জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ-জন্মহার কমেছে, বুকের দুধ খাওয়ানো বেড়েছে

জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এখন দেশে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর) বা মহিলাপ্রতি গড় সন্তানসংখ্যা ২ দশমিক ৩। অন্যদিকে দেশের চারটি বিভাগ প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হার অর্জন করেছে। অর্থাৎ নারীদের সন্তান জন্মদানের গড় হার কমে হয়েছে ২ দশমিক ২।


সর্বশেষ এই জরিপে বলা হয়েছে, ৩২ শতাংশ প্রসব হচ্ছে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তায়। জন্মের পর প্রথম ছয় মাসে শিশুর শুধু মায়ের দুধ খাওয়ার হার অনেক বেড়েছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। তবে এখনো প্রতি ১০ জনের মধ্যে চারজন শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ-২০১১ (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে—বিডিএইচএস)-এর প্রাথমিক ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ইউএসএআইডির আর্থিক সহায়তায় এর আগেও পাঁচটি জরিপ করেছে নিপোর্ট। নিপোর্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক সুব্রত কে ভদ্র প্রথম উপস্থাপনায় বলেন, সারা দেশের ৬০০ জরিপ এলাকায় (শহর ২০৭ ও গ্রাম ৩৯৩) ১৮ হাজার খানা থেকে তথ্য নেওয়া হয়। জরিপে ৫০ বছরের কম বয়সী ১৭ হাজার ৮০০ জন মহিলা এবং ১৫-৫৪ বছর বয়সী প্রায় চার হাজার বিবাহিত পুরুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইসিএফ-ইন্টারন্যাশনালের কারিগরি সহায়তায় মিত্র অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস মাঠ পর্যায়ে ২০১১ সালের ৮ জুলাই থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে। শেষ জরিপ হয়েছিল ২০০৭ সালে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেন, দুই দশকে বাংলাদেশে প্রজনন হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং খুব শিগগির তা প্রতিস্থাপন মাত্রা অর্জন করতে পারে। তিনি বলেন, ‘এসব অর্জন অত্যন্ত হূদয়গ্রাহী এবং এ জন্য আমি বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে অভিনন্দন জানাই।’
পরিবার পরিকল্পনা: জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে পরিবারের আকার ছোট হয়ে আসছে। বর্তমানে একজন নারী তাঁর প্রজনন বয়সে ২ দশমিক ৩টি শিশুর জন্ম দিচ্ছে। ১৯৭৫ সালে মহিলাপিছু গড় সন্তানসংখ্যা (টিএফআর) ছিল ৬ দশমিক ৩।
জরিপে বলা হচ্ছে, দেশের সব বিভাগে টিএফআর কমে এসেছে। খুলনা (১.৯), রাজশাহী (২.১), রংপুর (২.১) ও ঢাকা (২.২) প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হার (একজন মা তাঁর প্রজনন বয়সে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেবেন) অর্জন করেছে। দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ বাস করে এই চার বিভাগে। টিএফআর সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে (৩.১)।
জরিপে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জন নারী (৬১ শতাংশ) পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করেন। সিলেট বিভাগে এই হার সবচেয়ে কম (৪৫ শতাংশ) আর সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগে (৬৯ শতাংশ)।
জরিপের এই অংশ উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পরিচালক (সিপিইউসিসি) পিটার কিম স্ট্রিটফিল্ড। তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে ইচ্ছুক কিন্তু তা সময়মতো পান না, এ রকম নারীর সংখ্যা কমে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০০৭ সালে ছিল ১৭ শতাংশ। বর্তমানে এই হার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ শতাংশ।
কিম স্ট্রিটফিল্ড বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩৫ বছর ধরে প্রজনন হার কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের জনসংখ্যার সঙ্গে আর তিন কোটি মানুষ কম যোগ হয়েছে। দেড় কোটি জন্ম ও ৩০ হাজার মায়ের মৃত্যু ঠেকানো গেছে।
মাতৃস্বাস্থ্য: সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের চিফ অব পার্টি ইশতিয়াক মান্নান তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক মা প্রসব-পূর্ব, প্রসবকালে এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা পাচ্ছেন। বর্তমানে ৩২ শতাংশ মা প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান। ২০০৭ সালে এই হার ছিল ২১ শতাংশ।
জরিপে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় অর্ধেকের বেশি (৫৪ শতাংশ) মা প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান। গ্রামে এই হার ২৫ শতাংশ। ইশতিয়াক মান্নান বলেন, ২০১৬ সালের মধ্যে এই হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হলে গ্রামাঞ্চলে সেবা সম্প্রসারণ করতে হবে।
জরিপে দেখা গেছে, সারা দেশে ১৭ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। বেসরকারি হাসপাতালে যত প্রসব হয় তার ৭৩ শতাংশ অস্ত্রোপচারে। একে আশঙ্কাজনক বলেন ইশতিয়াক মান্নান।
শিশুস্বাস্থ্য: জরিপে দেখা গেছে, গত চার বছরে জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো ২১ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে ৬৪ শতাংশ শিশু জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খায়। ২০০৭ সালের জরিপে তা ছিল ৪৩ শতাংশ। পূর্ববর্তী জরিপেও এই হার মোটামুটি একই ছিল। জরিপের এই অংশ উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির পরিচালক (সিসিএইউচ) শামস এল আরেফিন।
বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এস কে রায় অনুষ্ঠানে বলেন, শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানের পক্ষে প্রচার এবং সরকার, এনজিও ও দাতাদের নানা উদ্যোগের কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।
স্বাস্থ্যসচিব মো. হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.