মিরসরাই দুর্ঘটনা-হৃদয়বিদারক!

সান্ত্বনা ও শোক প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা কী হতে পারে? মানুষের কোনো ভাষা, কোনো উপমা-উৎপ্রেক্ষা কি গভীর ও মর্মস্পর্শী বেদনায় শুশ্রূষা এনে দিতে পারে? মিরসরাইয়ের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর অনেকেই নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে ভাষাহীন শোক প্রকাশ করেছেন। অনাত্মীয়, দূরবর্তী মানুষেরাও নীরবে চোখের পানি ফেলেছেন।


টিভিতে, সংবাদপত্রের পাতায় এ ঘটনার সংবাদ দেখে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেননি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। দূরের মানুষের এ অশ্রু কি নিহত স্বজনদের বেদনা উপশম করতে পারে? পারে না। কেননা যে ছাত্ররা এ বিয়োগান্ত ঘটনার শিকার হয়েছে তারা ছিল একেকটি পরিবারের কাছে একেকটি ভবিষ্যৎ, সম্ভাবনা। প্রত্যেক বাবা-মার কাছে তারা ছিল সাত রাজার ধন। স্কুলগামী এ ছাত্রদের ঘিরে যত স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্ক্ষা পল্লবিত হয়ে উঠেছিল সেসবের সলিলসমাধি ঘটল মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। অকালে প্রাণ হারাল ৪৪ জন, যাদের ৪১ জনই স্কুলছাত্র। আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা দল বেঁধে খেলা দেখতে গিয়েছিল। এভাবে দল বেঁধে খেলা দেখতে যাওয়ার রেওয়াজ এখনও বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে আছে। খেলা ছিল মঘাদিয়া আঞ্জুমাননেসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে। খেলায় হেরে গিয়েছিল আবু তোরাব স্কুল। হয়তো মন কিছুটা খারাপ ছিল তাদের। হয়তো তারা জয়-পরাজয় নয়, অংশগ্রহণকেই বড় করে দেখছিল। হয়তো পরের কোনো প্রতিযোগিতায় স্কুলকে জিতিয়ে আনার প্রত্যয় কাজ করছিল কারও কারও মনে। কিন্তু ট্রাকে করে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পথিমধ্যে ছাত্রদের প্রাণপ্রদীপ নিভে গেল চিরতরে। ট্রাকের চালক তাদের খেলার মাঠে নিয়ে গিয়েছিল নিরাপদেই, কিন্তু ফেরার পথে চালকের আসনে বসা হেলপারের অসতর্কতা, ফোনে কথা বলা আর নিরাপদ রাখতে পারল না ফেরার পথ। ফেরার সকল পথ রুদ্ধ হলো, ছাত্ররা না ফেরার জগতে চলে গেল। যে হেলপারের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটল, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে নছিমনকে পাশ কাটাতে গিয়ে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটাল তার বিচার কীভাবে সম্ভব? কোনোভাবে কি সম্ভব? একটি দুটি নয় ৪৪ নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার শাস্তি কীভাবে দেওয়া যায়? দুর্ঘটনার পর থেকে ড্রাইভার-হেলপার দু'জনেই পলাতক। বোঝা যায়, পানির মধ্যে একটি মরণখাঁচা তৈরি করে পালিয়ে গিয়েছিল হেলপার। মানুষের শত চেষ্টায়, কান্নায়, আর্তনাদে, চিৎকারেও আর বাঁচানো যায়নি তাদের। অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে একেকটি শিশু। মিরসরাই এখন মৃতদের জনপদ। বাড়িতে বাড়িতে শিশুমৃত্যুর শোক। সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। শোকগ্রস্ত ওই জনপদে ছুটে গেছেন মন্ত্রী, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী শোক প্রকাশ করেছেন। দেশের সকল মানুষের সঙ্গে আমরাও গভীর শোক প্রকাশ করছি। কিন্তু শোক প্রকাশই যথেষ্ট নয়, আমরা আশা করব, ঘটনা তদন্তে যে কমিটি গঠিত হয়েছে তারা যথাযথভাবে প্রতিবেদন দেবেন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা হবে। নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক আন্দোলন চলছে বহুকাল। কিন্তু দিন দিন দেশের সড়কগুলো যেন আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনার খবরে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে পত্রিকার পাতা। মানুষ আর এই বৃথা রক্তপাত, মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সড়কে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা তাই সবার দাবি হয়ে উঠেছে। মিরসরাইয়ের ঘটনার পরও কি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ও বিস্তৃত উদ্যোগের দেখা মিলবে না?
 

No comments

Powered by Blogger.