কবি, কবিতা, রাজনীতি by হায়দার আকবর খান রনো
গত ২৫ জানুয়ারি আমার দেশ’র সম্পাদকীয় পাতায় সাংবাদিক আতাউস সামাদ এক নিবন্ধে লিখেছেন, “শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী বিধায় বক্তৃতা রচনায় ও লিখনে এবং সম্পাদনায় তিনি সহকারীদের সহায়তা পেয়ে থাকেন বলে অনুমান করি।
আজকাল সন্দেহ করার কারণ ঘটছে যে, তিনি তার সেই সহকারীদের কাছ থেকে সঠিক সেবা পাচ্ছেন কি-না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারতে সরকারি সফর করে দেশে ফিরে সে সম্পর্কে তার মূল্যায়ন জানানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন করছিলেন।... এক সমন্তব্য প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারত অবলম্বনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করেন, যা ছিল ওই মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র দুর্যোধনের জবানিতে। সেখানে দুর্যোধন বলছেন, তিনি সুখ চাননি, জয় চেয়েছিলেন এবং সেই জয় তিনি পেয়েছিলেন।” আতাউস সামাদ এরপর যে মন্তব্য করেছেন তার সঙ্গে একমত হয়েই পুনরুক্তি মনে হলেও আমিও কয়েকটি কথা বলতে চাই।রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা রাষ্ট্রনায়কদের যে সব বিষয়ে পাণ্ডিত্য থাকবে, এমনটা আশা করা যায় না। তবে রাষ্ট্রনায়কদের জানতে হবে, কোন বিষয়ে কার পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের দেশের দুই নেত্রী—বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে সচেতন আছেন বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনা অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথের কোনো বহুপঠিত বিখ্যাত কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার সময় তার ভুল হওয়ার কথা নয়। না, তিনি ভুল উদ্ধৃতি দিয়েছেন তা বলছি না। কিন্তু উদ্ধৃতি দ্বারা তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তার বিপরীতটাই কিন্তু আসলে বোঝানো হয়েছে। কবিতার মর্মার্থ যথাযথভাবে অনুধাবন করেই উদ্ধৃতি দেয়া উচিত ছিল। না হলে বিষয়টি হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের অভিজ্ঞতার বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামকে ঘিরে যে মন্তব্য করেছেন, তাও একইভাবে হাস্যকর। বিখ্যাত কবি ও কবিতা সম্পর্কে না জানাটা অপরাধ নয়, কিন্তু না জেনে হাস্যকর মন্তব্য করলে আমরা বড় অসহায় বোধ করি।
প্রথমে আসা যাক শেখ হাসিনার রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে। ‘গান্ধারীর আবেদন’ রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটি মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে লেখা। মহাভারতে ও রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ‘দুর্যোধন’ একটি দুষ্ট চরিত্র, যিনি জয়ের নেশায় সুখ-শান্তি-সুশাসন সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আতাউস সামাদ তাই সঠিকভাবেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন—“তিনি (শেখ হাসিনা) তার ‘সুন্দর সাফল্যের’ বর্ণনা দেয়ার জন্য দুর্যোধনের মতো একটি খলচরিত্রের (ঠরষষধরহড়ঁং) সহায়তা নিলেন কেন?”
গান্ধারীর আবেদন কবিতায় (নাটক) দুর্যোধন বলছেন—
‘সুখ চাহি নাই মহারাজ
জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।’
এখানে সুখ বিসর্জন দেয়ার মধ্যে মহত্বের দিকটি নেই। বরং শান্তিময়-মঙ্গলময় সুখের বিপরীতে রাজ্য জয়ের অভিলাষটাই প্রধান। পরের লাইনগুলো এই রকম—
‘ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা
কুরুপতি। দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা
জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,
সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত
অদ্য আমি জয়ী।’
এমন জয় কারোর কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যদি এমন জয় করেছেন বলে দাবি করেন, তবে সেটা মহত্বের নয়। বস্তুত শেখ হাসিনা সেটা বোঝাতে চাননি। কিন্তু উল্টোটা বলে ফেলেছেন ভুলবশত। এমন ভুল আমাদের বিভ্রান্ত করে, শঙ্কিত করে।
বস্তুত প্রধানমন্ত্রী কতটা জয় করেছেন সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে কিছুই করতে পারেননি। বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থেকে ভারত সরকার বিরত থাকবে—এমন আশ্বাসও পাওয়া যায়নি। বস্তুত বিজয় বা পরাজয়ের প্রশ্নটাই অবান্তর। ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে তার সুষ্ঠু সমাধানই আমাদের কাম্য। আর লক্ষ্য রাখতে হবে, বাংলাদেশের স্বার্থ যেন রক্ষিত হয়। এখানে কোনো পক্ষের জয় বা পরাজয়ের প্রশ্ন উঠবে কেন?
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতে চেয়েছেন, তিনি বিরাট জয় করে এসেছেন। তিনি বলতে চান, সেই জয়টাই তার কাম্য ছিল, ব্যক্তিগত সুখ নাকি তার কাম্য নয়। সম্ভবত সেটা বোঝাতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত করে নিজেকে দুর্যোধনের জায়গায় বসিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছেন এবং আমাদের বিভ্রান্ত করেছেন।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দাবি প্রত্যাখ্যান করে এই সফরকে ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছেন। আজকের এই রচনায় আমি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও যৌথ বিবৃতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি না। এসব বিষয়ে আমি আমার মন্তব্য স্বতন্ত্রভাবে আগেই করেছি। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে পুরোপুরি ব্যর্থ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তার বক্তব্যের অনেক বিষয়ে যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন বিষয়ে তিনি যা বলেছেন, তা শুধু আপত্তিকরই নয়, কিছুটা হাস্যকরও বটে।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরান্তে যে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে পালনের কথা বলা হয়েছে। এতে খালেদা জিয়া আপত্তি জানিয়েছেন। তার মতে, আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে উপেক্ষা করা হয়েছে। কী আশ্চর্য! এখানে উপেক্ষার কী তিনি দেখলেন? রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শ’ বছর পূর্ণ হবে ২০১১ সালে। কবি নজরুলের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। দেড়শ’ বছর হতে এখনও অনেক বাকি। সাধারণত মহান পুরুষদের একশ’, দেড়শ’, দুইশ’ বছর ইত্যাদি ঘটা করে পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথের দেড়শ’ বছর পালনের সঙ্গে কবি নজরুল প্রসঙ্গ টেনে আনাটা কি যৌক্তিক হলো?
খালেদা জিয়া যেভাবে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন, তা কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয়, এর মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িকতার গন্ধের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনই মহান কবি এবং বাঙালির গর্ব। এই গর্ব বাংলাদেশের বাঙালির যেমন, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরও। বাঙালির যে কোনো কবিকে নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত একত্রে গবেষণা, উত্সব, দিবস পালন ইত্যাদি করতেই পারে। কারণ আমরা একই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। বলা যেতে পারে, কবি নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। তাই নজরুলের ব্যাপারে আমাদের বিশেষ দুর্বলতা ও অধিকার থাকতেই পারে। এহেন যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি বিশেষ কবিকে জাতীয় কবি বলে ঘোষণা দেয়াটাও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য কখনোই মনে হয়নি। অন্য কোনো জাতি বা দেশ কোনো বিশেষ কবিকে জাতীয় কবি বলে ঘোষণা করেছে বলে আমার জানা নেই। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তিনজনই আমাদের বাংলা সাহিত্যের বড় কবি। পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশকে আমি বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে রাখতে চাই। এটি অবশ্য আমার অভিমত। তবে একথা সর্বজনস্বীকৃত, রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিই নন, তিনি বিশ্ব সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। শেক্সপিয়র, গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথ সমপর্যায়ের কবি। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বলে ঘোষণা করা হয়, যদিও এর কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। এক্ষেত্রে শেখ মুজিব পলিটিকস্ করেছেন বলে মনে করলে খুব একটা অন্যায় হবে না। সম্ভবত এখানেও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সস্তা সেন্টিমেন্ট জয় করার লক্ষ্যে সস্তা রাজনীতি করেছিলেন।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নজরুলকে স্থাপন করার যে প্রয়াস খালেদা জিয়া করেছেন, সেটাও এক ধরনের সস্তা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সাহিত্য সম্পর্কে যারা জানেন-বোঝেন, এমন লোক বিএনপিতে আছেন। তাদেরও উচিত ছিল সুপরামর্শ দেয়া।
ব্যক্তিগতভাবে আমি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল উভয়ের খুবই ভক্ত। কবিপ্রতিভা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বড়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আছে বিশ্ব মানবতাবোধ। অন্যদিকে নজরুল রবীন্দ্র যুগে বাস করেও ভিন্নধারার ও স্বাদের কবিতা রচনা করেছেন, যা তার প্রতিভার স্বাক্ষর দেয়। তাছাড়া নজরুলের গান তো অসাধারণ। পাশাপাশি নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি, দেশজ স্বকীয়তার মহত্তম চারণ কবি; যার কবিতায় আছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক, আছে সাম্যের কথা, শোষিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেণী শোষণমুক্তির প্রেরণা। তিনিই একমাত্র কবি যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করার জন্য জেল খেটেছেন। কবি জীবনানন্দের ভাষায়—‘আধুনিক বাংলাদেশে তিনি (কবি নজরুল ইসলাম) বাংলার মাটির বিশেষ সায়ত্ত সন্তান।... আজকের বাংলার অন্য কোনো কবি সম্পর্কে একথা বলা চলে না হয়তো।’ কবি নজরুল যখন কারাগারে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বসন্ত নাটকটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে উত্সর্গ করেছিলেন। অন্যদিকে কবি নজরুল রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধুপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করে। এ নিয়ে কত লোক ঠাট্টা বিদ্রূপ করেছেন।’ (‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’, আত্মশক্তি পত্রিকা, ১৯২৭ সাল)।
কবি নজরুল ইসলাম যখন ধূমকেতু নামে সাময়িকী বের করেন তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বাদবাণী পাঠিয়েছিলেন। তা নিম্নরূপ :
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ, অগ্নিসেতু
দুর্দিনের ঐ দুর্গ শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালো হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধ চেতন।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৪ শ্রাবণ, ১৩২৯’
সাহিত্য নিয়ে যারা কিছুটা নাড়াচাড়া করেন, তারা জানেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেমন ছিল।
আমি এখানে সাহিত্য আলোচনা করতে বসিনি। আমার আলোচ্য বিষয় হাসিনা-খালেদার কবি ও কবিতা নিয়ে সস্তা ও ভ্রান্ত রাজনীতি। আশা করি ভবিষ্যতে তারা বক্তৃতা-বিবৃতি ও কবিতার উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে আরও সাবধানী হবেন।
No comments