সুরঞ্জিত বাবুর থলের বিড়াল by ইমদাদুল হক মিলন
আপনাদের কাগজের কলকাতা প্রতিনিধি আছে না?
অবশ্যই।
তাকে একটু খোঁজখবর করতে বলুন।
কী ব্যাপারে?
অবশ্যই।
তাকে একটু খোঁজখবর করতে বলুন।
কী ব্যাপারে?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যাপারে। আমাদের রেলমন্ত্রীর কলকাতায় কখানা বাড়ি, কী কী প্রপার্টি। ব্যাংকে কত টাকা?
আমি আর এ বিষয়ে কথা বললাম না। আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে আলোচনা। বিদেশে বসবাস করা বাঙালিরাও প্রতি মুহূর্তে খোঁজখবর রাখছেন তাঁর। যেখানে যাই, সেখানেই শুধু এই আলোচনা। পহেলা বৈশাখের দিন এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। দিনের কাজ শেষ করে গেছি তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে প্রশ্নটা করলেন।
আমি সাধারণত রাজনৈতিক আলোচনায় থাকি না। অন্যরা আলাপ-আলোচনা করেন, আমি থাকি শ্রোতা হয়ে। সেদিনও শ্রোতা হয়ে গেলাম। জানি আমার আর কথা বলার সুযোগ নেই, যা বলার অন্যরাই বলবেন।
একজন বললেন, `আমি শুনেছি, কলকাতায় সুরঞ্জিত বাবুর ছয় তলা বিশাল বাড়ি আছে। ওখানকার ব্যাংকে টাকা আছে অঢেল। তৈরি বাড়ি কিনেছেন বছরখানেক হলো, আর নগদ টাকা নানাভাবে গিয়ে জমা হচ্ছে ব্যাংকে।`
আরেকজন বললেন, `এটা আর কী এমন ব্যাপার! আমি তো শুনলাম, দিরাই না কোন এলাকায় যেন তিনি বিশাল একটা মার্কেট করেছেন। ৫০-৬০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছেন। সেই মার্কেট উদ্বোধন করার কথা ছিল এর মধ্যেই। এর আগেই তো ঘটে গেল ঘটনা।`
লালু নামের এক ভদ্রলোক বললেন, `ভাই, আসল তথ্য আপনারা জানেন না। আমি একটা সোর্স থেকে জেনেছি, সে-রাতে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএসের গাড়িতে শুধু ৭০ লাখ টাকা ছিল না, টাকা ছিল চার কোটি ৭০ লাখ। পিলখানায় ধরা পড়ার পর চার কোটি এদিক-ওদিক হয়ে গেছে। টাকা যাচ্ছিল তাঁর বাড়িতেই। যাবতীয় সর্বনাশের মূলে ওই ব্যাটা ড্রাইভার।`
খোকন বলল, সুরঞ্জিত বাবুর ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত আইটি ইঞ্জিনিয়ার। তিনি `সেনগুপ্ত টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড` নামে কম্পানি করেছেন। রেলওয়ের ঘুষ কেলেঙ্কারির দুই দিন পর `ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ` বা `আইসিএক্স` লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বিটিআরসি থেকে। লাইসেন্সের জন্য ফি দিতে হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। সৌমেন নাকি সাধারণ চাকরিজীবী। একজন সাধারণ চাকরিজীবী পাঁচ কোটি টাকা কোথায় পান? তা ছাড়া আইসিএক্স অবকাঠামো তৈরি করতে লাগবে ৩০ কোটি টাকা। এত টাকা আসবে কোত্থেকে?
চটুল স্বভাবের লুৎফর বলল, কেন, রেলমন্ত্রী দেবেন। তাঁর কাছে ৩০ কোটি টাকা নস্যি, নস্যি। পাঁচ-সাত শ কোটি টাকা কামিয়ে ফেলেছেন না? রেলওয়ে বিশাল ব্যাপার। রেলমন্ত্রীর টাকা বানাতে কদিন লাগে?
আমি শুনেই যাচ্ছি। বললাম না, নীরব শ্রোতা!
মাসুদ খুবই ভাবুক টাইপের মানুষ। চিন্তাভাবনা করে কথা বলে। সে বলল, আমার মাথায় বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএসের ৭০ লাখ টাকার ঘটনা নিয়ে। পিলখানার গেটে গাড়িটা ধরা পড়ল, ওখানে বিজিবি তো আছেই, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও থাকেন। তাঁরা যখন গাড়িটা আটকালেন, টাকা উদ্ধার করলেন, সুরঞ্জিত বাবুর এপিএস এবং ড্রাইভারকে পুলিশে দিলেন না কেন? নিউ মার্কেট থানায় এখনো পর্যন্ত জিডি হয়নি কেন? ড্রাইভার যদি ব্ল্যাকমেইল করে থাকেন এ ব্যাপারে কেস হলো না কেন? থানা বলছে, তাদের কিছু জানানোই হয়নি। ওই ৭০ লাখ টাকা জব্দ করাও হয়নি। টাকা জমা হয়েছে এপিএসের অ্যাকাউন্টে। এ রকম একটি ঘটনার কোনো আইনগত পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয়নি?
শিলা একটি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ান। তিনি বললেন, `দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে শুনলাম। সুরঞ্জিত বাবুর পিএস হচ্ছেন একটি তদন্ত কমিটির প্রধান। মন্ত্রীর দুর্নীতিবিষয়ক তদন্ত কমিটির প্রধান যদি হন সেই মন্ত্রীর পিএস, তাহলে এই তদন্ত কমিটির অর্থ কী?`
মাসুদ বলল, সুরঞ্জিত বাবু সুনামগঞ্জের মানুষ। যে জায়গার নামের সঙ্গে আছে `সুনাম` সেই জায়গার মানুষ হয়ে তিনি জায়গাটিকে কলঙ্কিত করলেন। সুনামগঞ্জের রাজনীতিবিদরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও তাঁকে নিয়ে লজ্জা পাচ্ছে। কেউ কেউ খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছে। এমন রাজনীতিবিদকে এলাকায় ঢুকতে দেওয়া উচিত না বলেও মন্তব্য করেছে কেউ কেউ। সুরঞ্জিত বাবু বাম রাজনীতি করতেন। বাম রাজনীতি করা মানুষদের আমরা খুবই সৎ মানুষ হিসেবে জানি। তা ছাড়া সুরঞ্জিত বাবু আইনজ্ঞ হিসেবেও খুব নামকরা। তাঁর মতো মানুষ এটা কী করলেন?
একজন বললেন, `আরে ভাই তিনি তো করেননি, করেছে তাঁর এপিএস।`
মাসুদ হাত তুলে তাঁকে থামাল। এসব হাস্যকর কথা বলবেন না, ভাই। খবরের কাগজ পড়েন? পড়লে এই প্রশ্নটা করতেন না। তাঁর এপিএস ও জিএমকে রেলমন্ত্রী দশবার ফোন করেছিলেন। আর ওই জিএম ভদ্রলোক সম্পর্কে জানেন? এক বছর আগে তাঁর বাংলোয় ডাকাতি হয়েছিল। ধরা পড়ার পর ডাকাতরা বলেছে, আমরা ডাকাতি করেছি ২৪ লাখ টাকা, আর ওই জিএম বলছেন, আরে না না, দুই লাখ টাকা। এর অর্থ কী?
অর্থটা সবাই বুঝল এবং হাসতে লাগল।
রেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে টাকা দিতে হবে, এই প্রচারণা প্রকাশ্যে চালিয়েছেন জিএমসহ আরো কেউ কেউ। নিয়োগ বাণিজ্যে রেলমন্ত্রীকে জড়িয়ে টাকা তোলার কারণে রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা সুরঞ্জিত বাবুকে ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছিলেন। এর পরও বন্ধ হয়নি নিয়োগ-বাণিজ্য। এসবের অর্থ কী?
লুৎফর বলল, অর্থ খুব পরিষ্কার। ব্যাখ্যার দরকার নেই। যে যত কথাই বলুক, তীর সুরঞ্জিত বাবুর দিকে। বাংলাদেশের মানুষ এত বোকা না যে তারা বুঝতে পারবে না কোথায় কিভাবে কী হচ্ছে!
মাসুদ বলল, টিআইবি রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। সুরঞ্জিত বাবু প্রথম দিন বললেন, পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার। দুই দিন পর বললেন, পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। দূর দেশের কথা বলে লাভ নেই, পাশের দেশ ভারতের কথাই বলি, ভারতে রেল দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। বিনীতভাবে জাতির কাছে ক্ষমা চান। এ আমার ত্রুটি, আমি আমার দায়িত্বে মনোযোগী ছিলাম না। আমাকে ক্ষমা করুন। আর আমাদের রেলমন্ত্রী? এমন ঘুষ কেলেঙ্কারির পর কেন তিনি পদত্যাগ করছেন না? কেন এখনো চেয়ার আগলে বসে আছেন? দেশের মানুষের কাছে মুখ দেখাতে তাঁর লজ্জা করছে না? তাঁর তো প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করা উচিত।
হারুন নামের এক ভদ্রলোক বললেন, `আচ্ছা সুরঞ্জিত বাবুর বয়স কত?` লালু বলল, `৬৯-৭০ হবে।`
সঙ্গে সঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল আমার। কলেজজীবনে পড়েছিলাম। শিক্ষামূলক গল্প। নড়েচড়ে বসে বললাম, আমি একটা গল্প বলতে চাই।
সবাই আমার মুখের দিকে তাকাল। বলুন।
ঈশ্বর যখন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠালেন, মানুষের বয়স নির্ধারণ করে দিলেন ৫০ বছর। মানুষ বলল, `না না, এত কম বয়স আমরা নেব না। আমাদের আরো কিছু বয়স দিন।` ঈশ্বর তখন ঘোড়ার বয়স থেকে ২০ বছর বয়স কেটে সেই বয়স মানুষকে দিলেন। মানুষের বয়স দাঁড়াল ৭০ বছর। মানুষ তাতেও খুশি হলো না। আবার ঈশ্বরের কাছে আবেদন জানিয়ে বলল, `৭০ বছর বয়সেও আমরা খুশি না। আমাদের আরো কিছু বয়স দেওয়া হোক।` ঈশ্বর তখন বানরের বয়স থেকে ১০ বছর বয়স কেটে মানুষকে দিলেন। মানুষের বয়স দাঁড়াল ৮০ বছর। কিন্তু ঈশ্বরের কারবার খুবই অর্থময়। তিনি ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বেশির ভাগ মানুষকে রাখলেন প্রকৃত মানুষের চরিত্রে। যাবতীয় মানবিক কার্যাবলি, সৎ কাজ, শুভ কাজ, কল্যাণকর কাজ ওই বয়সের মধ্যেই সেরে ফেলে মানুষ। এর পরের ২০ বছর, মানুষ ছোটে ঘোড়ার গতিতে। ওই যে ২০ বছর ঘোড়ার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং স্বভাব হয়ে যায় ঘোড়ার মতো। দৌড়ের পর দৌড় মেরে কোনো কোনো মানুষ অযথাই কোনো একটা গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। প্রয়োজন নেই, তবু সে ছুটবে। এর পরের ১০টা বছরের অর্থ আরো খারাপ। যেহেতু এই ১০ বছর নেওয়া হয়েছে বানরের কাছ থেকে, ৭০-এর পর মানুষের স্বভাব বানরের মতো খোঁচাখুঁচির পর্যায়ে চলে যায়। তবে আগেই বলেছি, সব মানুষের ক্ষেত্রে না। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে।
সুরঞ্জিত বাবু অকারণেই ছুটছিলেন। প্রয়োজন ছিল না, তবু পচা শামুকে পা কাটলেন। কাটা পায়ের রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য তাঁর পদত্যাগ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আমি আর এ বিষয়ে কথা বললাম না। আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নিয়ে এখন দেশজুড়ে আলোচনা। বিদেশে বসবাস করা বাঙালিরাও প্রতি মুহূর্তে খোঁজখবর রাখছেন তাঁর। যেখানে যাই, সেখানেই শুধু এই আলোচনা। পহেলা বৈশাখের দিন এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। দিনের কাজ শেষ করে গেছি তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে প্রশ্নটা করলেন।
আমি সাধারণত রাজনৈতিক আলোচনায় থাকি না। অন্যরা আলাপ-আলোচনা করেন, আমি থাকি শ্রোতা হয়ে। সেদিনও শ্রোতা হয়ে গেলাম। জানি আমার আর কথা বলার সুযোগ নেই, যা বলার অন্যরাই বলবেন।
একজন বললেন, `আমি শুনেছি, কলকাতায় সুরঞ্জিত বাবুর ছয় তলা বিশাল বাড়ি আছে। ওখানকার ব্যাংকে টাকা আছে অঢেল। তৈরি বাড়ি কিনেছেন বছরখানেক হলো, আর নগদ টাকা নানাভাবে গিয়ে জমা হচ্ছে ব্যাংকে।`
আরেকজন বললেন, `এটা আর কী এমন ব্যাপার! আমি তো শুনলাম, দিরাই না কোন এলাকায় যেন তিনি বিশাল একটা মার্কেট করেছেন। ৫০-৬০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছেন। সেই মার্কেট উদ্বোধন করার কথা ছিল এর মধ্যেই। এর আগেই তো ঘটে গেল ঘটনা।`
লালু নামের এক ভদ্রলোক বললেন, `ভাই, আসল তথ্য আপনারা জানেন না। আমি একটা সোর্স থেকে জেনেছি, সে-রাতে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএসের গাড়িতে শুধু ৭০ লাখ টাকা ছিল না, টাকা ছিল চার কোটি ৭০ লাখ। পিলখানায় ধরা পড়ার পর চার কোটি এদিক-ওদিক হয়ে গেছে। টাকা যাচ্ছিল তাঁর বাড়িতেই। যাবতীয় সর্বনাশের মূলে ওই ব্যাটা ড্রাইভার।`
খোকন বলল, সুরঞ্জিত বাবুর ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত আইটি ইঞ্জিনিয়ার। তিনি `সেনগুপ্ত টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড` নামে কম্পানি করেছেন। রেলওয়ের ঘুষ কেলেঙ্কারির দুই দিন পর `ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ` বা `আইসিএক্স` লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বিটিআরসি থেকে। লাইসেন্সের জন্য ফি দিতে হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। সৌমেন নাকি সাধারণ চাকরিজীবী। একজন সাধারণ চাকরিজীবী পাঁচ কোটি টাকা কোথায় পান? তা ছাড়া আইসিএক্স অবকাঠামো তৈরি করতে লাগবে ৩০ কোটি টাকা। এত টাকা আসবে কোত্থেকে?
চটুল স্বভাবের লুৎফর বলল, কেন, রেলমন্ত্রী দেবেন। তাঁর কাছে ৩০ কোটি টাকা নস্যি, নস্যি। পাঁচ-সাত শ কোটি টাকা কামিয়ে ফেলেছেন না? রেলওয়ে বিশাল ব্যাপার। রেলমন্ত্রীর টাকা বানাতে কদিন লাগে?
আমি শুনেই যাচ্ছি। বললাম না, নীরব শ্রোতা!
মাসুদ খুবই ভাবুক টাইপের মানুষ। চিন্তাভাবনা করে কথা বলে। সে বলল, আমার মাথায় বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএসের ৭০ লাখ টাকার ঘটনা নিয়ে। পিলখানার গেটে গাড়িটা ধরা পড়ল, ওখানে বিজিবি তো আছেই, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও থাকেন। তাঁরা যখন গাড়িটা আটকালেন, টাকা উদ্ধার করলেন, সুরঞ্জিত বাবুর এপিএস এবং ড্রাইভারকে পুলিশে দিলেন না কেন? নিউ মার্কেট থানায় এখনো পর্যন্ত জিডি হয়নি কেন? ড্রাইভার যদি ব্ল্যাকমেইল করে থাকেন এ ব্যাপারে কেস হলো না কেন? থানা বলছে, তাদের কিছু জানানোই হয়নি। ওই ৭০ লাখ টাকা জব্দ করাও হয়নি। টাকা জমা হয়েছে এপিএসের অ্যাকাউন্টে। এ রকম একটি ঘটনার কোনো আইনগত পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয়নি?
শিলা একটি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ান। তিনি বললেন, `দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে শুনলাম। সুরঞ্জিত বাবুর পিএস হচ্ছেন একটি তদন্ত কমিটির প্রধান। মন্ত্রীর দুর্নীতিবিষয়ক তদন্ত কমিটির প্রধান যদি হন সেই মন্ত্রীর পিএস, তাহলে এই তদন্ত কমিটির অর্থ কী?`
মাসুদ বলল, সুরঞ্জিত বাবু সুনামগঞ্জের মানুষ। যে জায়গার নামের সঙ্গে আছে `সুনাম` সেই জায়গার মানুষ হয়ে তিনি জায়গাটিকে কলঙ্কিত করলেন। সুনামগঞ্জের রাজনীতিবিদরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও তাঁকে নিয়ে লজ্জা পাচ্ছে। কেউ কেউ খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছে। এমন রাজনীতিবিদকে এলাকায় ঢুকতে দেওয়া উচিত না বলেও মন্তব্য করেছে কেউ কেউ। সুরঞ্জিত বাবু বাম রাজনীতি করতেন। বাম রাজনীতি করা মানুষদের আমরা খুবই সৎ মানুষ হিসেবে জানি। তা ছাড়া সুরঞ্জিত বাবু আইনজ্ঞ হিসেবেও খুব নামকরা। তাঁর মতো মানুষ এটা কী করলেন?
একজন বললেন, `আরে ভাই তিনি তো করেননি, করেছে তাঁর এপিএস।`
মাসুদ হাত তুলে তাঁকে থামাল। এসব হাস্যকর কথা বলবেন না, ভাই। খবরের কাগজ পড়েন? পড়লে এই প্রশ্নটা করতেন না। তাঁর এপিএস ও জিএমকে রেলমন্ত্রী দশবার ফোন করেছিলেন। আর ওই জিএম ভদ্রলোক সম্পর্কে জানেন? এক বছর আগে তাঁর বাংলোয় ডাকাতি হয়েছিল। ধরা পড়ার পর ডাকাতরা বলেছে, আমরা ডাকাতি করেছি ২৪ লাখ টাকা, আর ওই জিএম বলছেন, আরে না না, দুই লাখ টাকা। এর অর্থ কী?
অর্থটা সবাই বুঝল এবং হাসতে লাগল।
রেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে টাকা দিতে হবে, এই প্রচারণা প্রকাশ্যে চালিয়েছেন জিএমসহ আরো কেউ কেউ। নিয়োগ বাণিজ্যে রেলমন্ত্রীকে জড়িয়ে টাকা তোলার কারণে রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা সুরঞ্জিত বাবুকে ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছিলেন। এর পরও বন্ধ হয়নি নিয়োগ-বাণিজ্য। এসবের অর্থ কী?
লুৎফর বলল, অর্থ খুব পরিষ্কার। ব্যাখ্যার দরকার নেই। যে যত কথাই বলুক, তীর সুরঞ্জিত বাবুর দিকে। বাংলাদেশের মানুষ এত বোকা না যে তারা বুঝতে পারবে না কোথায় কিভাবে কী হচ্ছে!
মাসুদ বলল, টিআইবি রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। সুরঞ্জিত বাবু প্রথম দিন বললেন, পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার। দুই দিন পর বললেন, পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। দূর দেশের কথা বলে লাভ নেই, পাশের দেশ ভারতের কথাই বলি, ভারতে রেল দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। বিনীতভাবে জাতির কাছে ক্ষমা চান। এ আমার ত্রুটি, আমি আমার দায়িত্বে মনোযোগী ছিলাম না। আমাকে ক্ষমা করুন। আর আমাদের রেলমন্ত্রী? এমন ঘুষ কেলেঙ্কারির পর কেন তিনি পদত্যাগ করছেন না? কেন এখনো চেয়ার আগলে বসে আছেন? দেশের মানুষের কাছে মুখ দেখাতে তাঁর লজ্জা করছে না? তাঁর তো প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করা উচিত।
হারুন নামের এক ভদ্রলোক বললেন, `আচ্ছা সুরঞ্জিত বাবুর বয়স কত?` লালু বলল, `৬৯-৭০ হবে।`
সঙ্গে সঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল আমার। কলেজজীবনে পড়েছিলাম। শিক্ষামূলক গল্প। নড়েচড়ে বসে বললাম, আমি একটা গল্প বলতে চাই।
সবাই আমার মুখের দিকে তাকাল। বলুন।
ঈশ্বর যখন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠালেন, মানুষের বয়স নির্ধারণ করে দিলেন ৫০ বছর। মানুষ বলল, `না না, এত কম বয়স আমরা নেব না। আমাদের আরো কিছু বয়স দিন।` ঈশ্বর তখন ঘোড়ার বয়স থেকে ২০ বছর বয়স কেটে সেই বয়স মানুষকে দিলেন। মানুষের বয়স দাঁড়াল ৭০ বছর। মানুষ তাতেও খুশি হলো না। আবার ঈশ্বরের কাছে আবেদন জানিয়ে বলল, `৭০ বছর বয়সেও আমরা খুশি না। আমাদের আরো কিছু বয়স দেওয়া হোক।` ঈশ্বর তখন বানরের বয়স থেকে ১০ বছর বয়স কেটে মানুষকে দিলেন। মানুষের বয়স দাঁড়াল ৮০ বছর। কিন্তু ঈশ্বরের কারবার খুবই অর্থময়। তিনি ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বেশির ভাগ মানুষকে রাখলেন প্রকৃত মানুষের চরিত্রে। যাবতীয় মানবিক কার্যাবলি, সৎ কাজ, শুভ কাজ, কল্যাণকর কাজ ওই বয়সের মধ্যেই সেরে ফেলে মানুষ। এর পরের ২০ বছর, মানুষ ছোটে ঘোড়ার গতিতে। ওই যে ২০ বছর ঘোড়ার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং স্বভাব হয়ে যায় ঘোড়ার মতো। দৌড়ের পর দৌড় মেরে কোনো কোনো মানুষ অযথাই কোনো একটা গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। প্রয়োজন নেই, তবু সে ছুটবে। এর পরের ১০টা বছরের অর্থ আরো খারাপ। যেহেতু এই ১০ বছর নেওয়া হয়েছে বানরের কাছ থেকে, ৭০-এর পর মানুষের স্বভাব বানরের মতো খোঁচাখুঁচির পর্যায়ে চলে যায়। তবে আগেই বলেছি, সব মানুষের ক্ষেত্রে না। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে।
সুরঞ্জিত বাবু অকারণেই ছুটছিলেন। প্রয়োজন ছিল না, তবু পচা শামুকে পা কাটলেন। কাটা পায়ের রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য তাঁর পদত্যাগ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
No comments