কণ্ঠস্বর-দ্বিতীয় পাকিস্তান? by রাহাত খান
দুই কান কাটা জামায়াতে ইসলামী এবং 'একই' পরিবারের বড়-ছোট দলগুলো হয়তো এসবই ভুলে গেছে। কিন্তু যারা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দেখেছেন, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালির জয় দেখেছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখেছেন,
তারা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন ও নির্যাতনের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না
যার এক কান কাটা, সে জনসমক্ষে যেতে লজ্জা পায়। দুই কান কাটা লোকের এই লজ্জাটা আর থাকে না। সে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাজারে বা জনসমক্ষে যায়। কান কাটা নিয়ে কে কী ভাবল, তার পরোয়া করে না।
আমি বলি না, জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ওপরে বর্ণিত দুই কান কাটা দশার লোক। কেন বলব? পিতা-মাতার সূত্রে পাওয়া তার কান দুটি তো যথাস্থানে আছে বহাল-তবিয়তে। খামাখা অসত্য কথা বলতে যাব কোন দুঃখে!
তবে হালে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ দল সম্পর্কে এই ভারপ্রাপ্ত লোকটি এমন এক কথা বলেছেন, যা শুনে দুই কান কাটা লোকের নির্লজ্জতা এবং বেপরোয়া চাল-চরিত্রের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই ভারপ্রাপ্ত বা ভারবাহী, যাই বলি, বোধকরি জানে না যে তার কথা শুনে, পুরনো ঢাকাই ভাষায় বলতে হয় : হালার ঘোড়া ভি হাইসা উঠবে!
তিনি বলেছেন : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার নাকি দেশটাকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে। তার মন্তব্য শুনে আমি শুধু ভাবছি কতখানি নির্লজ্জতা এবং উদ্ভব-উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলে এই ধরনের মন্তব্য করা যায়। তার মন্তব্যটি ছাপা হয়েছে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে।
পাকিস্তান, বলতে গেলে, দুনিয়ার সৃষ্টিছাড়া এক রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট জন্মলাভের পর এই রাষ্ট্র খুব অল্প সময়ই গণতন্ত্রের মুখ দেখেছিল। এরপর জামায়াতীদের ভাষায় 'পাক ওয়াতনে' হয় সেনাবাহিনী ক্ষমতা হরণ করেছে, নয় সেনাসমর্থিত 'নামকা ওয়াস্তে' সিভিল সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বোধহয় মনে করে তারা সব পারে। দেশ চালাতে পারে। যুদ্ধ জয় করতে পারে। তবে ইতিহাসের যে রেকর্ড তা বলে যে পাকবাহিনী দেশ চালাতে পারেনি, পারার কথাও নয়। তারা কোনো যুদ্ধেও জয় পায়নি। এই দেশ চালাতে না পারা, যুদ্ধ জয় করতে না পারা, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সেনাবাহিনীর পাচাটা দালাল ছিল বর্ণিত ভারপ্রাপ্তের দল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে বর্বর পাক শাসকগোষ্ঠীর এক নম্বরের দালাল ছিল এই দলটি। হক, তোয়াহা, মতিন প্রমুখ চীনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ও বাঙালির সেই রক্তঝরা জানবাজি রাখা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের পাচাটা দালালিতে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল দুই কান কাটা রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী।
পাকিস্তানের বর্বরের চেয়েও বর্বর শাসকগোষ্ঠী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমানে বাংলাদেশ) কার্যত একটা কলোনিতে পরিণত করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান) সস্তা, নকল, নিরেস যে দ্রব্য বা পণ্যাদিই উৎপাদিত হোক, সেসবের নিশ্চিত বাজার ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালিদের তা কিনতেই হতো। প্রথমে করাচি, পরে রাওয়ালপিন্ডি, সব শেষে ইসলামাবাদে রাজধানী গড়া হলো হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। বেশিরভাগ টাকা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির; কিন্তু রাজধানী নির্মাণের সব টাকা খরচ হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সেনা, নেভি এবং বিমান বাহিনীর সব কয়টা হেডকোয়ার্টারই স্থাপন করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। যদিও হেডকোয়ার্টার নির্মাণের বেশিরভাগ অর্থ জোগাতে হয়েছিল বাঙালিদের।
দুই কান কাটা জামায়াতে ইসলামী এবং 'একই' পরিবারের বড়-ছোট দলগুলো হয়তো এসবই ভুলে গেছে। কিন্তু যারা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দেখেছেন, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালির জয় দেখেছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখেছেন, তারা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন ও নির্যাতনের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা ছিল শতকরা ৪ ভাগ। সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা ছিল ছয় শতাংশ।
পাকিস্তানের এই শোষণ, পীড়ন ও নির্যাতনে বাঙালির সংগ্রাম শুরু হয় চলি্লশ দশকের শেষ দিক থেকেই। '৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিকে জাতিসত্তার মন্ত্রে দীক্ষা দেয়। এরপর '৬২ সালে আইয়ুব শাহির বিরুদ্ধে বাঙালি ছাত্র সমাজের শিক্ষা আন্দোলন। '৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, যা প্রতিটি বাঙালিকে জাতীয়তাবাদের গভীর উপলব্ধি এনে দেয়। এরপর '৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, যা আইয়ুব শাহি তথা পাকিস্তানের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।
বাঙালির যাবতীয় আন্দোলনের নেতা ছিলেন একজনই_ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণী, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জেল খাটছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপরও জেলখানা থেকে নানাভাবে উদ্দীপনা ও প্রেরণা জুগিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের। ১৯৬৬ সালের পর থেকে তো বাঙালির একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগে হাফ বাঙালি, হাফ পাকিস্তানি নেতারা কালের নিয়মেই ঝরে পড়েন। মধ্যযুগে কানু বিনে যেমন গীত ছিল না। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা মুক্তি সনদ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বাঙালির আর কোনো নেতা ছিলেন না। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রধান নেতা ও মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনিই। অনুপস্থিত থাকলেও তার নেতৃত্বেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাংলাদেশ নামের সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির জনক তিনিই, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।
অনেকে ভাবতে পারেন, ইতিহাসের পুরনো পাতা উল্টাবার দরকারটা কী! পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মহানায়ক যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যে সংঘটিত হয়েছিল তারই নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, এই ইতিহাস কে না জানে। আওয়ামী লীগ মানে তো সেই দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দল, জামায়াত, মুসলিম লীগ ও চীনাপন্থি কয়েকটি দল ছাড়া, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিল।
এসবই জানা কথা। ইতিহাসের সত্য। তবু যে পুরনো কথার চর্বিত চর্বণ করছি, তার একটাই কারণ। যারা বলছে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান করার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার_ সেই বেহায়া, দুই কান কাটা রাজনৈতিক দলটার অবগতির জন্য কথাগুলো বলছি। ১৯৭১ সালে বর্বর, নৃশংস পাকিস্তান বাহিনীর দোসর ছিল এই জামায়াত।
এরা রাজাকার। এরা আলবদর। এরা আল শামস। এই ধর্ম ব্যবসায়ী কুলাঙ্গারদের হাতে বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। বহু বাঙালি নারী ধর্ষণ করেছে মানুষ নামের অযোগ্য এই নরপশুরা। মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামউদ্দিন, সেলিনা পারভীনের মতো বহু বুদ্ধিজীবী হত্যার মূলে ছিল ভারপ্রাপ্ত লোকটার দল জামায়াত। এদের নির্লজ্জতা এবং ধৃষ্টতা দেখে অবাক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
দ্বিতীয় পাকিস্তান করতে চাইছে কারা? বাংলাদেশের মানুষ কি তা জানে না! যারা ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভিত্তিমূল থেকে স্বৈরাচারী ক্ষমতার বলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্যবাদ উঠিয়ে দিয়েছিল, জয়ের বদলে জিন্দাবাদ, বেতারের বদলে রেডিও এবং বিসমিল্লাহ চালু করেছিল, বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা তো কায়েম করতে চাইছে তারা। তাদের কাছে জাতীয় সঙ্গীতের বদলে 'প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ' গানটা বেশি প্রিয়, বেশি কাঙ্ক্ষিত। জামায়াত এই রাজনৈতিক পরিবারেরই অংশ। কথাটা আমার না। খালেদাপুত্র তারেক রহমানের।
জঙ্গিদের প্রশ্রয় দিয়ে, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীর সমর্থন ও আশ্রয় দিয়ে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়ে কারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো একটি সংঘর্ষমুখর, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে_ এগুলোর তো রেকর্ড আছে। দলিল আছে। দুই কান কাটা যাওয়া নির্লজ্জরা তাহলে কীভাবে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার দায় ও অপরাধ নিজেদের ঘাড়ে না নিয়ে এ জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে, ভাবতেও অবাক লাগে।
বর্ণিত এই ভারপ্রাপ্ত লোকটা প্রায়ই এরকম উল্টাপাল্টা কথা বলে। একদিন বলেছিল, স্বাধীনতা আমরা এনেছি, স্বাধীনতা আমরাই রক্ষা করব! কোনোদিন হয়তো লোকটা বলে বসবে, ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিয়েছিল 'রাজাকার'দের নেতা গোলাম আযম। আমরা শুধু এসব স্বাধীনতাবিরোধী লোকদের কাজী নজরুলের ভাষায় বলি : 'প্রতিকার আছে জানা, মাথার ওপর সুপুরি রাখিয়া পাদুকা হইবে হানা।'
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
যার এক কান কাটা, সে জনসমক্ষে যেতে লজ্জা পায়। দুই কান কাটা লোকের এই লজ্জাটা আর থাকে না। সে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাজারে বা জনসমক্ষে যায়। কান কাটা নিয়ে কে কী ভাবল, তার পরোয়া করে না।
আমি বলি না, জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ওপরে বর্ণিত দুই কান কাটা দশার লোক। কেন বলব? পিতা-মাতার সূত্রে পাওয়া তার কান দুটি তো যথাস্থানে আছে বহাল-তবিয়তে। খামাখা অসত্য কথা বলতে যাব কোন দুঃখে!
তবে হালে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ দল সম্পর্কে এই ভারপ্রাপ্ত লোকটি এমন এক কথা বলেছেন, যা শুনে দুই কান কাটা লোকের নির্লজ্জতা এবং বেপরোয়া চাল-চরিত্রের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই ভারপ্রাপ্ত বা ভারবাহী, যাই বলি, বোধকরি জানে না যে তার কথা শুনে, পুরনো ঢাকাই ভাষায় বলতে হয় : হালার ঘোড়া ভি হাইসা উঠবে!
তিনি বলেছেন : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার নাকি দেশটাকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে। তার মন্তব্য শুনে আমি শুধু ভাবছি কতখানি নির্লজ্জতা এবং উদ্ভব-উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলে এই ধরনের মন্তব্য করা যায়। তার মন্তব্যটি ছাপা হয়েছে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে।
পাকিস্তান, বলতে গেলে, দুনিয়ার সৃষ্টিছাড়া এক রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট জন্মলাভের পর এই রাষ্ট্র খুব অল্প সময়ই গণতন্ত্রের মুখ দেখেছিল। এরপর জামায়াতীদের ভাষায় 'পাক ওয়াতনে' হয় সেনাবাহিনী ক্ষমতা হরণ করেছে, নয় সেনাসমর্থিত 'নামকা ওয়াস্তে' সিভিল সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বোধহয় মনে করে তারা সব পারে। দেশ চালাতে পারে। যুদ্ধ জয় করতে পারে। তবে ইতিহাসের যে রেকর্ড তা বলে যে পাকবাহিনী দেশ চালাতে পারেনি, পারার কথাও নয়। তারা কোনো যুদ্ধেও জয় পায়নি। এই দেশ চালাতে না পারা, যুদ্ধ জয় করতে না পারা, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সেনাবাহিনীর পাচাটা দালাল ছিল বর্ণিত ভারপ্রাপ্তের দল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে বর্বর পাক শাসকগোষ্ঠীর এক নম্বরের দালাল ছিল এই দলটি। হক, তোয়াহা, মতিন প্রমুখ চীনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ও বাঙালির সেই রক্তঝরা জানবাজি রাখা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের পাচাটা দালালিতে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল দুই কান কাটা রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী।
পাকিস্তানের বর্বরের চেয়েও বর্বর শাসকগোষ্ঠী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমানে বাংলাদেশ) কার্যত একটা কলোনিতে পরিণত করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান) সস্তা, নকল, নিরেস যে দ্রব্য বা পণ্যাদিই উৎপাদিত হোক, সেসবের নিশ্চিত বাজার ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালিদের তা কিনতেই হতো। প্রথমে করাচি, পরে রাওয়ালপিন্ডি, সব শেষে ইসলামাবাদে রাজধানী গড়া হলো হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে। বেশিরভাগ টাকা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির; কিন্তু রাজধানী নির্মাণের সব টাকা খরচ হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সেনা, নেভি এবং বিমান বাহিনীর সব কয়টা হেডকোয়ার্টারই স্থাপন করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। যদিও হেডকোয়ার্টার নির্মাণের বেশিরভাগ অর্থ জোগাতে হয়েছিল বাঙালিদের।
দুই কান কাটা জামায়াতে ইসলামী এবং 'একই' পরিবারের বড়-ছোট দলগুলো হয়তো এসবই ভুলে গেছে। কিন্তু যারা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দেখেছেন, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালির জয় দেখেছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখেছেন, তারা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন ও নির্যাতনের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা ছিল শতকরা ৪ ভাগ। সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা ছিল ছয় শতাংশ।
পাকিস্তানের এই শোষণ, পীড়ন ও নির্যাতনে বাঙালির সংগ্রাম শুরু হয় চলি্লশ দশকের শেষ দিক থেকেই। '৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিকে জাতিসত্তার মন্ত্রে দীক্ষা দেয়। এরপর '৬২ সালে আইয়ুব শাহির বিরুদ্ধে বাঙালি ছাত্র সমাজের শিক্ষা আন্দোলন। '৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, যা প্রতিটি বাঙালিকে জাতীয়তাবাদের গভীর উপলব্ধি এনে দেয়। এরপর '৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, যা আইয়ুব শাহি তথা পাকিস্তানের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।
বাঙালির যাবতীয় আন্দোলনের নেতা ছিলেন একজনই_ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণী, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জেল খাটছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপরও জেলখানা থেকে নানাভাবে উদ্দীপনা ও প্রেরণা জুগিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের। ১৯৬৬ সালের পর থেকে তো বাঙালির একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগে হাফ বাঙালি, হাফ পাকিস্তানি নেতারা কালের নিয়মেই ঝরে পড়েন। মধ্যযুগে কানু বিনে যেমন গীত ছিল না। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা মুক্তি সনদ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বাঙালির আর কোনো নেতা ছিলেন না। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রধান নেতা ও মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনিই। অনুপস্থিত থাকলেও তার নেতৃত্বেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাংলাদেশ নামের সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির জনক তিনিই, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।
অনেকে ভাবতে পারেন, ইতিহাসের পুরনো পাতা উল্টাবার দরকারটা কী! পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার মহানায়ক যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যে সংঘটিত হয়েছিল তারই নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, এই ইতিহাস কে না জানে। আওয়ামী লীগ মানে তো সেই দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দল, জামায়াত, মুসলিম লীগ ও চীনাপন্থি কয়েকটি দল ছাড়া, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিল।
এসবই জানা কথা। ইতিহাসের সত্য। তবু যে পুরনো কথার চর্বিত চর্বণ করছি, তার একটাই কারণ। যারা বলছে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান করার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার_ সেই বেহায়া, দুই কান কাটা রাজনৈতিক দলটার অবগতির জন্য কথাগুলো বলছি। ১৯৭১ সালে বর্বর, নৃশংস পাকিস্তান বাহিনীর দোসর ছিল এই জামায়াত।
এরা রাজাকার। এরা আলবদর। এরা আল শামস। এই ধর্ম ব্যবসায়ী কুলাঙ্গারদের হাতে বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। বহু বাঙালি নারী ধর্ষণ করেছে মানুষ নামের অযোগ্য এই নরপশুরা। মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামউদ্দিন, সেলিনা পারভীনের মতো বহু বুদ্ধিজীবী হত্যার মূলে ছিল ভারপ্রাপ্ত লোকটার দল জামায়াত। এদের নির্লজ্জতা এবং ধৃষ্টতা দেখে অবাক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
দ্বিতীয় পাকিস্তান করতে চাইছে কারা? বাংলাদেশের মানুষ কি তা জানে না! যারা ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভিত্তিমূল থেকে স্বৈরাচারী ক্ষমতার বলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্যবাদ উঠিয়ে দিয়েছিল, জয়ের বদলে জিন্দাবাদ, বেতারের বদলে রেডিও এবং বিসমিল্লাহ চালু করেছিল, বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা তো কায়েম করতে চাইছে তারা। তাদের কাছে জাতীয় সঙ্গীতের বদলে 'প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ' গানটা বেশি প্রিয়, বেশি কাঙ্ক্ষিত। জামায়াত এই রাজনৈতিক পরিবারেরই অংশ। কথাটা আমার না। খালেদাপুত্র তারেক রহমানের।
জঙ্গিদের প্রশ্রয় দিয়ে, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীর সমর্থন ও আশ্রয় দিয়ে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়ে কারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো একটি সংঘর্ষমুখর, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে_ এগুলোর তো রেকর্ড আছে। দলিল আছে। দুই কান কাটা যাওয়া নির্লজ্জরা তাহলে কীভাবে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার দায় ও অপরাধ নিজেদের ঘাড়ে না নিয়ে এ জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে, ভাবতেও অবাক লাগে।
বর্ণিত এই ভারপ্রাপ্ত লোকটা প্রায়ই এরকম উল্টাপাল্টা কথা বলে। একদিন বলেছিল, স্বাধীনতা আমরা এনেছি, স্বাধীনতা আমরাই রক্ষা করব! কোনোদিন হয়তো লোকটা বলে বসবে, ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিয়েছিল 'রাজাকার'দের নেতা গোলাম আযম। আমরা শুধু এসব স্বাধীনতাবিরোধী লোকদের কাজী নজরুলের ভাষায় বলি : 'প্রতিকার আছে জানা, মাথার ওপর সুপুরি রাখিয়া পাদুকা হইবে হানা।'
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments