বিশেষ করে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে চালের বর্তমান মূল্যকে বেশি বলতেই হবে। চালের দাম বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের আয় একইভাবে সমন্বিত করতে পারে না, অর্থাৎ তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
প্রথম আলো দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা বাড়ানো, আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প বাজার অনুসন্ধান, সেটাও তো হচ্ছে। তার পরও তো দাম কমছে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সরকারের করণীয় কী?
মোস্তফা কামাল মুজেরী এ অবস্থায় সরকারের প্রধান করণীয় হলো, চাল গুদামজাত করলে লাভ হবে—এই ধারণার পরিবর্তন। এর একটা উপায় হচ্ছে, সরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়িয়ে দ্রুত বাজারে ছাড়া। সরকার সত্যিকার অর্থেই বাজারে চালের পরিমাণ বাড়াচ্ছে—এই বার্তা সবার কাছে পৌঁছানো দরকার। তাহলে মজুদদারেরা ভাবতে উৎসাহিত হবে, চাল ধরে রেখে আর অতিরিক্ত মুনাফা করা যাবে না।
তা ছাড়া বাজারের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা দরকার। যেমন—আমাদের বাজারের তথ্যব্যবস্থা জোরদার করা, বাজারের গতিশীলতাকে রক্ষা করা এবং বাজারে ন্যায্য লেনদেনের বিধিবিধান থাকা দরকার। বাজারের নিয়মগুলো যদি নিশ্চিত করা যায়, ঠিকমতো নজরদারি করা যায়, তাহলে কেউ অতিরিক্ত মজুদদারি করে বাজার অস্থিতিশীল করার পরিবেশ তৈরি করতে পারবে না।
সরকার যে কাজগুলো করছে, সে বার্তাগুলো যেভাবে যাওয়া দরকার, সেভাবে যাচ্ছে না। শুরু থেকে বলা হচ্ছে টিসিবিকে শক্তিশালী করা হবে, যাতে একে দিয়ে প্রয়োজনে বাজারে হস্তক্ষেপ করানো যায়। এখনো হয়নি সেটা। সরকারের সিদ্ধান্তে একটা দীর্ঘসূত্রতা আছে। ফলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকার তো এ রকম বলেই, কিন্তু কিছু করে না। তাই সরকারকে এখন কাজ করে দেখাতে হবে।
প্রথম আলো চাল ছাড়াও চিনি, ভোজ্যতেল, গম বা দুধের দাম—সবকিছুই বাড়ছে। সেসব খাদ্যপণ্যের ব্যাপারে সরকার আর কী করতে পারে?
মোস্তফা কামাল মুজেরী সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি হস্তক্ষেপকারী ভূমিকা নিতে হবে। সরকারের সামর্থ্য সীমিত, সবকিছু বিশ্ববাজার থেকে এনে অবারিতভাবে ভর্তুকি দিয়ে চালাতে পারবে না। চালের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা গেলে অন্যান্য পণ্যদামেও অস্থিতিশীলতা কমে আসবে। খাদ্যের দাম বাড়লে গরিব জনগোষ্ঠী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকারকে সামর্থ্য অনুযায়ী বাছাই করে ভর্তুকি দিতে হবে।
প্রথম আলো দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আমাদের কী করা উচিত?
মোস্তফা কামাল মুজেরী এ সময়ে এসে আমার মনে হয়, নব্বইয়ের দশকে খাদ্যনিরাপত্তা কৌশলে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। আগে আমরা বলতাম স্বনির্ভরতার কথা। নব্বইয়ে বলা হলো সেলফ রিলায়েন্স অর্থাৎ যদি টাকা থাকে, তাহলে আমদানি করেই চাহিদা মেটাতে পারব, উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর না দিলেও চলে। এখন হয়তো স্বনির্ভরতার ব্যাপারে আমাদের নতুন করে ভাবা দরকার। আমার মনে হয়, চালের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন-পরিস্থিতির দিকে সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে এবং আরও বেশি বাজারবান্ধব হস্তক্ষেপ করতে হবে। বাজার স্থিতিশীল করতে হস্তক্ষেপ করার সামর্থ্য সরকারের থাকতে হবে এবং প্রয়োজনমতো এর ব্যবহার করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তফা কামাল মুজেরী ধন্যবাদ।
No comments