ফিরে দেখার সংলাপ by কে জি মোস্তফা
স্মৃতি যেন এক ময়লা সিকি। মহাকালের চাকায় সেই সিকি গড়িয়ে চলে। স্মৃতিময় বয়সের কাছে কিন্তু থেকে যায় কিছু সাথী, পথের সাথী। মাঝেমধ্যে হৃদয়পুরে শুনি তার নিঃশব্দ কলরব। সেদিন প্রেসক্লাবের আড্ডায় ছিলেন ইংরেজি মাধ্যমের বিশিষ্ট সাংবাদিক আমিনুর রহমান।
স্বল্পভাষী, অমায়িক, ভদ্রলোক। বর্তমানে তিনি গ্যাটকোর কনসালট্যান্ট। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, পিতার চাকরির সুবাদে কিছুকাল নোয়াখালী জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সহসা একটা একাত্মতা অনুভব করলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্তগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভ, সেই নোয়াখালী জিলা স্কুলের আকাশ-বাতাস মনের আয়নায় ভেসে উঠল। খণ্ড মুহূর্তের চিন্তায় জীবনের কোনো না কোনো সত্য যেমন সামান্যর মধ্যে অসামান্য হয়ে ফুটে ওঠে।সাল ১৯৫০-৫৪। নদী ভাঙনের কারণে নোয়াখালী জিলা স্কুল সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত হয়েছিল সোনাপুর কেরামতিয়া মাদ্রাসায়। একই সময় জেলাসদর মাইজদীতে নিজস্বভবন নির্মাণ শুরু। শেষ হয় সম্ভবত ১৯৫২ সালে, যখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। সুদূর সোনাপুর থেকে দীর্ঘপথ হেঁটে মাইজদী যাতায়াত করতে হতো। সেই সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রিয়স্যার শ্রদ্ধেয় আবদুর রহিম এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক অত্যন্ত কোমলস্বভাবের মমতাজউদ্দীন স্যার। তখনকার দিনে শিক্ষকরা ছিলেন যেমনি সুপণ্ডিত ও ন্যায়বান, শিক্ষাদানে তেমনি আত্মনিবেদিত।
যাই হোক. পাঠ্যসূচিতে আমাদের দ্বিতীয় ভাষা ছিল উর্দু ও আরবি। আমার ছিল আরবি। বেশকিছুকাল আরবি পড়ানোর মৌলভী স্যার নেই। ঠিক ষাণ্মাসিক পরীক্ষার প্রাক্কালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে বদলি হয়ে এলেন একজন। নাম মৌলভী দলিল উদ্দিন আহমদ। মাথায় টার্কিসক্যাপ, গায়ে শেরওয়ানি, হাতে বনিয়াদী লাঠি। স্কুলে যোগদান করতে না করতেই তার হাতে পড়ল আরবি প্রশ্নপত্র তৈরির দায়িত্ব। পরীক্ষার হলে আমার তো মাথায় বাজ। যেসব চ্যাপ্টার তখনও পড়ানো হয়নি তা থেকেই বেশিরভাগ প্রশ্ন। ক্লাসের সেকেন্ডবয় আমি। আরবিতে প্রায়ই ৭০/৮০ নম্বর পেয়ে থাকি। এবার পাসমার্ক পাওয়াই কঠিন। দুষ্টমি বুদ্ধি জাগলো মাথায়। আমি খাতার পাতায়-পাতায় ২/১ লাইন করে পদ্য লিখলাম। অনেকটা তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। পদ্য হলো কি হলো না, কিন্তু অন্ত্যমিল রেখে-রেখে লিখলাম।
এমনতর উদ্ভট খাতা দেখে নিশ্চয়ই তিনি রেগেমেগে যাবেন। কঠিন শাস্তি অবধারিত। ভয়ে ভয়ে ছিলাম। যথাসময় টিচার্সরুমে এক দিন ডাক এলো। তার মুখমণ্ডলে রাগরাগ ভাব, মনের মধ্যে অস্বস্তির গোমড়া কালো মেঘ। আমার এমন বেয়াড়া মনোভাবের কারণ জানতে চাইলেন। আমি নির্ভয়ে মনের কথা বলার সাহস ও শক্তি কেমন করে যেন পেয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক চেয়ে মৃদু ভর্ত্সনা করলেন, বললেন পিতা-মাতা এবং শিক্ষকের সঙ্গে এমন বেয়াদবি করতে নেই। ভবিষ্যতের জন্য আমাকে হুশিয়ার করে দিলেন। শান্তকণ্ঠে বললেন, কবিতা লেখার যদি সখ হয়ে থাকে বিখ্যাত কবিদের কবিতা পড়বে। অন্ত্যমিল দিয়ে আবোল-তাবোল কিছু লিখলেই কবিতা হয় না। তার এমনতর উদার ব্যবহারে মাথা আমার লজ্জা ও শ্রদ্ধায় নুইয়ে পড়ল।
এরপর থেকে কী এক আশ্চর্য বাত্সল্য-স্নেহে তিনি ক্রমে আমাকে কাছে টানতে লাগলেন। একসময় যখন জানতে পারলেন, বহুদূর থেকে হেঁটে এসে আমি ক্লাস করছি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এক দিন নিজেরই বাসায় আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
সবাই তো একটা আশ্রয়ের কথা ভাবে। আশ্রয়ের দ্যোতনা না থাকলে হয়তো এত বড় একটা দুর্ভার সামলানো যেত না। যাই হোক, তার বাসাটি ছিল তত্কালীন মাইজদীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকা ল’ ইয়ার্স কলোনিতে। টলটলে দীঘিটির দক্ষিণ পাড়ে।
জিলা স্কুলের হেড মৌলভী তিনি। ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। উদার, কোনো ধরনের গোঁড়ামি ছিল না। সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রতিও ছিল ঝোঁক। চলাফেরা-বেশভূষায় আভিজাত্যবোধ। ছিলেন খাদ্যরসিক, রিচফুড তৈরিতে নিজেও ছিলেন পারদর্শী। কিন্তু তার সংসারটি ছিল বৃহত্। ছয় ছেলে আর চার মেয়ে। দোকানে প্রচুর ধারদেনা রেখেও দামিদামি খাবারের আয়োজন করতেন। এমন শৌখিন জীবনযাপনের জন্য অনেক সময় তাকে কটূক্তি সইতে হতো। অভাবী সংসারে এ যেন দারিদ্র্যের অহংকার।
তবে আজকের রাজা আগামীকালের ফকির হবে, গতকালের ফকির আগামীকাল রাজার সিংহাসনে বসবে, নিয়তির এও এক খেলা!
একসময় মৌলভী দলিল উদ্দিন স্যারের দিশাহীন ছেলেরা এক-এক করে ঝলসানো প্রাচুর্যের দ্বীপে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। প্রত্যেকেই ডলারের দীপ্তিতে হলো ভাস্বর। অঢেল প্রাচুর্যের মধ্যে জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে তার অনেক আরাম-আয়েশে।
সেই সময় জেলা শহর মাইজদী এমন সুবিস্তৃত ছিল না। ছিল না এতসব ভবন, সুরম্য অট্টালিকা। শুধু কোর্ট বিল্ডিং আর কিছু অস্থায়ী টিনশেড। শান্ত দীঘিটির চারপাশে সরকারি-বেসরকারি অফিস এবং দক্ষিণ পাড়ে উকিল-বার। ছিল ঐতিহ্যবাহী উমা গার্লস্্ হাই স্কুল। ওই স্কুলেরই শিক্ষয়িত্রী ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফারুক মোজাম্মেল হক এবং আজকের বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহারের শ্রদ্ধেয় মাতা।
আমি আর ফারুক একই বয়সী। আমাদের একটা নিজস্ব জগত্ ছিল। খেলাধুলা, পড়াশোনা, বেড়াতে যাওয়া। বয়ঃসন্ধি ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণের তীব্র জেদ ছিল আমাদের। পারস্পরিক বন্ধুতা ও প্রীতির টানে বিকালের নির্জনতায় দুজনে হেঁটে বেড়াতাম। আমাদের সঙ্গে হাঁটত কত স্বপ্ন, কত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সময়টা ছিল সবচেয়ে গ্রহণের, সবচেয়ে সঞ্চয়ের, সবচেয়ে সংলগ্নতার।
বর্তমান জীবন থেকে ফারুক দূরে সরে গেছে অনেকদিন, সময় তো অনেক কিছু দূরে নেয়, মানুষ নেয়, সম্পর্কও নেয়। কিন্তু জীবনগাঙের ঢেউ এঁকে রাখে চিহ্ন তার। সময়ের জলরেখা আজও মুছে দিতে পারেনি সেইসব অসামান্য স্মৃতি!
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
No comments