স্মরণ-বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাবেন না মহেশচন্দ্র রায় by জেসমিন বুলি
কানিছাত গাড়ুছু আকাশী আকালী
আকালী ঝুমঝুম করে রে বন্ধুয়া
আকালী ঝুমঝুম করে।
আকালী ঝুমঝুম করে রে বন্ধুয়া
আকালী ঝুমঝুম করে।
আরও ফেলাছু জহুরী বথুয়া
বথুয়া হলফল করে রে বন্ধুয়া
বাতাসে ঢুলিয়া পড়ে\
আকাশ আকালী এবং বথুয়া শাকের খেতের সৌন্দর্য দেখানোর পাশাপাশি ব্যঞ্জন তৈরির এ দুই উপাদানে তৈরি খাবার বন্ধুয়াকে খেতে আসার আমন্ত্রণ জানানোর অভিনব কৌশল মুগ্ধ করেনি এমন ভাওয়াইয়া শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। উত্তরবঙ্গের কৃষিপ্রধান অঞ্চলের মানুষগুলোর প্রতিদিনের গল্প নিয়ে এমন অনেক গানের স্রষ্টা মহেশচন্দ্র রায়ের গানগুলো কানে কানে ফিরলেও অনেকের জানা নেই এই গানের স্রষ্টার কথা। আজ এই গুণী শিল্পীর ১৮তম মৃত্যুদিবস।
মহেশচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলার অধীন পুটিমারী গ্রামে। পিতা স্বর্গীয় বাবুরাম রায়। মায়ের নাম বিমলা রানী। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে বেড়ে ওঠা এবং পুরোটা জীবন এই অঞ্চলের মানুষের কাছাকাছি যাঁর বিচরণ, তাঁর গানের বিষয় ও সুর মাটির খুব কাছে না থেকে আর যাবেই বা কোথায়। ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি, মুর্শিদি, মারফতি, ভক্তিমূলক তাঁর লিখিত সব ধারার গানেই পল্লবিত হয়েছে এ অঞ্চলের ভাষা ও সুরের মাধুরিমায়। যান্ত্রিক যুগের নানা অনুষঙ্গ তাঁর গানের সুরে-বাণীতে কখনো কখনো উপাদান আকারে এলেও প্রধান থেকেছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। আর তার চেয়েও বড় কথা, ভাওয়াইয়া মূলত নারী বিরহের গান— প্রচলিত এই ধারণাকে অতিক্রম করে তাঁর গানের চরিত্ররা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও তাদের প্রতিদিনের মনোজগৎ। গ্রামীণ জীবনে পারিবারিক নানা জটিলতা, আনন্দ-দুঃখের ঘটনার উপলব্ধি তাঁর গানে হয়ে উঠেছে এক একটি গল্প। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন—নদীভাঙন, ঝড় কিংবা ফসল বোনা-কাটা এমনকি জাতীয় চেতনামূলক বিষয়; যেমন—নতুন বছর, স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন প্রভৃতিও তাঁর গানের বিষয় হিসেবে এসেছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। যুদ্ধের সময়টি ছিল যেন আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। মহেশচন্দ্র রায়ও সেই আনন্দ-বেদনায় শরিক হয়েছেন। গানের বাণীতে অমর করেছেন একাত্তরকে। লোকজ সুর আর কথার মাধ্যমে এঁকেছেন মুক্তিযুদ্ধের জয়গাথা। একাত্তরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর রচিত তিনটি গান ‘চির জাগ্রত বাঙালি নিদ্রিত নয়’, ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা দোনো বাংলা ভাই’, ‘দ্যাশ হামার বাংলা রে’ সে সময় শিলিগুড়ি থেকে রক্তলাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
কোন বিষয় নিয়ে গান লেখেননি তিনি? তাঁর গানে সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রা যেমন উঠে এসেছে, তেমনই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ মানুষও উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে বিভক্ত সমাজে নর-নারীর সামাজিক সম্পর্কের সংকট কিংবা সৌন্দর্যও সুর-ছন্দে গাঁথা পড়েছে মহেশ রায়ের গানে। ‘রক্ত দিয়ে ওরা লিখে গেছে নাম’, ‘বাংলা হামার নারী পোঁতা জাগা’, ‘ও ধান আইলো রে’, ‘তিস্তা নদী রে এই কি রে তোর খেলা’, ‘আবো তুই মরিয়া গেইলে এ নাইওর মোক কায় নিগাইবে’, ‘টুলটুলি রে টুলটুলি’, ‘না দেখো তোর টেরিয়া সিতা’, ‘ওরে ফোঁক দিও না প্রাণবন্ধুয়া মাকলা বাঁশের বাঁশিতে’ কিংবা ‘বিয়াও বিয়াও করিস না মন’—এই গানগুলো উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রাণের গান হওয়া সত্ত্বেও দুই-তিন দশক ধরে অনুপস্থিত ছিল। মহেশচন্দ্র রায়ের শরীরী অনুপস্থিতিতে এগুলোর কোনো রেকর্ড বাজারে নেই। শিল্পীর মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপিও ছিল অজ্ঞাত। মানুষের মুখে মুখে যতটা ছিল, প্রচারমাধ্যমে তা-ও ছিল না। আশার কথা যে এ গানগুলো এখন আর দুষ্প্রাপ্য নয়। বাংলা একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমী প্রকাশ করেছে গানের সংকলন ও জীবনী এবং ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার আর্কাইভসে সংরক্ষিত হচ্ছে তাঁর গানের সুর, গাইছেন অনেক তরুণ শিল্পীও। তাই আর হারানোর আশঙ্কা নয়, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে মহেশ রায়ের গানের চর্চা—এমন আশার বাণী আজ দূরবর্তী কোনো বিষয় নয়। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার আর্কাইভসে মহেশচন্দ্র রায়ের ১০০ গান বাণীবদ্ধ ও প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ মহেশচন্দ্র রায়ের ১৮তম মৃত্যুদিবস পালন করছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। গুণী এই শিল্পীর জন্মদিনে তাঁর রচিত ভাওয়াইয়া গান নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে দেশ টিভি। হয়তো আগামী দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাবে মহেশচন্দ্র রায়ের গানের চর্চা ও প্রচার। মৃত্যুদিবসে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বথুয়া হলফল করে রে বন্ধুয়া
বাতাসে ঢুলিয়া পড়ে\
আকাশ আকালী এবং বথুয়া শাকের খেতের সৌন্দর্য দেখানোর পাশাপাশি ব্যঞ্জন তৈরির এ দুই উপাদানে তৈরি খাবার বন্ধুয়াকে খেতে আসার আমন্ত্রণ জানানোর অভিনব কৌশল মুগ্ধ করেনি এমন ভাওয়াইয়া শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। উত্তরবঙ্গের কৃষিপ্রধান অঞ্চলের মানুষগুলোর প্রতিদিনের গল্প নিয়ে এমন অনেক গানের স্রষ্টা মহেশচন্দ্র রায়ের গানগুলো কানে কানে ফিরলেও অনেকের জানা নেই এই গানের স্রষ্টার কথা। আজ এই গুণী শিল্পীর ১৮তম মৃত্যুদিবস।
মহেশচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলার অধীন পুটিমারী গ্রামে। পিতা স্বর্গীয় বাবুরাম রায়। মায়ের নাম বিমলা রানী। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে বেড়ে ওঠা এবং পুরোটা জীবন এই অঞ্চলের মানুষের কাছাকাছি যাঁর বিচরণ, তাঁর গানের বিষয় ও সুর মাটির খুব কাছে না থেকে আর যাবেই বা কোথায়। ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি, মুর্শিদি, মারফতি, ভক্তিমূলক তাঁর লিখিত সব ধারার গানেই পল্লবিত হয়েছে এ অঞ্চলের ভাষা ও সুরের মাধুরিমায়। যান্ত্রিক যুগের নানা অনুষঙ্গ তাঁর গানের সুরে-বাণীতে কখনো কখনো উপাদান আকারে এলেও প্রধান থেকেছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ। আর তার চেয়েও বড় কথা, ভাওয়াইয়া মূলত নারী বিরহের গান— প্রচলিত এই ধারণাকে অতিক্রম করে তাঁর গানের চরিত্ররা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও তাদের প্রতিদিনের মনোজগৎ। গ্রামীণ জীবনে পারিবারিক নানা জটিলতা, আনন্দ-দুঃখের ঘটনার উপলব্ধি তাঁর গানে হয়ে উঠেছে এক একটি গল্প। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন—নদীভাঙন, ঝড় কিংবা ফসল বোনা-কাটা এমনকি জাতীয় চেতনামূলক বিষয়; যেমন—নতুন বছর, স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন প্রভৃতিও তাঁর গানের বিষয় হিসেবে এসেছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। যুদ্ধের সময়টি ছিল যেন আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। মহেশচন্দ্র রায়ও সেই আনন্দ-বেদনায় শরিক হয়েছেন। গানের বাণীতে অমর করেছেন একাত্তরকে। লোকজ সুর আর কথার মাধ্যমে এঁকেছেন মুক্তিযুদ্ধের জয়গাথা। একাত্তরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর রচিত তিনটি গান ‘চির জাগ্রত বাঙালি নিদ্রিত নয়’, ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা দোনো বাংলা ভাই’, ‘দ্যাশ হামার বাংলা রে’ সে সময় শিলিগুড়ি থেকে রক্তলাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
কোন বিষয় নিয়ে গান লেখেননি তিনি? তাঁর গানে সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রা যেমন উঠে এসেছে, তেমনই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ মানুষও উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে বিভক্ত সমাজে নর-নারীর সামাজিক সম্পর্কের সংকট কিংবা সৌন্দর্যও সুর-ছন্দে গাঁথা পড়েছে মহেশ রায়ের গানে। ‘রক্ত দিয়ে ওরা লিখে গেছে নাম’, ‘বাংলা হামার নারী পোঁতা জাগা’, ‘ও ধান আইলো রে’, ‘তিস্তা নদী রে এই কি রে তোর খেলা’, ‘আবো তুই মরিয়া গেইলে এ নাইওর মোক কায় নিগাইবে’, ‘টুলটুলি রে টুলটুলি’, ‘না দেখো তোর টেরিয়া সিতা’, ‘ওরে ফোঁক দিও না প্রাণবন্ধুয়া মাকলা বাঁশের বাঁশিতে’ কিংবা ‘বিয়াও বিয়াও করিস না মন’—এই গানগুলো উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রাণের গান হওয়া সত্ত্বেও দুই-তিন দশক ধরে অনুপস্থিত ছিল। মহেশচন্দ্র রায়ের শরীরী অনুপস্থিতিতে এগুলোর কোনো রেকর্ড বাজারে নেই। শিল্পীর মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপিও ছিল অজ্ঞাত। মানুষের মুখে মুখে যতটা ছিল, প্রচারমাধ্যমে তা-ও ছিল না। আশার কথা যে এ গানগুলো এখন আর দুষ্প্রাপ্য নয়। বাংলা একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমী প্রকাশ করেছে গানের সংকলন ও জীবনী এবং ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার আর্কাইভসে সংরক্ষিত হচ্ছে তাঁর গানের সুর, গাইছেন অনেক তরুণ শিল্পীও। তাই আর হারানোর আশঙ্কা নয়, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে মহেশ রায়ের গানের চর্চা—এমন আশার বাণী আজ দূরবর্তী কোনো বিষয় নয়। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার আর্কাইভসে মহেশচন্দ্র রায়ের ১০০ গান বাণীবদ্ধ ও প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ মহেশচন্দ্র রায়ের ১৮তম মৃত্যুদিবস পালন করছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। গুণী এই শিল্পীর জন্মদিনে তাঁর রচিত ভাওয়াইয়া গান নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে দেশ টিভি। হয়তো আগামী দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাবে মহেশচন্দ্র রায়ের গানের চর্চা ও প্রচার। মৃত্যুদিবসে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
No comments