ভিন্নমত-মানুষকে কিসে সুখী করে? by আবু আহমেদ
আমেরিকানরা সুখ খুঁজতে দেশ ভ্রমণে বের হয়, তাদের ভ্রমণ লক্ষ্যের মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোও আছে। তারা তাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা করার জন্য হংকং, ম্যানিলা এবং ভারতের কেরালায়ও যায়। কেন তারা তাদের দেশের এত বিখ্যাত বিখ্যাত হাসপাতালের চিকিৎসাকে এড়িয়ে প্রাকৃতিক চিকিৎসার পেছনে ছুটছে? অধিকাংশ লোকই ভাবেন, অর্থ-কড়ি হলো সুখের আসল উপাদান।
এই ভাবনা যে কত বড় ভুল, তা তারা জানতে পারবেন অর্থ-কড়ি অনেক আছে এমন লোকদের জিজ্ঞেস করলে। বিশ্বে সুখের সূচক যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে আয়, আইনশৃঙ্খলা তথা নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সুখের আরেক বড় উপাদান প্রায়-দরিদ্র থাকা; এটা বোধ করি ওদের মাপের মধ্যে আনা হয়নি। আমাদের পাশের এক জ্ঞানী লোক প্রায়ই বলতেন, Poority is blessing, মানে দারিদ্র্য হলো আশীর্বাদ। তিনি কিন্তু ধনী লোক এবং উঁচু পদের লোক ছিলেন। তাঁর কথা শুনে মনে হতো, তিনি দরিদ্র হতে চাইছেন, নইলে কমপক্ষে দরিদ্রের মতো জীবনযাপন করতে চাইছেন। তিনি দেখিয়ে দিতেন, ওই যে কুঁড়েঘরের মতো ঘরটাতে দেখো একটা লোক গভীর ঘুমে অচেতন অবস্থায় আছে। কেউ তাকে জাগিয়ে দিলেই সে কেবল উঠবে। নতুবা সন্ধ্যা হয়ে যাবে, তবুও সে ঘুমেই থাকবে। আর আমাদের কথা চিন্তা করে দেখো! গত পাঁচ বছরে ঘুম নিয়ে অনবরত যুদ্ধ করছি, ঘুম আসে, ঘুম যায়, ঘুম বলতে যো বোঝায় সেই ঘুম আমার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। অথচ ওই লোকের বয়স আর আমার বয়স প্রায়ই সমান। তাহলে তোমরাই বলো, কে সুখী? আমার অনেক টাকা-পয়সা আছে, পদ ছিল বা এখনো আছে। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, কিন্তু ঘুমের জন্য ট্যাবলেট খেতে হয়, আর খাওয়াদাওয়ার মধ্যেও বাছ-বিচার করে খেতে হয়। আর ওই লোকটা ডাক্তারের কাছেও যায় না। যে রোজগার তা দিয়ে সে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভালোই ছিল, এখনো আছে। তার বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, আছে কুঁড়েঘর, ছোট্ট দুটো চৌকি, কিন্তু সে আরামে খায়, আরামে ঘুমায়। তার সুখের মূলে তোমরা যে অবস্থাকে বলো দরিদ্র, তাই নয় কি? প্রতিবেশী সেই জ্ঞানী লোকটা এও বললেন, গ্রামে গিয়ে দেখো, লোকে গল্প করছে, সামান্য ডাল-ভাত খাচ্ছে। কিন্তু ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ছে। আর উঠছে সেই সুবহে সাদিকের আজানের আগে। তাদের সঙ্গে তুলনা করো এই ঢাকা শহরের ধনী লোকদের জীবনযাপনের অবস্থাকে। সুখের সূচকে এরা অনেক নিচে আছে। তবে সত্য হলো, এই ধনী লোকগুলো তাদের নির্মিত দোজখ থেকে বের হতে পারবে না। পারবে মাত্র কিছুসংখ্যক, যারা প্রাচুর্য ত্যাগ করতে পেরেছে। এই ধনী লোকরা একটা ভুলের পর আর একটা ভুলের মধ্যে প্রবেশ করবে। এভাবে প্রবেশ করতে করতে কোনো নামিদামি হাসপাতালের বেডে তাদের শেষ জীবন কেটে যায়। আর ওই যে দরিদ্র লোকগুলো, তারাও প্রায় সমসময় বাঁচে, মরার সময়ও হঠাৎ মরে যায়। ওই মরণ কি উত্তম নয়? আবদুর রহমান সাহেবের ওসব কথার পূর্ণ অর্থ বয়স পূর্ণভাবে বৃদ্ধির আগে বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝেছি। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যে জীবন, সেই জীবনই মনে হয় সুখের। ডাক্তার-হাসপাতাল এসব তো আছে ওষুধ বিক্রি এবং বিল বানানোর জন্য। ডাক্তার-হাসপাতাল যদি মানুষকে সুস্থ করতে পারত, তাহলে আমেরিকানরা স্বদেশ ছেড়ে বাইরের সুখ দেখতে আসত না। মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে। এখন যতই সুখের সন্ধান করুক না কেন, প্রকৃতি তাদের শাস্তি দেবেই। আজকে মানুষের ভয়ে অন্য প্রাণীরা কম্পমান। তাদের আশ্রয়স্থলগুলোকে মানুষ একে একে দখল করে নিয়েছে। তারা হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে এই পৃথিবী থেকে। তাহলে মানুষকে নিজ হাতে নিজেদের জন্য দুর্গতি ডেকে আনছে। সামনে অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে। প্রাকৃতিক নিয়মেই মানুষ শুধু শাস্তি পেতে থাকবে। যত আবিষ্কারই হোক প্রকৃতি তাকে অন্যভাবে ফাঁদে ফেলে দেবেই। অন্য একটি কথা বলা ভালো। শুধু খাই খাই জীবন মানুষকে কখনো সুখী করতে পারে না। যে মানুষের মধ্যে এই বোধ না থাকে যে তাকে এক মহান সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন ও যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর কাছেই জবাবদিহি করতে হবে এবং তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে- সেই ধরনের মানুষ সুখ চেয়ে সুখ পাবে এটা বিশ্বাস হয় না। সৃষ্টিকর্তার ওপর যার আস্থা নেই সে কোনো সীমার মধ্যে থাকার প্রয়োজন অনুভব করে না এবং এসব লোক নিজেদের জন্য যেমন নরক তৈরিতে ব্যস্ত, অন্যদিকে সমাজকেও ওই দিকে নিতে প্রতিনিয়ত সচেষ্ট। কিন্তু সত্য হলো, এরা যে ভুলের মধ্যে আছে সেটাও তারা বোঝে না।
বাংলাদেশের মানুষের আয় বাড়ছে, কিন্তু সুখ কমে যাচ্ছে। কেন? উত্তর হলো, সুখের অন্য উপাদানগুলো এই সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আগের প্রকৃতি কি এখন আছে? নদী-জঙ্গল-প্রান্তর- এসব মিলেই তো সেই প্রকৃতি ছিল। এখন নদী নেই, থাকলেও শুকনো, জঙ্গল কেটে লোকে ধানের ক্ষেত করছে, নতুবা শিল্পপতিরা শিল্প স্থাপনের নামে সেই জঙ্গল ধ্বংস করছেন। আর বিস্তৃত প্রান্তর সে তো জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অনেক আগেই ইতি হয়ে গেছে। গ্রামের বা ছোট শহরের সেই দিঘি নামের জলাশয়গুলো কি আছে? আপনি-আমি কোথায় গিয়ে প্রকৃতিতে মিশে সাঁতার কাটব? সুখের অন্য সব উপাদান বাংলাদেশে অতিদ্রুত নিঃশেষ হচ্ছে। সেটাও কি সবাই দেখছে?
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের মানুষের আয় বাড়ছে, কিন্তু সুখ কমে যাচ্ছে। কেন? উত্তর হলো, সুখের অন্য উপাদানগুলো এই সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আগের প্রকৃতি কি এখন আছে? নদী-জঙ্গল-প্রান্তর- এসব মিলেই তো সেই প্রকৃতি ছিল। এখন নদী নেই, থাকলেও শুকনো, জঙ্গল কেটে লোকে ধানের ক্ষেত করছে, নতুবা শিল্পপতিরা শিল্প স্থাপনের নামে সেই জঙ্গল ধ্বংস করছেন। আর বিস্তৃত প্রান্তর সে তো জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অনেক আগেই ইতি হয়ে গেছে। গ্রামের বা ছোট শহরের সেই দিঘি নামের জলাশয়গুলো কি আছে? আপনি-আমি কোথায় গিয়ে প্রকৃতিতে মিশে সাঁতার কাটব? সুখের অন্য সব উপাদান বাংলাদেশে অতিদ্রুত নিঃশেষ হচ্ছে। সেটাও কি সবাই দেখছে?
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments