বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৮১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম সাহসী ও সফল এক মুক্তিযোদ্ধা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। চারদিকে নিঃশব্দ ও থমথমে। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। অন্ধকারে জোনাকি পোকার আলো।

এর মধ্যে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মইনুল হোসেন চৌধুরী। তাঁর সহযোদ্ধারা সন্তর্পণে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিচ্ছেন। তিনি শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি দেখছেন। তাঁর মনের মধ্যে চলছে তোলপাড়। কয়েক মাস আগে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের যুদ্ধে নিজ চোখের সামনে শহীদ হতে দেখেছেন প্রায় ৩৫ জন সহযোদ্ধাকে।
আগেই ঠিক করা ছিল, মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজ দল ঠিক রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে গোলাবর্ষণ শুরু করবে। চারদিকের নৈঃশব্দ্য ভেঙে ঠিক সময়েই গোলাবর্ষণ শুরু হলো। গোলাবর্ষণের প্রচণ্ডতা এমন যে, অনেক দূরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে থাকল।
মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর সহযোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁর নির্দেশ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকলেন। শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হটিয়ে তিতাস নদীর পার, মুকুন্দপুর, সিংগাইর বিল আর আজমপুর মুক্ত করাই তাঁদের লক্ষ্য। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি (আনুমানিক ৪০০ মিটার দূরে) হওয়া মাত্র পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে বন্ধ হয়ে গেল তাঁদের দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণ। এরপর শুরু হলো দুই পক্ষের মেশিনগান ও রাইফেলের অবিরাম গোলাগুলি।
এ রকম যুদ্ধে রক্তপাত, মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। মইনুল হোসেন চৌধুরীর মনে নানা অনুভূতি। অবচেতন মনে মৃত্যুচিন্তা যোদ্ধাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তিনি যুদ্ধের অধিনায়ক। তাঁকে সব ভয় লুকিয়ে রাখতে হবে। ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে হবে। কারণ, তাঁকে দেখেই উদ্দীপ্ত হবেন তাঁর সহযোদ্ধারা।
মইনুল হোসেন চৌধুরী যুদ্ধের ময়দানে তা-ই করতে থাকলেন। কুয়াশায় ঢাকা সেই রাতে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল প্রকৃতপক্ষেই কঠিন। ভোর না হতেই শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের তুমুল পাল্টা আক্রমণ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধরত তাদের প্রসিদ্ধ পাঠান রেজিমেন্ট-১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। দুর্ধর্ষ প্রকৃতির তারা। এর সঙ্গে তাদের ভারী কামানের গোলাবর্ষণ। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর দুটি স্যাবর জেটও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে গোলা ফেলতে থাকল। সব মিলে প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ।
মইনুল হোসেন চৌধুরী এতে বিচলিত হলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে তিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে থাকলেন। সারা দিন যুদ্ধ চলল। একের পর এক পাল্টা আক্রমণ চালিয়েও পাকিস্তানিরা সফল হতে পারল না। মইনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে থাকলেন। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে গেল। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১-৩ ডিসেম্বর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ায়।
মইনুল হোসেন চৌধুরী চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই রেজিমেন্টের তখন অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা। সে দিন বাঙালীদের ওপর গুলি চালাতে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্দেশ সরাসরি অমান্য করেন তিনি। ২৫ মার্চের পর এই জয়দেবপুর থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাঙালী সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। কামালপুরসহ আরও কয়েক স্থানে তিনি যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মইনুল হোসেন চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪।
মইনুল হোসেন চৌধুরী মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত থাকাকালে প্রেষণে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। ২০১০ সালে তিনি মারা যান।
মইনুল হোসেন চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার শিওরখাল গ্রামে। তবে বাস করতেন ঢাকায় (বাকলি হাউস, সড়ক ১১৬, গুলশান ১)। তাঁর বাবার নাম নূরুল হোসেন চৌধুরী, মা রিজিয়া খাতুন চৌধুরী। স্ত্রী রুবী চৌধুরী। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীর বিক্রম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com