মেহেরজান-মুক্তিযুদ্ধ ও নারীর প্রতি অবমাননার ছবি

খোলা মন নিয়েই আমরা মেহেরজান ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। দাবি করা হয়েছিল, একাত্তরের পটভূমিতে নির্মিত এটি একটি যুদ্ধ ও ভালোবাসার ছবি। কিন্তু আমরা নিদারুণ আশাহত হয়েছি। আশাহত হয়েছি এ কারণে নয় যে, ছবিটি দুর্বল, চরিত্রগুলো আপনশক্তিতে দাঁড়াতে পারছে না,


কিংবা হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাব আছে এর রং ও পোশাকে—এসব কোনোটিই আশাভঙ্গের কারণ নয়। আমরা বরং আহত হয়েছি, বলা যায় অপমানিত হয়েছি, কাহিনি আর ক্যামেরায় মেহেরজান এমন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে, যা আমাদের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ আর চেতনার সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা করেছে। যুদ্ধ ও ভালোবাসার ছবির বাতাবরণে আসলে এ এক প্রতারণা আর অপমানের ছবি। প্রতারণা পুরো জাতির সঙ্গে—যাঁরা অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা আর প্রগতিশীল মানসকাঠামোয় আস্থা রাখেন, তাঁদের সঙ্গে, আর অপমান সব নারী আর পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাকে।
পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল, এ ছিল এক সর্বসংহারী যুদ্ধ; তারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ধর্ষণ করেছে, লুণ্ঠন আর অগ্নিসংযোগ করেছে, একের পর এক গ্রাম-বন্দর-নগরে ধ্বংসের তাণ্ডব চালিয়েছে। উল্লেখ্য, বেলুচ রেজিমেন্টের প্রথম আক্রমণেই ২৫ মার্চ রাতে পিলখানায় প্রায় ৮০০ বাঙালি খুন হয়। কিন্তু মেহেরজান চলচ্চিত্র এর বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান শোনায়, যেখানে পাকসেনাদের একজন নিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, দল ত্যাগ করে, বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করাকে অন্যায় মনে করে। পাঠক, ধৈর্যহারা হবেন না, মেহেরজান ছবির পাকি ফোক ফ্যান্টাসি এখানেই শেষ নয়, সেই পাকসেনা ধর্ষণের হাত থেকে বাঙালি এক নারীকে বাঁচায় বলে দাবি করে এবং শেষে বাঙালি ওই নারী সেবা-শুশ্রূষা করে পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে প্রেমে মজে তার ঋণ শোধ করে। মনে রাখা দরকার, ছবির সময় কিন্তু একাত্তর, সারা দেশে চলছে ভয়ংকর যুদ্ধ। দেখানো হয় এক বাঙালি মেয়ে, ছবিতে যার নাম মেহেরজান, তার খালাতো বোন পাকসেনাদের দলধর্ষণের শিকার হয়ে কদিন আগেই বাড়ি ফেরে এবং একই বাড়িতে থেকেই মেহেরজান তার প্রেম চালিয়ে যায় ওই পাকসেনার সঙ্গে!
পরিচালক দাবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করার আগে তিনি মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। ঠিক যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস অনেক বড়, কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন রাখতে চাই, গবেষণা আর ইতিহাসের কোথায় এমন উপাদান রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে যুদ্ধরত পাকিস্তানি কোনো সেনাসদস্য নিজ দল ত্যাগ করে বাঙালিদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছে? বাঙালি কোনো নারীকে ধর্ষণ না করে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচিয়েছে? কিংবা যুদ্ধের ওই সময়ে এর প্রমাণ কোথায়, যেখানে একজন বাঙালি নারী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খুন হওয়া তার ভাইয়ের রক্ত আর ধর্ষিতা বোনের পাঁজরের ওপর দাঁড়িয়ে পাকসেনার সঙ্গেই নির্লজ্জ প্রেমে মেতেছে? কোথায় এর দলিলদস্তাবেজ? ছবির পরিচালক ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ ধর্ষিত নারীকে অপমানের কী মোক্ষম অস্ত্রই না বেছে নিয়েছেন! মুক্তিযুদ্ধ পুরো জাতির গর্ব আর চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত—সেই মুক্তিযুদ্ধের এই অপমান।
ছবিতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার দুই লাখ নারীর কথা নাকি ক্লিশে হয়ে গেছে, এটা শুনতে শুনতে মানুষ বিরক্ত হয়ে গেছে। এর বাইরেও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের ‘অন্য ডিসকোর্স’ আছে। কী সেই নতুন ডিসকোর্স? পাকসেনার সঙ্গে বাঙালি মেয়ের জমাট প্রেমের সম্পূর্ণ রঙিন বয়ান হচ্ছে তথাকথিত এই নতুন ডিসকোর্স। পাকসেনা যে কত মহান আর উদার, সে বাঙালির কাশি পেলে পানি এগিয়ে দেয়, ধর্ষণ না করে বাঙালি মেয়েকে বাঁচায়, নিজেকে হত্যা করার ভার দেয় অন্যের হাতে, নিজ দল ত্যাগ করে, বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে অন্যায় মনে করে। হত্যা আর ধর্ষণের জন্য যে পাকসেনাদের ‘সুনাম’ পৃথিবীজোড়া, কি আফসোস, মেহেরজান না দেখলে তাদের এমন কোমল আর মহান ইমেজ জানাই যেত না! আমাদের মনে হয়েছে, এটি একটি নির্ভেজাল পাকিস্তানি প্রপাগান্ডা ছবি, যার উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধের বিচারকে দ্বিধাগ্রস্ত বা বাধাগ্রস্ত করা।
ছবিটি দেখে মুক্তিযোদ্ধা ডা. নায়লা খান আমাদের মেইল করে জানিয়েছেন, তিনি খুবই বিস্মিত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বলে দাবিদার এই সরকারের সেন্সর বোর্ড কী করে মেহেরজান ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দিল! পরিচালক নিজে নারী হয়েও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ছবির প্রধান তিন নারীকেই নির্লজ্জভাবে ‘যৌনতার প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এদের একজন নীলা, ছবির ভাষায় ‘খানেলাগা’, যে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক দলধর্ষণের শিকার হয়েছে, ছবিতে বিশেষ কিছু ‘কোড’ তৈরি করে সেই বীরাঙ্গনাকে দেখানো হয়েছে ‘যৌনময়ী’ হিসেবে, পুরুষ দেখলে যে যৌনতাড়িত হয়ে পড়ে। নীলার মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে, সে ছাত্র ইউনিয়ন করত এবং পাকসেনা দ্বারা যেটা হয়েছে, সেটাই তার ধর্ষণের প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। এর মানে কী? এর মধ্য দিয়ে কি এই ইঙ্গিতই দেওয়া হচ্ছে না যে, পাকসেনাদের ধর্ষণ অত ভয়ংকর নয়, ছাত্র ইউনিয়নের কেউই তাকে প্রথম ধর্ষণ করেছিল, ‘ধর্ষণই নারীর নিয়তি’? পাকিস্তানিদের ধর্ষণকে তাই হালকা করে দেখতে হবে। বাহ! ধর্ষণের পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যার এ এক দারুণ নমুনা! দ্বিতীয় নারী সালমা, সারাক্ষণ সে তার বাবাকে বলছে, যেন তাকে বিয়ে দেওয়া হয় এবং সে বিয়েটি হবে ‘মুতা’ বিয়ে। পরিচালক কি জানেন মুতা বিয়ের ধারণা কোত্থেকে এসেছে?
আর সবচেয়ে ভয়ংকর উপস্থাপন, তৃতীয় নারী মেহেরজানের, যাকে সবচেয়ে আকর্ষণীয়, যৌক্তিক আর বুদ্ধিদীপ্ত করে দেখানো হয়েছে, কিন্তু ছবিতে তার করুণ পরিণতি হয়েছে পাকসেনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে; ‘আহতের সেবা, সেবা থেকে প্রেম’ গৎবাঁধা এই পিতৃতান্ত্রিক ছক থেকে নির্মাতারা বেরোতে পারেননি; এবং পাকসেনার প্রেম এতই গভীর যে, সেই প্রেমের নেশা মেহেরজান এক জীবনে কাটাতে পারেনি, তাই সারা জীবন অবিবাহিত থেকেছে। এর অনুবাদ কী? সর্বোচ্চ যুক্তিশীলতার মাপকাঠিতেই সর্বাত্মক যুদ্ধের সময়ে, বোনের ধর্ষিত হওয়ার পরিণতি প্রত্যক্ষ করেও পাকসেনার সঙ্গে প্রেম করা যৌক্তিক! দুই লাখ নারীর ধর্ষণের ঘটনা, ৩০ লাখ মানুষের হত্যাযজ্ঞ—কোনো পরিসংখ্যানই তাকে পাকসেনা ওয়াসিম খানের প্রেম থেকে মন সরাতে দেয় না, এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও। আর কী ভয়ংকর যে, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানের মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে, ওই প্রেমের জন্য অপরাধবোধে ভোগার কোনো কারণ নেই। এত দিন পাকসেনাদের হত্যা আর ধর্ষণের পুরোনো কথা আমরা জানতাম। এবার জানানো হলো, তারা কত মহান, তাদের প্রেম কত গভীর! কী মহান মানবিকতা! জয়তু মেহেরজান ও তার পরিচালক!
ছবিজুড়ে আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, মুক্তিযোদ্ধারা সামন্ত প্রভু খাজা সাহেবের সঙ্গে দেনদরবার করছে, তারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যাবেন কি না, তা নিয়ে এবং খাজা সাহেব তার গ্রামে কোনো ‘গণ্ডগোল’ হতে দেবে না বলে তাদের নিবৃত্ত করছে। মুক্তিযুদ্ধকে কারা ‘গণ্ডগোল’, ‘হট্টগোল’ বা ‘নিছক রক্তপাত’ হিসেবে দেখে, পাঠক, আপনারা তা জানেন। এই যদি হতো অবস্থা, তাহলে বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন হতো না। মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানের জাতিগত শোষণ, সামরিক শাসন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, এটা ছিল পাকিস্তানি সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধেও এক সর্বাত্মক যুদ্ধ।
বীরাঙ্গনা নিয়ে যখন আমরা কোনো ভালো ছবি করতে পারিনি, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যখন সফল কোনো ছবি করতে পারিনি, তখন পাকিস্তানি-বাঙালির এহেন প্রেমজ ছবি আমরা বানিয়ে ফেললাম, যার কোনো বিন্দুমাত্র ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আসলে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ বেদনা আর গভীর কষ্ট বোঝার সামর্থ্যই এ ছবির কলাকুশলীদের নেই। হত্যা আর ধর্ষণের জন্য পাকিস্তানিদের যখন ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলা হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে যা করেনি, ঠিক তখন বাঙালি নারী-পাকসেনার প্রেমের ‘উপরিচালাকি’র এই নির্জলা ইতিহাস বিকৃতির অর্থ আসলে অনেক গভীরে। এটি কেবল মেহেরজান চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত কলাকুশলী, যাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেবল তাদের দেখে বোঝা যাবে না, এর শেকড় অনেক ভেতরে, আরও কোনো গভীর মতাদর্শিক কূটচাল এর পেছনে রয়েছে।
প্রিয় পাঠক, তার মানে আমরা কি চাইছি ছবিটি নিষিদ্ধ করা হোক, কিংবা এর প্রদর্শনী বন্ধ করা হোক? না, মোটেও তা নয়। আমরা নিষিদ্ধের বিপক্ষে। আমরা মনে করি, চিন্তা আর সৃষ্টি প্রকাশের সব জানালা-দরজা খোলা থাকুক। এটি খোলা রাখতে হবে আলো-বাতাস আসার জন্য, সঙ্গে ধুলোবালি তো কিছু আসবেই। জাতির জন্য প্রতারণাপূর্ণ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননাকর এই ছবিটি না হয় ধুলোবালি হিসেবেই থাকুক। নতুন প্রজন্ম ঠিকই বুঝে নেবে প্রকৃত সত্য।
লেখকবৃন্দ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী ও একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনা

No comments

Powered by Blogger.