শেকড়ের ডাক-আমিনীর হরতাল কী ইঙ্গিত বহন করছে? by ফরহাদ মাহমুদ
নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করে ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির নামে গত সোমবার দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছিলেন। হরতালের সময় বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশের রাইফেল ও ওয়াকিটকি ছিনতাইসহ ব্যাপক সহিংস ঘটনা
ঘটে। কওমি মাদ্রাসায় পাঠরত শিশুদের এক হাতে লাঠি, আরেক হাতে পবিত্র কোরআন শরিফ ধরিয়ে দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়। অনেকেই ধারণা করেছেন, প্রকাশ্যে সমর্থন না জানালেও বিএনপি-জামায়াত জোট, বিশেষ করে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন শিবিরের কর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এই হরতালে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্পষ্টই এ রকম অভিযোগ করেছেন। হরতালের ঠিক পরের দিন মুক্তাঙ্গনে আমিনী সাহেব সমাবেশও ডেকেছিলেন, যদিও পুলিশের বাধায় তা হতে পারেনি। প্রায় একই সময়ে জামায়াতে ইসলামীও সেখানে সমাবেশ ডেকেছিল। সমাবেশে বাধা দেওয়ায় পল্টনে পুলিশ ও জামায়াত-শিবিরকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। অপরদিকে বিএনপি শিগগিরই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। সব ঘটনাকে এক সূত্রে গাঁথলে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা মোটেও সুখকর নয়।
হরতালের দিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি দেখে অনুমান করা যায়, পুলিশের ওপর হামলাকারীদের অনেকেই বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। হামলাকারীরা যেভাবে কুংফু-কারাতের স্টাইলে পুলিশকে আক্রমণ করেছে, তা থেকে বোঝা যায় এরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কারণ একজন পুলিশ সদস্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েই বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি অস্ত্র কিভাবে রক্ষা করতে হয় তা-ও জানেন। সেই পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র ও ওয়াকিটকি কেড়ে নেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। এ জন্য জঙ্গিদের 'আন-আর্মড কমব্যাট' বা অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধের বিশেষ কৌশল শেখানো হয়। পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকেও বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। এরা কারা? এরাও কী কওমি মাদ্রাসার ছাত্র? কোথায় চলে এসব জঙ্গি প্রশিক্ষণ? নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের কর্মীরাও কি এই হরতালে মাঠে নেমেছিল? দেশে কি শিগগিরই আবার জঙ্গি তৎপরতা শুরু হতে যাচ্ছে? সেদিনের হরতাল থেকে এ রকম অনেক প্রশ্নই উঠে এসেছে।
র্যাব-পুলিশের অভিযানে এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র, বোমা, জিহাদি বইসহ জঙ্গিরা ধরা পড়ছে। প্রায়ই গণমাধ্যমে সেসব খবর আসছে। গত বুধবারের পত্রিকায়ও আছে মোহাম্মদপুর থেকে ককটেল, বোমা ও জিহাদি বইসহ ১১ শিবিরকর্মীকে আটক করা হয়েছে। কাজেই দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে গেছে_এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা বরং সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আর সেটি হলো হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। দেশের অধিকাংশ আলেম স্বীকার না করলেও আমিনী সাহেব দাবি করছেন, গৃহীত নারী নীতিমালা কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আলোচনায় বসার এবং কোন কোন নীতি কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তিনি সে আহ্বানে সাড়া দেননি। এমনকি পত্রপত্রিকায়ও তিনি সুস্পষ্টভাবে তেমন কোনো বক্তব্য দিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি। তার পরও তিনি কেন এ হরতাল ডাকলেন? আর এই হরতালে পিকেটিং ও গাড়ি ভাঙচুরের কাজে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিশুদের কেন নামানো হলো? মিছিল, পিকেটিং ও ভাঙচুরে অংশ নেওয়া শিশুদের অনেকেই বলেছে, কেন এ হরতাল তা-ই তারা জানে না। হুজুর (শিক্ষক) ও বড় ভাইরা বলেছে বলেই তারা মিছিলে এসেছে (কালের কণ্ঠ, ৬ এপ্রিল)।
আরেকটি জঘন্য কাজ আমিনী সাহেব সেদিন করেছেন, সেটি হলো এক হাতে কোরআন ও অন্য হাতে লাঠি নিয়ে মিছিল করার নির্দেশ প্রদান। এরা লাঠি নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করবে, আর পুলিশ তাদের আদর করবে_এটা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। এরা গাড়ি ভাঙচুর করবে আর পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে_এটাও স্বাভাবিক নয়। ফলে পুলিশও তাদের ধাওয়া করবে এবং সংঘর্ষ বাধবে। তখন হাতে থাকা কোরআন শরিফ পায়ের তলায় পড়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারত। কিংবা ঘটেছে কি না_তাই-বা কে জানে! আমিনী সাহেব যে এমনটা অনুমান করতে পারেননি, তা কোনো বোকার পক্ষেও বিশ্বাস করা কঠিন। তাই বলা যায়, তিনি জেনেশুনেই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের অবমাননা করতে চেয়েছেন, যাতে তা নিয়ে পরবর্তীকালে আরেকটি ইস্যু তৈরি করা যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়। দেশের আলেম সমাজের অনেকেই আমিনী সাহেবের এ ধরনের অনৈতিক এবং কোরআন অবমাননার মতো নির্দেশ প্রদানের কড়া সমালোচনা করেছেন। এমনকি এ জন্য তাঁর শাস্তিও দাবি করেছেন।
বিগত জোট সরকারের আমলে দেশে যখন জঙ্গিবাদ ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখন থেকেই আমিনী সাহেবের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। তিনি সেদিনের হরতালেও তার প্রমাণ রেখেছেন। হরতালকারী শিশুদের অনেকেই জানিয়েছে, তাদের হুজুর ও বড় ভাইরা বলেছেন, দেশে ইসলাম রক্ষার জন্য জিহাদে অংশ নিতে হবে এবং আরো বড় জিহাদের জন্য তৈরি হতে হবে। তাদের কাফনের কাপড় পরিয়ে পিকেটিংয়ে নামানো হয়েছে। তার অর্থ প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে, আত্মঘাতী হতে হবে। বিগত জোট সরকারের আমলে আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আত্মঘাতী হামলার বহু নজির আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, কওমি মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার নামে কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে? সাধারণত অতিদরিদ্র, এতিম শিশুরাই এসব মাদ্রাসায় পড়তে আসে। এখনো তাদের ভালো-মন্দ বিচার করার বয়স হয়নি। এ অবস্থায় তাদের বিপথে পরিচালনা করা খুবই সহজ কাজ। এদের মধ্য থেকে আত্মঘাতী স্কোয়াড বানানোও কোনো কঠিন কাজ নয়। কওমি মাদ্রাসাগুলো কি জঙ্গিবাদের সেই প্রশিক্ষণ প্রদানের স্থান?
দেশে এখন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধকারীদের বিচারকাজ এগিয়ে চলেছে। রাজাকার, আলবদরসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা তাই এই বিচার ঠেকাতে খুবই তৎপর। '৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে তারা আবার এ দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত ছিল। কাজেই গত ৩৫ বছরে তারা সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, এমনকি প্রশাসনেও একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তাদের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন তো আছেই। কাজেই তারা যখন মরণকামড় দেবে, তা সামলানো খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সরকারের বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখে সচেতন মহল বরং উল্টো আশঙ্কাই করছে।
বিগত নির্বাচনের আগে সারা দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি প্রধান দাবি হিসেবে উঠে এসেছিল। এ ক্ষেত্রে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তেমনি অগ্রণী ভূমিকা ছিল এ দেশের তরুণ সমাজের। আর সেই অঙ্গীকারের কারণেই মহাজোট বিগত নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে বিজয়ী হতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের গত দুই বছরের কর্মকাণ্ড তরুণ সমাজকে অনেকটাই হতাশ করেছে। মন্ত্রী ও এমপি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অনেক কর্মকাণ্ডই তরুণ সমাজের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও অনেকে সরকারের অনেক কর্মকাণ্ডই সঠিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি মহাজোটকে সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীরাও ক্রমেই নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। কারণ তাঁরা দেখছেন, মহাজোটের নামে আওয়ামী লীগ সরকার কেবল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। যেসব কারণে আজ অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে না। আর এই নেতিবাচক অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছে এবং নেবে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র।
সরকারের সামনে এখনো কিছু পরিমাণ সুযোগ অবশিষ্ট আছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার। সে জন্য দুর্বলতাগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে। মহাজোটকে আওয়ামী লীগের সরকার না বানিয়ে মহাজোটের সরকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আবার একতাবদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। কেবল আহ্বান জানালেই তা হবে না। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে। আশা করি, বর্তমান সরকার ও মহাজোটের শীর্ষ নেতারা আসন্ন পরিস্থিতি কিছুটা হলেও অনুধাবন করবেন এবং তদনুযায়ী যা করার তা-ই তাঁরা করবেন। অন্যথায় যে ভয়াবহ পরিণতির দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। আবারও স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতেই যাবে এ দেশের শাসনক্ষমতা।
লেখক : সাংবাদিক
হরতালের দিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি দেখে অনুমান করা যায়, পুলিশের ওপর হামলাকারীদের অনেকেই বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। হামলাকারীরা যেভাবে কুংফু-কারাতের স্টাইলে পুলিশকে আক্রমণ করেছে, তা থেকে বোঝা যায় এরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কারণ একজন পুলিশ সদস্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েই বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি অস্ত্র কিভাবে রক্ষা করতে হয় তা-ও জানেন। সেই পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র ও ওয়াকিটকি কেড়ে নেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। এ জন্য জঙ্গিদের 'আন-আর্মড কমব্যাট' বা অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধের বিশেষ কৌশল শেখানো হয়। পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকেও বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। এরা কারা? এরাও কী কওমি মাদ্রাসার ছাত্র? কোথায় চলে এসব জঙ্গি প্রশিক্ষণ? নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের কর্মীরাও কি এই হরতালে মাঠে নেমেছিল? দেশে কি শিগগিরই আবার জঙ্গি তৎপরতা শুরু হতে যাচ্ছে? সেদিনের হরতাল থেকে এ রকম অনেক প্রশ্নই উঠে এসেছে।
র্যাব-পুলিশের অভিযানে এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র, বোমা, জিহাদি বইসহ জঙ্গিরা ধরা পড়ছে। প্রায়ই গণমাধ্যমে সেসব খবর আসছে। গত বুধবারের পত্রিকায়ও আছে মোহাম্মদপুর থেকে ককটেল, বোমা ও জিহাদি বইসহ ১১ শিবিরকর্মীকে আটক করা হয়েছে। কাজেই দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে গেছে_এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা বরং সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আর সেটি হলো হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। দেশের অধিকাংশ আলেম স্বীকার না করলেও আমিনী সাহেব দাবি করছেন, গৃহীত নারী নীতিমালা কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আলোচনায় বসার এবং কোন কোন নীতি কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তিনি সে আহ্বানে সাড়া দেননি। এমনকি পত্রপত্রিকায়ও তিনি সুস্পষ্টভাবে তেমন কোনো বক্তব্য দিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি। তার পরও তিনি কেন এ হরতাল ডাকলেন? আর এই হরতালে পিকেটিং ও গাড়ি ভাঙচুরের কাজে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিশুদের কেন নামানো হলো? মিছিল, পিকেটিং ও ভাঙচুরে অংশ নেওয়া শিশুদের অনেকেই বলেছে, কেন এ হরতাল তা-ই তারা জানে না। হুজুর (শিক্ষক) ও বড় ভাইরা বলেছে বলেই তারা মিছিলে এসেছে (কালের কণ্ঠ, ৬ এপ্রিল)।
আরেকটি জঘন্য কাজ আমিনী সাহেব সেদিন করেছেন, সেটি হলো এক হাতে কোরআন ও অন্য হাতে লাঠি নিয়ে মিছিল করার নির্দেশ প্রদান। এরা লাঠি নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করবে, আর পুলিশ তাদের আদর করবে_এটা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। এরা গাড়ি ভাঙচুর করবে আর পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে_এটাও স্বাভাবিক নয়। ফলে পুলিশও তাদের ধাওয়া করবে এবং সংঘর্ষ বাধবে। তখন হাতে থাকা কোরআন শরিফ পায়ের তলায় পড়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারত। কিংবা ঘটেছে কি না_তাই-বা কে জানে! আমিনী সাহেব যে এমনটা অনুমান করতে পারেননি, তা কোনো বোকার পক্ষেও বিশ্বাস করা কঠিন। তাই বলা যায়, তিনি জেনেশুনেই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের অবমাননা করতে চেয়েছেন, যাতে তা নিয়ে পরবর্তীকালে আরেকটি ইস্যু তৈরি করা যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়। দেশের আলেম সমাজের অনেকেই আমিনী সাহেবের এ ধরনের অনৈতিক এবং কোরআন অবমাননার মতো নির্দেশ প্রদানের কড়া সমালোচনা করেছেন। এমনকি এ জন্য তাঁর শাস্তিও দাবি করেছেন।
বিগত জোট সরকারের আমলে দেশে যখন জঙ্গিবাদ ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখন থেকেই আমিনী সাহেবের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। তিনি সেদিনের হরতালেও তার প্রমাণ রেখেছেন। হরতালকারী শিশুদের অনেকেই জানিয়েছে, তাদের হুজুর ও বড় ভাইরা বলেছেন, দেশে ইসলাম রক্ষার জন্য জিহাদে অংশ নিতে হবে এবং আরো বড় জিহাদের জন্য তৈরি হতে হবে। তাদের কাফনের কাপড় পরিয়ে পিকেটিংয়ে নামানো হয়েছে। তার অর্থ প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে, আত্মঘাতী হতে হবে। বিগত জোট সরকারের আমলে আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আত্মঘাতী হামলার বহু নজির আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, কওমি মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার নামে কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে? সাধারণত অতিদরিদ্র, এতিম শিশুরাই এসব মাদ্রাসায় পড়তে আসে। এখনো তাদের ভালো-মন্দ বিচার করার বয়স হয়নি। এ অবস্থায় তাদের বিপথে পরিচালনা করা খুবই সহজ কাজ। এদের মধ্য থেকে আত্মঘাতী স্কোয়াড বানানোও কোনো কঠিন কাজ নয়। কওমি মাদ্রাসাগুলো কি জঙ্গিবাদের সেই প্রশিক্ষণ প্রদানের স্থান?
দেশে এখন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধকারীদের বিচারকাজ এগিয়ে চলেছে। রাজাকার, আলবদরসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা তাই এই বিচার ঠেকাতে খুবই তৎপর। '৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে তারা আবার এ দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত ছিল। কাজেই গত ৩৫ বছরে তারা সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, এমনকি প্রশাসনেও একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তাদের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন তো আছেই। কাজেই তারা যখন মরণকামড় দেবে, তা সামলানো খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সরকারের বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখে সচেতন মহল বরং উল্টো আশঙ্কাই করছে।
বিগত নির্বাচনের আগে সারা দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি প্রধান দাবি হিসেবে উঠে এসেছিল। এ ক্ষেত্রে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তেমনি অগ্রণী ভূমিকা ছিল এ দেশের তরুণ সমাজের। আর সেই অঙ্গীকারের কারণেই মহাজোট বিগত নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে বিজয়ী হতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের গত দুই বছরের কর্মকাণ্ড তরুণ সমাজকে অনেকটাই হতাশ করেছে। মন্ত্রী ও এমপি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অনেক কর্মকাণ্ডই তরুণ সমাজের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও অনেকে সরকারের অনেক কর্মকাণ্ডই সঠিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি মহাজোটকে সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীরাও ক্রমেই নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। কারণ তাঁরা দেখছেন, মহাজোটের নামে আওয়ামী লীগ সরকার কেবল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। যেসব কারণে আজ অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে না। আর এই নেতিবাচক অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছে এবং নেবে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র।
সরকারের সামনে এখনো কিছু পরিমাণ সুযোগ অবশিষ্ট আছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার। সে জন্য দুর্বলতাগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে। মহাজোটকে আওয়ামী লীগের সরকার না বানিয়ে মহাজোটের সরকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আবার একতাবদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। কেবল আহ্বান জানালেই তা হবে না। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে। আশা করি, বর্তমান সরকার ও মহাজোটের শীর্ষ নেতারা আসন্ন পরিস্থিতি কিছুটা হলেও অনুধাবন করবেন এবং তদনুযায়ী যা করার তা-ই তাঁরা করবেন। অন্যথায় যে ভয়াবহ পরিণতির দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। আবারও স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতেই যাবে এ দেশের শাসনক্ষমতা।
লেখক : সাংবাদিক
No comments