বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা স্মারক ও চুক্তিঃ একটি পর্যালোচনা by প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বহুল আলোচিত ভারত সফরকালে গত ১১ জানুয়ারি ২০১০ নয়াদিল্লিতে ৫০ দফা যৌথ ইশতেহারের আওতায় তিনটি চুক্তি, একটি সমঝোতা স্মারক ও একটি সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার আলোকে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক পর্যালোচনার আগে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা কী সেটি সংজ্ঞায়িত হলে ভালো হয়।
জাতীয় স্বার্থ বলতে জাতিগত বা রাষ্ট্রীয় হিত, লাভ, মঙ্গল বা স্বার্থসংরক্ষণকে বোঝানো হয়। আর জাতীয় নিরাপত্তা হচ্ছে, রাষ্ট্র বা জাতি বিশেষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক নিরাপদ ও সুরক্ষিত অবস্থা।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল শতভাগ সফল আর প্রধান বিরোধী দল শতভাগ ব্যর্থ বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। সরকারি দল ও জোট নেতারা ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য মধ্যপন্থী, ডান ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রধান বিরোধী দলের কাছাকাছি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী এ সমঝোতা স্মারক ও চুক্তির বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীকে মহাসমারোহে সংবর্ধনা, মেডেল ও শান্তিপদক ইত্যাদিতে বিমোহিত করে একটি অসম দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক এবং চুক্তি বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা বলছেন, একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে একটি দুর্বল দেশের চুক্তির যে অবস্থা হয়, গত ১২ জানুয়ারি তাই হয়েছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশ যে কিছু পায়নি তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশকে পাওয়ার চেয়ে দিতে হয়েছে অনেক বেশি। দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তার সবই ভারতের দাবি বা প্রত্যাশার ভিত্তিতে হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেসব সমস্যা রয়েছে তার সবই ভবিষ্যতের জন্য ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশকে অস্বস্তিতে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের নামে করিডোর ও বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে ভারতের প্রায় সব দাবি পূরণ হয়েছে। নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি ভারতের এঅঞ্চলে কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রকে আরও সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত করবে। এদের মতে, সম্পাদিত স্মারক ও চুক্তি দ্বারা বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় বৃহত্ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কিছু লাভ হলেও সামগ্রিকভাবে দেশ ও ব্যাপক জনগণের কোনো লাভ হবে না। এখানে উল্লেখ্য, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন টকশো’র আলোচনায় সরকার সমর্থক সুশীল সমাজও দেয়ার চেয়ে প্রাপ্তির পরিমাণ যে অপ্রতুল সেটি অস্বীকার করতে পারছে না।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারের ৪৮ দফায় বর্ণিত স্মারকের তিনটি চুক্তি হচ্ছে : ১. অপরাধ বিষয়ে পরস্পরকে আইনি সহায়তা প্রদানের চুক্তি; ২. সাজাপ্রাপ্ত বন্দিবিনিময় চুক্তি ও ৩. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার মোকাবেলায় চুক্তি। অভিজ্ঞজনদের বিবেচনায় এ তিনটি চুক্তি দ্বারাই বৃহত্ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারত তার দুর্বল এবং ক্ষুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশের তুলনায় লাভবান হবে অনেক বেশি। আমরা জানি, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য—আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয়, হিমাচল প্রভৃতিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। ভারত ও তার মিত্ররা এসব রাজ্যের অধিবাসীদের সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতা কিংবা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে অভিহিত করলেও এরা নিজেদের স্বাধীনতাকামী বলে বিবেচনা করেন। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকেও বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা নেই। কোনো অঞ্চল বিশেষের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম জয়লাভ করলে সেটি হয় স্বাধীনতার লড়াই। আর পরাভূত হলে সেটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদের তকমা পরিয়ে দেয়া হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের লড়াইয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থেই আমরা কোনো পক্ষ হওয়া সঙ্গত হবে না; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, কোনো চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও সম্ভবত উলফা প্রধান রাজখোয়াকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরের অব্যবহিত আগে বিনা গ্রেফতারে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সম্পাদিত চুক্তি বলে হয়তো অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করা যাবে। উলফা এরইমধ্যে বাংলাদেশের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি ব্যক্ত করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কলকাতা সফর এ কারণে বাতিল হয়েছে বলেও শোনা যায়। যাই হোক, বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সম্পাদিত উপর্যুক্ত তিন চুক্তি দ্বারা এঅঞ্চলে ভারতের আধিপত্য আরও বাড়বে। বাংলাদেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের টার্গেটে পরিণত হবে। আমাদের নিরাপত্তা হবে বিঘ্নিত; কিন্তু শক্তিশালী ভারত বাংলাদেশী সন্ত্রাসীদের ঠিকই আশ্রয় দিয়ে যাবে। বাংলাদেশের ঘোষিত ২০ সন্ত্রাসীর মধ্যে এখন ১৭ জনই ভারতে অবস্থান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হওয়া সত্ত্বেও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের এখনও অভয়ারণ্য হচ্ছে ভারতের মাটি। বঙ্গভূমিসহ অন্যান্য বাংলাদেশ বিরোধী সংগ্রামকেও ভারত আশ্রয়, প্রশ্রয় ও মদত দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনদিক জুড়ে অর্থাত্ প্রায় পুরো স্থল সীমান্তের অপর পাশে ভারতের অবস্থান। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব চোখে পড়ার মতো মনে না হলেও প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এর উত্তরাঞ্চলের প্রায় বিচ্ছিন্ন সাত রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান বঙ্গোপসাগর কূলবর্তী বাংলাদেশের ভূ-অবস্থানগত গুরুত্বকে বাড়িয়ে তুলেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এ সাত রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ, এ রাজ্যগুলোতে ক্রমবর্ধিষ্ণু অসন্তোষ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নিমিত্তে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে অতি দ্রুত ও নিরাপদে মূল ভূখণ্ড থেকে ওই রাজ্যগুলোতে উপস্থিত হওয়া ক্রমশ ভারতের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাতীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও এতদঞ্চলে ভারতের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার নিরিখে বিচার করলে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এ খাতের গুরুত্ব ভারতের কাছে অপরিসীম। এ কারণে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারত ওই অঞ্চলে যাতায়াত ও যোগাযোগের সহজ এবং নিরাপদ পথের সন্ধানে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও বিশ্ব শক্তি হিসেবে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, এ লক্ষ্যে চীনকে মোকাবেলাকরণ প্রভৃতি কারণে অতি ক্ষুদ্র ‘চিকেন নেক’ শিলিগুড়ি করিডোর কিংবা একটু বড় ‘দার্জিলিং করিডোর’-এর উপর ভারত আর নির্ভর করতে চায় না। ভারত এ কাজে বাংলাদেশের ভূমি ও বন্দর ব্যবহার করতে চায়। পূর্বোক্ত লক্ষ্য পূরণের জন্যই ভারত এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের মূল রুট (কলকাতা-ঢাকা-টেকনাফ) পরিবর্তন করে (কলকাতা-সিলেট-তামাবিল) আসামে নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের জন্য অলাভজনক ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিসকে আগরতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণও ভারতের উপর্যুক্ত স্বার্থপূরণ সহায়ক পরিকল্পনার অংশবিশেষ মাত্র।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারের ২৩ দফায় ভারতকে চট্টগ্রাম, মংলা বন্দর ও আশুগঞ্জ দিয়ে ট্রানজিট দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। এ বিষয়টিকে দ্বিপাক্ষিকতার ঊর্ধ্বে তুলে ধরার নিমিত্তে ভুটান ও নেপালকে যুক্ত করে ধূম্রজাল সৃষ্টির প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করেছি। এ সমঝোতা স্মারকে নেপাল ও ভুটানের সম্মতির কোনো কথা নেই। এ বিষয়ে নেই ভারতের সুস্পষ্ট সম্মতির অভিব্যক্তি। এটি মূলত একপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশের অভিব্যক্তির বিবরণী মাত্র। বাংলাদেশের আশুগঞ্জকে এবং ভারতের শিলঘটিকে ‘পোর্ট অব কল’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কথাও এ বৈঠকে বলা হয়েছে। আশুগঞ্জ থেকে ভারি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা দেবে ভারত। বৈঠকে দু’পক্ষ সম্মত হয়েছে, নেপালে বাংলাদেশের ট্রানজিটের জন্য রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ ব্রডগেজ রুটটি চালু হবে। একই সঙ্গে ভুটানে বাংলাদেশের রেল রুট ট্রানজিট দেয়ার জন্যও অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ; কিন্তু এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে ভারতের প্রায় সব প্রধান চাওয়া ও দাবি পূরণ হলেও সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজানে বরাক নদীর টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের যে চরম উত্কণ্ঠা ও উদ্বেগ, সেটি হয়েছে উপেক্ষিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য ‘অ্যাডভার্স এফেক্ট’ বা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয় এমনকিছু ভারত টিপাইমুখে করবে না—যৌথ ঘোষণায় দু’দেশের এ সম্মতির কথা বলে প্রকারান্তরে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বৈধতা দেয়া হয়েছে ভারতকে। মারাত্মক ক্ষতির বিষয়টি আপেক্ষিক বলে বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হলেও ভারত বলবে তেমন কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। অতীতে ফারাক্কা বাঁধ দ্বারা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি না হওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল ভারত। ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও শুরু হবে মরুকরণ। আর সমগ্র দক্ষিণ বাংলায় লবণাক্তকরণ সমস্যা পর্যায়ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। পরে কয়েক দফা এটি নবায়নকৃত হয়; কিন্তু বর্তমানে এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি নেই। আশা করা হয়েছিল, এ সফরকালে এ বিষয়ে নতুন চুক্তি কিংবা আগের চুক্তিটি নবায়নকৃত হবে; কিন্তু সেটি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কৃত গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যে তার ন্যায্যহিস্যা পাচ্ছে না সে বিষয়টির উল্লেখ পর্যন্ত নেই যৌথ ঘোষণায়। বলা হয়েছে, তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ভবিষ্যতে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরপি) বৈঠক হবে। তিস্তা ছাড়াও ফেনী, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধবলা ও দুধকুমার নদীর পানি বণ্টন বিষয়েও উপরোক্ত বৈঠকে আলোচনার আশ্বাস ব্যক্ত হয়েছে। অভিজ্ঞজনদের মতে যৌথ ঘোষণায় তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির স্পিরিট অনুযায়ী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আরেক বিপর্যয় সম্ভবত আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কারণ, গঙ্গা চুক্তির দ্বারা ভারত বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। পরীক্ষামূলকভাবে ৪০ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত তা আর বন্ধ করেনি। চুক্তির আগে গঙ্গা নদী থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পেত সেটি চুক্তির পরে আরও কমে গেছে। তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ১৯৮৩ সালে দুই দেশ একমত হলেও আজ পর্যন্ত ভারত ওই চুক্তির ব্যাপারে তালবাহানা করে চলছে। গঙ্গা চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অমান্য করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে শক্তিশালী ভারত প্রমাণ করেছে যে, সে দুর্বল প্রতিবেশীর স্বার্থের বিষয়টি উপেক্ষা করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪৮টিতে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ভারত থেকে ৩ দশমিক ২৭৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি মূল্য হচ্ছে মাত্র ৩৫৮ মিলিয়ন ডলার। সরকারিভাবে বৈধ পথে আমদানির প্রায় দ্বিগুণ পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে অবৈধভাবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি নিঃসন্দেহে বড় বাধা। এ ঘাটতি কমানোর জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত কখনও সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধ শতাধিক পণ্যের নেগেটিভ লিস্ট রয়েছে ভারতের হাতে। এ তালিকার পণ্যগুলোকে ভারতে ঢুকতে দেয়া হয় না। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ট্যারিফ-নন ট্যারিফ বাধা। বাংলাদেশ নেগেটিভ লিস্ট থেকে ৪৭টি পণ্য বাদ দেয়ার অনুরোধ জানালেও যৌথ ইশতেহারে তার কোনো উল্লেখ নেই। এতে কেবল বলা হয়েছে, আরও কিছু বাংলাদেশী পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে ভারত। এছাড়াও ভারত তার স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের মান সার্টিফিকেটের অজুহাতে বাংলাদেশী পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশে বাধা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশী পণ্যের একটি স্বাভাবিক বাজার ছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারত সুবিধা পেলে এ স্বাভাবিক বাজারও বাংলাদেশ হারাবে। এছাড়া স্থল করিডোর দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এ সাত রাজ্যে পণ্য চলাচল করতে পারবে সহজে-অনায়াসে। বাংলাদেশী জিনিসের কোনো চাহিদাই তখন থাকবে না এই সাত রাজ্যে।
যৌথ ইশতেহারে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তির আলোকে সমন্বিত সীমান্ত সমস্যা নিরসনে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতের কাছে বেরুবাড়ি হস্তান্তর করলেও বিনিময়ে ভারত তিন বিঘা করিডোর বলে পরিচিত মাত্র ০৩ বিঘা জায়গা বাংলাদেশকে এখনও হস্তান্তর করেনি। এর ফলে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের বাসিন্দারা এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখন আবার বাংলাদেশ ভারতের নাগরিকদের ব্যবহারের জন্য তিন বিঘা করিডোরে ফ্লাইওভার নির্মাণে সম্মতি জানিয়েছে। স্থল সীমান্তের মতো সমুদ্রসীমা নিয়েও ভারত টালবাহানা করে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশকে বাধা দিচ্ছে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ) বাহিনী প্রতিদিন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে মারছে। গত এক বছরে কমপক্ষে ৯৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করলেও যৌথ ইশতেহারে বিষয়টির জরুরি কোনো উপস্থিতি নেই। কেবল বলা হয়েছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীরা সংযত আচরণ করবে।
উপর্যুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে ভারতের বিশাল প্রাপ্তির বিনিময়ে মূলত বাংলাদেশ কিছুই পায়নি বললে অত্যুক্তি হবে না। যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী ভারতের করিডোর রূপি ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। এ টাকা ব্যবহার করা হবে ট্রানজিট সুবিধা সহজলভ্যকরণকল্পে সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে। এছাড়া যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশের বিদ্যুত্ ঘাটতি মেটাতে আন্তঃগ্রিড সংযোগ লাইন বসানো সাপেক্ষে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ভারত সরবরাহ করবে বলে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ঘাটতি পূরণে এ সহায়তা যে নিতান্ত নগণ্য, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া দ্রুত এ বিদ্যুত্ পাওয়াও যাবে না। ভারত আশুগঞ্জ দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে ত্রিপুরায় যে বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে সেখান থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুত্ বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে। সঞ্চালন লাইন স্থাপন করে এ বিদ্যুত্ কেনা হবে বহু সময়ের ব্যাপার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকে যখন ১০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল রিজার্ভ পড়ে আছে তখন এক বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ ও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ প্রাপ্তির বিনিময়ে এ অসম যৌথ ঘোষণায় যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এছাড়া ভারতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের রেকর্ডও খুব ভালো নয়। সিডর আক্রান্ত একটি গ্রাম নতুন করে গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ভারত এখনও বাস্তবায়িত করেনি। তখন চালের সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশকে সুলভমূল্যে ৫ লাখ টন চাল বিক্রি করার কথাও দিয়েছিল ভারত। পরে স্থানীয় বাজার থেকে অনেক বেশি মূল্যে বাংলাদেশ ভারত থেকে চাল কিনতে বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারের আরও একটি চোখে পড়ার মতো দুর্বল দিক হচ্ছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ নিরাপত্তা প�
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল শতভাগ সফল আর প্রধান বিরোধী দল শতভাগ ব্যর্থ বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। সরকারি দল ও জোট নেতারা ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য মধ্যপন্থী, ডান ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রধান বিরোধী দলের কাছাকাছি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী এ সমঝোতা স্মারক ও চুক্তির বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীকে মহাসমারোহে সংবর্ধনা, মেডেল ও শান্তিপদক ইত্যাদিতে বিমোহিত করে একটি অসম দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক এবং চুক্তি বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা বলছেন, একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে একটি দুর্বল দেশের চুক্তির যে অবস্থা হয়, গত ১২ জানুয়ারি তাই হয়েছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশ যে কিছু পায়নি তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশকে পাওয়ার চেয়ে দিতে হয়েছে অনেক বেশি। দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তার সবই ভারতের দাবি বা প্রত্যাশার ভিত্তিতে হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেসব সমস্যা রয়েছে তার সবই ভবিষ্যতের জন্য ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশকে অস্বস্তিতে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের নামে করিডোর ও বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে ভারতের প্রায় সব দাবি পূরণ হয়েছে। নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি ভারতের এঅঞ্চলে কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রকে আরও সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত করবে। এদের মতে, সম্পাদিত স্মারক ও চুক্তি দ্বারা বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় বৃহত্ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কিছু লাভ হলেও সামগ্রিকভাবে দেশ ও ব্যাপক জনগণের কোনো লাভ হবে না। এখানে উল্লেখ্য, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন টকশো’র আলোচনায় সরকার সমর্থক সুশীল সমাজও দেয়ার চেয়ে প্রাপ্তির পরিমাণ যে অপ্রতুল সেটি অস্বীকার করতে পারছে না।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারের ৪৮ দফায় বর্ণিত স্মারকের তিনটি চুক্তি হচ্ছে : ১. অপরাধ বিষয়ে পরস্পরকে আইনি সহায়তা প্রদানের চুক্তি; ২. সাজাপ্রাপ্ত বন্দিবিনিময় চুক্তি ও ৩. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার মোকাবেলায় চুক্তি। অভিজ্ঞজনদের বিবেচনায় এ তিনটি চুক্তি দ্বারাই বৃহত্ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারত তার দুর্বল এবং ক্ষুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশের তুলনায় লাভবান হবে অনেক বেশি। আমরা জানি, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য—আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয়, হিমাচল প্রভৃতিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। ভারত ও তার মিত্ররা এসব রাজ্যের অধিবাসীদের সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতা কিংবা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে অভিহিত করলেও এরা নিজেদের স্বাধীনতাকামী বলে বিবেচনা করেন। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকেও বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা নেই। কোনো অঞ্চল বিশেষের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম জয়লাভ করলে সেটি হয় স্বাধীনতার লড়াই। আর পরাভূত হলে সেটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদের তকমা পরিয়ে দেয়া হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের লড়াইয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থেই আমরা কোনো পক্ষ হওয়া সঙ্গত হবে না; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, কোনো চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও সম্ভবত উলফা প্রধান রাজখোয়াকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরের অব্যবহিত আগে বিনা গ্রেফতারে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সম্পাদিত চুক্তি বলে হয়তো অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করা যাবে। উলফা এরইমধ্যে বাংলাদেশের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি ব্যক্ত করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কলকাতা সফর এ কারণে বাতিল হয়েছে বলেও শোনা যায়। যাই হোক, বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সম্পাদিত উপর্যুক্ত তিন চুক্তি দ্বারা এঅঞ্চলে ভারতের আধিপত্য আরও বাড়বে। বাংলাদেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের টার্গেটে পরিণত হবে। আমাদের নিরাপত্তা হবে বিঘ্নিত; কিন্তু শক্তিশালী ভারত বাংলাদেশী সন্ত্রাসীদের ঠিকই আশ্রয় দিয়ে যাবে। বাংলাদেশের ঘোষিত ২০ সন্ত্রাসীর মধ্যে এখন ১৭ জনই ভারতে অবস্থান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হওয়া সত্ত্বেও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের এখনও অভয়ারণ্য হচ্ছে ভারতের মাটি। বঙ্গভূমিসহ অন্যান্য বাংলাদেশ বিরোধী সংগ্রামকেও ভারত আশ্রয়, প্রশ্রয় ও মদত দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনদিক জুড়ে অর্থাত্ প্রায় পুরো স্থল সীমান্তের অপর পাশে ভারতের অবস্থান। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব চোখে পড়ার মতো মনে না হলেও প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এর উত্তরাঞ্চলের প্রায় বিচ্ছিন্ন সাত রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান বঙ্গোপসাগর কূলবর্তী বাংলাদেশের ভূ-অবস্থানগত গুরুত্বকে বাড়িয়ে তুলেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এ সাত রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ, এ রাজ্যগুলোতে ক্রমবর্ধিষ্ণু অসন্তোষ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নিমিত্তে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে অতি দ্রুত ও নিরাপদে মূল ভূখণ্ড থেকে ওই রাজ্যগুলোতে উপস্থিত হওয়া ক্রমশ ভারতের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাতীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও এতদঞ্চলে ভারতের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার নিরিখে বিচার করলে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এ খাতের গুরুত্ব ভারতের কাছে অপরিসীম। এ কারণে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারত ওই অঞ্চলে যাতায়াত ও যোগাযোগের সহজ এবং নিরাপদ পথের সন্ধানে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও বিশ্ব শক্তি হিসেবে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, এ লক্ষ্যে চীনকে মোকাবেলাকরণ প্রভৃতি কারণে অতি ক্ষুদ্র ‘চিকেন নেক’ শিলিগুড়ি করিডোর কিংবা একটু বড় ‘দার্জিলিং করিডোর’-এর উপর ভারত আর নির্ভর করতে চায় না। ভারত এ কাজে বাংলাদেশের ভূমি ও বন্দর ব্যবহার করতে চায়। পূর্বোক্ত লক্ষ্য পূরণের জন্যই ভারত এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের মূল রুট (কলকাতা-ঢাকা-টেকনাফ) পরিবর্তন করে (কলকাতা-সিলেট-তামাবিল) আসামে নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের জন্য অলাভজনক ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিসকে আগরতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণও ভারতের উপর্যুক্ত স্বার্থপূরণ সহায়ক পরিকল্পনার অংশবিশেষ মাত্র।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারের ২৩ দফায় ভারতকে চট্টগ্রাম, মংলা বন্দর ও আশুগঞ্জ দিয়ে ট্রানজিট দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। এ বিষয়টিকে দ্বিপাক্ষিকতার ঊর্ধ্বে তুলে ধরার নিমিত্তে ভুটান ও নেপালকে যুক্ত করে ধূম্রজাল সৃষ্টির প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করেছি। এ সমঝোতা স্মারকে নেপাল ও ভুটানের সম্মতির কোনো কথা নেই। এ বিষয়ে নেই ভারতের সুস্পষ্ট সম্মতির অভিব্যক্তি। এটি মূলত একপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশের অভিব্যক্তির বিবরণী মাত্র। বাংলাদেশের আশুগঞ্জকে এবং ভারতের শিলঘটিকে ‘পোর্ট অব কল’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কথাও এ বৈঠকে বলা হয়েছে। আশুগঞ্জ থেকে ভারি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা দেবে ভারত। বৈঠকে দু’পক্ষ সম্মত হয়েছে, নেপালে বাংলাদেশের ট্রানজিটের জন্য রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ ব্রডগেজ রুটটি চালু হবে। একই সঙ্গে ভুটানে বাংলাদেশের রেল রুট ট্রানজিট দেয়ার জন্যও অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ; কিন্তু এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে ভারতের প্রায় সব প্রধান চাওয়া ও দাবি পূরণ হলেও সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজানে বরাক নদীর টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের যে চরম উত্কণ্ঠা ও উদ্বেগ, সেটি হয়েছে উপেক্ষিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য ‘অ্যাডভার্স এফেক্ট’ বা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয় এমনকিছু ভারত টিপাইমুখে করবে না—যৌথ ঘোষণায় দু’দেশের এ সম্মতির কথা বলে প্রকারান্তরে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বৈধতা দেয়া হয়েছে ভারতকে। মারাত্মক ক্ষতির বিষয়টি আপেক্ষিক বলে বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হলেও ভারত বলবে তেমন কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। অতীতে ফারাক্কা বাঁধ দ্বারা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি না হওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল ভারত। ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও শুরু হবে মরুকরণ। আর সমগ্র দক্ষিণ বাংলায় লবণাক্তকরণ সমস্যা পর্যায়ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। পরে কয়েক দফা এটি নবায়নকৃত হয়; কিন্তু বর্তমানে এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি নেই। আশা করা হয়েছিল, এ সফরকালে এ বিষয়ে নতুন চুক্তি কিংবা আগের চুক্তিটি নবায়নকৃত হবে; কিন্তু সেটি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কৃত গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যে তার ন্যায্যহিস্যা পাচ্ছে না সে বিষয়টির উল্লেখ পর্যন্ত নেই যৌথ ঘোষণায়। বলা হয়েছে, তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ভবিষ্যতে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরপি) বৈঠক হবে। তিস্তা ছাড়াও ফেনী, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধবলা ও দুধকুমার নদীর পানি বণ্টন বিষয়েও উপরোক্ত বৈঠকে আলোচনার আশ্বাস ব্যক্ত হয়েছে। অভিজ্ঞজনদের মতে যৌথ ঘোষণায় তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির স্পিরিট অনুযায়ী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আরেক বিপর্যয় সম্ভবত আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কারণ, গঙ্গা চুক্তির দ্বারা ভারত বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। পরীক্ষামূলকভাবে ৪০ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত তা আর বন্ধ করেনি। চুক্তির আগে গঙ্গা নদী থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পেত সেটি চুক্তির পরে আরও কমে গেছে। তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ১৯৮৩ সালে দুই দেশ একমত হলেও আজ পর্যন্ত ভারত ওই চুক্তির ব্যাপারে তালবাহানা করে চলছে। গঙ্গা চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অমান্য করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে শক্তিশালী ভারত প্রমাণ করেছে যে, সে দুর্বল প্রতিবেশীর স্বার্থের বিষয়টি উপেক্ষা করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪৮টিতে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ভারত থেকে ৩ দশমিক ২৭৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি মূল্য হচ্ছে মাত্র ৩৫৮ মিলিয়ন ডলার। সরকারিভাবে বৈধ পথে আমদানির প্রায় দ্বিগুণ পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে অবৈধভাবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি নিঃসন্দেহে বড় বাধা। এ ঘাটতি কমানোর জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত কখনও সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধ শতাধিক পণ্যের নেগেটিভ লিস্ট রয়েছে ভারতের হাতে। এ তালিকার পণ্যগুলোকে ভারতে ঢুকতে দেয়া হয় না। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ট্যারিফ-নন ট্যারিফ বাধা। বাংলাদেশ নেগেটিভ লিস্ট থেকে ৪৭টি পণ্য বাদ দেয়ার অনুরোধ জানালেও যৌথ ইশতেহারে তার কোনো উল্লেখ নেই। এতে কেবল বলা হয়েছে, আরও কিছু বাংলাদেশী পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে ভারত। এছাড়াও ভারত তার স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের মান সার্টিফিকেটের অজুহাতে বাংলাদেশী পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশে বাধা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশী পণ্যের একটি স্বাভাবিক বাজার ছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারত সুবিধা পেলে এ স্বাভাবিক বাজারও বাংলাদেশ হারাবে। এছাড়া স্থল করিডোর দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এ সাত রাজ্যে পণ্য চলাচল করতে পারবে সহজে-অনায়াসে। বাংলাদেশী জিনিসের কোনো চাহিদাই তখন থাকবে না এই সাত রাজ্যে।
যৌথ ইশতেহারে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তির আলোকে সমন্বিত সীমান্ত সমস্যা নিরসনে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতের কাছে বেরুবাড়ি হস্তান্তর করলেও বিনিময়ে ভারত তিন বিঘা করিডোর বলে পরিচিত মাত্র ০৩ বিঘা জায়গা বাংলাদেশকে এখনও হস্তান্তর করেনি। এর ফলে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের বাসিন্দারা এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখন আবার বাংলাদেশ ভারতের নাগরিকদের ব্যবহারের জন্য তিন বিঘা করিডোরে ফ্লাইওভার নির্মাণে সম্মতি জানিয়েছে। স্থল সীমান্তের মতো সমুদ্রসীমা নিয়েও ভারত টালবাহানা করে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশকে বাধা দিচ্ছে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ) বাহিনী প্রতিদিন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলি করে মারছে। গত এক বছরে কমপক্ষে ৯৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করলেও যৌথ ইশতেহারে বিষয়টির জরুরি কোনো উপস্থিতি নেই। কেবল বলা হয়েছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীরা সংযত আচরণ করবে।
উপর্যুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে ভারতের বিশাল প্রাপ্তির বিনিময়ে মূলত বাংলাদেশ কিছুই পায়নি বললে অত্যুক্তি হবে না। যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী ভারতের করিডোর রূপি ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। এ টাকা ব্যবহার করা হবে ট্রানজিট সুবিধা সহজলভ্যকরণকল্পে সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে। এছাড়া যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশের বিদ্যুত্ ঘাটতি মেটাতে আন্তঃগ্রিড সংযোগ লাইন বসানো সাপেক্ষে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ভারত সরবরাহ করবে বলে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ঘাটতি পূরণে এ সহায়তা যে নিতান্ত নগণ্য, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া দ্রুত এ বিদ্যুত্ পাওয়াও যাবে না। ভারত আশুগঞ্জ দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে ত্রিপুরায় যে বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে সেখান থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুত্ বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে। সঞ্চালন লাইন স্থাপন করে এ বিদ্যুত্ কেনা হবে বহু সময়ের ব্যাপার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকে যখন ১০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল রিজার্ভ পড়ে আছে তখন এক বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ ও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ প্রাপ্তির বিনিময়ে এ অসম যৌথ ঘোষণায় যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এছাড়া ভারতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের রেকর্ডও খুব ভালো নয়। সিডর আক্রান্ত একটি গ্রাম নতুন করে গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ভারত এখনও বাস্তবায়িত করেনি। তখন চালের সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশকে সুলভমূল্যে ৫ লাখ টন চাল বিক্রি করার কথাও দিয়েছিল ভারত। পরে স্থানীয় বাজার থেকে অনেক বেশি মূল্যে বাংলাদেশ ভারত থেকে চাল কিনতে বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহারের আরও একটি চোখে পড়ার মতো দুর্বল দিক হচ্ছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ নিরাপত্তা প�
No comments