আমেরিকায় বাংলাদেশের পণ্য by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৪১ পেরিয়ে ৪২-এ পড়ল। এ সময় স্বাধীনতার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে যে কেউ হিসাব-নিকাশ করতেই পারেন। এ বিচার-বিবেচনায় ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অনেক কিছুই আলোচনায় উঠে আসতে পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক।
দেশে বিরাজিত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হতাশায় অন্যদের মতো আমিও অনেক সময় দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত হই, নেতিবাচক অনেক কিছুই বলে ফেলি এবং মাঝেমধ্যে এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখিও করি, কাগজে ছাপাই, লোকজন পড়ে, প্রতিক্রিয়া জানায়, কোনো কোনো সময় বাহবাও কুড়াই। তবে আজ বাংলাদেশের একটি ইতিবাচক দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। স্বাধীনতার ফসলস্বরূপ আর কিছু না হলেও বাংলাদেশ দুটো লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে। প্রথমত, প্রায় এক কোটি পরিশ্রমী জনশক্তি আজ বিদেশের মাটিতে কর্মরত। প্রতিবছর তাঁরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশে পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়া বিরাট আকারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আজকাল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। তৈরি পোশাক ছাড়াও আরো অনেক নন-ট্র্যাডিশনাল আইটেম দেশের বাইরে যাচ্ছে। রপ্তানিদ্রব্যের তালিকায় আছে বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত মাছ, সামুদ্রিক শেল ফিশ, টিনজাত ফল, ফলের রস, তরিতরকারি, গুঁড়া মসলা, কালিজিরা চাল, চিঁড়া-মুড়িজাতীয় শুকনো খাবার, চা, চামড়া, চামড়াজাতদ্রব্য, পাট, পাটজাতদ্রব্য, কুটির ও হস্তশিল্পজাত দ্রব্যসামগ্রী, সিরামিক টেবিলওয়্যার ও সিরামিক প্রোডাক্টস, সাবান, ব্যাটারি, বড়লেখার সুজানগরের আগর-আতর ও সুগন্ধিদ্রব্য, খেলনা, ওষুধ, কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্য, জুয়েলারি, ঘড়ি, নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে সিমেন্ট, পাথর, বালু, এমনকি ইটও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে রপ্তানি হয় বলে শুনেছি। ইদানীং স্ক্র্যাপ মেটাল ও তা থেকে তৈরি সমুদ্রগামী জাহাজও বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাচ্ছে। আমেরিকার বাজারে যেসব বাংলাদেশি পণ্য নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি বা পাই- তার বয়ানও আমার আজকের আলোচনায় উঠে আসবে।
প্রথমে বলছি, বাংলাদেশি তৈরি পোশাক শিল্পের বিবর্তন ও তার সাফল্যের সংক্ষিপ্ত পটভূমি। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে আমি কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে পিএইচডি শুরু করেছি। এমন সময় আমার বড় ভাইয়ের সুবাদে আমেরিকায় ইমিগ্র্যান্ট ভিসা পেয়ে যাই। এর কিছুদিন পরই বোস্টনের নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিতে অ্যাডমিশনসহ একটি টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের অফার আসে। অফারটি পেয়ে আগপাছ না ভেবেই ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ম্যানিটোবার পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে প্রত্যাহার করে নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে যোগ দেব পরবর্তী জানুয়ারিতে। উইনিপ্যাগ থেকে বোস্টন যাওয়ার পথে নিউ ইয়র্কে বড় ভাইয়ের বাসায় ছিলাম দুই-তিন সপ্তাহ। ওই সময় সেখানে দেখা হয়েছিল এক তরুণ বাংলাদেশি গার্মেন্ট উদ্যোক্তার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি সাহসের সঙ্গে বেশ জোর দিয়ে একটি কথা বলেছিলেন, যা আজও আমার মনে আছে। তাঁরই ভাষায়, 'এবার ব্যবসা লাইনআপ করে গেলাম, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর এসে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের কনট্রাক্ট সাইন করে যাব।' তখন ওই গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর চোখেমুখে যে আত্মপ্রত্যয় এবং দৃঢ়তার ছাপ দেখেছিলাম, তাতে তাঁর কথার বিশ্বাসযোগ্যতায় আমার মনে একটুও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দানা বাঁধতে পারেনি। এরপর প্রায় ১০ বছর কেটে যায়। ইতিমধ্যে জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের চার্লস্টন শহরে ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছি। এমনি একসময় ১৯৯০ সালের শেষদিকে চার্লস্টনে প্রয়াত ড. মুশফেকুর রহমানের বাড়িতে দেখা হয় বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত এবং সফল পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তার সঙ্গে। তাঁর পুরো নাম কী তা জানা হয়নি, তবে সবাই তাঁকে জাকারিয়া সাহেব বলে ডাকছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠিত একটি বড় এবং সফল গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক। তাঁর কম্পানির নাম ছিল 'জুয়েল গার্মেন্টস'। ওই দিন সবার মুখেই শুনছিলাম পোশাক শিল্পে জাকারিয়া সাহেবের সফলতা ও তাঁর ধন-দৌলতের কথা। ছেলেমেয়েদের আমেরিকায় পড়ানোর জন্য তিনি ওহাইওর ডেইটনে রীতিমতো আরেকটি সংসার পেতেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে কিছুদিন পর ডেইটনে জাকারিয়া সাহেবের বাসায়ও আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, তাঁর ছেলের নাম ছিল জুয়েল এবং মেয়ে দুটির নাম ছিল নয়ন ও নূপুর।
অন্য অনেক ব্যবসার সঙ্গে আমার এক মামারও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। তিনি ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে ঘন ঘন আমেরিকা আসেন। তিনি দেখেন কোন কোন স্টোরে তাঁর কম্পানির তৈরি পোশাক রাখে এবং বিক্রি করে। এতে তিনি স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ রকমের আত্মতৃপ্তি উপভোগ করেন। আমি এবং আমার স্ত্রী এখানকার ডিসকাউন্ট এবং স্পেশাল্টি স্টোরে- সব জায়গায়ই যাই। কোনো সময় কেনাকাটা করতে, কোনো সময় উইন্ডো শপিংয়ে বা নিছক ঘোরাঘুরি করতে। কম-বেশি প্রায় সব দোকানেই আমি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখতে দেখেছি। কোনো কোনো দোকান থেকে মাঝেমধ্যে কিনেছিও। ওয়াল মার্ট, কে-মার্ট, গ্যাপ, ওল্ড নেভি, মেসিজ, গুডিজ, টিজে ম্যাঙ্, টার্গেট, সিয়ার্স, ডিলার্ডস, জেসি পেনি, বেল্ক, ডিজনি স্টোরসের র্যাকে বাংলাদেশের তৈরি বিভিন্ন জাতের পোশাক হরহামেশাই দেখা যায়। বাংলাদেশের রপ্তানিজাত নন-ট্র্যাডিশনাল আইটেম রাখে আমেরিকার কার্লাইল অ্যান্ড কম্পানি, বাথ অ্যান্ড বডি ওয়ার্কস, ওল্ড মিল পটারিজ, পটারি বার্ন, বেড বাথ অ্যান্ড বিওন্ড, ডলার ট্রি, ডলার জেনারেল স্টোরস ইত্যাদি। বাংলাদেশের যাবতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এবার দিচ্ছি আমার দেখা আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশি দ্রব্যের একটি খতিয়ান। কয়েক মাস আগে আমি এবং আমার স্ত্রী একদিন কাপড় কিনতে গিয়েছিলাম মোটামুটি নামিদামি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরস মেসিজে। আমার স্ত্রী মেয়েদের কাপড় দেখছিলেন। আমি ওপরতলায় ঘোরাঘুরি করছিলাম ডমেস্পি সেকশনে। হঠাৎ চোখে পড়ল বাংলাদেশের সিরামিক প্রোডাক্টস। ডিনার প্লেট, কারি বোল, ফুলদানি, পানির জার বা পিচার, সল্ট অ্যান্ড পেপার শেকার ইত্যাদি। কেনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দাম দেখেই আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। একেকটি ডিনার প্লেটের দাম ৭০ ডলার, একেকটি মাঝারি আকারের কারি বোলের দাম ধরা হয়েছে ৪৫ ডলার করে। এক জোড়া সল্ট অ্যান্ড পেপার শেকারের দাম ৫০ ডলার। ফুলদানি ও পিচারের দামটা সঠিক মনে করতে পারছি না। প্রতিটি প্রোডাক্টের কোয়ালিটি এবং ফিনিশিং দেখলাম খুবই উন্নতমানের। আইটেমগুলোর গায়ে ছাপায় লেখা, 'প্রোডাক্ট অব বাংলাদেশ'; কিন্তু কোন কম্পানির তৈরি, অনেক চেষ্টা করেও তার হদিস বের করতে পারলাম না। আরো দেখলাম, আমেরিকান কাস্টমাররা উৎসাহভরে শেলফে রাখা বাংলাদেশি জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করছে, উল্টেপাল্টে দেখছে, প্রাইস স্টিকারের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। হয়তো কিনবে, হয়তো বা কিনবে না। তবে কেউ না কেউ তো অবশ্যই কিনবে, নতুবা মেসিজের মতো দোকানের ফ্লোরে এগুলো স্থান করে নিতে পারত না। মেসিজের দোতলায় বাংলাদেশের সিরামিক টেবিলওয়্যার দেখে আমার ও আমার স্ত্রীর কাছে সেদিন খুবই ভালো লেগেছিল।
তার কয়েক মাস মাত্র সেদিন আমি এবং আমার স্ত্রী গিয়েছিলাম অরগ্যানিক চেইন ফুড স্টোরস 'হোল ফুডসের' দোকানে। হোল ফুডসে গ্রসারি সেরে রাস্তার ওপারে গেলাম তাদেরই সাবসিডিয়ারি বডি কেয়ারের দোকান 'হোল বডি' শপে। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে অভিভূত না হয়ে পারলাম না। অ্যান্ট্রেন্স দরজার সামনে একটি আয়লের মাথায় শেলফের নিচে মেঝেতে রাখা তালপাতার তৈরি কিছু ফ্রুট বাস্কেট এবং লম্বা হাতলওয়ালা মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ। দোকানে ঢোকার সময় আমার চোখে পড়েনি। বেরিয়ে আসার সময় আমার স্ত্রী আমাকে বলল, 'দেখো বাংলাদেশি প্রোডাক্টস।' আমি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। পড়ে দেখলাম, 'ব্লেসিং বাস্কেট' নামে একটি এনজিও জিনিসগুলো তৈরি করেছে বাংলাদেশের কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া একটি কাগজে 'ব্লেসিং বাস্কেট' প্রজেক্টের ম্যানেজার মিসেস তেরেসা উইলসনের একটি মূল্যবান কোটেশন শোভা পাচ্ছে প্রতিটি দ্রব্যের গায়ে, পড়ে দেখলাম কাগজের লেভেলে লেখা আছে, 'দেয়ার ইজ নো হিডেন অ্যাজেন্ডা। উই সিম্পলি ওয়ান্ট টু অ্যান্ড পোভার্টি ফ্রম দ্য লাইভস অব দৌজ হু উই সার্ভ'। অর্থাৎ 'আমাদের কোনো গোপন অভিসন্ধি নেই। আমরা যাদের সেবা দিচ্ছি, শুধু তাদের জীবন থেকে দারিদ্র্য দূর করতে চাই।' যেসব হস্ত ও কুটির শিল্পী বাস্কেট এবং ব্যাগগুলো তৈরি করেছেন, তাঁদের নামও সেঁটে দেওয়া হয়েছে প্রোডাক্টের গায়ে কাপড়ের লেবেলে। যাঁদের নাম আমি আজ এখানে লিখব তাঁরা যদি আমার এ লেখাটি পড়েন বা যিনি পড়েছেন, তাঁর কাছে শুনতে পান, তবে জানি না তাঁদের মনের অনুভূতি কেমন হবে, তবে তাঁদের নাম আজ গর্বভরে লিখতে পেরে আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে হয়তো বা তাঁরা দেশের লাখো কোটি মা-বোনের মতোই একেকজন গ্রাম্য বধূ কিংবা বালিকা, কিন্তু আমার কাছে তাঁরা প্রত্যেকেই সুদূর আমেরিকায় একেকজন বাংলাদেশি অ্যাম্বাসাডর। নিজেদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে তাঁরা সগৌরবে দেশমাতৃকা ও তার সুনাম তুলে ধরেছেন। আমার এই কলামের মাধ্যমে আজ আমি বাংলাদেশের নাম না জানা অখ্যাত অজপাড়াগাঁয়ের এই শিল্পীদের জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব শিল্পীর মন ও হাতের ছোঁয়া নিয়ে কয়েকটি ফ্রুট বাস্কেট এবং হ্যান্ডব্যাগ আমেরিকার বাজারে সগর্বে বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করছে তাঁরা হলেন- স্বর্ণ, পপি, সুচিত্রা, সুষমা, রীতা, ববিতা এবং মেরি। তাঁদের হাতের তৈরি জিনিসগুলো আমি সেদিন দেখেছি হোল বডি শপের ফ্লোরে, আজ হয়তো বা সেগুলো শোভা পাচ্ছে কোনো মার্কিন পরিবারের বেডরুমে অথবা বসার ঘরে। বাংলাদেশের এই পরিশ্রমী মানুষগুলোর প্রতি আমেরিকা প্রবাসী প্রতিটি বাংলাদেশি অভিবাসীর পক্ষ থেকে আবারও জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ।
লেখক : টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর- জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
Email : awahid2569@gmail.com
প্রথমে বলছি, বাংলাদেশি তৈরি পোশাক শিল্পের বিবর্তন ও তার সাফল্যের সংক্ষিপ্ত পটভূমি। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে আমি কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে পিএইচডি শুরু করেছি। এমন সময় আমার বড় ভাইয়ের সুবাদে আমেরিকায় ইমিগ্র্যান্ট ভিসা পেয়ে যাই। এর কিছুদিন পরই বোস্টনের নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিতে অ্যাডমিশনসহ একটি টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের অফার আসে। অফারটি পেয়ে আগপাছ না ভেবেই ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ম্যানিটোবার পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে প্রত্যাহার করে নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে যোগ দেব পরবর্তী জানুয়ারিতে। উইনিপ্যাগ থেকে বোস্টন যাওয়ার পথে নিউ ইয়র্কে বড় ভাইয়ের বাসায় ছিলাম দুই-তিন সপ্তাহ। ওই সময় সেখানে দেখা হয়েছিল এক তরুণ বাংলাদেশি গার্মেন্ট উদ্যোক্তার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি সাহসের সঙ্গে বেশ জোর দিয়ে একটি কথা বলেছিলেন, যা আজও আমার মনে আছে। তাঁরই ভাষায়, 'এবার ব্যবসা লাইনআপ করে গেলাম, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর এসে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের কনট্রাক্ট সাইন করে যাব।' তখন ওই গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর চোখেমুখে যে আত্মপ্রত্যয় এবং দৃঢ়তার ছাপ দেখেছিলাম, তাতে তাঁর কথার বিশ্বাসযোগ্যতায় আমার মনে একটুও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দানা বাঁধতে পারেনি। এরপর প্রায় ১০ বছর কেটে যায়। ইতিমধ্যে জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের চার্লস্টন শহরে ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছি। এমনি একসময় ১৯৯০ সালের শেষদিকে চার্লস্টনে প্রয়াত ড. মুশফেকুর রহমানের বাড়িতে দেখা হয় বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত এবং সফল পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তার সঙ্গে। তাঁর পুরো নাম কী তা জানা হয়নি, তবে সবাই তাঁকে জাকারিয়া সাহেব বলে ডাকছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠিত একটি বড় এবং সফল গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক। তাঁর কম্পানির নাম ছিল 'জুয়েল গার্মেন্টস'। ওই দিন সবার মুখেই শুনছিলাম পোশাক শিল্পে জাকারিয়া সাহেবের সফলতা ও তাঁর ধন-দৌলতের কথা। ছেলেমেয়েদের আমেরিকায় পড়ানোর জন্য তিনি ওহাইওর ডেইটনে রীতিমতো আরেকটি সংসার পেতেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে কিছুদিন পর ডেইটনে জাকারিয়া সাহেবের বাসায়ও আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, তাঁর ছেলের নাম ছিল জুয়েল এবং মেয়ে দুটির নাম ছিল নয়ন ও নূপুর।
অন্য অনেক ব্যবসার সঙ্গে আমার এক মামারও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। তিনি ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে ঘন ঘন আমেরিকা আসেন। তিনি দেখেন কোন কোন স্টোরে তাঁর কম্পানির তৈরি পোশাক রাখে এবং বিক্রি করে। এতে তিনি স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ রকমের আত্মতৃপ্তি উপভোগ করেন। আমি এবং আমার স্ত্রী এখানকার ডিসকাউন্ট এবং স্পেশাল্টি স্টোরে- সব জায়গায়ই যাই। কোনো সময় কেনাকাটা করতে, কোনো সময় উইন্ডো শপিংয়ে বা নিছক ঘোরাঘুরি করতে। কম-বেশি প্রায় সব দোকানেই আমি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখতে দেখেছি। কোনো কোনো দোকান থেকে মাঝেমধ্যে কিনেছিও। ওয়াল মার্ট, কে-মার্ট, গ্যাপ, ওল্ড নেভি, মেসিজ, গুডিজ, টিজে ম্যাঙ্, টার্গেট, সিয়ার্স, ডিলার্ডস, জেসি পেনি, বেল্ক, ডিজনি স্টোরসের র্যাকে বাংলাদেশের তৈরি বিভিন্ন জাতের পোশাক হরহামেশাই দেখা যায়। বাংলাদেশের রপ্তানিজাত নন-ট্র্যাডিশনাল আইটেম রাখে আমেরিকার কার্লাইল অ্যান্ড কম্পানি, বাথ অ্যান্ড বডি ওয়ার্কস, ওল্ড মিল পটারিজ, পটারি বার্ন, বেড বাথ অ্যান্ড বিওন্ড, ডলার ট্রি, ডলার জেনারেল স্টোরস ইত্যাদি। বাংলাদেশের যাবতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এবার দিচ্ছি আমার দেখা আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশি দ্রব্যের একটি খতিয়ান। কয়েক মাস আগে আমি এবং আমার স্ত্রী একদিন কাপড় কিনতে গিয়েছিলাম মোটামুটি নামিদামি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরস মেসিজে। আমার স্ত্রী মেয়েদের কাপড় দেখছিলেন। আমি ওপরতলায় ঘোরাঘুরি করছিলাম ডমেস্পি সেকশনে। হঠাৎ চোখে পড়ল বাংলাদেশের সিরামিক প্রোডাক্টস। ডিনার প্লেট, কারি বোল, ফুলদানি, পানির জার বা পিচার, সল্ট অ্যান্ড পেপার শেকার ইত্যাদি। কেনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দাম দেখেই আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। একেকটি ডিনার প্লেটের দাম ৭০ ডলার, একেকটি মাঝারি আকারের কারি বোলের দাম ধরা হয়েছে ৪৫ ডলার করে। এক জোড়া সল্ট অ্যান্ড পেপার শেকারের দাম ৫০ ডলার। ফুলদানি ও পিচারের দামটা সঠিক মনে করতে পারছি না। প্রতিটি প্রোডাক্টের কোয়ালিটি এবং ফিনিশিং দেখলাম খুবই উন্নতমানের। আইটেমগুলোর গায়ে ছাপায় লেখা, 'প্রোডাক্ট অব বাংলাদেশ'; কিন্তু কোন কম্পানির তৈরি, অনেক চেষ্টা করেও তার হদিস বের করতে পারলাম না। আরো দেখলাম, আমেরিকান কাস্টমাররা উৎসাহভরে শেলফে রাখা বাংলাদেশি জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করছে, উল্টেপাল্টে দেখছে, প্রাইস স্টিকারের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। হয়তো কিনবে, হয়তো বা কিনবে না। তবে কেউ না কেউ তো অবশ্যই কিনবে, নতুবা মেসিজের মতো দোকানের ফ্লোরে এগুলো স্থান করে নিতে পারত না। মেসিজের দোতলায় বাংলাদেশের সিরামিক টেবিলওয়্যার দেখে আমার ও আমার স্ত্রীর কাছে সেদিন খুবই ভালো লেগেছিল।
তার কয়েক মাস মাত্র সেদিন আমি এবং আমার স্ত্রী গিয়েছিলাম অরগ্যানিক চেইন ফুড স্টোরস 'হোল ফুডসের' দোকানে। হোল ফুডসে গ্রসারি সেরে রাস্তার ওপারে গেলাম তাদেরই সাবসিডিয়ারি বডি কেয়ারের দোকান 'হোল বডি' শপে। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে অভিভূত না হয়ে পারলাম না। অ্যান্ট্রেন্স দরজার সামনে একটি আয়লের মাথায় শেলফের নিচে মেঝেতে রাখা তালপাতার তৈরি কিছু ফ্রুট বাস্কেট এবং লম্বা হাতলওয়ালা মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ। দোকানে ঢোকার সময় আমার চোখে পড়েনি। বেরিয়ে আসার সময় আমার স্ত্রী আমাকে বলল, 'দেখো বাংলাদেশি প্রোডাক্টস।' আমি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। পড়ে দেখলাম, 'ব্লেসিং বাস্কেট' নামে একটি এনজিও জিনিসগুলো তৈরি করেছে বাংলাদেশের কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া একটি কাগজে 'ব্লেসিং বাস্কেট' প্রজেক্টের ম্যানেজার মিসেস তেরেসা উইলসনের একটি মূল্যবান কোটেশন শোভা পাচ্ছে প্রতিটি দ্রব্যের গায়ে, পড়ে দেখলাম কাগজের লেভেলে লেখা আছে, 'দেয়ার ইজ নো হিডেন অ্যাজেন্ডা। উই সিম্পলি ওয়ান্ট টু অ্যান্ড পোভার্টি ফ্রম দ্য লাইভস অব দৌজ হু উই সার্ভ'। অর্থাৎ 'আমাদের কোনো গোপন অভিসন্ধি নেই। আমরা যাদের সেবা দিচ্ছি, শুধু তাদের জীবন থেকে দারিদ্র্য দূর করতে চাই।' যেসব হস্ত ও কুটির শিল্পী বাস্কেট এবং ব্যাগগুলো তৈরি করেছেন, তাঁদের নামও সেঁটে দেওয়া হয়েছে প্রোডাক্টের গায়ে কাপড়ের লেবেলে। যাঁদের নাম আমি আজ এখানে লিখব তাঁরা যদি আমার এ লেখাটি পড়েন বা যিনি পড়েছেন, তাঁর কাছে শুনতে পান, তবে জানি না তাঁদের মনের অনুভূতি কেমন হবে, তবে তাঁদের নাম আজ গর্বভরে লিখতে পেরে আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে হয়তো বা তাঁরা দেশের লাখো কোটি মা-বোনের মতোই একেকজন গ্রাম্য বধূ কিংবা বালিকা, কিন্তু আমার কাছে তাঁরা প্রত্যেকেই সুদূর আমেরিকায় একেকজন বাংলাদেশি অ্যাম্বাসাডর। নিজেদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে তাঁরা সগৌরবে দেশমাতৃকা ও তার সুনাম তুলে ধরেছেন। আমার এই কলামের মাধ্যমে আজ আমি বাংলাদেশের নাম না জানা অখ্যাত অজপাড়াগাঁয়ের এই শিল্পীদের জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব শিল্পীর মন ও হাতের ছোঁয়া নিয়ে কয়েকটি ফ্রুট বাস্কেট এবং হ্যান্ডব্যাগ আমেরিকার বাজারে সগর্বে বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করছে তাঁরা হলেন- স্বর্ণ, পপি, সুচিত্রা, সুষমা, রীতা, ববিতা এবং মেরি। তাঁদের হাতের তৈরি জিনিসগুলো আমি সেদিন দেখেছি হোল বডি শপের ফ্লোরে, আজ হয়তো বা সেগুলো শোভা পাচ্ছে কোনো মার্কিন পরিবারের বেডরুমে অথবা বসার ঘরে। বাংলাদেশের এই পরিশ্রমী মানুষগুলোর প্রতি আমেরিকা প্রবাসী প্রতিটি বাংলাদেশি অভিবাসীর পক্ষ থেকে আবারও জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ।
লেখক : টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর- জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
Email : awahid2569@gmail.com
No comments