জাতীয় পোশাক-জাতিসত্তার পরিচায়ক হয়ে উঠুক by কামাল লোহানী
জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীতের পর পোশাকটাই তো নির্ধারিত হওয়া উচিত ছিল। ফল, পশু, পাখি, মাছ ইত্যাদির বিষয় নির্ধারিত হয়ে গেছে সেই কবে, সেই প্রথম জমানাতেই। কিন্তু যা দিয়ে চেনা যাবে, বাঙালি বিশ্বের কাছে চিহ্নিত হবে, দর্শনধারী হবে, সেটাই হয়নি আজ পর্যন্ত।
যদিও আমার ব্যক্তিগত বিষয়, তবু রাষ্ট্র জড়িত, তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বিষয়টি উত্থাপন করতে চাই। কারণ যদি সরকার বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে তা কিছুটা চিন্তায় সহায়তা করতে পারবে
মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার একচলি্লশ বছর পেরিয়ে গেল, অথচ বাংলাদেশের মানুষ আজও জাতীয় পোশাক পেল না। জাতীয় পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি জাতীয় সঙ্গীতও। জুটেছে পশু, পাখি এমনকি মাছও। অথচ যে পোশাক পরলে বাংলাদেশের মানুষকে দেখে বিশ্বের সব মানুষ বলতে পারবে এই লোকটি বাংলাদেশের, তেমন কোনো পোশাক জাতীয়ভাবে গৃহীত হয়নি। বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সেমিনার, সম্মেলনে উপস্থিত হলে দেখা যায় নানা দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব জাতীয় পোশাকে সজ্জিত। আনুষ্ঠানিক আয়োজন হলে তাতে জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, সৌদি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যীয় অথবা আফ্রিকার নানা দেশের প্রতিনিধিরা জাতীয় পোশাক পরে থাকেন। এমনকি পাকিস্তান, ভারতও তাদের নিজস্ব পোশাকে উপস্থিত থাকে। অথচ আমরা আজও ব্রিটিশদের পোশাক গায়ে ঘুরে বেড়াই।
এখন তো আমরা পরাধীন নই। বাংলাদেশ বিপুল রক্ত খরচে স্বাধীনতা অর্জন করেছি ওই পাকিস্তানিদের পরাজিত করে, অথচ আজ পর্যন্ত আমরা নিজেদের সংস্কৃতি ও জাতিতত্ত্বের পরিচয় চিহ্ন হিসেবে কোনো জাতীয় পোশাক নির্ধারণ করতে পারিনি। আজও সেই ব্রিটিশ গোলামির কিংবা ইউরোপীয় ছাঁচের 'ড্রেস' পরতেই পছন্দ করি সবাই। নিজেদের পোশাক হিসেবে সহজলভ্য এবং তুলনামূলকভাবে কম খরচের পোশাক পায়জামা ও পাঞ্জাবি এবং স্যান্ডেল শু হতে পারে। তবে শীতকালের জন্য 'চাইনিজ কোট' যাকে বলি, সেটি ব্যবহার করতে পারি। না হলে আমাদের দেশের বরেণ্য শিল্পীদের কাছ থেকে নকশা নিয়ে 'জাতীয় পোশাক' হিসেবে নতুন কিছুও নির্ধারণ করতে পারি। কোনো দলের প্রভাব যেন না পড়ে ওই পোশাকে, কারণ এটা সব মানুষের পরিধেয় হতে হবে। আবার ইদানীং বেশকিছু বছর ধরে পাঞ্জাবির সঙ্গে জিন্সের প্যান্টও ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা জাতীয় পোশাক হিসেবে গৃহীত হবে না। কারণ জিন্স পরে বিশেষ বয়স বা গোত্রের মানুষ। মহিলাদের ব্যাপারে যদি শাড়ি রেখে দেওয়া হয়, সেটাই গ্রহণযোগ্য হবে। তবে জাতীয় পোশাক বললে তার নির্দিষ্ট একটি রঙ ও চরিত্র থাকতে হবে। অবশ্য জাতীয় পোশাক হিসেবে যা-ই নির্ধারিত হোক না কেন, ইচ্ছানুযায়ী যে কেউ যে কোনো ধরনের জামা-কাপড় পরিধান করতে পারবেন। কিন্তু জাতীয় অনুষ্ঠানে বা বিদেশে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করার সময় তা পরিধান করতে পারি। অবশ্যই রুচিসম্মত হতে হবে এবং বাঙালি জাতিসত্তাবিরোধী হওয়া উচিত হবে না।
জাতীয় পোশাক যে কোনো জাতির জন্য গৌরবের। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে একজনকে চেনা যায় তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন। যে কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে এভাবে উপস্থিত হতে পারাটা গৌরবের, জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশের একটি মাধ্যমও বটে। তাই জাতীয় পোশাক থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়, অপরিহার্য। জাতীয় পোশাক নির্ধারণের প্রক্রিয়া কী! বর্তমান মহাজোট সরকার জাতীয় পোশাক নির্ধারণের জন্য ছোট কমিটি গঠন করবে, কমিটি তাদের পরামর্শ অনুযায়ী নকশা বা পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য মন্তব্যসহ প্রস্তাব আকারে সরকারকে দেবে এবং সরকার তাদের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চূড়ান্ত প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবে। আলোচনা হবে। তবে জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীনরা তো থাকবেই, বিরোধী দলকেও থাকতে হবে। বিস্তারিত আলোচনা ও বিবেচনার মাধ্যমে 'জাতীয় পোশাক' সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এটি দ্রুত সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এ সম্পর্কে কেউ কিছুই চিন্তা-ভাবনা করেন না। না হলে জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীতের পর পোশাকটাই তো নির্ধারিত হওয়া উচিত ছিল। ফল, পশু, পাখি, মাছ ইত্যাদির বিষয় নির্ধারিত হয়ে গেছে সেই কবে, সেই প্রথম জমানাতেই। কিন্তু যা দিয়ে চেনা যাবে, বাঙালি বিশ্বের কাছে চিহ্নিত হবে, দর্শনধারী হবে, সেটাই হয়নি আজ পর্যন্ত।
যদিও আমার ব্যক্তিগত বিষয়, তবু রাষ্ট্র জড়িত, তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বিষয়টি উত্থাপন করতে চাই। কারণ যদি সরকার বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে তা কিছুটা চিন্তায় সহায়তা করতে পারবে।
১৯৭৯ সাল সম্ভবত। আফ্রিকার কমনওয়েলথ রাষ্ট্র জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্সিয়াল এনট্যুরেজে একজন পত্রিকা সম্পাদককে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে রাজশাহী থেকে সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকা দৈনিক বার্তার সম্পাদক হিসেবে আমাকে মনোনীত করা হয়েছিল। যথারীতি চিঠি পেলাম। রাজশাহী থেকে ঢাকায় এলাম। বার্তার ঢাকা ব্যুরো প্রধান বন্ধু সলিমুল্লা বলল, তোমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে 'নোট ভার্বাল' এবং পোস্টাল অথরিটি ছাড়াও পরামর্শ শুনে নিতে হবে নানা আনুষ্ঠানিকতাসহ। গেলাম। শুনলাম সবই। ওই বিভাগীয় পরিচালক আমাকে বললেন, লুসাকায় এখন মাঘের শীত, সুতরাং সোয়েটার, গরম চাদর নিয়ে নেবে। আর কিছু প্রয়োজন নেই। অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা ও সব রকম পরামর্শ শুনে ব্যুরো অফিসে ফিরতেই বন্ধু সলিমুল্লা বলল, তুই একবার দাউদ ভাইকে ফোন কর। তিনি তোকে খোঁজ করছিলেন। কোথায় ফোন করতে হবে, বঙ্গভবনের নম্বরটা আমাকে দিল ও। করলাম ফোন কিন্তু পেলাম না। ওরা অফিস থেকে বললেন, তিনি লাঞ্চে গেছেন। সলিমুল্লা বলল, ঢাকা ক্লাবে ফোন কর। এখন ওখানেই পাবি। করলাম। দাউদ খান মজলিস, জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রেস অ্যাডভাইজার। জিয়া তখন রাষ্ট্রপতি। ধরলেন। তবে শুরুতেই গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেলেন। 'কামাল শোন, আমি তো জানি তুমি প্যান্ট পর না, কিন্তু এই এনট্যুরেজে যেতে নাকি সুট পরতে হবে। আমি বলেছি, তবু তুমি একবার মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার সাদেকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে একটু কথা বলে নিও।' নম্বর দিলেন।
বঙ্গভবনে মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার সাহেবের কাছে টেলিফোন করলাম, তিনি ধরলেন। এবারে বলতে শুরু করলেন, 'আপনাকে অবশ্যই সুট পরতে হবে।' আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, দুঃখিত আমি কোনোদিন সুট পরি না। জবাবে তিনি বললেন, কোনো একজন বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিন। আমি হেসে ফেললাম। বললাম, সে কী করে হয়? আমার তো লাগবেও না ঠিকমতো। তা ছাড়া আমার তো শার্ট নেই। জুতাও পরি না। ব্রিগেডিয়ার সাহেব কথার পিঠে কথা বলতে বলতে একসময় বলে বসলেন_ তাহলে লুঙ্গি পরেন না কেন? Why don't you wear Lungi? স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো Yes, I do. But I think your father also do that. বিতর্ক-উত্তেজনার মাত্রা বেড়ে যেতেই তিনি বললেন, Then you wont be allowed to board the plane. . আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,Then I don't go.. শুধু বললাম না, টেলিফোনের রিসিভারটা রেখে দিলাম। পাশে দাঁড়িয়ে আমার শিক্ষয়িত্রী স্ত্রী বাদানুবাদ শুনছিলেন। বললেন, ভালো করেছ। অদ্ভুত attitude তো ভদ্রলোকের। সামরিক বাহিনীর লোক হলেই হুকুম জারি করতে চায়। ও ক্ষমতার দাপট দেখাতে চেয়েছে। ঠিক করেছ, তুমি তোমার জাতিত্ববোধ এবং মানবিকতাকে ওর কাছে সমর্পণ করনি।
এবার আমি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দৈনিক বাংলা পত্রিকার একজন সিনিয়র সহকারী সম্পাদক আহমদ হুমায়ুন, যিনি আমার সহযাত্রী ছিলেন, তাকে ফোনে ব্যাপারটা জানালাম। হুমায়ুন বললেন, লোহানী, এখুনি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন না, একটু অপেক্ষা করুন। আমি তথ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ খানের সঙ্গে কথা বলি। তারপর সিদ্ধান্ত না হয় নেবেন।... কিছুক্ষণ পর হুমায়ুন আমাকে জানালেন, তথ্যমন্ত্রী এসব কিছুই জানেন না। আমরা কে কে যাচ্ছি, তাও জানেন না। যা হোক, হাবিবুল্লাহ খান তথ্যমন্ত্রী ও হুমায়ুনের বোনজামাই হলেও কোনো সমাধান দিতে পারেননি। তখন হুমায়ুন আমাকে বললেন, তাহলে আমিও যাচ্ছি না।... এবার দু'জনে সিদ্ধান্ত নিলাম, টেলিফোন লাইনটা বিচ্ছিন্ন করে রেখে দেব। আমি ফোন লাইনটা অকেজো করে রাখার আগে পিআইডি অর্থাৎ তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টকে জানালাম, ভোররাতে আমি যে গাড়ি চেয়েছিলাম এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য, তার আর প্রয়োজন নেই। অন্য ব্যবস্থা করেছি।...তারপর টেলিফোন লাইনটা বিচ্ছিন্ন করে রেখে দিলাম, যেন কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে ঘরে শুয়ে ঘুমালাম। সম্ভবত পরদিন দৈনিক সংবাদ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, দৈনিক বার্তার সম্পাদককে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি। তিনি ফিরে গেছেন। ... খবরটা সঠিক ছিল না। বন্ধু আউয়াল খান তখন সংবাদের বার্তা সম্পাদক। তিনি উৎসাহ নিয়ে রিপোর্ট করিয়েছিলেন, কিন্তু রিপোর্টার কোনো খবর সংগ্রহ না করেই লিখেছিলেন। আর তথ্য সংগ্রহ করবেনই-বা কেমন করে, আমি তো ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলাম।
যাই হোক, যাওয়া হলো না। পররাষ্ট্র বিষয়ক আমলাতন্ত্র হেরে গেল সামরিক আমলার একজনের কাছে। এদিকে খবর পেলাম, আমার আরেক বন্ধু দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা জহিরুল আলম, বাসসের গোলাম তাহাব্বুর দলের সঙ্গে ছিলেন রিপোর্ট করার জন্য। দেশের খ্যাতিমান সংবাদ পাঠক তাজুল ইসলাম তখন ছিলেন বিমানের জনসংযোগ কর্মাধ্যক্ষ। বিশেষ সম্মানিত অতিথি যাত্রী হলে তাকে ফ্লাইটে থাকতেই হতো। সুতরাং তিনিও ছিলেন। বন্ধু জহির যখন শুনল মিলিটারি সেক্রেটারির সঙ্গে আমার বিতর্কের কথা তখন ও বলেছিল, ভেবেছিলাম পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বিমানবন্দরে যাব। দেখছি প্যান্ট-শার্ট পরেই যেতে হবে।...গিয়েছিল তা-ই। আমার ক্ষোভ ছিল না, কারণ জহির প্যান্ট-শার্টেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু গোলাম তাহাব্বুর এর প্রতিবাদ করে বিমানেই জিয়া সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাজুল ইসলাম তাকে বাধা দেন। রাষ্ট্রপতিকে এখন এ নিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে না। পরে বলতে পারবেন। যাই হোক, ওইভাবেই অসম্পূর্ণ এনট্যুরেজ লুসাকা চলে গিয়েছিল। কিন্তু মজার ঘটনা ঘটল সেখানে। শ্রীলংকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রেমাদাসা দেখা করতে এলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। পরনে তার শ্রীলংকার জাতীয় পোশাক। সাদা কাপড়ের ফতুয়া এবং লুঙ্গি পরা। এ ছবি ছাপা হলো আমাদের দেশের কাগজে। সিপিএর সম্পাদক ফিরে এসে এ নিয়ে কাগজে উপসম্পাদকীয়ও লিখলেন। ভারতের ইংরেজি সংবাদপত্র 'অমৃতবাজার পত্রিকা'য় ÔSARTORIAL PRESTIGEÕ †nwWs w`‡q Box Item হিসেবে ছাপা হলো খবরটি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা আমার সাক্ষাৎকার ও পূর্ণ আলোকচিত্রসহ একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। এসব দেখে জিয়ার মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আমাকে টেলিফোন করে রোজার সময় বলে ইফতারির দাওয়াত দিলেন, আহমদ হুমায়ুন ও গিয়াস কামাল চৌধুরীকেও ডাকলেন।... লুসাকা থেকে ফেরার পর মওদুদ সাহেব রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি কথা বলে একদিন আমাদের নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। ঠিক হলো দিনক্ষণ। হঠাৎ করে দাউদ খান মজলিশ একদিন ফোন করে তারিখটা পাল্টে এক শুক্রবারে ঠিক করলেন, কারণ এ সময়টায় মওদুদ বরিশালে ট্যুরে যাবেন। শুনেছি, এটা তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। কারণ মওদুদ থাকলে দাউদ ভাইয়ের গাফিলতিটা ধরা পড়ে যাবে বলে, দিনটা তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে আমি, হুমায়ুন ও গিয়াস কামাল বঙ্গভবনে গেলাম। প্রথমে দাউদ ভাই ব্রিগেডিয়ার সাদেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তার কামরায়ই বসতে হলো। ব্রিগেডিয়ার আমাকে দেখে মন্তব্য করলেন, you look nice in this dress পিত্তি আমার জ্বলে গেল। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। জবাব তো দিলামই না। অবশেষে এক সময় রাষ্ট্রপতির কামরায় ঢোকার অনুমতি মিলল। তিনি আর্মি কায়দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ম্যাপ দেখছিলেন, ঘুরে বসতে বললেন। শুনলেন সব কাহিনী। তারপর অনেক কথাই হয়েছিল, সেসব বলে লাভ নেই। মোদ্দা কথা, তিনি সেদিন বলেছিলেন, আমি একজন আর্টিস্টকে একটা নকশা করতে বলেছি জাতীয় পোশাকের। বললেন, দেশি এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই জাতীয় পোশাকটি তৈরি করতে হবে।...শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তিনি আবার সাফারি সুট পরতে বলবেন না তো? দুশ্চিন্তা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। জিয়া বললেন,Next time you will go in this dress. হুমায়ুন বাইরে এসে বললেন, লোহানী, এবারে আপনাকেNorth poleÑ উত্তর মেরুতে পাঠানো হবে।...এরপর কোনো মেরুতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আর্টিস্ট কোনো নকশা দিয়েছিল কি-না জানি না, কারণ তখন থেকে ৩৩ বছর হয়ে গেছে কোনো সরকারই জাতীয় পোশাকের ব্যাপারে সিরিয়াস নয় মনে হচ্ছে। বাংলার মানুষের ব্যবহার উপযোগী জাতীয় কোনো পোশাক হলে কি উচ্চবিত্তদের অসুবিধা হবে?
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার একচলি্লশ বছর পেরিয়ে গেল, অথচ বাংলাদেশের মানুষ আজও জাতীয় পোশাক পেল না। জাতীয় পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি জাতীয় সঙ্গীতও। জুটেছে পশু, পাখি এমনকি মাছও। অথচ যে পোশাক পরলে বাংলাদেশের মানুষকে দেখে বিশ্বের সব মানুষ বলতে পারবে এই লোকটি বাংলাদেশের, তেমন কোনো পোশাক জাতীয়ভাবে গৃহীত হয়নি। বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সেমিনার, সম্মেলনে উপস্থিত হলে দেখা যায় নানা দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব জাতীয় পোশাকে সজ্জিত। আনুষ্ঠানিক আয়োজন হলে তাতে জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, সৌদি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যীয় অথবা আফ্রিকার নানা দেশের প্রতিনিধিরা জাতীয় পোশাক পরে থাকেন। এমনকি পাকিস্তান, ভারতও তাদের নিজস্ব পোশাকে উপস্থিত থাকে। অথচ আমরা আজও ব্রিটিশদের পোশাক গায়ে ঘুরে বেড়াই।
এখন তো আমরা পরাধীন নই। বাংলাদেশ বিপুল রক্ত খরচে স্বাধীনতা অর্জন করেছি ওই পাকিস্তানিদের পরাজিত করে, অথচ আজ পর্যন্ত আমরা নিজেদের সংস্কৃতি ও জাতিতত্ত্বের পরিচয় চিহ্ন হিসেবে কোনো জাতীয় পোশাক নির্ধারণ করতে পারিনি। আজও সেই ব্রিটিশ গোলামির কিংবা ইউরোপীয় ছাঁচের 'ড্রেস' পরতেই পছন্দ করি সবাই। নিজেদের পোশাক হিসেবে সহজলভ্য এবং তুলনামূলকভাবে কম খরচের পোশাক পায়জামা ও পাঞ্জাবি এবং স্যান্ডেল শু হতে পারে। তবে শীতকালের জন্য 'চাইনিজ কোট' যাকে বলি, সেটি ব্যবহার করতে পারি। না হলে আমাদের দেশের বরেণ্য শিল্পীদের কাছ থেকে নকশা নিয়ে 'জাতীয় পোশাক' হিসেবে নতুন কিছুও নির্ধারণ করতে পারি। কোনো দলের প্রভাব যেন না পড়ে ওই পোশাকে, কারণ এটা সব মানুষের পরিধেয় হতে হবে। আবার ইদানীং বেশকিছু বছর ধরে পাঞ্জাবির সঙ্গে জিন্সের প্যান্টও ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা জাতীয় পোশাক হিসেবে গৃহীত হবে না। কারণ জিন্স পরে বিশেষ বয়স বা গোত্রের মানুষ। মহিলাদের ব্যাপারে যদি শাড়ি রেখে দেওয়া হয়, সেটাই গ্রহণযোগ্য হবে। তবে জাতীয় পোশাক বললে তার নির্দিষ্ট একটি রঙ ও চরিত্র থাকতে হবে। অবশ্য জাতীয় পোশাক হিসেবে যা-ই নির্ধারিত হোক না কেন, ইচ্ছানুযায়ী যে কেউ যে কোনো ধরনের জামা-কাপড় পরিধান করতে পারবেন। কিন্তু জাতীয় অনুষ্ঠানে বা বিদেশে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করার সময় তা পরিধান করতে পারি। অবশ্যই রুচিসম্মত হতে হবে এবং বাঙালি জাতিসত্তাবিরোধী হওয়া উচিত হবে না।
জাতীয় পোশাক যে কোনো জাতির জন্য গৌরবের। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে একজনকে চেনা যায় তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন। যে কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে এভাবে উপস্থিত হতে পারাটা গৌরবের, জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশের একটি মাধ্যমও বটে। তাই জাতীয় পোশাক থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়, অপরিহার্য। জাতীয় পোশাক নির্ধারণের প্রক্রিয়া কী! বর্তমান মহাজোট সরকার জাতীয় পোশাক নির্ধারণের জন্য ছোট কমিটি গঠন করবে, কমিটি তাদের পরামর্শ অনুযায়ী নকশা বা পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য মন্তব্যসহ প্রস্তাব আকারে সরকারকে দেবে এবং সরকার তাদের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চূড়ান্ত প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবে। আলোচনা হবে। তবে জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীনরা তো থাকবেই, বিরোধী দলকেও থাকতে হবে। বিস্তারিত আলোচনা ও বিবেচনার মাধ্যমে 'জাতীয় পোশাক' সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এটি দ্রুত সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এ সম্পর্কে কেউ কিছুই চিন্তা-ভাবনা করেন না। না হলে জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীতের পর পোশাকটাই তো নির্ধারিত হওয়া উচিত ছিল। ফল, পশু, পাখি, মাছ ইত্যাদির বিষয় নির্ধারিত হয়ে গেছে সেই কবে, সেই প্রথম জমানাতেই। কিন্তু যা দিয়ে চেনা যাবে, বাঙালি বিশ্বের কাছে চিহ্নিত হবে, দর্শনধারী হবে, সেটাই হয়নি আজ পর্যন্ত।
যদিও আমার ব্যক্তিগত বিষয়, তবু রাষ্ট্র জড়িত, তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বিষয়টি উত্থাপন করতে চাই। কারণ যদি সরকার বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে তা কিছুটা চিন্তায় সহায়তা করতে পারবে।
১৯৭৯ সাল সম্ভবত। আফ্রিকার কমনওয়েলথ রাষ্ট্র জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্সিয়াল এনট্যুরেজে একজন পত্রিকা সম্পাদককে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে রাজশাহী থেকে সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকা দৈনিক বার্তার সম্পাদক হিসেবে আমাকে মনোনীত করা হয়েছিল। যথারীতি চিঠি পেলাম। রাজশাহী থেকে ঢাকায় এলাম। বার্তার ঢাকা ব্যুরো প্রধান বন্ধু সলিমুল্লা বলল, তোমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে 'নোট ভার্বাল' এবং পোস্টাল অথরিটি ছাড়াও পরামর্শ শুনে নিতে হবে নানা আনুষ্ঠানিকতাসহ। গেলাম। শুনলাম সবই। ওই বিভাগীয় পরিচালক আমাকে বললেন, লুসাকায় এখন মাঘের শীত, সুতরাং সোয়েটার, গরম চাদর নিয়ে নেবে। আর কিছু প্রয়োজন নেই। অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা ও সব রকম পরামর্শ শুনে ব্যুরো অফিসে ফিরতেই বন্ধু সলিমুল্লা বলল, তুই একবার দাউদ ভাইকে ফোন কর। তিনি তোকে খোঁজ করছিলেন। কোথায় ফোন করতে হবে, বঙ্গভবনের নম্বরটা আমাকে দিল ও। করলাম ফোন কিন্তু পেলাম না। ওরা অফিস থেকে বললেন, তিনি লাঞ্চে গেছেন। সলিমুল্লা বলল, ঢাকা ক্লাবে ফোন কর। এখন ওখানেই পাবি। করলাম। দাউদ খান মজলিস, জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রেস অ্যাডভাইজার। জিয়া তখন রাষ্ট্রপতি। ধরলেন। তবে শুরুতেই গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেলেন। 'কামাল শোন, আমি তো জানি তুমি প্যান্ট পর না, কিন্তু এই এনট্যুরেজে যেতে নাকি সুট পরতে হবে। আমি বলেছি, তবু তুমি একবার মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার সাদেকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে একটু কথা বলে নিও।' নম্বর দিলেন।
বঙ্গভবনে মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার সাহেবের কাছে টেলিফোন করলাম, তিনি ধরলেন। এবারে বলতে শুরু করলেন, 'আপনাকে অবশ্যই সুট পরতে হবে।' আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, দুঃখিত আমি কোনোদিন সুট পরি না। জবাবে তিনি বললেন, কোনো একজন বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিন। আমি হেসে ফেললাম। বললাম, সে কী করে হয়? আমার তো লাগবেও না ঠিকমতো। তা ছাড়া আমার তো শার্ট নেই। জুতাও পরি না। ব্রিগেডিয়ার সাহেব কথার পিঠে কথা বলতে বলতে একসময় বলে বসলেন_ তাহলে লুঙ্গি পরেন না কেন? Why don't you wear Lungi? স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো Yes, I do. But I think your father also do that. বিতর্ক-উত্তেজনার মাত্রা বেড়ে যেতেই তিনি বললেন, Then you wont be allowed to board the plane. . আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,Then I don't go.. শুধু বললাম না, টেলিফোনের রিসিভারটা রেখে দিলাম। পাশে দাঁড়িয়ে আমার শিক্ষয়িত্রী স্ত্রী বাদানুবাদ শুনছিলেন। বললেন, ভালো করেছ। অদ্ভুত attitude তো ভদ্রলোকের। সামরিক বাহিনীর লোক হলেই হুকুম জারি করতে চায়। ও ক্ষমতার দাপট দেখাতে চেয়েছে। ঠিক করেছ, তুমি তোমার জাতিত্ববোধ এবং মানবিকতাকে ওর কাছে সমর্পণ করনি।
এবার আমি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দৈনিক বাংলা পত্রিকার একজন সিনিয়র সহকারী সম্পাদক আহমদ হুমায়ুন, যিনি আমার সহযাত্রী ছিলেন, তাকে ফোনে ব্যাপারটা জানালাম। হুমায়ুন বললেন, লোহানী, এখুনি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন না, একটু অপেক্ষা করুন। আমি তথ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ খানের সঙ্গে কথা বলি। তারপর সিদ্ধান্ত না হয় নেবেন।... কিছুক্ষণ পর হুমায়ুন আমাকে জানালেন, তথ্যমন্ত্রী এসব কিছুই জানেন না। আমরা কে কে যাচ্ছি, তাও জানেন না। যা হোক, হাবিবুল্লাহ খান তথ্যমন্ত্রী ও হুমায়ুনের বোনজামাই হলেও কোনো সমাধান দিতে পারেননি। তখন হুমায়ুন আমাকে বললেন, তাহলে আমিও যাচ্ছি না।... এবার দু'জনে সিদ্ধান্ত নিলাম, টেলিফোন লাইনটা বিচ্ছিন্ন করে রেখে দেব। আমি ফোন লাইনটা অকেজো করে রাখার আগে পিআইডি অর্থাৎ তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টকে জানালাম, ভোররাতে আমি যে গাড়ি চেয়েছিলাম এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য, তার আর প্রয়োজন নেই। অন্য ব্যবস্থা করেছি।...তারপর টেলিফোন লাইনটা বিচ্ছিন্ন করে রেখে দিলাম, যেন কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে ঘরে শুয়ে ঘুমালাম। সম্ভবত পরদিন দৈনিক সংবাদ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, দৈনিক বার্তার সম্পাদককে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি। তিনি ফিরে গেছেন। ... খবরটা সঠিক ছিল না। বন্ধু আউয়াল খান তখন সংবাদের বার্তা সম্পাদক। তিনি উৎসাহ নিয়ে রিপোর্ট করিয়েছিলেন, কিন্তু রিপোর্টার কোনো খবর সংগ্রহ না করেই লিখেছিলেন। আর তথ্য সংগ্রহ করবেনই-বা কেমন করে, আমি তো ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলাম।
যাই হোক, যাওয়া হলো না। পররাষ্ট্র বিষয়ক আমলাতন্ত্র হেরে গেল সামরিক আমলার একজনের কাছে। এদিকে খবর পেলাম, আমার আরেক বন্ধু দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা জহিরুল আলম, বাসসের গোলাম তাহাব্বুর দলের সঙ্গে ছিলেন রিপোর্ট করার জন্য। দেশের খ্যাতিমান সংবাদ পাঠক তাজুল ইসলাম তখন ছিলেন বিমানের জনসংযোগ কর্মাধ্যক্ষ। বিশেষ সম্মানিত অতিথি যাত্রী হলে তাকে ফ্লাইটে থাকতেই হতো। সুতরাং তিনিও ছিলেন। বন্ধু জহির যখন শুনল মিলিটারি সেক্রেটারির সঙ্গে আমার বিতর্কের কথা তখন ও বলেছিল, ভেবেছিলাম পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বিমানবন্দরে যাব। দেখছি প্যান্ট-শার্ট পরেই যেতে হবে।...গিয়েছিল তা-ই। আমার ক্ষোভ ছিল না, কারণ জহির প্যান্ট-শার্টেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু গোলাম তাহাব্বুর এর প্রতিবাদ করে বিমানেই জিয়া সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাজুল ইসলাম তাকে বাধা দেন। রাষ্ট্রপতিকে এখন এ নিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে না। পরে বলতে পারবেন। যাই হোক, ওইভাবেই অসম্পূর্ণ এনট্যুরেজ লুসাকা চলে গিয়েছিল। কিন্তু মজার ঘটনা ঘটল সেখানে। শ্রীলংকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রেমাদাসা দেখা করতে এলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। পরনে তার শ্রীলংকার জাতীয় পোশাক। সাদা কাপড়ের ফতুয়া এবং লুঙ্গি পরা। এ ছবি ছাপা হলো আমাদের দেশের কাগজে। সিপিএর সম্পাদক ফিরে এসে এ নিয়ে কাগজে উপসম্পাদকীয়ও লিখলেন। ভারতের ইংরেজি সংবাদপত্র 'অমৃতবাজার পত্রিকা'য় ÔSARTORIAL PRESTIGEÕ †nwWs w`‡q Box Item হিসেবে ছাপা হলো খবরটি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা আমার সাক্ষাৎকার ও পূর্ণ আলোকচিত্রসহ একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। এসব দেখে জিয়ার মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আমাকে টেলিফোন করে রোজার সময় বলে ইফতারির দাওয়াত দিলেন, আহমদ হুমায়ুন ও গিয়াস কামাল চৌধুরীকেও ডাকলেন।... লুসাকা থেকে ফেরার পর মওদুদ সাহেব রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি কথা বলে একদিন আমাদের নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। ঠিক হলো দিনক্ষণ। হঠাৎ করে দাউদ খান মজলিশ একদিন ফোন করে তারিখটা পাল্টে এক শুক্রবারে ঠিক করলেন, কারণ এ সময়টায় মওদুদ বরিশালে ট্যুরে যাবেন। শুনেছি, এটা তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল। কারণ মওদুদ থাকলে দাউদ ভাইয়ের গাফিলতিটা ধরা পড়ে যাবে বলে, দিনটা তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে আমি, হুমায়ুন ও গিয়াস কামাল বঙ্গভবনে গেলাম। প্রথমে দাউদ ভাই ব্রিগেডিয়ার সাদেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তার কামরায়ই বসতে হলো। ব্রিগেডিয়ার আমাকে দেখে মন্তব্য করলেন, you look nice in this dress পিত্তি আমার জ্বলে গেল। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। জবাব তো দিলামই না। অবশেষে এক সময় রাষ্ট্রপতির কামরায় ঢোকার অনুমতি মিলল। তিনি আর্মি কায়দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ম্যাপ দেখছিলেন, ঘুরে বসতে বললেন। শুনলেন সব কাহিনী। তারপর অনেক কথাই হয়েছিল, সেসব বলে লাভ নেই। মোদ্দা কথা, তিনি সেদিন বলেছিলেন, আমি একজন আর্টিস্টকে একটা নকশা করতে বলেছি জাতীয় পোশাকের। বললেন, দেশি এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই জাতীয় পোশাকটি তৈরি করতে হবে।...শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তিনি আবার সাফারি সুট পরতে বলবেন না তো? দুশ্চিন্তা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। জিয়া বললেন,Next time you will go in this dress. হুমায়ুন বাইরে এসে বললেন, লোহানী, এবারে আপনাকেNorth poleÑ উত্তর মেরুতে পাঠানো হবে।...এরপর কোনো মেরুতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আর্টিস্ট কোনো নকশা দিয়েছিল কি-না জানি না, কারণ তখন থেকে ৩৩ বছর হয়ে গেছে কোনো সরকারই জাতীয় পোশাকের ব্যাপারে সিরিয়াস নয় মনে হচ্ছে। বাংলার মানুষের ব্যবহার উপযোগী জাতীয় কোনো পোশাক হলে কি উচ্চবিত্তদের অসুবিধা হবে?
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments