ভারত এক অবন্ধুসুলভ প্রতিবেশী by ইলিয়াস খান
ড. জেগাথেসানের সঙ্গে গত বছর পরিচয় হয় লন্ডনে। লন্ডন কলেজ অব ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজের আমন্ত্রণ এবং সঙ্গে টি২০ বিশ্বকাপের খেলা দেখা ছিল আমার লন্ডন যাত্রার কারণ। তখন জুন মাস। শ্রীলঙ্কা সরকার কেবল তামিল টাইগারদের নিশ্চিহ্ন করার দাবি করে যাচ্ছে।
ড. জেগা একজন শ্রীলঙ্কান তামিল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে আছেন। এলটিটিই’র দীর্ঘদিনের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার সুযোগে তার সঙ্গে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে আমার ২০০৮ সালে কলম্বোয় অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার অভিজ্ঞতাও কাজে লাগে। এই সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে ক্যান্ডিসহ শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি। কথা হয়েছে দেশটির তামিল ও সিংহলি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে।
ড. জেগা খুব সংবেদনশীল মানুষ। একদিন লন্ডনের উপকণ্ঠে ঘুরতে গিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেতে খেতে শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গ উঠলে এক পর্যায়ে চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে এই তামিল শিক্ষাবিদের। আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাই। বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরে বলেন, ‘প্রথমত তুমি আমাদের প্রতিবেশী। দ্বিতীয়ত, একজন সাংবাদিক। বিষয়গুলো তোমার জেনে রাখা উচিত।’ জেগা যে সিংহলি-তামিল দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গ তুলবেন তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। আমিও আগ্রহ নিয়ে শুনতে শুরু করি। তার ক্ষোভ শ্রীলঙ্কা সরকারের চেয়েও দিল্লির প্রতি বেশি। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার তামিলরা দীর্ঘদিন ধরে যে যুদ্ধ করছে এর পেছনে ছিল ভারতের হাত। নয়াদিল্লি একদিকে তামিল গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, আবার অন্যদিকে কলম্বোকে অস্ত্র দিয়েছে। অথচ এই দুই জাতিগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব মেটাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু করেনি। এর ফলে হাজার হাজার তামিলকে প্রাণ দিতে হলো বেঘোরে। জেগাকে আমি নিবৃত্ত করি এবং বলি, আর একদিন আলোচনা করব এ নিয়ে।
শ্রীলঙ্কায় বসে কথা হয়েছিল সাংবাদিক সুদেরা’র সঙ্গে। তিনি সিংহলি। তার ক্ষোভও ভারতের বিরুদ্ধে। বলেন, শ্রীলঙ্কা যখন শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকার সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তামিল বিদ্রোহ শুরু হয় এবং নিঃসন্দেহে এর পেছনে ছিল ভারতের হাত। সুদেরা আরও অনেক কিছু বলেছেন। লেখার কলেবর বাড়াব না বলে সেদিকে আর যাচ্ছি না।
চীন আন্তর্জাতিক বেতারে নেপালি ভাষা বিভাগের বিদেশ বিশেষজ্ঞ ছিলেন মি. রমেন। বেইজিংয়ে এক বছর কাছাকাছি থাকার সুবাদে তার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ভারতের জন্যই আমাদের দেশটা দাঁড়াতে পারল না। প্রয়োজনমত সরকার গঠন করে, আবার পতন ঘটায়। নেপালের রাজপরিবারের হত্যাকাণ্ডেও দিল্লির হাত ছিল—এমনটিই ধারণা অধিকাংশ নেপালির। মি. রমেনই নন, ছাত্রজীবনে নেপাল গিয়েছিলাম স্টাডি ট্যুরে। কাঠমান্ডুর বিখ্যাত ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশ মতবিনিময় হয়েছিল। কেন যেন তারা ভারতের নামও শুনতে পারে না। আগেই উল্লেখ করেছি, বছরখানেক বেইজিং ছিলাম, চীন আন্তর্জাতিক বেতারে। সেখানে চীনা সহকর্মী ছাড়াও সাধারণ চীনাদের সঙ্গে কথা হতো চীন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে। সত্যি বলতে কী, চীনা নাগরিকরা ভারত সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন তা রীতিমত আতঙ্কজনক।
উপরোল্লিখিত এসব বক্তব্যের মধ্যে উঠে এসেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষের মন কোনোভাবেই জয় করতে পারছে না দিল্লি। একটি বড় দেশের বড়ত্ব প্রমাণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে সত্ প্রতিবেশী সুলভ অবস্থান। নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে বলা হবে না—নয়াদিল্লি তা পারেনি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল, বলা যায়, গণচীন। ১৪টি দেশ চীনের প্রতিবেশী। একমাত্র ভারত ছাড়া সব প্রতিবেশীর সঙ্গে তাদের চমত্কার সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কম সফল নয়। বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার এই দেশটিতে গিয়ে অনেক কানাডীয় ও মেক্সিকানের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী, বেশ পছন্দ করেন এই প্রতিবেশীকে। তারা হরহামেশা মার্কিন মুল্লুকে আসেন। আনন্দঘন সময় কাটিয়ে চলে যান, অনেকে আবার থেকেও যান। আর আমাদের অবস্থা? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই বলি। গত বছরের এপ্রিল মাসে ভারতে লোকসভা নির্বাচন হয়। আমার খুব ইচ্ছা জাগে এই নির্বাচনের খবর কাভার করতে যাওয়ার। কারণ ভোটার সংখ্যার হিসাবে ভারত সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। রাজ্যে রাজ্যে ঘুরব, দেখব, আমার দেশ-এ খবর পাঠাব—এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করে নিজের মধ্যে। অফিসকে জানাই। অফিস ইতিবাচক সাড়া দিয়ে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলে। আমি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করি। সরাসরি গিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করে আসি। একজন কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। তাকে প্রায়ই ফোন করি। তিনি জানান, দিল্লি থেকে নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স এলেই ভিসা পাওয়া যাবে। মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করে আমি প্রস্তুতি নিতে থাকি। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। ‘মোবাইল ক্যানট বি রিচ অ্যাট দিস মোমেন্ট’—বন্ধ মোবাইলের এই সেট করা কথার মতো আমাকে বারবার বলা হয়, ক্লিয়ারেন্স এলেই ভিসা পেয়ে যাবেন। কিন্তু এই ক্লিয়ারেন্স আর আসেনি, কখনও আসত কিনা তাও জানি না। শেষ পর্যন্ত দেড় মাস ঘুরে আমি পাসপোর্ট নিয়ে আসি। ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়ে দেখেছি, সাধারণ নিরীহ মানুষকে ভিসা সংগ্রহের জন্য কী অমানবিক পরিশ্রম করতে হয়। চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন। মনে হয় যেন ভারত বিশাল এক সমৃদ্ধিশালী দেশ, ইউরোপ-আমেরিকার মতো। বাংলাদেশ থেকে কেউ যেতে পারলে আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আমার চোখে তো এখনও ভাসে, রাজধানী ট্রেনে দিল্লি যেতে যেতে দেখেছি, শত শত মানুষ, পুরুষ-মহিলা ভেদাভেদ নেই, খোলা জায়গায় সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। চেহারায় তাদের দারিদ্র্যের ছাপ প্রকট। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখার সুবাদে এরকম দরিদ্র চেহারা বাংলাদেশে দেখা যায় না। যাই হোক, আমি জানতে পারিনি কেন আমাকে ভিসা দেয়া হয়নি। হয়তো আমার কর্মস্থল দৈনিক আমার দেশ বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলে, হয়তো আমি আমার দেশ’র পক্ষে কিছু রিপোর্ট করেছি—এই অপরাধে (!) ভিসা দেয়া যাবে না? এর আগেও ২০০৫ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে নয়াদিল্লি যেতে গিয়ে মাত্র পাঁচদিনের ভিসা মিলেছিল। অথচ ওই বছরই এক মাসের ভিসা চেয়ে এক বছরের ভিসা পেয়েছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আসলে আমার ধারণা, ভারতের কূটনৈতিক তত্পরতার গতি-প্রকৃতি দেখেই এই ধারণা জন্মেছে—ভারত তার প্রতিবেশীদের আস্থায় আনতে পারছে না। মনের মধ্যে প্রথিত এই আস্থার সঙ্কট খুব দ্রুত দূর হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
বলা যায়, বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের পেটের মধ্যে। বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের সেভেন সিস্টার হিসেবে পরিচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য। নির্যাতন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে ভারত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই সাত রাজ্যে বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকেও তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা পাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ যদি একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে টিকে থাকে, তাহলে ওই রাজ্যগুলো তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে আরও আগ্রহী হবে—এমনটিই ধারণা ভারতের নীতিনির্ধারকদের। এজন্যই বাংলাদেশ যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য যা যা দরকার তার সবই করছে নয়াদিল্লি। তবে দেশটির ভাগ্য ভালো। মাঝে মাঝেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানা পন্থায় বশংবদ সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। যেমন এই মুহূর্তে নেপালে রয়েছে ভারতের বশংবদ সরকার। হামিদ কারজাইও ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত। যদিও চীন আর মিয়ানমার নয়াদিল্লির কৌটিল্য নীতির ধার ধারে না।
ভারত মূলত প্রতিবেশীদের কাছে একটি উত্পীড়ক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে তিনটি চুক্তি ও কিছু সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে এসেছেন। শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তিনি হিন্দু পুরাণের খলনায়ক ‘দুর্যোধনের মতো জয়’ করে এসেছেন। যদিও বাংলাদেশের মানুষ এই জয় প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপরও বলতে হয়, মানুষের ভালোবাসা ছাড়া বড় কিছু অর্জন করা যায় না। এই উপলব্ধি কবে হবে ভারতের?
লেখক : সাংবাদিক
ড. জেগা খুব সংবেদনশীল মানুষ। একদিন লন্ডনের উপকণ্ঠে ঘুরতে গিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেতে খেতে শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গ উঠলে এক পর্যায়ে চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে এই তামিল শিক্ষাবিদের। আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাই। বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরে বলেন, ‘প্রথমত তুমি আমাদের প্রতিবেশী। দ্বিতীয়ত, একজন সাংবাদিক। বিষয়গুলো তোমার জেনে রাখা উচিত।’ জেগা যে সিংহলি-তামিল দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গ তুলবেন তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। আমিও আগ্রহ নিয়ে শুনতে শুরু করি। তার ক্ষোভ শ্রীলঙ্কা সরকারের চেয়েও দিল্লির প্রতি বেশি। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার তামিলরা দীর্ঘদিন ধরে যে যুদ্ধ করছে এর পেছনে ছিল ভারতের হাত। নয়াদিল্লি একদিকে তামিল গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, আবার অন্যদিকে কলম্বোকে অস্ত্র দিয়েছে। অথচ এই দুই জাতিগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব মেটাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু করেনি। এর ফলে হাজার হাজার তামিলকে প্রাণ দিতে হলো বেঘোরে। জেগাকে আমি নিবৃত্ত করি এবং বলি, আর একদিন আলোচনা করব এ নিয়ে।
শ্রীলঙ্কায় বসে কথা হয়েছিল সাংবাদিক সুদেরা’র সঙ্গে। তিনি সিংহলি। তার ক্ষোভও ভারতের বিরুদ্ধে। বলেন, শ্রীলঙ্কা যখন শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকার সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তামিল বিদ্রোহ শুরু হয় এবং নিঃসন্দেহে এর পেছনে ছিল ভারতের হাত। সুদেরা আরও অনেক কিছু বলেছেন। লেখার কলেবর বাড়াব না বলে সেদিকে আর যাচ্ছি না।
চীন আন্তর্জাতিক বেতারে নেপালি ভাষা বিভাগের বিদেশ বিশেষজ্ঞ ছিলেন মি. রমেন। বেইজিংয়ে এক বছর কাছাকাছি থাকার সুবাদে তার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ভারতের জন্যই আমাদের দেশটা দাঁড়াতে পারল না। প্রয়োজনমত সরকার গঠন করে, আবার পতন ঘটায়। নেপালের রাজপরিবারের হত্যাকাণ্ডেও দিল্লির হাত ছিল—এমনটিই ধারণা অধিকাংশ নেপালির। মি. রমেনই নন, ছাত্রজীবনে নেপাল গিয়েছিলাম স্টাডি ট্যুরে। কাঠমান্ডুর বিখ্যাত ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশ মতবিনিময় হয়েছিল। কেন যেন তারা ভারতের নামও শুনতে পারে না। আগেই উল্লেখ করেছি, বছরখানেক বেইজিং ছিলাম, চীন আন্তর্জাতিক বেতারে। সেখানে চীনা সহকর্মী ছাড়াও সাধারণ চীনাদের সঙ্গে কথা হতো চীন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে। সত্যি বলতে কী, চীনা নাগরিকরা ভারত সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন তা রীতিমত আতঙ্কজনক।
উপরোল্লিখিত এসব বক্তব্যের মধ্যে উঠে এসেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ মানুষের মন কোনোভাবেই জয় করতে পারছে না দিল্লি। একটি বড় দেশের বড়ত্ব প্রমাণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে সত্ প্রতিবেশী সুলভ অবস্থান। নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে বলা হবে না—নয়াদিল্লি তা পারেনি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল, বলা যায়, গণচীন। ১৪টি দেশ চীনের প্রতিবেশী। একমাত্র ভারত ছাড়া সব প্রতিবেশীর সঙ্গে তাদের চমত্কার সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কম সফল নয়। বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার এই দেশটিতে গিয়ে অনেক কানাডীয় ও মেক্সিকানের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী, বেশ পছন্দ করেন এই প্রতিবেশীকে। তারা হরহামেশা মার্কিন মুল্লুকে আসেন। আনন্দঘন সময় কাটিয়ে চলে যান, অনেকে আবার থেকেও যান। আর আমাদের অবস্থা? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই বলি। গত বছরের এপ্রিল মাসে ভারতে লোকসভা নির্বাচন হয়। আমার খুব ইচ্ছা জাগে এই নির্বাচনের খবর কাভার করতে যাওয়ার। কারণ ভোটার সংখ্যার হিসাবে ভারত সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। রাজ্যে রাজ্যে ঘুরব, দেখব, আমার দেশ-এ খবর পাঠাব—এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করে নিজের মধ্যে। অফিসকে জানাই। অফিস ইতিবাচক সাড়া দিয়ে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলে। আমি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করি। সরাসরি গিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করে আসি। একজন কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। তাকে প্রায়ই ফোন করি। তিনি জানান, দিল্লি থেকে নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স এলেই ভিসা পাওয়া যাবে। মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করে আমি প্রস্তুতি নিতে থাকি। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। ‘মোবাইল ক্যানট বি রিচ অ্যাট দিস মোমেন্ট’—বন্ধ মোবাইলের এই সেট করা কথার মতো আমাকে বারবার বলা হয়, ক্লিয়ারেন্স এলেই ভিসা পেয়ে যাবেন। কিন্তু এই ক্লিয়ারেন্স আর আসেনি, কখনও আসত কিনা তাও জানি না। শেষ পর্যন্ত দেড় মাস ঘুরে আমি পাসপোর্ট নিয়ে আসি। ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়ে দেখেছি, সাধারণ নিরীহ মানুষকে ভিসা সংগ্রহের জন্য কী অমানবিক পরিশ্রম করতে হয়। চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন। মনে হয় যেন ভারত বিশাল এক সমৃদ্ধিশালী দেশ, ইউরোপ-আমেরিকার মতো। বাংলাদেশ থেকে কেউ যেতে পারলে আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আমার চোখে তো এখনও ভাসে, রাজধানী ট্রেনে দিল্লি যেতে যেতে দেখেছি, শত শত মানুষ, পুরুষ-মহিলা ভেদাভেদ নেই, খোলা জায়গায় সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। চেহারায় তাদের দারিদ্র্যের ছাপ প্রকট। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখার সুবাদে এরকম দরিদ্র চেহারা বাংলাদেশে দেখা যায় না। যাই হোক, আমি জানতে পারিনি কেন আমাকে ভিসা দেয়া হয়নি। হয়তো আমার কর্মস্থল দৈনিক আমার দেশ বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলে, হয়তো আমি আমার দেশ’র পক্ষে কিছু রিপোর্ট করেছি—এই অপরাধে (!) ভিসা দেয়া যাবে না? এর আগেও ২০০৫ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে নয়াদিল্লি যেতে গিয়ে মাত্র পাঁচদিনের ভিসা মিলেছিল। অথচ ওই বছরই এক মাসের ভিসা চেয়ে এক বছরের ভিসা পেয়েছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আসলে আমার ধারণা, ভারতের কূটনৈতিক তত্পরতার গতি-প্রকৃতি দেখেই এই ধারণা জন্মেছে—ভারত তার প্রতিবেশীদের আস্থায় আনতে পারছে না। মনের মধ্যে প্রথিত এই আস্থার সঙ্কট খুব দ্রুত দূর হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
বলা যায়, বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের পেটের মধ্যে। বাংলাদেশ ঘিরে ভারতের সেভেন সিস্টার হিসেবে পরিচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য। নির্যাতন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে ভারত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই সাত রাজ্যে বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকেও তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা পাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ যদি একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে টিকে থাকে, তাহলে ওই রাজ্যগুলো তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে আরও আগ্রহী হবে—এমনটিই ধারণা ভারতের নীতিনির্ধারকদের। এজন্যই বাংলাদেশ যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য যা যা দরকার তার সবই করছে নয়াদিল্লি। তবে দেশটির ভাগ্য ভালো। মাঝে মাঝেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানা পন্থায় বশংবদ সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। যেমন এই মুহূর্তে নেপালে রয়েছে ভারতের বশংবদ সরকার। হামিদ কারজাইও ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত। যদিও চীন আর মিয়ানমার নয়াদিল্লির কৌটিল্য নীতির ধার ধারে না।
ভারত মূলত প্রতিবেশীদের কাছে একটি উত্পীড়ক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে তিনটি চুক্তি ও কিছু সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে এসেছেন। শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তিনি হিন্দু পুরাণের খলনায়ক ‘দুর্যোধনের মতো জয়’ করে এসেছেন। যদিও বাংলাদেশের মানুষ এই জয় প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপরও বলতে হয়, মানুষের ভালোবাসা ছাড়া বড় কিছু অর্জন করা যায় না। এই উপলব্ধি কবে হবে ভারতের?
লেখক : সাংবাদিক
No comments