উইকিলিকসে বাংলাদেশ-র‌্যাবের জনপ্রিয়তা বনাম মানবাধিকারের মরীচিকা by মশিউল আলম

মানবাধিকার-সচেতন যেসব নাগরিক দাবি করেন, অপরাধ দমন করতে হবে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে, তাঁরা স্বীকার করুন বা না করুন, বাংলাদেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) একটি জনপ্রিয় বাহিনী।
র‌্যাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে বা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখির পাঠক-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলে র‌্যাবের জনপ্রিয়তা টের পেতে অসুবিধা হয় না।


বস্তুত, ২০০৪ সালের জুন থেকে কাজ শুরু করে এক বছরের মধ্যে র‌্যাব এমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পরের বছর ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সদর দপ্তরে পাঠানো এক গোপন তারবার্তায় র‌্যাবের জনপ্রিয়তাকে ‘প্রশ্নাতীত’ (আনকোয়েশ্চান্ড) বলে মন্তব্য করা হয়। ২০০৫ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ শামাসের লেখা ‘র‌্যাবের বর্ষপূর্তি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক ওই তারবার্তায় মন্তব্য করা হয়, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী দুর্নীতিগ্রস্ত এবং রাজনীতিকরণের শিকার—এমন পটভূমিতে ‘প্রকৃত’ অপরাধীদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সক্রিয় তৎপরতার ফলে এ বাহিনীর জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
তবে, এমন আশঙ্কাও কেউ কেউ ব্যক্ত করেছিলেন যে র‌্যাবেরও রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে র‌্যাব। সে সময়ের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তুলেছিল, র‌্যাব তাদের নেতা-কর্মীদের পিছু লেগেছে। এগুলো উল্লেখ করে জুডিথ শামাস তাঁর ওই তারবার্তায় লিখেছিলেন, এসব আশঙ্কা-অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁর মনে হয়, ‘র‌্যাবের মনোযোগের মূল কেন্দ্রে রয়েছে এমন কুখ্যাত অপরাধীরাই, যাদের নানা ভয়ংকর অপরাধের দীর্ঘ ইতিহাস আছে।’
তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতা-কর্মীদের একাংশের মধ্যেও এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল যে তাঁরা যখন ক্ষমতায় থাকবেন না, তখন তাঁদের মধ্যকার দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী-অপরাধীরা র‌্যাবের হাত থেকে রক্ষা পাবেন কীভাবে। জুডিথ শামাস ওই তারবার্তার এক জায়গায় লিখেছেন, সরকারের একজন মন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, তাঁর দলের কিছু নেতা-কর্মী চান, তাঁদের সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আগে যেন র‌্যাব ভেঙে দেওয়া হয়। কারণ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় র‌্যাব থাকলে তাঁরা র‌্যাবের হাতে মারা পড়বেন।

‘ক্রসফায়ার’ অথবা ‘বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড’
র‌্যাবের জনপ্রিয়তা ও সমালোচনার প্রধান কারণ তথাকথিত ‘ক্রসফায়ার’। জুডিথ শামাসের ওই তারবার্তায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের দুর্বল আইন প্রয়োগ কাঠামোতে বিতর্কিত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন একটি জনপ্রিয় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে অপরাধ দমনে প্রধানত ‘ক্রসফায়ার’নির্ভর পদক্ষেপের ফলপ্রসূতার কারণে।’ তারবার্তাটিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৪ সালের জুন থেকে ২০০৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ক্রসফায়ারে ১১৭ জন সন্দেহভাজন অপরাধীকে হত্যা করেছে র‌্যাব। ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর জুডিথ শামাসের লেখা আরেকটি গোপন তারবার্তা থেকে জানা যায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তাঁকে বলেন যে ২০০৫ সালে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১৪৮ ব্যক্তি।
২৩ আগস্টের তারবার্তায় ক্রসফায়ারকে বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড (এক্সট্রা-জুডিশিয়াল এক্সেকিউশান) বলে বর্ণনা করে লেখা হয়েছে: ‘আটক ও সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সদস্যরা এই পদক্ষেপ [ক্রসফায়ার] গ্রহণ করেন এবং এর ফলে রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বলা হয়। প্রতিটি ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে ঘটনার যে বিবরণ দেওয়া হয় তা সর্বদা বস্তুত একই রকম: আটককৃত সন্দেহভাজন অপরাধী যখন র‌্যাবের সদস্যদের অবৈধ অস্ত্রের গোপন মজুদ বা তার সহযোগী অপরাধীদের গোপন আস্তানায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, তখন অপরাধীচক্র ও র‌্যাব সদস্যদের মধ্যে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ, যার মাঝখানে পড়ে আটককৃত ও র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গেকার সন্দেহভাজন অপরাধীটি প্রাণ হারায়।’
যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে এসব মৃত্যুর ব্যাখ্যা চেয়েছে। ২০০৫ সালের ৬ জুন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের লেখা একটি তারবার্তা থেকে জানা যাচ্ছে, ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁদের সব সময় ছকবাঁধা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল চৌধুরী ফজলুল বারীর সঙ্গে মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের বৈঠকের বরাত দিয়ে হ্যারি কে টমাস লিখেছেন, বারী তাঁদের বলেন যে র‌্যাবের সদস্যদের প্রতি অপরাধীরা গুলি ছুড়লে তাঁদের জন্য এটাই স্বাভাবিক যে তাঁরাও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালাবেন। এভাবেই ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে। কিন্তু দূতাবাসের কর্মকর্তারা যখন ফজলুল বারীকে জিজ্ঞাসা করেন, সব ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রায় একই রকমের কেন? তখন তিনি এর কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে বলেন, র‌্যাব ‘চিহ্নিত’ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, এটা জনগণ পছন্দও করে, কারণ এর ফলে জনজীবনে স্বস্তি নেমে এসেছে। বারী বলেন, ‘আমরা গরিব, তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ, আমাদের লোকসংখ্যা ১৪ কোটি; এ রকম অবস্থায় ১০০-২০০ লোক কি কোনো বিষয়?’

নীতিগত সিদ্ধান্ত
ক্রসফায়ার র‌্যাবের স্বাধীন ইচ্ছায় ঘটে না। এ-বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তটি নিয়েছে সরকার; র‌্যাব পরিচালিত হয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ২০০৫ সালের ৬ জুনের তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস লিখেছেন, ‘এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো যে নীতিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ঘটছে, তা অস্বীকার করার তেমন কোনো চেষ্টা সরকারের ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতারা যেমন করেন না, তেমনই তিনিও [র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক চৌধুরী ফজলুল বারী] করলেন না, বরং তিনি ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডগুলোকে জরুরি প্রয়োজনীয়, স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে জায়েজ করার বিশদ চেষ্টা করলেন।’
জুডিথ শামাস ২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের তারবার্তায় লিখেছেন, ‘র‌্যাবের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকারের নেতারা ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে কুখ্যাত অপরাধীদের দমন করার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ ও জনপ্রিয় পদক্ষেপ বলে সমর্থন করে সেগুলোকে সংগত বলে দাবি করে এসেছেন। র‌্যাব আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ক্রসফায়ার চালায় অথবা ক্রসফায়ারের শিকার ব্যক্তিরা এমন অপরাধী যাদের ওই পরিণতিই প্রাপ্য—সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে যাঁরা আমাদের এ ধরনের কথা বলেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন প্রধানমন্ত্রী [খালেদা জিয়া], স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী [বাবর], আইনমন্ত্রী [মওদুদ আহমদ] ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী [মোরশেদ খান]। আইনমন্ত্রী [মওদুদ আহমদ] আমাদের বলেন, দীর্ঘকাল ধরে অপরাধবৃত্তির শিকার হয়ে আসছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, তাদের অধিকারের কাছে অল্প কিছুসংখ্যক অপরাধীর অধিকার পরাস্ত হওয়া উচিত।’
জুডিথ শামাস লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশ জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১০০ জন প্রবেশক পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার সামনে বক্তৃতাকালে র‌্যাব ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে, ওই নবীন সরকারি কর্মকর্তারা তাঁর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করার বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানান। একজন বলেন, ‘জাতির মঙ্গলের স্বার্থে’ এবং ‘সমাজের দুর্বলতা’ দূর করার লক্ষ্যে সরকার এই সিদ্ধান্ত [র‌্যাবকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়ার] নিয়েছে।

মানবাধিকারের মরীচিকা
মানবাধিকার বলতে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ যা বোঝে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সম্ভবত তা বোঝে না। যাঁর আমলে র‌্যাব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর একবার সংবাদমাধ্যমে অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘অপরাধীরা যখন এনকাউন্টারে নিহত হয় তখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার প্রতিবাদ করে। কিন্তু যখন পুলিশের সদস্যরা অপরাধীদের হাতে নিহত হয়, তখন কেউ মানবাধিকারের কথা বলে না।’
এই কথার মধ্যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মানবাধিকার সম্পর্কে সাধারণ ধারণার প্রতিধ্বনি আছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী, যে পাঁচ-দশটা খুন করেছে, যার নামে থানায় দশ-পনেরটা মামলা আছে, পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বা আদালত থেকে জামিন নিয়ে হাজত থেকে বেরিয়ে এসে যে আবার মানুষ খুন করে, র‌্যাব তাকে গুলি করে মারলে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বোঝে না।
তাই তারা ক্রসফায়ার সমর্থন করে। তাই র‌্যাব জনপ্রিয়। আর র‌্যাব যে জনপ্রিয়, তা র‌্যাবের সদস্যরা বিলক্ষণ জানেন। তাঁদের জন্য মুশকিল দেখা দেয় কেবল তখনই, যখন ক্রসফায়ারে ভুলক্রমে কোনো নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ মারা পড়ে। তাই প্রতিটি ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে নিহত ব্যক্তিকে অপরাধী-সন্ত্রাসী প্রমাণ করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। সেই চেষ্টা যখন বিশ্বাসযোগ্য হয় না, তখন র‌্যাব সত্যিই বেশ মুশকিলে পড়ে যায়। একটি দৃষ্টান্ত ঝালকাঠির কিশোর লিমন; তাকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে র‌্যাব সফল হয়নি। যাঁরা লিমনকে গুলি করে পঙ্গু করার জন্য র‌্যাব সদস্যদের বিচার দাবি করেছেন, তাঁরা সব সময় জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, লিমন নিরীহ কিশোর, সন্ত্রাসী নয়। অর্থাৎ লিমন যদি সত্যিই সন্ত্রাসী হতো, তাহলে তাকে গুলি করার দায়ে র‌্যাব সমালোচনার মুখে পড়ত না।
এভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মানবাধিকারের দাবি সীমাবদ্ধ রয়েছে কেবল নিরীহ নিরপরাধ মানুষের গুলিবিদ্ধ না হওয়ার অধিকারের মধ্যে। খুনি, সন্ত্রাসী, ডাকাতসহ অপরাধবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মানবাধিকারের ধারণা বাস্তবিক এক মরীচিকা; এই মরীচিকা দেখছেন শুধু মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, সুশীল-বুদ্ধিজীবী সমাজের ক্ষুদ্র একটি অংশ। তবে এই ক্ষুদ্র অংশের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা যখন শোরগোল করেন, তখন দেশে-বিদেশে সাড়া পড়ে যায়। বিদেশি দাতা বা উন্নয়ন-সহযোগীরা প্রশ্ন তোলে, সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চায়। তখন সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়; সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে পারে না যে বিচারের আগেই অপরাধীদের হত্যা করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি ‘ক্রসফায়ারজনিত’ মৃত্যুর ঘটনা একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে তদন্ত করানো হয়। সব তদন্তের ফল অভিন্ন: এ পর্যন্ত যতগুলো ক্রসফায়ার ঘটেছে, সবগুলোকেই আইনগতভাবে বৈধ বলা হয়েছে। র‌্যাব ও সরকারের খাতায় ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.