গণতন্ত্র ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি by ড. একেএম আজহারুল ইসলাম
গত কয়েকদিন ধরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রসঙ্গে সংবাদপত্রে নানা ধরনের খবরাখবর বের হচ্ছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে মর্মে আইনমন্ত্রী সম্প্রতি এক বক্তব্য দেন।
এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দেশের প্রথম সারির ইসলামী দলগুলোর নেতারা বলেছেন (আমার দেশ, ৯/১/১০), ‘ধর্মভিত্তিক তথা ইসলামী রাজনীতি কোরআনের রাজনীতি। রাসূল (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদিন এ রাজনীতি করেছেন। প্রত্যেক মুসলমানের ইসলামী রাজনীতি করা ফরজ। এ রাজনীতি বন্ধ করার অধিকার কারও নেই। ইসলামী রাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ ধর্মীয় অধিকার ও ঈমানের ওপর আঘাতের শামিল। সরকারের আইনমন্ত্রী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।’ আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিবাদে প্রতি শুক্রবার তৌহিদী জনতা দেশের মসজিদগুলো থেকে মিছিল নিয়ে বের হচ্ছে, বিক্ষোভ হচ্ছে।
একই বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়েছিল গত ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারির পরে। জরুরি অবস্থা ঘোষণাকালীন অঙ্গীকার করা হয় যে, সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এজন্য নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে। সংলাপ মোটামুটি এগিয়ে চলে। কিন্তু ইতিবাচক আলোচনার মধ্যে দুটি বিষয় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্তরায় হয়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি হলো, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণের প্রশ্নে, আর অপরটি হলো ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্নে। প্রথমটির সৃষ্টি হয় নেতৃত্ব মাইনাস ইস্যুকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনের বিএনপি সংক্রান্ত বিতর্কিত সিদ্ধান্তে। আর দ্বিতীয়টি হয় সংলাপের শুরুতেই কিছু কিছু ব্যক্তি বা দল কর্তৃক নতুন ইস্যু তৈরির কৌশল অবলম্বনের দ্বারা। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তখন কয়েকটি মহল থেকে দাবি ওঠে। আবার এর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিলেন অনেকে। এনিয়ে দেশের ’সুশীল’ সমাজেও ছিল ভিন্ন ভিন্ন মত। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে বলা হয়েছিল, গণতন্ত্র ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি একে অপরের বিরোধী। কাজেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল কোনোমতেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারে না। আর এও বলা হচ্ছিল যে, একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সম্মুখে আসে : ক) মৌলবাদ-জিহাদের ধুয়া, খ) জঙ্গিবাদ প্রশ্নে ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা, গ) মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সম্পর্ক এবং ঙ) কুরআন ও গণতন্ত্র।
মৌলবাদ-জিহাদের ধুয়া : প্রথমে মৌলবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। দেশের নাস্তিকসহ অনেকেই ইসলাম পালনকারীদের ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী হিসেবে গালি দিয়ে চলেছে। ইসলামকে গোঁড়া ও রণোন্মাদ ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করার জন্য ‘মৌলবাদ’ ও ‘জিহাদ’ শব্দবন্ধটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ৯/১১ ট্রাজেডির পর থেকে মার্কিন নব্য-রাজনীতিবিদ ও প্রচার মাধ্যমগুলো ইসলামকে ‘শয়তানি শক্তি’ হিসেবে নিন্দিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। পশ্চিমা পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ, ইভানজেলিক খ্রিস্টান ও গণমাধ্যমগুলো এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে এই দুটো শব্দবন্ধকে প্রকাশ্য আলোচনায় এমন বিকৃতভাবে উপস্থিত করছে যে, ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে জনমানসে বিশাল ভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর ‘বুদ্ধিজীবী’ ও রাজনৈতিক নেতা একই কাজ করছেন।
মৌলবাদ হচ্ছে মূলত একটি মার্কিন প্রসঙ্গ। ১৯২০-এর দশকে মার্কিন ইভানজেলিক প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টবাদের ইতিহাস থেকে এর উত্পত্তি। কিছু ইভানজেলিক মনে করতেন, ‘আধুনিক ধর্মতত্ত্ব ও কিছু নির্দিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক প্রবণতাকে নিরপেক্ষভাবে প্রতিহত করাই একজন প্রকৃত খ্রিস্টানের প্রধান কর্তব্য। ‘মৌলবাদ’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা যায়, ইসলামসহ যে কোনো ধর্মের মৌল বিষয়গুলোর প্রতি আপোষহীন আনুগত্য। কিন্তু সম্প্রতি শুধু ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের ব্যাপারে বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মুসলিম মৌলবাদীরা ইসলামের মৌল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হন না এবং কেউ বিচ্যুত হলে তিনি আর প্রকৃত অর্থে মুসলিম থাকেন না। কোনো মুসলমান যদি সন্ত্রাসী কাজ করে তবে তিনি ইসলামের মৌল নীতি লঙ্ঘন করলেন। একজন প্রকৃত মুসলমান সহিংসতা সৃষ্টি করে মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে কোনো নিরীহ লোককে হত্যা করতে পারে না। কিন্তু ইসলামের নামে কিছু বিপথগামী লোকের কর্মকাণ্ডকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও অন্যরা মৌলবাদী এবং চরমপন্থী বা সন্ত্রাসী কাজ বলে অভিহিত করছে। এসব লোকদের ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসী’ বলা সঠিক, কিন্তু তাদের ‘মৌলবাদী’ বলা যুক্তিহীন। কারণ ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত মুসলমান মাত্রই মৌলবাদী অথচ পশ্চিমারা ‘মৌলবাদী’ পরিভাষাটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে।
জঙ্গিবাদ প্রশ্নে ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা : বছর কয়েক আগে বাংলাদেশে দেখা গেছে, তথাকথিত আলেম শ্রেণীভুক্ত কিছু লোকের নেতৃত্বে জেএমবি নামক একটি নতুন গ্রুপ ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। বাংলাদেশ সরকার এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় এবং এদের দমন করতে বেশ কিছু সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দেশের প্রখ্যাত ইসলামী নেতৃত্ব ও আলেমদের মাধ্যমে হামলা, সহিংসতা ও হত্যার (বিশেষত আত্মঘাতী বোমা হামলা) বিরুদ্ধে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার করা হয়। দেশের পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক সব গণমাধ্যম তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই এ সশস্ত্র সংগঠনটির মূল হোতাদের পাকড়াও করা সম্ভব হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সম্পর্ক : মুক্তিযুদ্ধ কি রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কের ইতি ঘটিয়েছে? এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে (আসাদ বিন হাফিজ ১৫ নভেম্বর ২০০৭)। ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। এ কেন্দ্রের কার্যক্রমের কিছু অংশ মুক্তিযুদ্ধ যে ইসলামবিরোধী নয়, তা প্রমাণ করার জন্য ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ নামে ধারাবাহিকভাবে কথিকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।... অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের মাহাত্ম্যে খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছিলেন। ইসলামকে সবার কাছে যথার্থরূপে তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সেই ধারাবাহিক ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ কথিকা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অত্যন্ত সময়োপযোগী ও উপকারী হয়েছিল।
ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও গণতন্ত্র কি পরষমরবিরোধী? কুরআনের আলোকে গণতন্ত্র : ‘গণতন্ত্র’ হচ্ছে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের জন্য, জনগণের এক সরকারের নাম। শত বছরের যাচাই বাছাইয়ের পর বিশ্ব গণতন্ত্রের নীতি আদর্শ গ্রহণ করেছে। যে কোন কিছু করার স্বাধীনতাসহ ইংল্যান্ডের রাজা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার চাটুকাররা বলতেন, ‘রাজা কোনো ভুল করতে পারেন না।’ শেষ পর্যন্ত ১২১৫ সালের ১৫ জুন ইংল্যান্ডের সুশীল সমাজ রাজাকে প্রথমবারের মতো একটি ‘ম্যাগনাকার্টায়’ স্বাক্ষর দানে বাধ্য করেন, যেখানে গণমানুষের কিছু অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করা হয়। এর পথ ধরেই ইংল্যান্ডে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠার পথ অবারিত হয়। এ ম্যাগনাকার্টা স্বাক্ষরের পাঁচ শতাব্দী আগেই হজরত মুহাম্মদের (সা.) নেতৃত্বে মদীনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও পৌত্তলিকসহ ছোট-বড় সব গোষ্ঠী একটি একক রাষ্ট্রের অধিবাসী হিসেবে মদিনায় বাস ও কাজ করার অঙ্গীকার করেন।
কিন্তু মদিনার তত্কালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘মদিনা সনদ’ ছিল ‘ম্যাগনাকার্টা’র চেয়ে তুলনাহীনভাবে শ্রেষ্ঠতর। ঐতিহাসিক মদিনা সনদে ইহুদি ও পৌত্তলিকসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। সে সনদে ঘোষিত হয়, ‘আজ থেকে রক্তপাত ও ব্যভিচার নিষিদ্ধ হলো এবং সকল সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।’ সনদে আরও বলা হয়, ‘স্বাক্ষরিত গোষ্ঠীসমূহের কেউ বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে সকল গোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে তাদেরকে প্রতিহত করবে।’ ইংল্যান্ডে স্বাক্ষরিত ম্যাগনাকার্টার বিপরীতে কয়েক শতাব্দী আগে প্রতিষ্ঠিত মদিনা সনদের বহুমাত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের এগুলো কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র। ...‘মূর্তিপূজকসহ মদিনার সকল জাতি-গোষ্ঠীর প্রকৃত ও বৈধ স্বার্থ রক্ষার অনন্য দলিল হিসেবে এবং গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিমালা প্রতিষ্ঠার অনবদ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে মদিনা সনদ এক মাইলফলকরূপে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
বলা হয় ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও গণতন্ত্র পরষমরবিরোধী। কিন্তু কথাটি মোটেই সত্য নয়। ‘পবিত্র কুরআন কি গণতন্ত্র বিষয়ে কোনো আলোচনা করেছে?।’ ইসলাম কি গণতন্ত্র বিরোধী? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে কুরআনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যায়। কোরআনে ‘গণতন্ত্র’ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে না বলা হলেও সূরা ‘আশ শূরায়’ পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। ‘যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, পারষমরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে’ (কোরআন ৪২ : ৩৮)।
এই আয়াতের মুখ্য শব্দটি হচ্ছে ‘শূরা’ যা পারষমরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার জোর তাগিদ দিয়েছে। এখন প্রশ্ন তোলা যায়, কোরআনের এ আয়াতের সঙ্গে ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ গঠনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কী? নির্বাচন কমিশন সাধারণ জনতার মতামত বা পরামর্শ নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে। যেহেতু লাখ লাখ লোকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা সম্ভব নয়, সেহেতু প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সেই ‘পরামর্শ’ (consultation) গ্রহণ সম্ভব। গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের লক্ষ্যে সংসদ সদস্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন পরোক্ষভাবে সব ভোটারের মতামত গ্রহণ করে। সুতরাং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হওয়ার আগে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশ করা কোরআনের এ বাণীর আক্ষরিক ও চেতনাগত অনুবাদ ছাড়া কিছু নয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনুবাদক ও কোরআন গবেষক আল্লামা ইউসুফ আলী বলেছেন, মহানবী (সা.) ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এবং ইসলামের প্রথম যুগের শাসকরা ‘পরামর্শের নীতির’ পূর্ণ ও সফল বাস্তবায়ন করেছেন। আধুনিককালের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে (অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও) এই নীতি বাস্তবায়নের একটি চেষ্টা মাত্র। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইসলাম গণতন্ত্রের বিরোধী তো নয়ই, বরং রাষ্ট্রে সমানাধিকারের ভিত্তিতে বহুত্ববাদী, বহুজাতিক সমাজ বিনির্মাণের পক্ষে।
পরমতসহিষ্ণুতা ও জাতীয় ঐকমত্য : পরমত সহিষ্ণুতা ও জাতীয় ঐকমত্য একটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখে। আমরা দেখেছি, পৃথিবীর যেসব দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে সেসব দেশেই নেতৃত্বদানকারী দল ও ব্যক্তি দীর্ঘদিন জনগণের আস্থাভাজন হয়ে দেশ চালিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ‘স্বাধীনতা লাভের পর জাতীয় ঐকমত্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশের জনগণের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ’ উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে তা হয়নি। স্বাধীন হওয়ার পরপরই এখানে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য যা কিছু করা দরকার তার সবটাই করা হয়’। বিশেষ করে ‘ইসলামপন্থী লোকদের ওপর সর্বাত্মক অভিযান’ পরিচালনা ছিল মারাত্মক ভুল। ‘ইসলামী দলগুলো নিষিদ্ধ করা হলো। এটাই ছিল নেতৃত্বের জনবিচ্ছিন্নতার শুরু। “হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও মসজিদের ইমামদের কারারুদ্ধ করা হলো। টুপি, দাড়িওয়ালাদের ওপর নেমে এল নির্যাতন। তাফসির মাহফিল পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে গেল। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা এবং সমাজতন্ত্রের নামে নাস্তিক্যবাদ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ঘোষিত হলো। বিশ্বের তিন নম্বর মুসলিম দেশ, শাহজালাল, শাহমাখদুম, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, খানজাহান আলীর বাংলাদেশের সংবিধানে কোথাও আল্লাহ, রাসূল (সা.) বা ইসলাম শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি।... ক্ষমতার দাম্ভিকতা, অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ন, উপরন্তু ধর্মপ্রাণ দেশটিকে খোদাদ্রোহী, ইসলাম দুশমনদের অভয়ারণ্যে পরিণত [হয়]... উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে আনতে শুরু করে দেশের মানুষ।” (সোনার বাংলা, ৯ নভেম্বর, ২০০৭)।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ও ইসলামী রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব সময়ই মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আর রাজনৈতিক নেতা মৌলবাদের ইস্যু তুলে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে চায়। নির্বাচনে যাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন কতটুকু? এ ধরনের রাজনৈতিক গ্রুপ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। যারা এসব দাবি করছে তাদের আদর্শ তো মানুষ গ্রহণ করছে না। তাদের আদর্শ যদি মানুষ গ্রহণ করে তাহলে তো ইসলামভিত্তিক দল এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যায়, নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে না।
ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শ মেনে চলার জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নির্দেশ প্রদান করেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ মেনে চলার জন্য কোরআন-সুন্নাহতে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। খণ্ডিতভাবে জীবনযাপন করার সুযোগ নেই। তাই ইসলাম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা যায় না। আল্লাহর নির্দেশ পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে মানুষ ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করে আসছে। গণতন্ত্রের মূলনীতি হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। গণতন্ত্রে অন্য আদর্শ বা মতকে নিষিদ্ধ করার দাবির সুযোগ নেই। অন্য দলকে গায়ের জোরে নিষিদ্ধ করার কথা গণতন্ত্র বলেও না। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতোই সব মতের রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশে থাকবে—এটিই হলো বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা।
লেখক : সাবেক ভিসি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
একই বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়েছিল গত ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারির পরে। জরুরি অবস্থা ঘোষণাকালীন অঙ্গীকার করা হয় যে, সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এজন্য নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে। সংলাপ মোটামুটি এগিয়ে চলে। কিন্তু ইতিবাচক আলোচনার মধ্যে দুটি বিষয় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্তরায় হয়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি হলো, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণের প্রশ্নে, আর অপরটি হলো ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্নে। প্রথমটির সৃষ্টি হয় নেতৃত্ব মাইনাস ইস্যুকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনের বিএনপি সংক্রান্ত বিতর্কিত সিদ্ধান্তে। আর দ্বিতীয়টি হয় সংলাপের শুরুতেই কিছু কিছু ব্যক্তি বা দল কর্তৃক নতুন ইস্যু তৈরির কৌশল অবলম্বনের দ্বারা। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তখন কয়েকটি মহল থেকে দাবি ওঠে। আবার এর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিলেন অনেকে। এনিয়ে দেশের ’সুশীল’ সমাজেও ছিল ভিন্ন ভিন্ন মত। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে বলা হয়েছিল, গণতন্ত্র ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি একে অপরের বিরোধী। কাজেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল কোনোমতেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারে না। আর এও বলা হচ্ছিল যে, একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সম্মুখে আসে : ক) মৌলবাদ-জিহাদের ধুয়া, খ) জঙ্গিবাদ প্রশ্নে ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা, গ) মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সম্পর্ক এবং ঙ) কুরআন ও গণতন্ত্র।
মৌলবাদ-জিহাদের ধুয়া : প্রথমে মৌলবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। দেশের নাস্তিকসহ অনেকেই ইসলাম পালনকারীদের ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী হিসেবে গালি দিয়ে চলেছে। ইসলামকে গোঁড়া ও রণোন্মাদ ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করার জন্য ‘মৌলবাদ’ ও ‘জিহাদ’ শব্দবন্ধটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ৯/১১ ট্রাজেডির পর থেকে মার্কিন নব্য-রাজনীতিবিদ ও প্রচার মাধ্যমগুলো ইসলামকে ‘শয়তানি শক্তি’ হিসেবে নিন্দিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। পশ্চিমা পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ, ইভানজেলিক খ্রিস্টান ও গণমাধ্যমগুলো এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে এই দুটো শব্দবন্ধকে প্রকাশ্য আলোচনায় এমন বিকৃতভাবে উপস্থিত করছে যে, ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে জনমানসে বিশাল ভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর ‘বুদ্ধিজীবী’ ও রাজনৈতিক নেতা একই কাজ করছেন।
মৌলবাদ হচ্ছে মূলত একটি মার্কিন প্রসঙ্গ। ১৯২০-এর দশকে মার্কিন ইভানজেলিক প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টবাদের ইতিহাস থেকে এর উত্পত্তি। কিছু ইভানজেলিক মনে করতেন, ‘আধুনিক ধর্মতত্ত্ব ও কিছু নির্দিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক প্রবণতাকে নিরপেক্ষভাবে প্রতিহত করাই একজন প্রকৃত খ্রিস্টানের প্রধান কর্তব্য। ‘মৌলবাদ’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা যায়, ইসলামসহ যে কোনো ধর্মের মৌল বিষয়গুলোর প্রতি আপোষহীন আনুগত্য। কিন্তু সম্প্রতি শুধু ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের ব্যাপারে বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মুসলিম মৌলবাদীরা ইসলামের মৌল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হন না এবং কেউ বিচ্যুত হলে তিনি আর প্রকৃত অর্থে মুসলিম থাকেন না। কোনো মুসলমান যদি সন্ত্রাসী কাজ করে তবে তিনি ইসলামের মৌল নীতি লঙ্ঘন করলেন। একজন প্রকৃত মুসলমান সহিংসতা সৃষ্টি করে মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে কোনো নিরীহ লোককে হত্যা করতে পারে না। কিন্তু ইসলামের নামে কিছু বিপথগামী লোকের কর্মকাণ্ডকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও অন্যরা মৌলবাদী এবং চরমপন্থী বা সন্ত্রাসী কাজ বলে অভিহিত করছে। এসব লোকদের ‘চরমপন্থী’ বা ‘সন্ত্রাসী’ বলা সঠিক, কিন্তু তাদের ‘মৌলবাদী’ বলা যুক্তিহীন। কারণ ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত মুসলমান মাত্রই মৌলবাদী অথচ পশ্চিমারা ‘মৌলবাদী’ পরিভাষাটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে।
জঙ্গিবাদ প্রশ্নে ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা : বছর কয়েক আগে বাংলাদেশে দেখা গেছে, তথাকথিত আলেম শ্রেণীভুক্ত কিছু লোকের নেতৃত্বে জেএমবি নামক একটি নতুন গ্রুপ ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। বাংলাদেশ সরকার এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় এবং এদের দমন করতে বেশ কিছু সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দেশের প্রখ্যাত ইসলামী নেতৃত্ব ও আলেমদের মাধ্যমে হামলা, সহিংসতা ও হত্যার (বিশেষত আত্মঘাতী বোমা হামলা) বিরুদ্ধে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার করা হয়। দেশের পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক সব গণমাধ্যম তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই এ সশস্ত্র সংগঠনটির মূল হোতাদের পাকড়াও করা সম্ভব হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সম্পর্ক : মুক্তিযুদ্ধ কি রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কের ইতি ঘটিয়েছে? এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে (আসাদ বিন হাফিজ ১৫ নভেম্বর ২০০৭)। ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। এ কেন্দ্রের কার্যক্রমের কিছু অংশ মুক্তিযুদ্ধ যে ইসলামবিরোধী নয়, তা প্রমাণ করার জন্য ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ নামে ধারাবাহিকভাবে কথিকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।... অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের মাহাত্ম্যে খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছিলেন। ইসলামকে সবার কাছে যথার্থরূপে তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সেই ধারাবাহিক ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ কথিকা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অত্যন্ত সময়োপযোগী ও উপকারী হয়েছিল।
ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও গণতন্ত্র কি পরষমরবিরোধী? কুরআনের আলোকে গণতন্ত্র : ‘গণতন্ত্র’ হচ্ছে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের জন্য, জনগণের এক সরকারের নাম। শত বছরের যাচাই বাছাইয়ের পর বিশ্ব গণতন্ত্রের নীতি আদর্শ গ্রহণ করেছে। যে কোন কিছু করার স্বাধীনতাসহ ইংল্যান্ডের রাজা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার চাটুকাররা বলতেন, ‘রাজা কোনো ভুল করতে পারেন না।’ শেষ পর্যন্ত ১২১৫ সালের ১৫ জুন ইংল্যান্ডের সুশীল সমাজ রাজাকে প্রথমবারের মতো একটি ‘ম্যাগনাকার্টায়’ স্বাক্ষর দানে বাধ্য করেন, যেখানে গণমানুষের কিছু অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করা হয়। এর পথ ধরেই ইংল্যান্ডে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠার পথ অবারিত হয়। এ ম্যাগনাকার্টা স্বাক্ষরের পাঁচ শতাব্দী আগেই হজরত মুহাম্মদের (সা.) নেতৃত্বে মদীনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও পৌত্তলিকসহ ছোট-বড় সব গোষ্ঠী একটি একক রাষ্ট্রের অধিবাসী হিসেবে মদিনায় বাস ও কাজ করার অঙ্গীকার করেন।
কিন্তু মদিনার তত্কালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘মদিনা সনদ’ ছিল ‘ম্যাগনাকার্টা’র চেয়ে তুলনাহীনভাবে শ্রেষ্ঠতর। ঐতিহাসিক মদিনা সনদে ইহুদি ও পৌত্তলিকসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। সে সনদে ঘোষিত হয়, ‘আজ থেকে রক্তপাত ও ব্যভিচার নিষিদ্ধ হলো এবং সকল সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।’ সনদে আরও বলা হয়, ‘স্বাক্ষরিত গোষ্ঠীসমূহের কেউ বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে সকল গোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে তাদেরকে প্রতিহত করবে।’ ইংল্যান্ডে স্বাক্ষরিত ম্যাগনাকার্টার বিপরীতে কয়েক শতাব্দী আগে প্রতিষ্ঠিত মদিনা সনদের বহুমাত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের এগুলো কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র। ...‘মূর্তিপূজকসহ মদিনার সকল জাতি-গোষ্ঠীর প্রকৃত ও বৈধ স্বার্থ রক্ষার অনন্য দলিল হিসেবে এবং গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিমালা প্রতিষ্ঠার অনবদ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে মদিনা সনদ এক মাইলফলকরূপে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
বলা হয় ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও গণতন্ত্র পরষমরবিরোধী। কিন্তু কথাটি মোটেই সত্য নয়। ‘পবিত্র কুরআন কি গণতন্ত্র বিষয়ে কোনো আলোচনা করেছে?।’ ইসলাম কি গণতন্ত্র বিরোধী? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে কুরআনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যায়। কোরআনে ‘গণতন্ত্র’ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে না বলা হলেও সূরা ‘আশ শূরায়’ পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। ‘যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, পারষমরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে’ (কোরআন ৪২ : ৩৮)।
এই আয়াতের মুখ্য শব্দটি হচ্ছে ‘শূরা’ যা পারষমরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার জোর তাগিদ দিয়েছে। এখন প্রশ্ন তোলা যায়, কোরআনের এ আয়াতের সঙ্গে ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ গঠনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কী? নির্বাচন কমিশন সাধারণ জনতার মতামত বা পরামর্শ নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে। যেহেতু লাখ লাখ লোকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা সম্ভব নয়, সেহেতু প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সেই ‘পরামর্শ’ (consultation) গ্রহণ সম্ভব। গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের লক্ষ্যে সংসদ সদস্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন পরোক্ষভাবে সব ভোটারের মতামত গ্রহণ করে। সুতরাং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হওয়ার আগে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশ করা কোরআনের এ বাণীর আক্ষরিক ও চেতনাগত অনুবাদ ছাড়া কিছু নয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনুবাদক ও কোরআন গবেষক আল্লামা ইউসুফ আলী বলেছেন, মহানবী (সা.) ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এবং ইসলামের প্রথম যুগের শাসকরা ‘পরামর্শের নীতির’ পূর্ণ ও সফল বাস্তবায়ন করেছেন। আধুনিককালের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে (অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও) এই নীতি বাস্তবায়নের একটি চেষ্টা মাত্র। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইসলাম গণতন্ত্রের বিরোধী তো নয়ই, বরং রাষ্ট্রে সমানাধিকারের ভিত্তিতে বহুত্ববাদী, বহুজাতিক সমাজ বিনির্মাণের পক্ষে।
পরমতসহিষ্ণুতা ও জাতীয় ঐকমত্য : পরমত সহিষ্ণুতা ও জাতীয় ঐকমত্য একটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখে। আমরা দেখেছি, পৃথিবীর যেসব দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে সেসব দেশেই নেতৃত্বদানকারী দল ও ব্যক্তি দীর্ঘদিন জনগণের আস্থাভাজন হয়ে দেশ চালিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ‘স্বাধীনতা লাভের পর জাতীয় ঐকমত্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশের জনগণের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ’ উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে তা হয়নি। স্বাধীন হওয়ার পরপরই এখানে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য যা কিছু করা দরকার তার সবটাই করা হয়’। বিশেষ করে ‘ইসলামপন্থী লোকদের ওপর সর্বাত্মক অভিযান’ পরিচালনা ছিল মারাত্মক ভুল। ‘ইসলামী দলগুলো নিষিদ্ধ করা হলো। এটাই ছিল নেতৃত্বের জনবিচ্ছিন্নতার শুরু। “হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও মসজিদের ইমামদের কারারুদ্ধ করা হলো। টুপি, দাড়িওয়ালাদের ওপর নেমে এল নির্যাতন। তাফসির মাহফিল পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে গেল। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা এবং সমাজতন্ত্রের নামে নাস্তিক্যবাদ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ঘোষিত হলো। বিশ্বের তিন নম্বর মুসলিম দেশ, শাহজালাল, শাহমাখদুম, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, খানজাহান আলীর বাংলাদেশের সংবিধানে কোথাও আল্লাহ, রাসূল (সা.) বা ইসলাম শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি।... ক্ষমতার দাম্ভিকতা, অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ন, উপরন্তু ধর্মপ্রাণ দেশটিকে খোদাদ্রোহী, ইসলাম দুশমনদের অভয়ারণ্যে পরিণত [হয়]... উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে আনতে শুরু করে দেশের মানুষ।” (সোনার বাংলা, ৯ নভেম্বর, ২০০৭)।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ও ইসলামী রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব সময়ই মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আর রাজনৈতিক নেতা মৌলবাদের ইস্যু তুলে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে চায়। নির্বাচনে যাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন কতটুকু? এ ধরনের রাজনৈতিক গ্রুপ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। যারা এসব দাবি করছে তাদের আদর্শ তো মানুষ গ্রহণ করছে না। তাদের আদর্শ যদি মানুষ গ্রহণ করে তাহলে তো ইসলামভিত্তিক দল এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যায়, নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে না।
ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শ মেনে চলার জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নির্দেশ প্রদান করেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ মেনে চলার জন্য কোরআন-সুন্নাহতে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। খণ্ডিতভাবে জীবনযাপন করার সুযোগ নেই। তাই ইসলাম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা যায় না। আল্লাহর নির্দেশ পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে মানুষ ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করে আসছে। গণতন্ত্রের মূলনীতি হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। গণতন্ত্রে অন্য আদর্শ বা মতকে নিষিদ্ধ করার দাবির সুযোগ নেই। অন্য দলকে গায়ের জোরে নিষিদ্ধ করার কথা গণতন্ত্র বলেও না। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতোই সব মতের রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশে থাকবে—এটিই হলো বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা।
লেখক : সাবেক ভিসি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
No comments