সমকালীন প্রসঙ্গ-ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমা ও গুন্টার গ্রাসের কবিতা by বদরুদ্দীন উমর

গুন্টার গ্রাসের কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমা নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক ও ঝড় এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে দেখা যাচ্ছে তাতে ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির ইন্সপেকশন বা পরিদর্শন আন্তর্জাতিকভাবে এখন জরুরি হয়েছে।


জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক কমিশনকে এখন এ কাজে নিযুক্ত হতে হবে। এতদিনের জানা, কিন্তু গোপন রাখা বিষয়টি যখন আলোচিত হচ্ছে, তখন একে ধামাচাপা দিয়ে রাখা এবং সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক ইসরায়েলকে একটি সাধু রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করার চক্রান্ত নস্যাৎ করে সাম্রাজ্যবাদ এবং ইসরায়েলের মুখোশ পুরোপুরি উন্মোচনের সময় এখন এসেছে

জার্মান লেখক ও কবি গুন্টার গ্রাস কয়েকদিন আগে একটি কবিতা লিখেছেন। রাজনৈতিক কবিতা। এই কবিতায় যে মূল কথাটি তিনি বলেছেন সে কথা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার ইউরোপিয়ান মিত্ররা খুব যত্নের সঙ্গে আড়াল করে রাখে। কথাটি হলো, ইসরায়েলের কাছে পর্বতপ্রমাণ পারমাণবিক বোমা মজুদ আছে। এই মজুদ তারা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে এবং পারমাণবিক বোমা তৈরির বিরুদ্ধে যে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আছে তা অমান্য করে গোপনে তারা এখনও এই বোমা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং নিজেদের মজুদ বৃদ্ধি করছে।
এ কথাটি আমি বহুদিন ধরে মাঝে মধ্যে লিখে আসছি এবং ১১ মার্চ ২০১২ তারিখের যুগান্তরেও লিখেছি। 'ইসরাইলের পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে কোন আওয়াজ ও প্রতিরোধ নেই কেন?' আমি তাতে বলেছিলাম যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা এ বিষয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থে নিশ্চুপ আছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে অন্য কেউই এ বিষয়ে কিছু বলে না। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশেও কোথাও কেউ এ নিয়ে আলোচনা করে না। প্রতিবাদ হয় না। পত্রপত্রিকাতে কোনো লেখা দেখা যায় না, তারা কোনো সম্পাদকীয় লেখে না। কাজেই ইসরায়েল নিজেদের দেশে পারমাণবিক বোমা স্তূপীকৃত রেখে ইরানকে তার কথিত পারমাণবিক বোমা তৈরি থেকে বিরত রাখার জন্য সে দেশটি আক্রমণের যে প্রস্তুতি নিচ্ছে তার বিরুদ্ধেও সাম্রাজ্যবাদীরা কিছুই বলে না। কারণ তারাই এর ইন্ধনদাতা। কিন্তু তাদের বাইরে দুনিয়ার বুদ্ধিজীবীরা, রাষ্ট্রনেতা ও রাজনৈতিক দলও কিছুই বলে না।
এখন জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমার ওপর লিখে তাকে মধ্যপ্রাচ্যে সব থেকে বিপজ্জনক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করায় ইসরায়েল ও বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো গ্রাসের বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার হয়ে তাকে দায়িত্বহীন ইত্যাদি বলে গালাগালি করছে! এটা দেখে এখন আমাদের দেশেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইসরায়েলের এই ক্রিমিনাল কাজের বিরুদ্ধে বেশি না হলেও কিছু লেখালেখি হচ্ছে। নিজেদের চিন্তা-চেতনা দিয়ে যে কাজ তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এখন পশ্চিমা দেশগুলোতে সে বিষয়ে কথা ওঠায় এরাও সরব হয়েছেন। এতেও দোষের কিছু নেই। ভালো কাজে দেরি হলেও ক্ষতি নেই।
ডযধঃ সঁংঃ নব ংধরফ বা যে কথা বলতেই হবে শীর্ষক কবিতাটি লেখায় ইসরায়েল গুন্টার গ্রাসের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে বিষোদ্গার করছে এবং গ্রাসের ইসরায়েল প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে! তাদের এই দ্বিতীয় কর্মটি হাস্যকর। কারণ, গুন্টার গ্রাস ইসরায়েল সফরের জন্য ব্যাগ্র নন এবং সেখানে যাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তার কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সমগ্র পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ গ্রাসের কবিতাটির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। কারণ তারা যেভাবে ইসরায়েলকে নিজেদের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে তার চরিত্রও গ্রাসের এই কবিতার দ্বারা উন্মোচিত হয়েছে। গ্রাসের কবিতার মূল্য কতখানি শিল্পোত্তীর্ণ এ কথা বা এ বিতর্ক এ ক্ষেত্রে যারা করেন তাদের কথাবার্তার মধ্যে সারবন্তু বলে কিছু নেই। আসল কথা হলো, এই কবিতার মাধ্যমে গুন্টার গ্রাস বিশ্বের জনগণের কাছে যে বার্তা পেঁৗছাতে চেয়েছেন সেটা ঠিকমতোই পেঁৗছেছে। কবিতাটির বিরুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের যে ত্রুক্রদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তার থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়।
ইরান যে পারমাণবিক বোমার কাজে তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিযুক্ত রেখেছে এর কোনো প্রমাণই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের হাতে নেই। ইরানের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগ উত্থাপন করলেও তার কোনো প্রমাণ তাদের হাতে না থাকা সত্ত্বেও যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইরাক আক্রমণ করে সে দেশটি দখল করেছিল তাদের তেলসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য, ঠিক সেভাবেই এখন তারা আবার একইভাবে ইরানের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ উত্থাপন করছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির। ইরানের তেল লুটপাট করাই যে এর লক্ষ্য এ নিয়ে দুনিয়ায় সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের কোনো সংশয় বা দ্বিতীয় মত নেই। কিন্তু সুস্থ বুদ্ধির পরোয়া করে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নীতিনির্ধারণ ও তা কার্যকর করে না। এদিক দিয়ে তারা বেপরোয়া। তারা শক্তি মদমত্ত।
ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিষাক্ত নরখাদক রাষ্ট্র (চধৎধংরঃব ংঃধঃব)। এই বিষাক্ত ও বিপজ্জনক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদীরা চক্রান্তে লিপ্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে তারা এ কাজে সফল হয়। সেই থেকে এই রাষ্ট্রটিকে দিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে নিয়ে অন্য সাম্রাজ্যবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যে যত অশান্তি সৃষ্টি করেছে একটি ছোট রাষ্ট্রের মাধ্যমে এত বড় অঞ্চলজুড়ে এত বড় অশান্তি সৃষ্টি ইতিপূর্বে ইতিহাসে আর দেখা যায়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাজনি জগতে (ঋরহধহপরধষ ড়িৎষফ) ইহুদিবাদীদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ আছে। এই ইহুদিবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণ ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সব ইহুদিই ইহুদিবাদী (তরড়হরংঃ) রাষ্ট্রের স্বপক্ষে নেই। কোনোদিন তা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ইসরায়েলবিরোধী ইহুদিদের সংখ্যা ও তৎপরতা যে কোনো সময়ের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে ইসরায়েলবিরোধী এক বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ইহুদি। এ বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার এ কারণে যে, ইসরায়েলের বিষয়টিকে একটি সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রদানের চেষ্টা প্রায়ই করা হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিষয়টির দিকে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিশেষ সম্পর্ক নেই, যদিও মুসলমান এবং ইহুদিদের মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক বিরোধিতা দীর্ঘদিন ধরে আছে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, মুসলমানদের থেকে খ্রিস্টানদের সঙ্গে ইহুদিদের শুধু বিরোধিতা নয়, একটা শত্রুতার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ইংরেজ ঔপন্যাসিক স্কটের 'আইভানহো', শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিসসহ পশ্চিমা ভাষার অনেক রচনায় খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মধ্যে এই সম্পর্কের চেহারা দেখা যায়। হিটলার যে জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে ইহুদিদেরও তার তীব্র আক্রমণের লক্ষ্যস্থল করেছিল এটা কে না জানে? কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থে খ্রিস্টান-ইহুদি শত্রুতাকে মুসলমান-ইহুদি শত্রুতায় পরিণত করার চক্রান্ত করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের এই লক্ষ্য অর্জন করে। খ্রিস্টান ইহুদি সাম্প্রদায়িক শত্রুতার পরিবর্তে শক্তিশালীভাবে দেখা যায় মুসলমান-ইহুদি শত্রুতার সম্পর্ক। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা কীভাবে নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্ব-স্ব সংঘর্ষ সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনে সে সম্পর্কের অবসান ঘটায় সেটা ঐতিহাসিকভাবে খ্রিস্টান-ইহুদি সম্পর্ক এবং মুসলমান-ইহুদি সম্পর্কের বিবর্তনের মধ্যে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
যাই হোক, এ বিষয়টির অবতারণা এখানে করা হলো এ কারণে যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল ও মুসলমান জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মূল কারণ এ দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের কোনো ধরনের দ্বন্দ্বের মধ্যে লিখিত নেই। সাম্রাজ্যবাদী মতলবাজিই এর মূল কারণ। সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের মতলব হাসিল করার জন্যই এই বিরোধকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ প্রচেষ্টায় তাদের সাফল্য কম মনে করার উপায় নেই।
পরিশেষে এ বিষয়টি জোর দিয়েই বলা দরকার যে, গুন্টার গ্রাসের কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমা নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক ও ঝড় এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে দেখা যাচ্ছে তাতে ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির ইন্সপেকশন বা পরিদর্শন আন্তর্জাতিকভাবে এখন জরুরি হয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক কমিশনকে এখন এ কাজে নিযুক্ত হতে হবে। এতদিনের জানা, কিন্তু গোপন রাখা বিষয়টি যখন আলোচিত হচ্ছে, তখন একে ধামাচাপা দিয়ে রাখা এবং সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক ইসরায়েলকে একটি সাধু রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করার চক্রান্ত নস্যাৎ করে সাম্রাজ্যবাদ এবং ইসরায়েলের মুখোশ পুরোপুরি উন্মোচনের সময় এখন এসেছে। এটাই হলো এখন জাতিসংঘ এবং তাদের পারমাণবিক কমিশনের এক আশু ও জরুরি কর্তব্য। এ কাজ তারা করবে কি-না এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ জাতিসংঘ সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ীই কাজ করে। এ অবস্থায় বিশ্বের সচেতন জনগণের কাজ হলো, ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক কমিশন কর্তৃক পরিদর্শনের জন্য জোর দাবি করা। এর জন্য প্রচার কাজ এবং আন্দোলন করা। এ কাজ বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের এক অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরি কর্মসূচি।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, গুন্টার গ্রাসের কবিতা এবং বিশ্বজুড়ে এ নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় এখন বইছে এ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনকারী আরব রাষ্ট্রগুলো এবং তাদের সংগঠন আরব লীগের কোনো বক্তব্য নেই! অথচ লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশে সাম্রাজ্যবাদী লাইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে এদের উৎসাহের শেষ নেই! কাজেই মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুধু ইসরায়েল নয়, প্রতিক্রিয়াশীল আরব রাষ্ট্রগুলোরও আমূল পরিবর্তন ছাড়া সম্পন্ন হওয়ার কোনো উপায় নেই।
১৬.৪.২০১২

No comments

Powered by Blogger.