তারিখ আসে তারিখ যায়! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
এখন ঢাকা নগরীতে সবচেয়ে দুঃসহ যে সমস্যা তার নাম যানজট। কোনো বিশেষণই যানজটের তীব্রতা বোঝাতে যথেষ্ট নয়। অনেক বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে এক বন্ধুর এয়ারপোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে যে সময় লেগেছে তার কম সময়ে নাকি নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়া যাওয়া যায়।
সত্যি-মিথ্যে জানি না। নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়ার দূরত্বও জানি না। তারপরও মনে হয়েছে বন্ধুর বক্তব্যে সারবক্তা নিশ্চয়ই আছে। রাজপথে মানুষ আর যানবাহনের গিজিগিজি দেখে প্রবাসী বন্ধু বললেন, এই শহর অচিরেই কলাপ্স্ করবে। যানবাহন কিংবা জনসংখ্যা প্রতিদিন যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে এমন হতাশাজনক ভবিষ্যত্ ছাড়া দেশের জন্য আর কিছু তিনি ভাবতে পারছেন না।
এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় আছে?
বন্ধুর সহজ উক্তি : উপায় অবশ্যই আছে। আজ পর্যন্ত কোনো সমস্যারই জন্ম হয়নি যার নেই সমাধান। সমাধান অবশ্যই আছে এবং তা বের করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। বড় বড় নগরীর নানাবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন রকম কর্তৃপক্ষ থাকেন। এই কর্তৃপক্ষের সমন্বিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায়। তবে মনে রাখা দরকার, সমস্যা সমাধানের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো অবশ্যই হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সহজে গ্রহণযোগ্য। মানুষ পরিবর্তন সব সময়ে অপছন্দ করে। তাই পরিবর্তনটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে মানুষ বেশি ঝামেলায় না পড়ে তা পালন করতে পারে।
আমাদের দেশে পরিবর্তন আনার জন্য চেষ্টা তো কম করা হলো না। কিন্তু উন্নতি খুব দৃশ্যমান তো নয়। ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে তার দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য কম তো চেষ্টা হচ্ছে না।
বন্ধু বললেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানীর যানজট নিয়ে অনেক কথা শোনা গেছে। এক সময়ে ব্যাংককের যানজটের দুর্নাম সারা পৃথিবীতে এতো ছিল যে ভ্রমণে আসার সময় বিভিন্ন দেশের পর্যটন ব্যুরো থেকে স্ব স্ব দেশের নাগরিককে রীতিমত সতর্ক করে বলা হতো : বিঅয়্যার অব নটরিয়াস ট্রাফিক অব ব্যাংকক। ব্যাংককের যানজট এমনই দুঃসহ আর তীব্র ছিল। ট্রাফিক ব্যবস্থা আর নারী পাচার (উইমেন ট্রাফিকিং) এ দুই ট্রাফিকের জন্য দুর্নাম ছিল ব্যাংককের। অথচ আজ ব্যাংককের অবস্থা পুরোদস্তুর উল্টো। রাজধানীর যানজট এখন অতীতের সমস্যা, একই অবস্থা ছিল টোকিওর। সেখানেও আজ অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা।
টোকিও শহর মাটির ওপর যতটা, মাটির নিচেও প্রায় ততটাই, নানা ধরনের যানবাহনের কারণে মানুষ অতি দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে যেতে পারে। যানবাহন ব্যবস্থা এতই উন্নতমানের যে, মানুষ ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করার কথা পারতপক্ষে করে না। মাটির ওপরে যেমন আছে দ্রুতগতির ট্রেন, বাস, মাটির নিচে তেমনি টিউব, মেট্রো রেল। টোকিওতে দেখেছি, মানুষজন এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যের দূরত্ব বোঝাতে কিলোমিটার না বলে সময়ের উল্লেখ করেন। অমুক স্টেশন থেকে অমুক জায়গার দূরত্ব ২৪ মিনিট জাতীয় কথা।
এর ঠিক বিপরীত চিত্র এখন ঢাকার। সময়ের হিসেবে যদি দূরত্ব বোঝাতে যান, তাহলে নিশ্চিত বোকা হতে হবে। এক বছর আগেও কারওয়ান বাজার থেকে উত্তরা পৌঁছাতে বাসে লাগত ৩৫-৪০ মিনিট, এখন কমপক্ষে দু’ঘণ্টা! কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি। এই দশ-বারো কিলোমিটার পথে পিঁপড়ার গতিতে যানবাহন চলে। কখনও কখনও দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়িঘোড়া। কী অ্যাম্বুলেন্স, কী ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, কী আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার গাড়ি—সব একাকার।
আগুন লাগলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িকে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর প্রতিনিয়ত জবাবদিহি করতে হয় বিলম্বে পৌঁছানোর জন্য। অভিযোগের অঙ্গুলি উত্তোলন করে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি সময়মত পৌঁছালে ক্ষতির পরিমাণ আরও কম হতো। অথবা অগ্নিনির্বাপক দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলেছে। পৌঁছালেও অভিযুক্ত হতে হলে দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না। কিন্তু ঘটনা তাই। এ যেন সেই ইংরেজি ট্রান্সলেশনের জন্য পরীক্ষায় প্রায় বাক্য : ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল— জাতীয় ব্যাপার। ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দীর্ঘ এবং প্রশস্ত রাস্তা নেই, পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত দীর্ঘ রাস্তা আছে। যানজটের কারণ হিসেবে এ কারণটিকেও চিহ্নিত করা হয়।
জরুরি সরকার মহা আড়ম্বরে র্যাংগস ভবন ভাঙার কাজে লেগেছিল। বারোজন শ্রমিক ভবন ভাঙতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এ জানুয়ারিতে র্যাংগস ভবন দুর্ঘটনার এক বছর পূর্ণ হলো।
ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো বদলে গেল। কিন্তু বদলালো না প্রস্তাবিত র্যাংগস ভবন সংলগ্ন রাস্তার দৃশ্য। বলা হয়েছিল এ রাস্তা চালু হলে যানজট পরিস্থিতির প্রভূত উন্নতি হবে।
সড়ক উদ্বোধনের দিনক্ষণ একাধিকবার নির্ধারণ করাও হয়। এখন শুনি রাস্তার ওপর রেল ট্র্যাক নিচে রেখে যে ফ্লাইওভার হওয়ার কথা তার জন্য এই বিলম্ব।
ফ্লাইওভার প্রকল্পে হঠাত্ করে যুক্ত হয়েছে এমনটা নয়। শুরু থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা ছিল। আসলে আমরা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে যত উত্সাহী, তা অর্জন করতে ততটা নই।
কত যে তারিখ নির্ধারণ করা হয় শুধুই নির্ধারণ করার জন্য, তার হিসাব যদি রাখি চমকিত হতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় আছে?
বন্ধুর সহজ উক্তি : উপায় অবশ্যই আছে। আজ পর্যন্ত কোনো সমস্যারই জন্ম হয়নি যার নেই সমাধান। সমাধান অবশ্যই আছে এবং তা বের করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। বড় বড় নগরীর নানাবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন রকম কর্তৃপক্ষ থাকেন। এই কর্তৃপক্ষের সমন্বিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায়। তবে মনে রাখা দরকার, সমস্যা সমাধানের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো অবশ্যই হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সহজে গ্রহণযোগ্য। মানুষ পরিবর্তন সব সময়ে অপছন্দ করে। তাই পরিবর্তনটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে মানুষ বেশি ঝামেলায় না পড়ে তা পালন করতে পারে।
আমাদের দেশে পরিবর্তন আনার জন্য চেষ্টা তো কম করা হলো না। কিন্তু উন্নতি খুব দৃশ্যমান তো নয়। ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে তার দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য কম তো চেষ্টা হচ্ছে না।
বন্ধু বললেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানীর যানজট নিয়ে অনেক কথা শোনা গেছে। এক সময়ে ব্যাংককের যানজটের দুর্নাম সারা পৃথিবীতে এতো ছিল যে ভ্রমণে আসার সময় বিভিন্ন দেশের পর্যটন ব্যুরো থেকে স্ব স্ব দেশের নাগরিককে রীতিমত সতর্ক করে বলা হতো : বিঅয়্যার অব নটরিয়াস ট্রাফিক অব ব্যাংকক। ব্যাংককের যানজট এমনই দুঃসহ আর তীব্র ছিল। ট্রাফিক ব্যবস্থা আর নারী পাচার (উইমেন ট্রাফিকিং) এ দুই ট্রাফিকের জন্য দুর্নাম ছিল ব্যাংককের। অথচ আজ ব্যাংককের অবস্থা পুরোদস্তুর উল্টো। রাজধানীর যানজট এখন অতীতের সমস্যা, একই অবস্থা ছিল টোকিওর। সেখানেও আজ অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা।
টোকিও শহর মাটির ওপর যতটা, মাটির নিচেও প্রায় ততটাই, নানা ধরনের যানবাহনের কারণে মানুষ অতি দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে যেতে পারে। যানবাহন ব্যবস্থা এতই উন্নতমানের যে, মানুষ ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করার কথা পারতপক্ষে করে না। মাটির ওপরে যেমন আছে দ্রুতগতির ট্রেন, বাস, মাটির নিচে তেমনি টিউব, মেট্রো রেল। টোকিওতে দেখেছি, মানুষজন এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যের দূরত্ব বোঝাতে কিলোমিটার না বলে সময়ের উল্লেখ করেন। অমুক স্টেশন থেকে অমুক জায়গার দূরত্ব ২৪ মিনিট জাতীয় কথা।
এর ঠিক বিপরীত চিত্র এখন ঢাকার। সময়ের হিসেবে যদি দূরত্ব বোঝাতে যান, তাহলে নিশ্চিত বোকা হতে হবে। এক বছর আগেও কারওয়ান বাজার থেকে উত্তরা পৌঁছাতে বাসে লাগত ৩৫-৪০ মিনিট, এখন কমপক্ষে দু’ঘণ্টা! কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি। এই দশ-বারো কিলোমিটার পথে পিঁপড়ার গতিতে যানবাহন চলে। কখনও কখনও দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়িঘোড়া। কী অ্যাম্বুলেন্স, কী ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, কী আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার গাড়ি—সব একাকার।
আগুন লাগলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িকে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর প্রতিনিয়ত জবাবদিহি করতে হয় বিলম্বে পৌঁছানোর জন্য। অভিযোগের অঙ্গুলি উত্তোলন করে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি সময়মত পৌঁছালে ক্ষতির পরিমাণ আরও কম হতো। অথবা অগ্নিনির্বাপক দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলেছে। পৌঁছালেও অভিযুক্ত হতে হলে দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না। কিন্তু ঘটনা তাই। এ যেন সেই ইংরেজি ট্রান্সলেশনের জন্য পরীক্ষায় প্রায় বাক্য : ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল— জাতীয় ব্যাপার। ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দীর্ঘ এবং প্রশস্ত রাস্তা নেই, পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত দীর্ঘ রাস্তা আছে। যানজটের কারণ হিসেবে এ কারণটিকেও চিহ্নিত করা হয়।
জরুরি সরকার মহা আড়ম্বরে র্যাংগস ভবন ভাঙার কাজে লেগেছিল। বারোজন শ্রমিক ভবন ভাঙতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এ জানুয়ারিতে র্যাংগস ভবন দুর্ঘটনার এক বছর পূর্ণ হলো।
ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো বদলে গেল। কিন্তু বদলালো না প্রস্তাবিত র্যাংগস ভবন সংলগ্ন রাস্তার দৃশ্য। বলা হয়েছিল এ রাস্তা চালু হলে যানজট পরিস্থিতির প্রভূত উন্নতি হবে।
সড়ক উদ্বোধনের দিনক্ষণ একাধিকবার নির্ধারণ করাও হয়। এখন শুনি রাস্তার ওপর রেল ট্র্যাক নিচে রেখে যে ফ্লাইওভার হওয়ার কথা তার জন্য এই বিলম্ব।
ফ্লাইওভার প্রকল্পে হঠাত্ করে যুক্ত হয়েছে এমনটা নয়। শুরু থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা ছিল। আসলে আমরা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে যত উত্সাহী, তা অর্জন করতে ততটা নই।
কত যে তারিখ নির্ধারণ করা হয় শুধুই নির্ধারণ করার জন্য, তার হিসাব যদি রাখি চমকিত হতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
No comments