সাদাকালো-ঐক্যবদ্ধভাবে অশুভ শক্তিকে রুখতে হবে by আহমদ রফিক
সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে উত্তাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোটের ডাকা হরতালে (৪ এপ্রিল) জামায়াত-বিএনপির পরোক্ষ সমর্থন বিষয়টিকে উসকে দিচ্ছে। উদ্দেশ্য_এই সুযোগে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা।
কারণ, ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় রাজনীতিতে টেনে এনে অতীতে অনেক অঘটন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। গত শতকের চলি্লশের দশক তার প্রমাণ। সেই ট্র্যাডিশন এখনো দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে।
সেই হিসাবে বর্তমান ঘটনা ছোট হলেও সামাজিক বিচারে এর গুরুত্ব খাটো করে দেখা ঠিক নয়। কারণ, গত চার দশকে এদিক থেকে সমাজের মানসিক উন্নতি ঘটা তো দূরের কথা, রক্ষণশীলতার টান বরং বেড়েছে। ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা এখনো ভালোই চলে। ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারের মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় করাও কঠিন নয়। বাংলাদেশি সমাজের এ জাতীয় চরিত্র কারো ধারণায় ছিল না।
কারণ, পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের দাবিতে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধে দৃশ্যমান আদর্শগত আবেগ তাৎক্ষণিক হলেও মিথ্যা ছিল না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সেক্যুলার জাতীয়তার চেতনা স্থায়ী হয়নি। অন্তত সমাজের একটি বড় অংশে তো নয়ই। এটা অনেকের জন্যই বিস্ময়ের।
তবু এ সম্পর্কে আমাদের মননশীল সমাজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মহলের বড় একটা মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ভাবা দরকার, এত বড় একটা সেক্যুলার উপপ্লবের পর (যে উপপ্লব একাধারে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক) ধর্মীয় রাজনীতির পক্ষে জনসমর্থন কেন তৈরি হলো এবং তা কিভাবে হলো। সেক্যুলার সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে ধর্মীয় সূত্র যুক্ত হলো। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, দেখা দেয়নি জনপ্রতিক্রিয়াও। স্বৈরশাসনকালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম যুক্ত হলো। এখনো একই অবস্থা। রাজনৈতিক মহল, সেক্যুলার সুশীল সমাজ, এমনকি ছাত্রসমাজ থেকেও যুক্তিসংগত প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি, যে প্রতিবাদ আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে। দেখেশুনে মনে হয়েছে, ওই অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনাটি সবাই নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে। সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এটা ছিল রীতিমতো এক দুঃসংবাদ।
রাষ্ট্রনীতিতে গণতান্ত্রিকতা কি এ অবস্থায় বহাল থেকেছে? এই অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন কি নিছক ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র (যা ছিল পাকিস্তানি শাসনকালের রাজনৈতিক ঐতিহ্য), নাকি সেক্যুলার গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, যে গণতন্ত্রের সামাজিক ভিত তখনো মজবুত হয়ে উঠতে পারেনি। সে জন্যই যত বিপত্তি।
সমাজবিজ্ঞানী বা রাজনৈতিক লেখকদের কেউ কেউ এর কারণ হিসেবে সুশাসনের অভাব এবং জাতীয় স্তরে অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে ব্যর্থতার মতো বিষয়াদির কথা উল্লেখ করে থাকেন। তা ছাড়া ব্যাপক সামাজিক দুর্নীতির বিষয়টি তো আছেই। এগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার না করেও বলতে হয়, সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনা, গভীর জাতীয়তাবোধ এবং যুক্তিবাদী মানসিকতার অভাব অপেক্ষাকৃত বড় কারণ।
সমাজে যে পরিবর্তন ঘটা একসময় অপরিহার্য ছিল, সঠিক সময়ে তা না ঘটায় বিপরীত স্রোতের প্রভাবে সমাজের মন ক্রমেই পেছন থেকে হেঁটেছে। আরো পরে বিশ্ব রাজনৈতিক ধর্মীয় জঙ্গিবাদের টানে সমাজে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রভাব বেড়েছে। জাতীয়তাবাদী বা প্রগতিবাদী রাজনীতি শুরুতে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেনি। তা ছাড়া ছিল ধর্মীয় প্রভাবযুক্ত বিপরীত ধারার রাজনীতি, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুনর্বাসিত ধর্মীয় রক্ষণশীলতার রাজনীতি, যার উচ্ছেদ ঘটেছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণ এখন এমন এক স্তরে যে, গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি হুমকির সম্মুখীন, নারী অধিকারবিষয়ক গণতান্ত্রিক নীতি বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ। তাই তারা কোরআন-সুন্নাহর অজুহাতে হরতাল এবং ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলনের ভয় দেখাতে দ্বিধা করছে না। উদ্দেশ্য একটাই_রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।
৪ এপ্রিলের হরতাল খুব একটা সফল না হলেও (বিশেষ করে ঢাকায়) এর একটা অশুভ লক্ষণ সবারই চোখে পড়ার কথা। ব্যাপকভাবে বিভিন্ন বয়সী মাদ্রাসাছাত্রকে লাঠি হাতে মাঠে নামানো এবং চট্টগ্রাম, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা এবং পাইকারি হারে গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনা পাক-আফগান তালেবানি রাজনীতির আভাস আনে। 'আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান' স্লোগান ভুলে যাওয়ার নয়, খাটো করে দেখার মতোও নয়_তখনো বলেছি, এখনো বলি।
কথাটা বলছি এ জন্য যে জাতীয়তাবাদী বর্তমান সরকার বিপুল ভোটে জয়ী হলেও সমাজে প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রভাব কিন্তু হেলাফেলার মতো নয়। তেমনি নয় মাদ্রাসাশক্তিও। তারুণ্যের বিভ্রান্ত শক্তির সঙ্গে ধর্মীয় অন্ধত্ব যুক্ত হয়ে যে হিংস্রতার প্রকাশ ঘটাতে পারে, আফগানিস্তান তার প্রমাণ। সেখানে বিদেশি নিয়ন্ত্রিত গৃহযুদ্ধ সহজে শেষ হওয়ার নয়। বাংলাদেশে জেএমবি শক্তিহীন হওয়ার পর নতুন করে হিজবুত তাহ্রীর জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। এরা সবাই জাতীয়তাবাদী-গণতান্ত্রিক রাজনীতির শত্রু।
অদূর অতীতে মাদ্রাসাছাত্রদের এতটা ব্যাপক সহিংস সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল দেখা যায়নি। এতটা হিংস্রতা নিয়ে এর আগে পুলিশের মুখোমুখি হতে দেখা যায়নি এদের। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ফরিদপুর এবং অংশত সিদ্ধিরগঞ্জে মাদ্রাসাছাত্রদের হিংস্রশক্তির প্রকাশ এবং পুলিশ-র্যাবের ওপর আক্রমণ একধরনের অশনিসংকেত বলেই ভবিষ্যতের জন্য সরকার সতর্ক হবে, আশা করছি। বিশেষ করে সারা দেশে কওমি মাদ্রাসাছাত্রদের সংখ্যা বিবেচনায়। তাই কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বিবেচনা করি।
নীতিগতভাবে সরকারপক্ষে দরকার এদের বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে ঐক্যের ভিত তৈরি করা। এই সহিংসতার একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এদের জনবিচ্ছিন্নতা। তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের আশু কর্তব্য জনস্বার্থের বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সব গণতন্ত্রী সংগঠনের সঙ্গে নীতিগত ঐক্যের চেষ্টা চালানো। এককথায়, গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে যথাসম্ভব শক্তিশালী করে তোলা।
তা ছাড়া প্রতিক্রিয়াশীল তরুণ শক্তিকে গণতান্ত্রিক-প্রগতিবাদী তারুণ্যের ঐক্যবদ্ধ শক্তির মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। এই বিশেষ দিকেও তাদের নজর দিতে হবে, আন্তরিক চেষ্টা চালাতে হবে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে গণতন্ত্রী-প্রগতিবাদী সব ছাত্রকে এক মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। তা না হলে জামায়াত-শিবির এবং মাদ্রাসা-তালেবানদের সাফল্যের সঙ্গে রুখতে পারা যাবে না। এখানে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চেতনা যেন প্রাধান্য না পায়। মনে রাখতে হবে, সংঘবদ্ধ শক্তিই তুরুপের তাস।
'আমিনীর সহিংস হরতাল'-এর বিরুদ্ধে সমালোচনা শুনছি নির্দলীয় ব্যক্তিদের মুখেও। যেমন_লেখক সমাজসেবী জামিল আখতার বীণু বলছেন, 'ধর্মকে রাজনীতির ময়দানে টেনে আনা অন্যায়।'
একজন গাড়িচালকের মন্তব্য, 'ওরা তো ধর্মের নামে মানুষ খুন করে, একাত্তরেও করেছে।' এক তরুণ সাংবাদিকের কথা, 'মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মগজ ধোলাই দরকার, যাতে ওদের ছাত্ররা পথে নামতে না পারে।' নানা মতের সারকথা হলো, ঐক্যবদ্ধ শক্তি, জনশক্তিই পারবে হিংস্র শক্তির যথার্থ মোকাবিলা করতে। আজকের অশুভ শক্তি রুখতে জনগণের কাছে যাওয়া এবং তাদের এমন বোধে উদ্দীপ্ত করা জরুরি যে ধর্ম ব্যক্তিগত আচরণের বিষয়; রাজনৈতিক ব্যবসার জন্য ধর্ম নয়। আরেকটি কথা, এই সুযোগে কোণঠাসা জামায়াত রাজপথে ফিরতে চাইছে, যাতে ঘাতক অপরাধীদের বিচার বন্ধ হয়।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক
সেই হিসাবে বর্তমান ঘটনা ছোট হলেও সামাজিক বিচারে এর গুরুত্ব খাটো করে দেখা ঠিক নয়। কারণ, গত চার দশকে এদিক থেকে সমাজের মানসিক উন্নতি ঘটা তো দূরের কথা, রক্ষণশীলতার টান বরং বেড়েছে। ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা এখনো ভালোই চলে। ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারের মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় করাও কঠিন নয়। বাংলাদেশি সমাজের এ জাতীয় চরিত্র কারো ধারণায় ছিল না।
কারণ, পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের দাবিতে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধে দৃশ্যমান আদর্শগত আবেগ তাৎক্ষণিক হলেও মিথ্যা ছিল না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সেক্যুলার জাতীয়তার চেতনা স্থায়ী হয়নি। অন্তত সমাজের একটি বড় অংশে তো নয়ই। এটা অনেকের জন্যই বিস্ময়ের।
তবু এ সম্পর্কে আমাদের মননশীল সমাজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মহলের বড় একটা মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ভাবা দরকার, এত বড় একটা সেক্যুলার উপপ্লবের পর (যে উপপ্লব একাধারে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক) ধর্মীয় রাজনীতির পক্ষে জনসমর্থন কেন তৈরি হলো এবং তা কিভাবে হলো। সেক্যুলার সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে ধর্মীয় সূত্র যুক্ত হলো। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, দেখা দেয়নি জনপ্রতিক্রিয়াও। স্বৈরশাসনকালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম যুক্ত হলো। এখনো একই অবস্থা। রাজনৈতিক মহল, সেক্যুলার সুশীল সমাজ, এমনকি ছাত্রসমাজ থেকেও যুক্তিসংগত প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি, যে প্রতিবাদ আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে। দেখেশুনে মনে হয়েছে, ওই অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনাটি সবাই নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে। সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এটা ছিল রীতিমতো এক দুঃসংবাদ।
রাষ্ট্রনীতিতে গণতান্ত্রিকতা কি এ অবস্থায় বহাল থেকেছে? এই অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন কি নিছক ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র (যা ছিল পাকিস্তানি শাসনকালের রাজনৈতিক ঐতিহ্য), নাকি সেক্যুলার গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, যে গণতন্ত্রের সামাজিক ভিত তখনো মজবুত হয়ে উঠতে পারেনি। সে জন্যই যত বিপত্তি।
সমাজবিজ্ঞানী বা রাজনৈতিক লেখকদের কেউ কেউ এর কারণ হিসেবে সুশাসনের অভাব এবং জাতীয় স্তরে অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসনে ব্যর্থতার মতো বিষয়াদির কথা উল্লেখ করে থাকেন। তা ছাড়া ব্যাপক সামাজিক দুর্নীতির বিষয়টি তো আছেই। এগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার না করেও বলতে হয়, সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনা, গভীর জাতীয়তাবোধ এবং যুক্তিবাদী মানসিকতার অভাব অপেক্ষাকৃত বড় কারণ।
সমাজে যে পরিবর্তন ঘটা একসময় অপরিহার্য ছিল, সঠিক সময়ে তা না ঘটায় বিপরীত স্রোতের প্রভাবে সমাজের মন ক্রমেই পেছন থেকে হেঁটেছে। আরো পরে বিশ্ব রাজনৈতিক ধর্মীয় জঙ্গিবাদের টানে সমাজে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রভাব বেড়েছে। জাতীয়তাবাদী বা প্রগতিবাদী রাজনীতি শুরুতে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেনি। তা ছাড়া ছিল ধর্মীয় প্রভাবযুক্ত বিপরীত ধারার রাজনীতি, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুনর্বাসিত ধর্মীয় রক্ষণশীলতার রাজনীতি, যার উচ্ছেদ ঘটেছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক শক্তির মেরুকরণ এখন এমন এক স্তরে যে, গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি হুমকির সম্মুখীন, নারী অধিকারবিষয়ক গণতান্ত্রিক নীতি বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ। তাই তারা কোরআন-সুন্নাহর অজুহাতে হরতাল এবং ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলনের ভয় দেখাতে দ্বিধা করছে না। উদ্দেশ্য একটাই_রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।
৪ এপ্রিলের হরতাল খুব একটা সফল না হলেও (বিশেষ করে ঢাকায়) এর একটা অশুভ লক্ষণ সবারই চোখে পড়ার কথা। ব্যাপকভাবে বিভিন্ন বয়সী মাদ্রাসাছাত্রকে লাঠি হাতে মাঠে নামানো এবং চট্টগ্রাম, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা এবং পাইকারি হারে গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনা পাক-আফগান তালেবানি রাজনীতির আভাস আনে। 'আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান' স্লোগান ভুলে যাওয়ার নয়, খাটো করে দেখার মতোও নয়_তখনো বলেছি, এখনো বলি।
কথাটা বলছি এ জন্য যে জাতীয়তাবাদী বর্তমান সরকার বিপুল ভোটে জয়ী হলেও সমাজে প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রভাব কিন্তু হেলাফেলার মতো নয়। তেমনি নয় মাদ্রাসাশক্তিও। তারুণ্যের বিভ্রান্ত শক্তির সঙ্গে ধর্মীয় অন্ধত্ব যুক্ত হয়ে যে হিংস্রতার প্রকাশ ঘটাতে পারে, আফগানিস্তান তার প্রমাণ। সেখানে বিদেশি নিয়ন্ত্রিত গৃহযুদ্ধ সহজে শেষ হওয়ার নয়। বাংলাদেশে জেএমবি শক্তিহীন হওয়ার পর নতুন করে হিজবুত তাহ্রীর জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। এরা সবাই জাতীয়তাবাদী-গণতান্ত্রিক রাজনীতির শত্রু।
অদূর অতীতে মাদ্রাসাছাত্রদের এতটা ব্যাপক সহিংস সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল দেখা যায়নি। এতটা হিংস্রতা নিয়ে এর আগে পুলিশের মুখোমুখি হতে দেখা যায়নি এদের। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ফরিদপুর এবং অংশত সিদ্ধিরগঞ্জে মাদ্রাসাছাত্রদের হিংস্রশক্তির প্রকাশ এবং পুলিশ-র্যাবের ওপর আক্রমণ একধরনের অশনিসংকেত বলেই ভবিষ্যতের জন্য সরকার সতর্ক হবে, আশা করছি। বিশেষ করে সারা দেশে কওমি মাদ্রাসাছাত্রদের সংখ্যা বিবেচনায়। তাই কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বিবেচনা করি।
নীতিগতভাবে সরকারপক্ষে দরকার এদের বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে ঐক্যের ভিত তৈরি করা। এই সহিংসতার একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এদের জনবিচ্ছিন্নতা। তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের আশু কর্তব্য জনস্বার্থের বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সব গণতন্ত্রী সংগঠনের সঙ্গে নীতিগত ঐক্যের চেষ্টা চালানো। এককথায়, গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে যথাসম্ভব শক্তিশালী করে তোলা।
তা ছাড়া প্রতিক্রিয়াশীল তরুণ শক্তিকে গণতান্ত্রিক-প্রগতিবাদী তারুণ্যের ঐক্যবদ্ধ শক্তির মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। এই বিশেষ দিকেও তাদের নজর দিতে হবে, আন্তরিক চেষ্টা চালাতে হবে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে গণতন্ত্রী-প্রগতিবাদী সব ছাত্রকে এক মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। তা না হলে জামায়াত-শিবির এবং মাদ্রাসা-তালেবানদের সাফল্যের সঙ্গে রুখতে পারা যাবে না। এখানে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চেতনা যেন প্রাধান্য না পায়। মনে রাখতে হবে, সংঘবদ্ধ শক্তিই তুরুপের তাস।
'আমিনীর সহিংস হরতাল'-এর বিরুদ্ধে সমালোচনা শুনছি নির্দলীয় ব্যক্তিদের মুখেও। যেমন_লেখক সমাজসেবী জামিল আখতার বীণু বলছেন, 'ধর্মকে রাজনীতির ময়দানে টেনে আনা অন্যায়।'
একজন গাড়িচালকের মন্তব্য, 'ওরা তো ধর্মের নামে মানুষ খুন করে, একাত্তরেও করেছে।' এক তরুণ সাংবাদিকের কথা, 'মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মগজ ধোলাই দরকার, যাতে ওদের ছাত্ররা পথে নামতে না পারে।' নানা মতের সারকথা হলো, ঐক্যবদ্ধ শক্তি, জনশক্তিই পারবে হিংস্র শক্তির যথার্থ মোকাবিলা করতে। আজকের অশুভ শক্তি রুখতে জনগণের কাছে যাওয়া এবং তাদের এমন বোধে উদ্দীপ্ত করা জরুরি যে ধর্ম ব্যক্তিগত আচরণের বিষয়; রাজনৈতিক ব্যবসার জন্য ধর্ম নয়। আরেকটি কথা, এই সুযোগে কোণঠাসা জামায়াত রাজপথে ফিরতে চাইছে, যাতে ঘাতক অপরাধীদের বিচার বন্ধ হয়।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক
No comments