সচিবালয়ে বিস্ফোরণ

দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র সচিবালয়ের ভেতরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে গতকাল রবিবার পর পর দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ওই সময় মন্ত্রণালয়েই অবস্থান করছিলেন।


বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের হরতাল চলাকালে কড়া পুলিশ পাহারার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ অবশ্য ককটেল নিক্ষেপকারীদের ধরতে পারেনি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ হামলার জন্য হরতাল আহ্বানকারীদের দায়ী করেছেন। সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা অনুসন্ধানে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মিলি বিশ্বাসের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অপর সদস্য হলেন পুলিশের রমনা জোনের এডিসি মাহতাব উদ্দিন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সচিবালয়ে দুই নম্বর গেটের অদূরে আট নম্বর ভবনের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবন) সামনে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি এবং সচিবালয়ের দক্ষিণ সীমানা দেয়ালে আরেক ককটেল বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণস্থলের কয়েক গজ দূরে নির্দিষ্ট গ্যারেজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র সচিবের গাড়ি রাখা ছিল। প্রায় এক গজ দূরত্বে রাখা ছিল আনসার ভিডিপির জলপাই রঙের একটি জিপ। বিস্ফোরণে এই গাড়ির পেছন দিকের একটি গ্লাস ফেটে যায়।
জানা যায়, সচিবালয়ের ঠিক সামনে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন। গতকাল সকালে সেখানে কৃষি পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠান শেষে দুপুর ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে যান। প্রায় একঘণ্টা অবস্থানের পর সচিবালয় থেকে বের হন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে সচিবালয় ও আশপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ছিল। নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই এই বিস্ফোরণ ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের কাছ থেকে জানা যায়, বিকেল পৌনে ৪টার দিকে সচিবালয়ের পাশের আবদুল গণি রোড দিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে দুই যুবক ভেতরে দুটি ককটেল নিক্ষেপ করে। এর একটি গিয়ে পড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গ্যারেজের পাশে। অন্যটি সীমানা দেয়ালে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর গাড়িচালক শংকর বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সকাল ১০টায় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়কে নামিয়ে গাড়িটি গ্যারেজেই রাখি। তখন সেখানে সচিব স্যারের গাড়িও ছিল। বিস্ফোরণের ঘটনার সময় আমি আমতলায় চাবিঘরে ছিলাম। শব্দ শুনে দৌড়ে আসি। দেখি গাড়ির সামনে ধোঁয়া উড়ছে।'
ঘটনার ২০-২৫ মিনিটের মাথায় ঘটনাস্থলে যান রমনা অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার সৈয়দ নূরুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের জানান, একটি মোটরসাইকেলে দুই যুবক এসে বোমা দুটি ছুড়ে দিয়েই দ্রুত পালিয়ে যায়। মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক জিরো পয়েন্ট দিয়ে চলে যায়। কেন ধরা সম্ভব হলো না_জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিরো পয়েন্টেও পুলিশ ছিল। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ প্রস্তুত ছিল না। পুলিশ দ্বিধায় ছিল। তিনি বলেন, 'আসামি ধরে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। তাদের ধরতে পারলেই সাফল্য আমাদের। বিভিন্ন চেকপোস্টে তথ্য পাঠানো হয়েছে। পুলিশ তাদের ধরতে চেষ্টা চালাচ্ছে।'
ঘটনার পর বিকেল সোয়া ৪টার দিকে বিস্ফোরণস্থলটি পাশে রাখা দুটি পিলার দিয়ে চিহ্নিত করে রাখেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এ ঘটনা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের কোনো বক্তব্য দেননি। এ অবস্থায় বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাঁর গাড়িতে করে অন্যত্র চলে যান। আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি আবার মন্ত্রণালয়ে ফিরে আসেন।
বিস্ফোরণের কিছু সময় পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে ছাত্র ও যুবলীগের একদল কর্মী সচিবালয়ের ফটকে আসেন। বোমা হামলাকারীদের কিছু সময় ধরে খোঁজাখুঁজিও করেন তারা।
বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে যান গোয়েন্দা পুলিশের বোমা বিশেষজ্ঞ দল। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার সানোয়ার হোসেন। তিনি ঘটনাস্থলে আলামত পর্যবেক্ষণ করে সাংবাদিকদের জানান, জর্দায় কৌটায় দুই ধরনের রাসায়নিক ছিল। কোনো ধরনের স্প্লিন্টার ছিল না। এ কারণে বেশি শব্দ হয়েছে। কেউ হতাহত হয়নি। এটি হাতে তৈরি। আর ছোঁড়া হয়েছে দক্ষ হাতে। ১০-১২ ফুট দূরত্ব থেকে এগুলো ছুঁড়ে মারা হয়েছে।
বিস্ফোরণের খবর পেয়ে সচিবালয়ে আসা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ইব্রাহিম ফাতেমী বলেন, এই বিস্ফোরণের উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্ক সৃষ্টি। ঘটনার পর সচিবালয়ের নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হচ্ছে। সচিবালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও বিস্ফোরণস্থলে আলামত পর্যবেক্ষণ করেন।
গতকাল বিস্ফোরণের শব্দে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অফিস সময় শেষের আগেই অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আতঙ্কে সচিবালয় এলাকা ত্যাগ করেন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া : বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বিএনপির প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেছেন, তারা কেন সচিবালয়ে চোরাগুপ্তা হামলা করবে? এ হামলার মধ্যে দিয়ে তারা কী করতে চায়, তা পরিষ্কার হয়েছে। চোরাগুপ্তা হামলা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালাতে বাধ্য হবে। গতকাল সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
দায়িত্ব অবহেলার কারণে কাউকে বরখাস্ত করা হয়েছে কি না_জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি ঘটনা ঘটলে তদন্ত হবে। তদন্ত হলে মামলাও হতে পারে। এরপর অন্যকিছু।
তদন্ত ছাড়াই 'এ হামলা বিরোধীদল করেছে' কিভাবে বলছেন_জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা তাদের পরিকল্পনার অংশ। হরতাল আহ্বানকারীদের এ দায়িত্ব নিতে হবে। ককটেল বিস্ফোরণের বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কি না_জানতে চাইলে টুকু বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে তা তদন্ত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। বিভাগীয় তদন্ত করা হবে। প্রয়োজনে মামলাও হবে।
নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করছেন কি না বা সচিবালয়ে নিরাপত্তার ঘাটতি আছে কি না_এ প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রশ্নই আসে না। নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। একটি ককটেল ও বোমা নিক্ষেপ করে নিরাপত্তা বিঘি্নত করার কোনো সুযোগ নেই। এটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.