জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দুই বছর by শরিফুল ইসলাম সেলিম

একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আকাঙ্ক্ষা বহুদিন ধরে লালন করে আসছে এ দেশের মানুষ। যার ফলে এবং কিছুটা আন্তর্জাতিক চাপে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর জারি করা হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০০৭।


এরপর ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং মুনিরা খান ও অধ্যাপক নীরু কুমার চাকমাকে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। এর কিছুদিন পরই ক্ষমতায় আসে বর্তমান নির্বাচিত সরকার। সংসদের প্রথম অধিবেশনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশকে অনুমোদন না দেওয়ায় কমিশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। অবশেষে ৭ জুলাই ২০০৯ সংসদে উত্থাপিত হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯। ৯ জুলাই ২০০৯ তা সংসদে পাস হয় এবং ১৪ জুলাই ২০০৯ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। নতুন আইনটিকে ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ২০০৭ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজকর্মকে বৈধতা দেওয়া হয়।
গত দুই বছরে কমিশনের তেমন কোনো কাজ দৃশ্যমান হয়নি। কিছু কিছু ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ, কোনো ভিকটিমকে দেখতে যাওয়া অথবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে প্রতিবেদন চাওয়ার মধ্যেই মূলত তাদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। হেফাজতে মৃত্যু, লাশ গুম, ক্রসফায়ারসহ নানা ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও সেসব ইস্যুতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখন পর্যন্ত নজির স্থাপনের মতো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কমিশনের চেয়ারম্যান অবশ্য প্রতিদিনই নানা সভা-সেমিনারে মানবাধিকার বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ। কমিশনের গত দুই বছরের কার্যক্রমের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত হলেও তা নিজস্ব ছিল না। বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজ করেছে কমিশন। বিধি চূড়ান্ত না হলে কোনো অভিযোগের তদন্ত সম্ভব নয়। বিধির পাশাপাশি লোকবল, যানবাহনসহ নিজস্ব অফিসও জরুরি। মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুসারে বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে তদন্ত করতে পারবে না কমিশন। আবার বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত শেষে শুধু সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কমিশন নিজে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইন অনুযায়ী কমিশন সরকার বা এর কর্তৃপক্ষের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবেদন চাইতে পারবে। তবে না পেলে করণীয় স্পষ্ট নয়। এ ধরনের শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে কমিশন চালানো যাবে না এটি স্পষ্ট। যদি মানবাধিকার কমিশন রাখতে হয় তবে একে ঢেলে সাজাতে হবে।
তারপরও সরকার কমিশনকে অনেক কিছু না দিলেও যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, এর নূ্যনতম ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সীমাবদ্ধতার মাঝেও কমিশন চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কারণ যে কোনো ঘটনা তদন্তে কমিশন চাইলেই লোকবলসহ প্রশাসনিক সহায়তা পেতে পারে। অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোও কমিশনকে নানাভাবে সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু কাজের উদ্যোগ না থাকলে তো কেউ কিছু করতে পারবে না। মানবাধিকার কমিশনকে সহায়তা করা মানেই হচ্ছে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান এখন কার্যত কোনো কাজই করতে পারছে না। গত দুই বছরে কমিশন মানবাধিকার ইস্যুতে একটিমাত্র ঘটনার তদন্তে অংশ নিলেও সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি আজও। কাগজে-কলমে কমিশনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন পর্যন্ত বিবৃতি ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া কার্যত কিছুই করতে পারেনি তারা। মানবাধিকার কমিশনে বর্তমানে আইন আছে, বিধি নেই। অভিযোগ আছে, তদন্ত নেই। পদবি আছে, লোকবল নেই। ফলে মানবাধিকার ইস্যুতে কমিশনের দৃষ্টান্তমূলক কোনো কাজ নেই।
selimru.law@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.