ধরনাধারায় (পর্ব-২০)-অঙ্কে তুখোড় ছিলেন আশরাফ স্যার by আলী যাকের
আলোকের এইগত পর্বে গণেশ স্যারের কথা লিখেছিলাম। যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা আমরা পাকিস্তান সৃষ্টির সময় দেখেছি, তা আমাদের দেশের অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একধরনের নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করেছিল। এই নিরাপত্তাহীনতার প্রথম শিকার গণেশ স্যার।
তিনি সেই পঞ্চাশের দশকের শেষে এক সকালে আমাদের ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটে চলে যান। যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় অকৃতদার
মানুষটি আমাদের বাসায় আসেন বাবার কাছ থেকে বিদায় নিতে। যাওয়ার সময় আমাদের গেটে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'যাই রে গুটলু।' আমার এই নামটি গণেশ স্যারের দেওয়া। তারপর আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, 'পড়াশোনায় মনোযোগ দিস।' বলেই দীননাথ সেন রোড দিয়ে হন্ হন্ করে হেঁটে তাঁর গন্তব্যের দিকে চলে গেলেন। একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না। এখন মনে হয়, সেই সন্ধ্যায় গণেশ স্যারের চেহারাটা বড্ড বেশি নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আমাদের গৃহশিক্ষক হিসেবে আসেন এক তরুণতর মানুষ, আশরাফুল হক। আশরাফ স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স করছিলেন যত দূর মনে পড়ে। ওঁর সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল অঙ্ক এবং পরিসংখ্যান। অঙ্কে তুখোড় ছিলেন আশরাফ স্যার এবং আমাদের প্রবেশিকা পরীক্ষা পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। অঙ্ক বিষয়টা সে সময় আমার কাছে রহস্যময় ছিল, কিন্তু কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতেন না ওই রহস্যময় গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার উপায়। নিত্যই মনে প্রশ্ন দেখা দিত, বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে। কিন্তু ওই প্রশ্নের কোনো জবাব পেতাম না। যেমন (a+b)2 কেন a2+2ab+b2 হবে_এটার একটা বোধগম্য ব্যাখ্যা কোনো দিন পেয়েছি বলে মনে হয় না। ঠধষঁব অথবা মূল্য, অংংঁসবফ বা ধরে নেওয়ার ব্যাপারটা সহজভাবে বুঝিয়ে দিলে আমার মোটা মাথায় অঙ্ক হয়তো সহজে বোঝা যেত। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, আমার ধারণা সেটা হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ আমি শেষ পর্যন্ত অঙ্ক বুঝে উঠতে পারিনি। আশরাফ স্যার প্রাণান্তকর চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে অঙ্ক মুখস্থ করতে বলতেন। এই আমি অবশ্য পরে সমাজবিজ্ঞান পড়ার সময় পরিসংখ্যানে বেশ ভালোই করেছিলাম। আসলে কারো কারো মাথা বোধ হয় দেরিতে খোলে। আমার মাথাও দেরিতে খুলেছিল। যাকগে সে কথা। আশরাফ স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমার সব বালখিল্যতা এবং দুষ্টুমি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করতেন। আসলে আমাদের বাল্যকালে এবং কৈশোরে সব শিক্ষকই যে স্নেহ, ভালোবাসার সঙ্গে তাঁদের বিদ্যার্থীদের পড়াতেন, সে রকম খুব একটা আর দেখা যায় না। প্রসঙ্গত, তখনকার স্কুলশিক্ষক আর এখনকার স্কুলশিক্ষকের মধ্যে একটা তুলনামূলক বিচারের কথা মনে জাগতেই পারে। এটা প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হয় যে এই তুলনা কোনো গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর নির্ভর করে করা নয়; আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমাদের সময় শিক্ষকদের অনেক বেশি মনোযোগ পেয়েছি আমরা। তাঁরা যখন বলতেন, 'পড়াশোনায় মনোযোগী হও', তখন আমরা জানতাম আমাদের পেছন থেকে এক জোড়া চোখ নিরন্তর নিরীক্ষণ করছে। যত অভিযোগই আজ করি না কেন, ওই রকম স্নেহশীল মানুষ, যাঁদের দৃষ্টি সর্বদাই আমাদের ওপর প্রায় সূর্যেরই মতো আলো প্রক্ষেপণ করত, কী পরম যত্নে আমাদের পড়াতেন। প্রায় সন্তানেরই মতো ছাত্রদের দেখভাল করতেন। সেই ছাত্রদের কেউ পড়াশোনায় ভালো না করলে তাঁরা প্রচণ্ড দুঃখ পেতেন, আবার ভালো করলে হতেন আনন্দিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁদের যে যেই বিষয় পড়াতেন সে বিষয়ে ছিলেন পণ্ডিত। সেই সময় সাধারণত ভালো ছাত্রদের অনেকেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন। তাঁদের সবাই জানতেন যে মাস্টারি করে যে জাগতিক অর্জন, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়তো তারা কামাতে পারতেন অন্য কোনো কাজ করে। কিন্তু মানুষ নির্মাণের যে আনন্দ তার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি আর কোথাও নেই_এ ধরনের একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল তাঁদের মধ্যে। আজকের চেহারাটা ভিন্ন। এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকতায় আসছেন এমন সব মানুষ, যাঁরা পড়াশোনায় ভালো ছিলেন না। অন্য কোনো পেশায় কোনো জুতসই কাজ হয়নি বিধায় শিক্ষকতার ক্ষেত্রে চাকরি গ্রহণ, যাতে সময়ে যদি একটি ভালো কাজ পাওয়া যায়, তাহলে এই পেশাকে বিদায় জানাবেন। অর্থাৎ শিক্ষকতার পেশাটি হচ্ছে একটি Spring Board। এখান থেকে যেকোনো গন্তব্যের প্রতি উল্লম্ফন সম্ভব। এর পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে, শিক্ষকের আর্থিক অর্জন অতি নগণ্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এই যুক্তিটি গ্রাহ্য করার মতো। কিন্তু আরো একটি বিষয় একটু ভেবে দেখার আছে। যাঁরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন, তাঁদের উচিত এ পেশায় আসা কেবল এই পেশাটির বিশেষত্বের জন্যই এবং যদি তাঁরা লোভের বশবর্তী হয়ে অন্য কোনো পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন, তবে সেটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার। আমার এ ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছে আরো এই কারণে যে আজকের এই দুর্মূল্যের বাজারেও স্বল্প আয়ের কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা ছাত্র পড়িয়ে সত্যিকার আত্মতৃপ্তি পান। শিক্ষক হিসেবে এ রকম মানুষেরই প্রয়োজন। এসব শিক্ষক সংখ্যায় ক্রমেই কমে আসছেন। বিপদ সেখানেই। যাঁদের অনেক পয়সা আছে, তাঁরাই প্রচুর অর্থ ব্যয়ে যথাযথ শিক্ষা ক্রয় করবেন আর যাঁরা স্বল্পবিত্তের মানুষ, তাঁরা হয় অর্ধশিক্ষিত হয়ে বেঁচে থাকবেন, নয়তো স্ব-শিক্ষিত হয়ে সমাজের বিদগ্ধজনদের মধ্যে স্থান করে নেবেন। ভালো শিক্ষকরা ছিলেন বলেই হয়তো আমাদের বড় হয়ে ওঠায় এমন অনেক শিক্ষকের সাহচর্য পেয়েছি, যাঁদের অবদান আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁরা না হলে একজন পূর্ণাঙ্গ এবং চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে আজকের এ অবস্থায় আসতে পারতাম বলে মনে হয় না।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মানুষটি আমাদের বাসায় আসেন বাবার কাছ থেকে বিদায় নিতে। যাওয়ার সময় আমাদের গেটে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'যাই রে গুটলু।' আমার এই নামটি গণেশ স্যারের দেওয়া। তারপর আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, 'পড়াশোনায় মনোযোগ দিস।' বলেই দীননাথ সেন রোড দিয়ে হন্ হন্ করে হেঁটে তাঁর গন্তব্যের দিকে চলে গেলেন। একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না। এখন মনে হয়, সেই সন্ধ্যায় গণেশ স্যারের চেহারাটা বড্ড বেশি নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আমাদের গৃহশিক্ষক হিসেবে আসেন এক তরুণতর মানুষ, আশরাফুল হক। আশরাফ স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স করছিলেন যত দূর মনে পড়ে। ওঁর সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল অঙ্ক এবং পরিসংখ্যান। অঙ্কে তুখোড় ছিলেন আশরাফ স্যার এবং আমাদের প্রবেশিকা পরীক্ষা পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। অঙ্ক বিষয়টা সে সময় আমার কাছে রহস্যময় ছিল, কিন্তু কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতেন না ওই রহস্যময় গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার উপায়। নিত্যই মনে প্রশ্ন দেখা দিত, বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে। কিন্তু ওই প্রশ্নের কোনো জবাব পেতাম না। যেমন (a+b)2 কেন a2+2ab+b2 হবে_এটার একটা বোধগম্য ব্যাখ্যা কোনো দিন পেয়েছি বলে মনে হয় না। ঠধষঁব অথবা মূল্য, অংংঁসবফ বা ধরে নেওয়ার ব্যাপারটা সহজভাবে বুঝিয়ে দিলে আমার মোটা মাথায় অঙ্ক হয়তো সহজে বোঝা যেত। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, আমার ধারণা সেটা হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ আমি শেষ পর্যন্ত অঙ্ক বুঝে উঠতে পারিনি। আশরাফ স্যার প্রাণান্তকর চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে অঙ্ক মুখস্থ করতে বলতেন। এই আমি অবশ্য পরে সমাজবিজ্ঞান পড়ার সময় পরিসংখ্যানে বেশ ভালোই করেছিলাম। আসলে কারো কারো মাথা বোধ হয় দেরিতে খোলে। আমার মাথাও দেরিতে খুলেছিল। যাকগে সে কথা। আশরাফ স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমার সব বালখিল্যতা এবং দুষ্টুমি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করতেন। আসলে আমাদের বাল্যকালে এবং কৈশোরে সব শিক্ষকই যে স্নেহ, ভালোবাসার সঙ্গে তাঁদের বিদ্যার্থীদের পড়াতেন, সে রকম খুব একটা আর দেখা যায় না। প্রসঙ্গত, তখনকার স্কুলশিক্ষক আর এখনকার স্কুলশিক্ষকের মধ্যে একটা তুলনামূলক বিচারের কথা মনে জাগতেই পারে। এটা প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হয় যে এই তুলনা কোনো গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর নির্ভর করে করা নয়; আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমাদের সময় শিক্ষকদের অনেক বেশি মনোযোগ পেয়েছি আমরা। তাঁরা যখন বলতেন, 'পড়াশোনায় মনোযোগী হও', তখন আমরা জানতাম আমাদের পেছন থেকে এক জোড়া চোখ নিরন্তর নিরীক্ষণ করছে। যত অভিযোগই আজ করি না কেন, ওই রকম স্নেহশীল মানুষ, যাঁদের দৃষ্টি সর্বদাই আমাদের ওপর প্রায় সূর্যেরই মতো আলো প্রক্ষেপণ করত, কী পরম যত্নে আমাদের পড়াতেন। প্রায় সন্তানেরই মতো ছাত্রদের দেখভাল করতেন। সেই ছাত্রদের কেউ পড়াশোনায় ভালো না করলে তাঁরা প্রচণ্ড দুঃখ পেতেন, আবার ভালো করলে হতেন আনন্দিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁদের যে যেই বিষয় পড়াতেন সে বিষয়ে ছিলেন পণ্ডিত। সেই সময় সাধারণত ভালো ছাত্রদের অনেকেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন। তাঁদের সবাই জানতেন যে মাস্টারি করে যে জাগতিক অর্জন, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়তো তারা কামাতে পারতেন অন্য কোনো কাজ করে। কিন্তু মানুষ নির্মাণের যে আনন্দ তার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি আর কোথাও নেই_এ ধরনের একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল তাঁদের মধ্যে। আজকের চেহারাটা ভিন্ন। এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকতায় আসছেন এমন সব মানুষ, যাঁরা পড়াশোনায় ভালো ছিলেন না। অন্য কোনো পেশায় কোনো জুতসই কাজ হয়নি বিধায় শিক্ষকতার ক্ষেত্রে চাকরি গ্রহণ, যাতে সময়ে যদি একটি ভালো কাজ পাওয়া যায়, তাহলে এই পেশাকে বিদায় জানাবেন। অর্থাৎ শিক্ষকতার পেশাটি হচ্ছে একটি Spring Board। এখান থেকে যেকোনো গন্তব্যের প্রতি উল্লম্ফন সম্ভব। এর পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে, শিক্ষকের আর্থিক অর্জন অতি নগণ্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এই যুক্তিটি গ্রাহ্য করার মতো। কিন্তু আরো একটি বিষয় একটু ভেবে দেখার আছে। যাঁরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন, তাঁদের উচিত এ পেশায় আসা কেবল এই পেশাটির বিশেষত্বের জন্যই এবং যদি তাঁরা লোভের বশবর্তী হয়ে অন্য কোনো পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন, তবে সেটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার। আমার এ ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছে আরো এই কারণে যে আজকের এই দুর্মূল্যের বাজারেও স্বল্প আয়ের কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা ছাত্র পড়িয়ে সত্যিকার আত্মতৃপ্তি পান। শিক্ষক হিসেবে এ রকম মানুষেরই প্রয়োজন। এসব শিক্ষক সংখ্যায় ক্রমেই কমে আসছেন। বিপদ সেখানেই। যাঁদের অনেক পয়সা আছে, তাঁরাই প্রচুর অর্থ ব্যয়ে যথাযথ শিক্ষা ক্রয় করবেন আর যাঁরা স্বল্পবিত্তের মানুষ, তাঁরা হয় অর্ধশিক্ষিত হয়ে বেঁচে থাকবেন, নয়তো স্ব-শিক্ষিত হয়ে সমাজের বিদগ্ধজনদের মধ্যে স্থান করে নেবেন। ভালো শিক্ষকরা ছিলেন বলেই হয়তো আমাদের বড় হয়ে ওঠায় এমন অনেক শিক্ষকের সাহচর্য পেয়েছি, যাঁদের অবদান আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁরা না হলে একজন পূর্ণাঙ্গ এবং চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে আজকের এ অবস্থায় আসতে পারতাম বলে মনে হয় না।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments