চরাচর-অতীত গৌরবগাথা মহাস্থান শিলালিপি by স্বপন কুমার দাস

গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। এ জাদুঘরে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ কক্ষে বহু প্রচ্ছদ ও চিত্র স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে মহাস্থান শিলালিপির একটি চিত্রও আছে।


এ নিদর্শন দ্বারা আদিতে এ দেশে প্রচলিত লিপির কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে এ শিলালিপির ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্তি্বক মূল্যও অনেক। প্রাচীনকালে বাংলাদেশে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, উন্নত শাসনব্যবস্থা ছিল, ছিলেন প্রজাহিতৈষী শাসক_এ লিপির মাধ্যমে তাও উঠে এসেছে। সেকালে রাজ্য, রাজা ও প্রজা সম্পর্কে লিখিত নিদর্শন বলতে নানা সময়ে নানাভাবে ও স্থানে উৎকীর্ণ লিপিকে বোঝাত। শাসকরা তাঁদের রাজাজ্ঞা, গৌরবগাথা ও মূল প্রশান্তির কথা বহনযোগ্য শিলাতে, স্তম্ভে ও পবর্তগাত্রে প্রচলিত লিপি দ্বারা খোদিত ঘরে লিখে রাখতেন। মহাস্থানে প্রাপ্ত শিলালিপিটি তেমনি একটি রাজাজ্ঞা। এটি দেখতে অনেকটা অর্ধবৃত্তাকার শিলাখণ্ডের মতো। লিপিটি ব্রাহ্মী অক্ষরে প্রাকৃত ভাষায় লিখিত। এর দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৩ সে.মি. প্রস্থ ২ দশমিক ৭ সে.মি.। এটি ১৯৩১ সালে বর্তমানে বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্তি্বক খোঁড়াখুঁড়ির সময় পাওয়া যায়। এ নিদর্শনটি ভারতবর্ষে প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন শিলালিপি। নিদর্শনটি খিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়কার। বর্তমানে এটি কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। শিলালিপিটির বাংলা অর্থ হচ্ছে 'পুণ্ড্রনগরে (মহাস্থান) অবস্থিত মৌর্য শাসনাধীন কোনো এক রাজকর্মচারীর আদিষ্ট হয়েছেন যে ওই এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্যের জন্য সরকারি খাদ্যভাণ্ডার থেকে খাদ্য এবং কোষাগার থেকে অর্থ প্রদান করা হোক। তবে অভাব দূর হয়ে সুদিন ফিরে এলে প্রকাশকৃত খাদ্য ও অর্থ আবার ফেরত নিয়ে সরকারি ভাণ্ডারে যেন জমা রাখা হয়।' এই লিপির ভাষ্যমতে তখন পুণ্ড্রনগরে শাসনব্যবস্থা উন্নত ছিল এবং দৈব-দুর্বিপাকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের রাজভাণ্ডার থেকে সাহায্যের জন্য আপৎকালীন খাদ্যভাণ্ডার গড়ে উঠেছিল। তখন ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাদের শুধু খাদ্য নয়, অর্থসাহায্যও দেওয়া হতো। সে যুগে এখন গণমুখী শাসনব্যবস্থার কারণে মৌর্য শাসকদের প্রতি জনগণ শ্রদ্ধাশীল ছিল। মহাস্থানগড়ে এ মহামূল্যবান শিলালিপিটি আবিষ্কৃত হওয়ায় শুধু পুণ্ড্রনগরের অস্তিত্বই প্রমাণিত হয়নি, এর দ্বারা মৌর্য যুগে প্রচলিত উন্নত শাসনব্যবস্থা কথাটিও উঠে এসেছে। মৌর্য শাসকদের পিতৃসুলভ দায়িত্ববোধ তথা কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা বলবৎ থাকায় প্রজাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের ইউরোপীয় প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচার অপেক্ষা মৌর্য শাসন বহুগুণে প্রজাহিতৈষী ছিল। বিংশ শতকে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর পশ্চিম ইউরোপে যে কল্যাণকর রাষ্ট্রের রূপ দেখা যায়, তারও আদিরূপ ছিল ওই পুণ্ড্রনগর। আজ সারা বিশ্বে যে কল্যাণকর অর্থনীতির জয়ঢাক বাজানো হচ্ছে, তাও শুরু হয়েছিল এই বাংলাদেশে, দুই হাজার বছর আগে। কিন্তু কালের আগ্রাসী আচরণে সেই সভ্যতা আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। ছিন্ন হয়ে গেছে বিশ্বসভ্যতার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগসূত্রটি। বাংলাদেশের সোনালি অতীত এখন শুধু ইতিহাসের বিষয়।
স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.