গন্তব্য ঢাকা-গ্রামের থোন আইছি খাওনের জন্যই তো by শর্মিলা সিনড্রেলা
চারপাশে সুনসান নীরবতা। কদমের পর কদম হেঁটেও ক্লান্ত দুপুরে দেখা মেলে না বেশি কারও। বোধ হয় এই দুপুরে একটু জিরাতে অনেকেই গা এলিয়েছে বিছানায়। শীত পালাতে না-পালাতেই গরম শুরু করেছে তার রাজত্ব। আর সূর্যও হাত মিলিয়েছে তাতে।
চলতে চলতে দেখা মেলে যাদের সঙ্গে, তারা নিজেদের কাজ নিয়ে অনেক না হলেও একটু ব্যস্ত তো বটেই। কেবল পাশের রাস্তাটা দিয়ে হুটহাট গাড়িগুলোর বেরিয়ে যাওয়ার আওয়াজ। জায়গাটা আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বেতার ভবনের সামনে। এই অলস দুপুরেও একটা দোকান ঘিরে বেশ আড্ডা চলছে বলেই মনে হলো।
লোকটির নাম জাকির। শুধুই জাকির। বসেছেন একটা টেবিল আর একটা চেয়ার নিয়ে। গাছের ছায়ায়। তাঁর কাজ হচ্ছে ফ্লেক্সিলোড করা। রাস্তায় যেতে যেতে কারও মোবাইলে টাকাটা শেষ হয়ে গেলেই এখান থেকে তাঁরা মোবাইলে টাকা তুলে নেন অনায়াসে।
জাকিরের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। একেবারে সদরেই। আজ প্রায় ৩০ বছর ঢাকায়। একটু পরিবর্তনের আশায় ঢাকার পথে পা বাড়ানো। সেই সময়ে রক্তে জোশ ছিল। কিন্তু এখন বয়স গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪-এর কোঠায়। দিন শেষে প্রাপ্তি কী? ‘নাহ্, যা কিছু করমু বলে আসছিলাম, তা পাইলাম কই। খুব ইচ্ছা আছিল একটা বাড়ি করমু। হলো না।’ কিন্তু কেন? কেন যেসব স্বপ্ন বেঁধে ঢাকায় আসেন তা পূরণ করতে পারেন না জাকিররা? তিনি বলেন, ‘আমাদের অভাবের সংসার। আর অভাবের সংসারে সবাই চাই ছেলেরা কাম করুক। তখন এক বেলা খাইলে আর এক বেলা খাই না এমন অবস্থা। তাই পড়া হলো না। কেলাস সিক্সের পর আর পড়া হয় নাই। আর এবার আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎও নষ্ট হয়ে গেল। ম্যাট্রিক পাস করার পর অরে কৃষি পলিটেকনিকে ভর্তি করছি। এক লোকে বলল, দুই লক্ষ টাকা দিলে অরে একটা সরকারি চাকরি পাওয়াইয়া দিবে। ধার করে আমি এক লক্ষ টাকা দিলাম। কিন্তু না পাইলাম ছেলের চাকরি, না পাইলাম টাকা। এখন প্রতি মাসে ধারের জন্যে দিতে হয় তিন হাজার টাকা সুদ। অর পড়ার খরচ চালামু কোনখান দিয়া।’
এক মাস পরপর গ্রামের বাড়িতে যান জাকির। থাকেন হয়তো তিন-চার দিন। এর পরই আবার টাকার চিন্তায় ফিরে আসতে হয় ঢাকায়। তাই উপভোগ করার আগেই যেন ফুরিয়ে যায় অল্প কয়েকটা দিন। বলেন, ‘ঢাকার আবহাওয়া আর ভালো লাগে না। গ্রামে গেলে পরিবেশ মনে করেন অনেক ভালো। যাই তো তিন-চার দিনের জন্যে। এই তিন-চার দিনে সংসারের এক-আধটু কাজ আর সব কিছু গুছিয়েই শেষ হয়ে যাই।’
গ্রাম ছেড়ে আসা মানুষগুলোর কাছে বোধহয় অতীত বলতে কেবলই গ্রাম। বর্তমানের এই ঢাকা শহর ছেড়ে সবাই চান সেই আপন নীড়ে ফিরতে। জাকিরের দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে সংসার। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে, সেও এখন ঢাকায়। বাড়িতে থাকা বলতে স্ত্রী আর মা। ২৫ মার্চের দুপুরে বসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের স্মৃতি আওড়ান জাকির। ‘তখন আমরা সবাই অনেক ভয়ে ছিলাম। বাড়ির যত জিনিসপত্র ছিল, পাঞ্জাবিদের ভয়ে আমরা সবই মাটির নিচে লুকায়া রাখছিলাম। আর মা-বোনদের নিয়েও ছিলাম অনেক ভয়ে।’ গ্রামের কথা কি আর এত সহজেই শেষ হয়? ‘ছোটবেলায় আমরা স্কুলে গেছি, খেতে কাম করছি আর খেলাধুলাও করছি। তখন আমরা ফুটবল খেলতাম বেশি। ক্রিকেট কি আর ছিল? খেতের কাম অনেক পরিশ্রমের। কষ্ট হয় করতে। এখন তো আমার জমিজায়গা নাই। আমরা তিন বোন ও চার ভাই। ভাইরা মিলে একখণ্ড জমি কিনে সেখানেই ঘর করছি।’ পাশের ক্রেতাটির হাতে সুপারি দেওয়া পান দিতে দিতে বলেন, ‘এই সুপারিগুলান আমার নিজের গাছের। ঘরের পাশে কয়েকটা গাছ লাগাইছি, সেখানে সুপারি হইছে। পরে নিজে কেটে নিয়ে আনছি ঢাকায়।’
ফ্লেক্সিলোডের দোকানে দিনভর টাকা দেওয়ার পাশাপাশি চকলেট, পানও রাখেন। যদি একটু বিক্রি বাড়ে। ঢাকা ছাড়ার স্বপ্নটা চোখের কোণে। তবে সেই স্বপ্নটা পূরণ করতে করতে এখনো জাকিরের ১০ থেকে ১২ বছর লেগে যাবে। এখানে থাকেন একটা মেসে। সকালবেলা নিজে রান্না করে খেয়ে তবে সকাল সাতটায় আসেন নিজের পসরা নিয়ে। আর সেই বিকেল পাঁচটায় ঘরে ফিরে নিজে রান্না করে তবে খান। কী করলে জীবনে একটু রং আসত তা জানেন না জাকির। তবে চেষ্টাও নেহাত কম করেননি। ঢাকায় এলেন। তারপর ভাবলেন যাবেন পাকিস্তানে। বাড়িতে গেলেন কিন্তু সবাই ধরে বসাল বিয়ের পিঁড়িতে। আর যাওয়া হলো না। সেটা হয়তো একদিক থেকে ভালোই হয়েছিল। ভালো কিছুর আশায় গেলেন সৌদি আরব। না, ভালো লাগল না। ফিরে এলেন বাংলায়। আবার এলেন সেই ঢাকাতেই। এখন কেবল দিন গোনা, কবে আবার একেবারে ফেরা হবে বাড়ি। কথাগুলো বলতে বলতে মাখানো ঝালমুড়িটা মুখে তোলেন জাকির। পাশে দাঁড়ানো বন্ধুটি ফোড়ন কাটেন, ‘তোমার খাওয়া লেগেই থাকে।’ জবাব দেন জাকির, ‘গ্রামের থোন আইছি খাওনের জন্যেই তো।’
শর্মিলা সিনড্রেলা
লোকটির নাম জাকির। শুধুই জাকির। বসেছেন একটা টেবিল আর একটা চেয়ার নিয়ে। গাছের ছায়ায়। তাঁর কাজ হচ্ছে ফ্লেক্সিলোড করা। রাস্তায় যেতে যেতে কারও মোবাইলে টাকাটা শেষ হয়ে গেলেই এখান থেকে তাঁরা মোবাইলে টাকা তুলে নেন অনায়াসে।
জাকিরের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। একেবারে সদরেই। আজ প্রায় ৩০ বছর ঢাকায়। একটু পরিবর্তনের আশায় ঢাকার পথে পা বাড়ানো। সেই সময়ে রক্তে জোশ ছিল। কিন্তু এখন বয়স গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪-এর কোঠায়। দিন শেষে প্রাপ্তি কী? ‘নাহ্, যা কিছু করমু বলে আসছিলাম, তা পাইলাম কই। খুব ইচ্ছা আছিল একটা বাড়ি করমু। হলো না।’ কিন্তু কেন? কেন যেসব স্বপ্ন বেঁধে ঢাকায় আসেন তা পূরণ করতে পারেন না জাকিররা? তিনি বলেন, ‘আমাদের অভাবের সংসার। আর অভাবের সংসারে সবাই চাই ছেলেরা কাম করুক। তখন এক বেলা খাইলে আর এক বেলা খাই না এমন অবস্থা। তাই পড়া হলো না। কেলাস সিক্সের পর আর পড়া হয় নাই। আর এবার আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎও নষ্ট হয়ে গেল। ম্যাট্রিক পাস করার পর অরে কৃষি পলিটেকনিকে ভর্তি করছি। এক লোকে বলল, দুই লক্ষ টাকা দিলে অরে একটা সরকারি চাকরি পাওয়াইয়া দিবে। ধার করে আমি এক লক্ষ টাকা দিলাম। কিন্তু না পাইলাম ছেলের চাকরি, না পাইলাম টাকা। এখন প্রতি মাসে ধারের জন্যে দিতে হয় তিন হাজার টাকা সুদ। অর পড়ার খরচ চালামু কোনখান দিয়া।’
এক মাস পরপর গ্রামের বাড়িতে যান জাকির। থাকেন হয়তো তিন-চার দিন। এর পরই আবার টাকার চিন্তায় ফিরে আসতে হয় ঢাকায়। তাই উপভোগ করার আগেই যেন ফুরিয়ে যায় অল্প কয়েকটা দিন। বলেন, ‘ঢাকার আবহাওয়া আর ভালো লাগে না। গ্রামে গেলে পরিবেশ মনে করেন অনেক ভালো। যাই তো তিন-চার দিনের জন্যে। এই তিন-চার দিনে সংসারের এক-আধটু কাজ আর সব কিছু গুছিয়েই শেষ হয়ে যাই।’
গ্রাম ছেড়ে আসা মানুষগুলোর কাছে বোধহয় অতীত বলতে কেবলই গ্রাম। বর্তমানের এই ঢাকা শহর ছেড়ে সবাই চান সেই আপন নীড়ে ফিরতে। জাকিরের দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে সংসার। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে, সেও এখন ঢাকায়। বাড়িতে থাকা বলতে স্ত্রী আর মা। ২৫ মার্চের দুপুরে বসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের স্মৃতি আওড়ান জাকির। ‘তখন আমরা সবাই অনেক ভয়ে ছিলাম। বাড়ির যত জিনিসপত্র ছিল, পাঞ্জাবিদের ভয়ে আমরা সবই মাটির নিচে লুকায়া রাখছিলাম। আর মা-বোনদের নিয়েও ছিলাম অনেক ভয়ে।’ গ্রামের কথা কি আর এত সহজেই শেষ হয়? ‘ছোটবেলায় আমরা স্কুলে গেছি, খেতে কাম করছি আর খেলাধুলাও করছি। তখন আমরা ফুটবল খেলতাম বেশি। ক্রিকেট কি আর ছিল? খেতের কাম অনেক পরিশ্রমের। কষ্ট হয় করতে। এখন তো আমার জমিজায়গা নাই। আমরা তিন বোন ও চার ভাই। ভাইরা মিলে একখণ্ড জমি কিনে সেখানেই ঘর করছি।’ পাশের ক্রেতাটির হাতে সুপারি দেওয়া পান দিতে দিতে বলেন, ‘এই সুপারিগুলান আমার নিজের গাছের। ঘরের পাশে কয়েকটা গাছ লাগাইছি, সেখানে সুপারি হইছে। পরে নিজে কেটে নিয়ে আনছি ঢাকায়।’
ফ্লেক্সিলোডের দোকানে দিনভর টাকা দেওয়ার পাশাপাশি চকলেট, পানও রাখেন। যদি একটু বিক্রি বাড়ে। ঢাকা ছাড়ার স্বপ্নটা চোখের কোণে। তবে সেই স্বপ্নটা পূরণ করতে করতে এখনো জাকিরের ১০ থেকে ১২ বছর লেগে যাবে। এখানে থাকেন একটা মেসে। সকালবেলা নিজে রান্না করে খেয়ে তবে সকাল সাতটায় আসেন নিজের পসরা নিয়ে। আর সেই বিকেল পাঁচটায় ঘরে ফিরে নিজে রান্না করে তবে খান। কী করলে জীবনে একটু রং আসত তা জানেন না জাকির। তবে চেষ্টাও নেহাত কম করেননি। ঢাকায় এলেন। তারপর ভাবলেন যাবেন পাকিস্তানে। বাড়িতে গেলেন কিন্তু সবাই ধরে বসাল বিয়ের পিঁড়িতে। আর যাওয়া হলো না। সেটা হয়তো একদিক থেকে ভালোই হয়েছিল। ভালো কিছুর আশায় গেলেন সৌদি আরব। না, ভালো লাগল না। ফিরে এলেন বাংলায়। আবার এলেন সেই ঢাকাতেই। এখন কেবল দিন গোনা, কবে আবার একেবারে ফেরা হবে বাড়ি। কথাগুলো বলতে বলতে মাখানো ঝালমুড়িটা মুখে তোলেন জাকির। পাশে দাঁড়ানো বন্ধুটি ফোড়ন কাটেন, ‘তোমার খাওয়া লেগেই থাকে।’ জবাব দেন জাকির, ‘গ্রামের থোন আইছি খাওনের জন্যেই তো।’
শর্মিলা সিনড্রেলা
No comments