শিক্ষা-শিক্ষকদের মর্যাদা ও কোচিং ব্যবসা by মোঃ মোত্র্তূজা আহমেদ
মৌলিক শিক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আমরা এখন বিপণন শিক্ষা পদ্ধতির দিকে চলে গেছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা এখন ভোগবাদী, পুঁজিবাদী চিন্তার ধারক। তাদের ক্লাসরুমে শিক্ষা দেওয়া মানেই হলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, কিন্তু আমরা নিজেরাই দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলেছি।
বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষকদেরও টাকার প্রয়োজন, কিন্তু কোনোভাবেই প্রাইভেট পড়িয়ে নয়। শিক্ষকতা একটি পেশা নয়, এটি সেবাও বটে
মানবসম্পদের অনুন্নয়নই একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান নির্দেশক হলো সে দেশের শিক্ষা। আগে মনে করা হতো, যে দেশে যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সে দেশ তত বেশি উন্নত। কিন্তু এ ধারণার এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন মনে করা হয়, যে দেশে যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। আইনের শাসন, প্রকৃত গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। টিচার্স আর দি আর্কিটেক্ট অব দ্য সোসাইটি। সমাজের এই কারিগরদের দক্ষ শিক্ষাদানের ওপরই একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন নির্ভর করছে। একজন ডাক্তার, ব্যারিস্টার, জজ, সচিব সবাই তৈরি হন কোনো না কোনো শিক্ষকের হাত থেকে। সুতরাং সেই শিক্ষক সমাজের অবহেলা করলে দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার হার ২.৪ শতাংশ (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-২০১০)। এত অল্প শিক্ষিত লোক দিয়ে এই ১৫ কোটি মানুষের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? তাই শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই এবং শিক্ষকের অবহেলা কাম্য নয়।
শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কোনো খরচ নয়, এটা এক ধরনের বিনিয়োগ। এই খাতে যত বেশি বিনিয়োগ করা হবে তার চেয়ে দ্বিগুণ রিটার্ন আসবে। সরকার যদি এই খাতে বিনিয়োগ করে একজন আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিংস, পিকাসো, ইবনে সিনার মতো জগদ্বিখ্যাত মানুষ তৈরি করতে পারে, তা হলেই কেবল দেশের সুনাম, মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উন্নত বিশ্বের কাতারে বাংলাদেশ নাম লেখাবে। এসব মহৎ মানুষ কেবল তৈরি করতে পারে একজন ভালো শিক্ষক। একজন ভালো শিক্ষক হতে হলে সর্বপ্রথম দরকার একজন মেধাবী ছাত্র, কিন্তু এখন মেধাবীরা এই মহৎ পেশায় আসতে অনিচ্ছুক। তারা অনেক বেশি বেতনে বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদা এসব পেশা থেকে অনেক কম। একজন দক্ষ শিক্ষক হাজারো দক্ষ মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন। যারা দেশ, সমাজ এবং সংগঠনের নেতৃত্ব দান করেন; যদি এই শিক্ষক সমাজকে আমরা অবহেলা করি তাহলে দেশে কীভাবে মানবসম্পদ সৃষ্টি হবে? তাই এ কথাটি সত্য, যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সেই দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।
আমাদের দেশে প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বেতন তেমন আকর্ষণীয় নয়। সমাজের এসব আলোকিত মানুষ দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে মানবসম্পদে পরিণত করছে। আমাদের দেশে রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা এখনও বাড়িভাড়া পান ১০০ টাকা। যাদের হাত ধরে একটি শিশু পড়ালেখা শেখে, তাদের এই করুণ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এখনও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে অনেক শিক্ষক আছেন, যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে জমিতে লাঙল চালান, এরপর স্কুলে হাজির হন পাঠদান করার জন্য। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা অনেক আগেই শিক্ষকদের মূল্য বুঝতে পেরেছে এবং তাদের বেতন কাঠামো এমনভাবে নির্ধারণ করেছে, যাতে শিক্ষকদের মর্যাদা সব পেশা থেকে ওপরে থাকে এবং তাদের বাড়তি টাকা আয় করার জন্য অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত থাকতে না হয়। শিক্ষকদের একমাত্র উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং তা বিতরণ করা। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষকরা এক বেলা খাবারের পর যদি অন্য বেলার খাবারের চিন্তা করেন, তাহলে কীভাবে তারা গবেষণা করবেন, বিতরণ করবেন নতুন জ্ঞান? একজন শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন একজন ভালো বিচারক, প্রশাসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ। তারাই তো দেশের মানবসম্পদ। শিক্ষকরাই দেশের মানবসম্পদ তৈরির কারিগর। সুতরাং শিক্ষকদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, সর্বোচ্চ বেতন দিয়ে তাদের সমাদর করতে হবে। তাহলেই দেশে গুণীর জন্ম হবে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে।
এবার আসা যাক শিক্ষকরা কেন প্রাইভেট পড়ান? উত্তর সবারই জানা_ বাড়তি আয়ের ইচ্ছায়। শিক্ষকরা এখন ক্লাস রুমে সময় দেওয়ার পরিবর্তে প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বহুজাতিক কোম্পানির মতো ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষকরা এখন অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তারা এ পেশা বেছে নিয়েছেন। বিজ্ঞাপনের শব্দগুলোও খুবই আকর্ষণীয়। গ্যারান্টি সহকারে এ+ পাওয়ার নিশ্চয়তা। এখানে সব বিষয়ে এ+ পাওয়ার গ্যারান্টিতে পড়ানো হয়। স্কুল-কলেজের এসব বিবেকবান শিক্ষক নিজেদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে সরাসরি কোচিং ও প্রাইভেট ব্যবসায় নিয়োজিত। শিক্ষাকে এখন পণ্য বানিয়ে তারা শিক্ষার্থীর কাছে বিক্রি করছেন। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মন থেকে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের সম্মান করে, মন থেকে নয়। শিক্ষা যদি পণ্য হয় তাহলে সেই শিক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় কিন্তু আলোকিত মানুষ হওয়া যায় না। আমরা দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে দিচ্ছি। সম্পদ তৈরি না করে দেশের বোঝা তৈরি করছি। আর এ বোঝা তৈরির পেছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দায়ী এই শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকরা এখন বস্তুবাদী চিন্তার ধারক ও বাহক। শিক্ষকরা যখন দেখেন_ তারই ছাত্র গাড়ি-বাড়ি করছে, আর তিনি হয়তো ঠিকমতো বাজার করতে পারছেন না, তখনই পুঁজিবাদী চিন্তা থেকে তারা বাড়তি আয়ের ইচ্ছায় এসব কোচিং ও প্রাইভেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু সব ছাত্রছাত্রীর পক্ষে যে প্রাইভেট বা কোচিং করা সম্ভব নয়, শিক্ষকরা এ কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। তারা বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে। অভিভাবকরাও দিশেহারা, তারাও তাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেট পড়াতে।
মৌলিক শিক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আমরা এখন বিপণন শিক্ষা পদ্ধতির দিকে চলে গেছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা এখন ভোগবাদী, পুঁজিবাদী চিন্তার ধারক। তাদের ক্লাসরুমে শিক্ষা দেওয়া মানেই হলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, কিন্তু আমরা নিজেরাই দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলেছি। বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষকদেরও টাকার প্রয়োজন, কিন্তু কোনোভাবেই প্রাইভেট পড়িয়ে নয়। শিক্ষকতা একটি পেশা নয়, এটি সেবাও বটে। সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামো এখন সময়ের দাবি মাত্র। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং অন্য সব সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের মৌলিক জ্ঞান বিতরণের পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। আলোকিত মানুষ তৈরি করার মাধ্যমেই কেবল গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব। আর এ কাজে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। মানবকে সম্পদে পরিণত করে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করাই শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব।
মোঃ মোত্র্তূজা আহমেদ : প্রভাষক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
amm203@gmail.com
মানবসম্পদের অনুন্নয়নই একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান নির্দেশক হলো সে দেশের শিক্ষা। আগে মনে করা হতো, যে দেশে যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সে দেশ তত বেশি উন্নত। কিন্তু এ ধারণার এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন মনে করা হয়, যে দেশে যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। আইনের শাসন, প্রকৃত গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। টিচার্স আর দি আর্কিটেক্ট অব দ্য সোসাইটি। সমাজের এই কারিগরদের দক্ষ শিক্ষাদানের ওপরই একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন নির্ভর করছে। একজন ডাক্তার, ব্যারিস্টার, জজ, সচিব সবাই তৈরি হন কোনো না কোনো শিক্ষকের হাত থেকে। সুতরাং সেই শিক্ষক সমাজের অবহেলা করলে দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার হার ২.৪ শতাংশ (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-২০১০)। এত অল্প শিক্ষিত লোক দিয়ে এই ১৫ কোটি মানুষের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? তাই শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই এবং শিক্ষকের অবহেলা কাম্য নয়।
শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কোনো খরচ নয়, এটা এক ধরনের বিনিয়োগ। এই খাতে যত বেশি বিনিয়োগ করা হবে তার চেয়ে দ্বিগুণ রিটার্ন আসবে। সরকার যদি এই খাতে বিনিয়োগ করে একজন আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিংস, পিকাসো, ইবনে সিনার মতো জগদ্বিখ্যাত মানুষ তৈরি করতে পারে, তা হলেই কেবল দেশের সুনাম, মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উন্নত বিশ্বের কাতারে বাংলাদেশ নাম লেখাবে। এসব মহৎ মানুষ কেবল তৈরি করতে পারে একজন ভালো শিক্ষক। একজন ভালো শিক্ষক হতে হলে সর্বপ্রথম দরকার একজন মেধাবী ছাত্র, কিন্তু এখন মেধাবীরা এই মহৎ পেশায় আসতে অনিচ্ছুক। তারা অনেক বেশি বেতনে বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদা এসব পেশা থেকে অনেক কম। একজন দক্ষ শিক্ষক হাজারো দক্ষ মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন। যারা দেশ, সমাজ এবং সংগঠনের নেতৃত্ব দান করেন; যদি এই শিক্ষক সমাজকে আমরা অবহেলা করি তাহলে দেশে কীভাবে মানবসম্পদ সৃষ্টি হবে? তাই এ কথাটি সত্য, যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সেই দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।
আমাদের দেশে প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বেতন তেমন আকর্ষণীয় নয়। সমাজের এসব আলোকিত মানুষ দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে মানবসম্পদে পরিণত করছে। আমাদের দেশে রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা এখনও বাড়িভাড়া পান ১০০ টাকা। যাদের হাত ধরে একটি শিশু পড়ালেখা শেখে, তাদের এই করুণ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এখনও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে অনেক শিক্ষক আছেন, যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে জমিতে লাঙল চালান, এরপর স্কুলে হাজির হন পাঠদান করার জন্য। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা অনেক আগেই শিক্ষকদের মূল্য বুঝতে পেরেছে এবং তাদের বেতন কাঠামো এমনভাবে নির্ধারণ করেছে, যাতে শিক্ষকদের মর্যাদা সব পেশা থেকে ওপরে থাকে এবং তাদের বাড়তি টাকা আয় করার জন্য অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত থাকতে না হয়। শিক্ষকদের একমাত্র উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং তা বিতরণ করা। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষকরা এক বেলা খাবারের পর যদি অন্য বেলার খাবারের চিন্তা করেন, তাহলে কীভাবে তারা গবেষণা করবেন, বিতরণ করবেন নতুন জ্ঞান? একজন শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন একজন ভালো বিচারক, প্রশাসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ। তারাই তো দেশের মানবসম্পদ। শিক্ষকরাই দেশের মানবসম্পদ তৈরির কারিগর। সুতরাং শিক্ষকদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, সর্বোচ্চ বেতন দিয়ে তাদের সমাদর করতে হবে। তাহলেই দেশে গুণীর জন্ম হবে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে।
এবার আসা যাক শিক্ষকরা কেন প্রাইভেট পড়ান? উত্তর সবারই জানা_ বাড়তি আয়ের ইচ্ছায়। শিক্ষকরা এখন ক্লাস রুমে সময় দেওয়ার পরিবর্তে প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বহুজাতিক কোম্পানির মতো ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষকরা এখন অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তারা এ পেশা বেছে নিয়েছেন। বিজ্ঞাপনের শব্দগুলোও খুবই আকর্ষণীয়। গ্যারান্টি সহকারে এ+ পাওয়ার নিশ্চয়তা। এখানে সব বিষয়ে এ+ পাওয়ার গ্যারান্টিতে পড়ানো হয়। স্কুল-কলেজের এসব বিবেকবান শিক্ষক নিজেদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে সরাসরি কোচিং ও প্রাইভেট ব্যবসায় নিয়োজিত। শিক্ষাকে এখন পণ্য বানিয়ে তারা শিক্ষার্থীর কাছে বিক্রি করছেন। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মন থেকে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের সম্মান করে, মন থেকে নয়। শিক্ষা যদি পণ্য হয় তাহলে সেই শিক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় কিন্তু আলোকিত মানুষ হওয়া যায় না। আমরা দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে দিচ্ছি। সম্পদ তৈরি না করে দেশের বোঝা তৈরি করছি। আর এ বোঝা তৈরির পেছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দায়ী এই শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকরা এখন বস্তুবাদী চিন্তার ধারক ও বাহক। শিক্ষকরা যখন দেখেন_ তারই ছাত্র গাড়ি-বাড়ি করছে, আর তিনি হয়তো ঠিকমতো বাজার করতে পারছেন না, তখনই পুঁজিবাদী চিন্তা থেকে তারা বাড়তি আয়ের ইচ্ছায় এসব কোচিং ও প্রাইভেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু সব ছাত্রছাত্রীর পক্ষে যে প্রাইভেট বা কোচিং করা সম্ভব নয়, শিক্ষকরা এ কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। তারা বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে। অভিভাবকরাও দিশেহারা, তারাও তাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেট পড়াতে।
মৌলিক শিক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আমরা এখন বিপণন শিক্ষা পদ্ধতির দিকে চলে গেছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা এখন ভোগবাদী, পুঁজিবাদী চিন্তার ধারক। তাদের ক্লাসরুমে শিক্ষা দেওয়া মানেই হলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, কিন্তু আমরা নিজেরাই দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলেছি। বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষকদেরও টাকার প্রয়োজন, কিন্তু কোনোভাবেই প্রাইভেট পড়িয়ে নয়। শিক্ষকতা একটি পেশা নয়, এটি সেবাও বটে। সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামো এখন সময়ের দাবি মাত্র। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং অন্য সব সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের মৌলিক জ্ঞান বিতরণের পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। আলোকিত মানুষ তৈরি করার মাধ্যমেই কেবল গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব। আর এ কাজে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। মানবকে সম্পদে পরিণত করে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করাই শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব।
মোঃ মোত্র্তূজা আহমেদ : প্রভাষক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
amm203@gmail.com
No comments