দাহকালের কথা-সূচক by মাহমুদুজ্জামান বাবু
দৃশ্যগুলো অস্বাভাবিক। কয়েক দিন ধরে দেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত শেয়ারবাজারের সূচক ওঠানামার জুয়াখেলার নানা রঙের কাণ্ডকীর্তি দেখতে দেখতে আমাদের চোখ সেসব সয়েও নিল সম্ভবত নিজে নিজেই। নিয়মও তাই; প্রথম প্রথম খারাপ লাগবে। অস্বস্তি হবে।
তারপর একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি যদি চলতেই থাকে, হোক তা ভুল বা অন্যায়, আমাদের মস্তিষ্ক একসময় জেনে যাবে, মেনে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কোন মস্তিষ্ক? কম জানা বা ভুল জানা মস্তিষ্ক। এটা বিজ্ঞানসিদ্ধ মতামত। চারপাশ এ রকম অনেক উদাহরণে সয়লাব হয়ে আছে। দীর্ঘদিন যদি কোনো ভুল বা মিথ্যা বা অনাচার সাবলীল চলতে থাকে, নিরুপায় বোধ তখন শেখায়—যা চলছে, তা-ই স্বাভাবিক। আর সর্বনাশ তখনই ষোলোকলা পূর্ণ করে দেঁতো হাসি হাসে। শেয়ারবাজারের বড় জুয়াড়িরা ছোটদের সর্বনাশের বত্রিশকলা পূর্ণ করে বগল বাজিয়ে নাচছেন। ২০ জানুয়ারি সূচক নেমেছে ৬০০ পয়েন্ট। সময় লেগেছে পাঁচ মিনিট। এরই মধ্যে সব হারানো বিক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মিছিল মতিঝিল থেকে চলে গেছে সিলেটে, অর্থমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করতে। এটাকেই সম্ভবত বিদ্যুৎগতি বলে! সূচক সম্পর্কে, ওঠানামা সম্পর্কে, ২৩৭ কিংবা ৬০০ পয়েন্ট সম্পর্কে আমার কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। আমি কেবল সেসব মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি, যাঁরা বলছেন—এটা স্বাভাবিক এবং যাঁরা হিংস্র উন্মত্ততায় রাজপথে অন্যের জানমালের ওপর হামলা করছেন।
কোনটা স্বাভাবিক? তিন দিন আগে একাধিক দৈনিকে ছাপানো একটি আলোকচিত্র? বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের হাতে আক্রান্ত একটি ব্যক্তিগত গাড়ি, চালকের আসনে বসে থাকা একজন সিটবেল্ট বাঁধা নারী, একটি হাত গাড়ির দরজা বাইরে থেকে খুলে ফেলেছে, আর একটি হাত সেই চালককে টেনেহিঁচড়ে নামাতে চাইছে গাড়ি থেকে। আতঙ্কিত, বিপন্ন, অসম্মানিত নারীর এই ছবিটি স্বাভাবিক? নাকি ওই ছবিটা? একজন বিনিয়োগকারীকে ছয় জোড়া পা বিরতিহীন লাথি মারতে মারতে রাস্তায় শুইয়ে ফেলেছে? কুণ্ডলী পাকানো শরীরের রক্তাক্ত মুখের ছবিটা স্বাভাবিক? নাকি শেয়ারবাজারের জুয়াখেলায় লোভ ও লাভের নির্লজ্জ ঢেউয়ের দোলা? কোনটা?
জানি না। জানতেও চাই না আমরা। প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে না। তাই প্রশ্ন করি না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা এখন নয় শুধু, বহুকাল ধরেই তো শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতা, জনস্বার্থ উপেক্ষা, নিজেদের গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়ানোর যন্ত্র মাত্র। জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, আইনের শাসন—এসব শব্দ, বাক্য ও কথা শুধু সংবিধানের পাতায় পাতায় লেখা। আমজনতা সেসব চড়া স্বরে শুনতে পায় শুধু পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সময়, নির্বাচনী ইশতেহার ও বক্তৃতার মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে। তারপর আবার একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর তাই তো মস্তিষ্ক মেনে নেয় সব অনাচার—যে, প্রশ্ন না করাটাই স্বাভাবিক। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের একটি ছবির নাম হীরক রাজার দেশে। তো হীরকের রাজা স্বাভাবিকভাবেই অত্যাচারী। প্রজারা যেন এসব নিয়ে প্রতিবাদ না করে, রাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আঙুল না তোলে—এ জন্য রাজা রাজবিজ্ঞানীকে (রাজার অনুগত বিজ্ঞানী) দিয়ে একটা যন্ত্র বানাল। যন্ত্রটার কাজ হলো মগজ ধোলাই করা। যে প্রশ্ন করে, তাকে প্রশ্নহীন করো। যে প্রতিবাদ করে, তাকে প্রতিবাদহীন করো। একটা সংলাপ মনে পড়ছে; ছাত্রদের মগজ ধোলাই করার পর ছাত্ররা সমস্বরে বলতে থাকে, ‘জানার কোনো শেষ নাই/ জানার চেষ্টা বৃথা তাই...।’
একুশ শতকের মগজ ধোলাই যন্ত্রগুলো অত্যাধুনিক। জোর করে সেখানে কাউকে ঠেলে দিতে হয় না। পৃথিবীজুড়েই এখন ব্যক্তিবাদের জয়জয়কার। ব্যক্তির লাভ, ব্যক্তির স্বার্থ, ব্যক্তির ইচ্ছা, ব্যক্তির সুবিধা—এই হচ্ছে আমাদের ছুটে চলার মূল প্রণোদনা। যদিও মানুষ সামাজিক জীব, সন্দেহ নেই যে সে সমাজবদ্ধ হয়েই বাঁচে। অন্যের সহযোগিতায় বাঁচে, একের শ্রমে অন্যের মঙ্গলধ্বনি শোনা যায়। মানবজাতির নানা কালপর্বে যে যুগপুরুষেরা মানবতা ও মনুষ্যত্বের ঝান্ডা তুলেছিলেন, তাঁদেরও বাণী ছিল তাই। মনে পড়ে, ভাবসম্প্রসারণ শিখতে হয়েছিল আমাদের মাধ্যমিক স্কুলে, ‘আপনারে ল’য়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে...!’ বিশ্ববিজ্ঞানের কিংবদন্তি, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন...‘আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা অপরে তৈরি করে, যে বস্ত্র পরিধান করি তাও অপরের প্রস্তুত, যে গৃহে বাস করি অপরেই তা নির্মাণ করে। অপরের দ্বারা জ্ঞান ও উপলব্ধির প্রায় সমস্ত অংশের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে ভাষার মধ্য দিয়ে—সে ভাষা অপরেই সৃষ্টি করেছে।’...এই বোধগুলো আমাদের মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কে দায়ী?
১৯৯৯ সালে আমেরিকার বেসরকারি টিভি এবিসি শুরু করেছিল ‘হু ওয়ান্টস টু বি এ মিলিয়নিয়ার’ অনুষ্ঠানটি। তারই আদলে ভারতের স্টার প্লাস টিভি ২০০০ সালে করেছে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’। ব্রিটিশ টেলিভিশন শো ‘পপ আইডল’-এর অনুকরণে ফক্স নেটওয়ার্ক আমেরিকায় ২০০২ সালে শুরু করে আমেরিকান আইডল। ভারতে সেটা নাম বদলে সনি টিভি শুরু করে ২০০৪ সালে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’ নামে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে এনটিভি শুরু করেছিল ‘ক্লোজআপ ওয়ান: তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ নামে। এ বছর বাংলাদেশে ‘কে হবে কোটিপতি’ অনুষ্ঠানের সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম নাচিয়ে গেল বলিউডের শাহরুখ খান ও তাঁর দল। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ১৬ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি বলিউডের বাণিজ্যিক শিল্পীদের নিয়ে ‘বিগ শো’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খোদ বিসিবি। স্থূল রুচি, দেহসর্বস্ব নৃত্য আর ভিনদেশি ভাষার সংগীত নামের বেলেল্লাপনার এই আয়োজন কি সরকারের বিনা অনুমোদনে হচ্ছে? সরকার তাহলে কাদের? ব্যবসায়ীদের? নাকি বাংলাদেশের? কে না জানে, ব্যবসায়ীদের কোনো স্বদেশ নেই! শুধু লাভ! শুধু মুনাফা! মনুষ্যত্ব? ফুঁ...! সূচকটা প্রতিদিন নিচের দিকে নামছে। চক্ষুষ্মান কেউ নেই?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
কোনটা স্বাভাবিক? তিন দিন আগে একাধিক দৈনিকে ছাপানো একটি আলোকচিত্র? বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের হাতে আক্রান্ত একটি ব্যক্তিগত গাড়ি, চালকের আসনে বসে থাকা একজন সিটবেল্ট বাঁধা নারী, একটি হাত গাড়ির দরজা বাইরে থেকে খুলে ফেলেছে, আর একটি হাত সেই চালককে টেনেহিঁচড়ে নামাতে চাইছে গাড়ি থেকে। আতঙ্কিত, বিপন্ন, অসম্মানিত নারীর এই ছবিটি স্বাভাবিক? নাকি ওই ছবিটা? একজন বিনিয়োগকারীকে ছয় জোড়া পা বিরতিহীন লাথি মারতে মারতে রাস্তায় শুইয়ে ফেলেছে? কুণ্ডলী পাকানো শরীরের রক্তাক্ত মুখের ছবিটা স্বাভাবিক? নাকি শেয়ারবাজারের জুয়াখেলায় লোভ ও লাভের নির্লজ্জ ঢেউয়ের দোলা? কোনটা?
জানি না। জানতেও চাই না আমরা। প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে না। তাই প্রশ্ন করি না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা এখন নয় শুধু, বহুকাল ধরেই তো শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতা, জনস্বার্থ উপেক্ষা, নিজেদের গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়ানোর যন্ত্র মাত্র। জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, আইনের শাসন—এসব শব্দ, বাক্য ও কথা শুধু সংবিধানের পাতায় পাতায় লেখা। আমজনতা সেসব চড়া স্বরে শুনতে পায় শুধু পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সময়, নির্বাচনী ইশতেহার ও বক্তৃতার মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে। তারপর আবার একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর তাই তো মস্তিষ্ক মেনে নেয় সব অনাচার—যে, প্রশ্ন না করাটাই স্বাভাবিক। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের একটি ছবির নাম হীরক রাজার দেশে। তো হীরকের রাজা স্বাভাবিকভাবেই অত্যাচারী। প্রজারা যেন এসব নিয়ে প্রতিবাদ না করে, রাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আঙুল না তোলে—এ জন্য রাজা রাজবিজ্ঞানীকে (রাজার অনুগত বিজ্ঞানী) দিয়ে একটা যন্ত্র বানাল। যন্ত্রটার কাজ হলো মগজ ধোলাই করা। যে প্রশ্ন করে, তাকে প্রশ্নহীন করো। যে প্রতিবাদ করে, তাকে প্রতিবাদহীন করো। একটা সংলাপ মনে পড়ছে; ছাত্রদের মগজ ধোলাই করার পর ছাত্ররা সমস্বরে বলতে থাকে, ‘জানার কোনো শেষ নাই/ জানার চেষ্টা বৃথা তাই...।’
একুশ শতকের মগজ ধোলাই যন্ত্রগুলো অত্যাধুনিক। জোর করে সেখানে কাউকে ঠেলে দিতে হয় না। পৃথিবীজুড়েই এখন ব্যক্তিবাদের জয়জয়কার। ব্যক্তির লাভ, ব্যক্তির স্বার্থ, ব্যক্তির ইচ্ছা, ব্যক্তির সুবিধা—এই হচ্ছে আমাদের ছুটে চলার মূল প্রণোদনা। যদিও মানুষ সামাজিক জীব, সন্দেহ নেই যে সে সমাজবদ্ধ হয়েই বাঁচে। অন্যের সহযোগিতায় বাঁচে, একের শ্রমে অন্যের মঙ্গলধ্বনি শোনা যায়। মানবজাতির নানা কালপর্বে যে যুগপুরুষেরা মানবতা ও মনুষ্যত্বের ঝান্ডা তুলেছিলেন, তাঁদেরও বাণী ছিল তাই। মনে পড়ে, ভাবসম্প্রসারণ শিখতে হয়েছিল আমাদের মাধ্যমিক স্কুলে, ‘আপনারে ল’য়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে...!’ বিশ্ববিজ্ঞানের কিংবদন্তি, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন...‘আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি তা অপরে তৈরি করে, যে বস্ত্র পরিধান করি তাও অপরের প্রস্তুত, যে গৃহে বাস করি অপরেই তা নির্মাণ করে। অপরের দ্বারা জ্ঞান ও উপলব্ধির প্রায় সমস্ত অংশের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে ভাষার মধ্য দিয়ে—সে ভাষা অপরেই সৃষ্টি করেছে।’...এই বোধগুলো আমাদের মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কে দায়ী?
১৯৯৯ সালে আমেরিকার বেসরকারি টিভি এবিসি শুরু করেছিল ‘হু ওয়ান্টস টু বি এ মিলিয়নিয়ার’ অনুষ্ঠানটি। তারই আদলে ভারতের স্টার প্লাস টিভি ২০০০ সালে করেছে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’। ব্রিটিশ টেলিভিশন শো ‘পপ আইডল’-এর অনুকরণে ফক্স নেটওয়ার্ক আমেরিকায় ২০০২ সালে শুরু করে আমেরিকান আইডল। ভারতে সেটা নাম বদলে সনি টিভি শুরু করে ২০০৪ সালে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’ নামে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে এনটিভি শুরু করেছিল ‘ক্লোজআপ ওয়ান: তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ নামে। এ বছর বাংলাদেশে ‘কে হবে কোটিপতি’ অনুষ্ঠানের সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম নাচিয়ে গেল বলিউডের শাহরুখ খান ও তাঁর দল। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ১৬ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি বলিউডের বাণিজ্যিক শিল্পীদের নিয়ে ‘বিগ শো’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খোদ বিসিবি। স্থূল রুচি, দেহসর্বস্ব নৃত্য আর ভিনদেশি ভাষার সংগীত নামের বেলেল্লাপনার এই আয়োজন কি সরকারের বিনা অনুমোদনে হচ্ছে? সরকার তাহলে কাদের? ব্যবসায়ীদের? নাকি বাংলাদেশের? কে না জানে, ব্যবসায়ীদের কোনো স্বদেশ নেই! শুধু লাভ! শুধু মুনাফা! মনুষ্যত্ব? ফুঁ...! সূচকটা প্রতিদিন নিচের দিকে নামছে। চক্ষুষ্মান কেউ নেই?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
No comments