কবি না থাকলে কী কী থাকবে না by আল মাহমুদ
আজকাল অনেক মানুষের কথাই আমার মনে পড়ে। যারা একদা আমাকে লেখালেখিতে সাহায্য করতে এসেছিলেন। যদিও তাদের চেহারাটা চোখে ভাসে; কিন্তু নামধাম মনে থাকে না। আমি বলতাম আর তারা উবু হয়ে বসে লেখাটা তুলে নিত। কোনো প্রশ্ন করত না।
কেন এমন হলো? আমি কেন অন্যরকমভাবে বিষয়টা পর্যালোচনা করিনি। এসব কোনো কিছুই কেউ ঘাড় ফিরিয়ে উত্থাপন না করে কেবল লিখে যেত। লেখা হয়ে গেলে নীরবে নিঃশব্দে কাগজ গুটিয়ে চলে যেত। আজকাল তাদের কথা সহসা আমার মনে পড়ে। কত মানুষের সাহায্য যে লেখার ব্যাপারে আমাকে নিতে হয়েছে, তা মনে পড়লে আমিও কম অবাক হই না।
নাম মনে থাকে না; কিন্তু অনেকেরই চেহারা আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। কেউ ফিরে আসে না। শুধু একবার আসে যখন আমি সৃষ্টি করি। তারপর তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তারাও সেটা বুঝতে পারে এবং অন্তর্হিত হয়ে যায়। সৃষ্টিশীল মানুষের অনেক দোষ থাকে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি থাকে অনুতাপ-আফসোস।
যখন কিছু মুখের কথা সকৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করতে যাই তখন পারি না। নাম মনে থাকে না। ধাম হারিয়ে গেছে। সে জন্যই সম্ভবত আমার বাম দিকটা সবসময় শূন্যতার হাহাকারে ভরা।
ভাবি, আমি তো চলতে চলতে বহুদূর চলে এসেছি। অনেক পথ অতিক্রম করেছি, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। এখন পেছন ফিরে তাকালে কাউকে আর দেখতে পাই না। অন্যভাবে বলতে গেলে হয়তো বা দেখতে চাইও না। আমি কবি। স্বপ্নের মধ্যে হাঁটাই আমার কাজ। যদি দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে এভাবে এক দিন অন্তিমে পৌঁছে যাব। এ কথা তো সবারই জানা যে, আমি সাধ্যমত লিখেছি। কী লিখেছি সেটা আমিও জানতে চাই না। আজও এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি লিখে কোথাও পৌঁছবার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি তো জানি না, এটা কোন জায়গা। এখন কোথায় আছি। বলার মতো কথা হলো পথে আছি কিংবা হয়তো বা কোনো প্রান্তরে আছি। কোনো পরিসমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি না। তা বলে আমি তো পরিশ্রম কম করিনি। পৌঁছতে চাই। কিন্তু কোথায় পৌঁছব? আমার আগে যারা আমার মতো পথে-প্রান্তরে পরিশ্রম ঝরিয়ে চলে গেছেন তাদের ঘাম শুকানোর কোনো বিশ্রাম ছিল না। আমি বিশ্রাম চাই, বিরাম চাই, পরিণাম চাই। এতগুলো দাবি হয়তো বা স্বপ্নদ্রষ্টা কবিকে মানায় না। কিন্তু সব মানুষ তো আর এক রকম হয় না। আমি কাজ করেছি বলেই পারিশ্রমিক দাবি করি। কিন্তু দেবার মতো কেউ আছে কি? যদি না থাকে তাহলে পথে-প্রান্তরে, হাটে-ঘাটে-মাঠে আমি আমার সৃষ্টি দামি মানুষের মধ্যে রেখে যাব। আমার কথা ঘাটের মাঝিরা বলবে। খেয়া পারাপারের নৌকা আমার নাম ধরে হাঁক দেবে। কাজ করেছি, দাম চাই, নাম চাই এবং আমি না বললেও সবাই জানে পরিণাম চাই। আমার পরিশ্রম তো কবির পরিশ্রম। বৃথা যেতে পারে না। আমি স্বপ্ন নির্মাণ করি এবং সত্যের কাছে এনে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিই। এই তো হাত পেতেছি আমার প্রাপ্য আমাকে কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দাও। আমি বেশি চাই না, কমও আমাকে দেয়া উচিত নয়।
জগতে কবিকে বঞ্চিত রাখার মহত্-ক্ষুদ্র-বৃহত্ ইতিহাস পাওয়া যায়। সে সব পর্যালোচনা করলে আজও পাঠকের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কবির প্রতিশ্রুত স্বর্ণমুদ্রা নানা তালবাহানার পর যখন সত্যিই কবির বাসস্থানে এসে পৌঁছে তখন দেখা যায় অন্য গেইট দিয়ে কবির লাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। এটাই তো জগতের কবিদের বঞ্চনার নিয়ম। কিন্তু কোনো কবিই এই নিয়মের আয়ত্তে আসতে সম্মত হননি। তিনি সোনার টাকার পরিবর্তে রুপোর টাকা গ্রহণ করতে সম্মত হননি। সব সুলতানই শেষ পর্যন্ত কবিকে ঠেকাতে গিয়ে জুলুমের ভাগী হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সোনার টাকাই তাকে দিতে হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, কবি জীবিত থাকতে তা দেখে যেতে পারেন না। সোনার টাকা আসে মৃত্যুর পর।
লেখালেখির পথে আমার পরেও মানুষ আসবে। তারা আমার আগেও এসেছিলেন। এই জটিল লেনদেনের খেলায় কেবল কবিরাই চিরকাল বঞ্চিত থাকবে কেন? কেন তারা ছেড়ে দেবে তাদের সত্যিকার পাওনাটা। কম কেন নেবে? কারণ দম ফুরাবার আগে আমি তো বিশ্রাম নেইনি। বিরাম ছিল না আমার। কত বিভিন্ন রসে আমি রসসিক্ত করেছি বাংলাদেশের মাটিকে। তা না হলে কি তুমি ভাব বাংলাদেশ এত সবুজ হতো। এই শ্যামলিমা আমার রক্ত মাংসের মধ্য থেকে উত্থিত হয়েছে। এর কোনো পরাজয় নেই। তবে জয়ের স্বীকৃতি স্বাভাবিকভাবে কবির করায়ত্ত হতে চায় না। কবি শুধু কবিই।
আর কিছু নন। কবি না থাকলে কী কী থাকবে না, তা কি তুমি জান? যদি না জান তাহলে লিখে নাও—কবি না থাকলে স্বপ্ন থাকবে না, সবুজ থাকবে না,
সঙ্গীত থাকবে না। আর থাকবে না ভালোবাসা। যার কথা তোমরা দিবস রজনী বলতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাও।
লেখক : কবি
নাম মনে থাকে না; কিন্তু অনেকেরই চেহারা আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। কেউ ফিরে আসে না। শুধু একবার আসে যখন আমি সৃষ্টি করি। তারপর তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তারাও সেটা বুঝতে পারে এবং অন্তর্হিত হয়ে যায়। সৃষ্টিশীল মানুষের অনেক দোষ থাকে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি থাকে অনুতাপ-আফসোস।
যখন কিছু মুখের কথা সকৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করতে যাই তখন পারি না। নাম মনে থাকে না। ধাম হারিয়ে গেছে। সে জন্যই সম্ভবত আমার বাম দিকটা সবসময় শূন্যতার হাহাকারে ভরা।
ভাবি, আমি তো চলতে চলতে বহুদূর চলে এসেছি। অনেক পথ অতিক্রম করেছি, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। এখন পেছন ফিরে তাকালে কাউকে আর দেখতে পাই না। অন্যভাবে বলতে গেলে হয়তো বা দেখতে চাইও না। আমি কবি। স্বপ্নের মধ্যে হাঁটাই আমার কাজ। যদি দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে এভাবে এক দিন অন্তিমে পৌঁছে যাব। এ কথা তো সবারই জানা যে, আমি সাধ্যমত লিখেছি। কী লিখেছি সেটা আমিও জানতে চাই না। আজও এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি লিখে কোথাও পৌঁছবার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি তো জানি না, এটা কোন জায়গা। এখন কোথায় আছি। বলার মতো কথা হলো পথে আছি কিংবা হয়তো বা কোনো প্রান্তরে আছি। কোনো পরিসমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি না। তা বলে আমি তো পরিশ্রম কম করিনি। পৌঁছতে চাই। কিন্তু কোথায় পৌঁছব? আমার আগে যারা আমার মতো পথে-প্রান্তরে পরিশ্রম ঝরিয়ে চলে গেছেন তাদের ঘাম শুকানোর কোনো বিশ্রাম ছিল না। আমি বিশ্রাম চাই, বিরাম চাই, পরিণাম চাই। এতগুলো দাবি হয়তো বা স্বপ্নদ্রষ্টা কবিকে মানায় না। কিন্তু সব মানুষ তো আর এক রকম হয় না। আমি কাজ করেছি বলেই পারিশ্রমিক দাবি করি। কিন্তু দেবার মতো কেউ আছে কি? যদি না থাকে তাহলে পথে-প্রান্তরে, হাটে-ঘাটে-মাঠে আমি আমার সৃষ্টি দামি মানুষের মধ্যে রেখে যাব। আমার কথা ঘাটের মাঝিরা বলবে। খেয়া পারাপারের নৌকা আমার নাম ধরে হাঁক দেবে। কাজ করেছি, দাম চাই, নাম চাই এবং আমি না বললেও সবাই জানে পরিণাম চাই। আমার পরিশ্রম তো কবির পরিশ্রম। বৃথা যেতে পারে না। আমি স্বপ্ন নির্মাণ করি এবং সত্যের কাছে এনে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিই। এই তো হাত পেতেছি আমার প্রাপ্য আমাকে কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দাও। আমি বেশি চাই না, কমও আমাকে দেয়া উচিত নয়।
জগতে কবিকে বঞ্চিত রাখার মহত্-ক্ষুদ্র-বৃহত্ ইতিহাস পাওয়া যায়। সে সব পর্যালোচনা করলে আজও পাঠকের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কবির প্রতিশ্রুত স্বর্ণমুদ্রা নানা তালবাহানার পর যখন সত্যিই কবির বাসস্থানে এসে পৌঁছে তখন দেখা যায় অন্য গেইট দিয়ে কবির লাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। এটাই তো জগতের কবিদের বঞ্চনার নিয়ম। কিন্তু কোনো কবিই এই নিয়মের আয়ত্তে আসতে সম্মত হননি। তিনি সোনার টাকার পরিবর্তে রুপোর টাকা গ্রহণ করতে সম্মত হননি। সব সুলতানই শেষ পর্যন্ত কবিকে ঠেকাতে গিয়ে জুলুমের ভাগী হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সোনার টাকাই তাকে দিতে হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, কবি জীবিত থাকতে তা দেখে যেতে পারেন না। সোনার টাকা আসে মৃত্যুর পর।
লেখালেখির পথে আমার পরেও মানুষ আসবে। তারা আমার আগেও এসেছিলেন। এই জটিল লেনদেনের খেলায় কেবল কবিরাই চিরকাল বঞ্চিত থাকবে কেন? কেন তারা ছেড়ে দেবে তাদের সত্যিকার পাওনাটা। কম কেন নেবে? কারণ দম ফুরাবার আগে আমি তো বিশ্রাম নেইনি। বিরাম ছিল না আমার। কত বিভিন্ন রসে আমি রসসিক্ত করেছি বাংলাদেশের মাটিকে। তা না হলে কি তুমি ভাব বাংলাদেশ এত সবুজ হতো। এই শ্যামলিমা আমার রক্ত মাংসের মধ্য থেকে উত্থিত হয়েছে। এর কোনো পরাজয় নেই। তবে জয়ের স্বীকৃতি স্বাভাবিকভাবে কবির করায়ত্ত হতে চায় না। কবি শুধু কবিই।
আর কিছু নন। কবি না থাকলে কী কী থাকবে না, তা কি তুমি জান? যদি না জান তাহলে লিখে নাও—কবি না থাকলে স্বপ্ন থাকবে না, সবুজ থাকবে না,
সঙ্গীত থাকবে না। আর থাকবে না ভালোবাসা। যার কথা তোমরা দিবস রজনী বলতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাও।
লেখক : কবি
No comments