অনৈতিকতা-দেশে-বিদেশে প্রতারণার রকমফের by আবদুল মান্নান
বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে রাতের সংবাদে জিনের বাদশা গ্রেপ্তারবিষয়ক সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল। জিনের বাদশাবিষয়ক এমন সংবাদ নিয়মিত বিরতি দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। কিছু প্রতারক নিজেকে জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে সাধারণত ধনাঢ্য ধর্মভীরু মানুষকে নিয়মিত প্রতারণা করে।
তারা দাবি করে, টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার ইত্যাদি মূল্যবান জিনিসকে জিনের সহায়তায় দ্বিগুণ করে দিতে পারে। সন্তানহীন দম্পতিকে সন্তান দিতে পারে। গুপ্তধনের সন্ধান দেওয়ার কাজটা সবচেয়ে সহজ। আদালতে মামলা-মোকদ্দমা থাকলে তাতে জেতার ব্যবস্থা করতে পারে। কিছু সহজ-সরল মানুষ এই প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে নিয়মিত প্রতারিত হন। এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নাকি এই ধরনের ১০০ বাদশা আটক আছে। সেদিন এ সংবাদটি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, প্রতারণার জন্য বাংলাদেশের চেয়ে উর্বর ক্ষেত্র বুঝি বিশ্বে আর কোথাও নেই। অনেক সময় বাংলাদেশি প্রতারকেরা তাদের প্রতারণার ক্ষেত্র অন্য দেশেও খুব সহজে বিস্তার করে।
১৯৯৯ সালে তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালনরত। একদিন সুদূর নিউজিল্যান্ড থেকে উড়ে এসে আমার দপ্তরে হাজির হলেন সে দেশের অভিবাসন (immigration) দপ্তরের এক কর্মকর্তা। তিনি আগেই আমার কাছে থেকে সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর হাতে সে দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসন-প্রত্যাশী ব্যক্তিদের একগাদা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে আছে শ দেড়েক। এই সার্টিফিকেটের জোরে তাঁদের অনেকে সে দেশে দীর্ঘদিন ধরে চাকরিও করছেন। সবাই এখন সে দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন। সেই কর্মকর্তা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সফর করছেন সার্টিফিকেটগুলো আসল না নকল, তা যাচাই করার জন্য। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে পাঠানো হলো সার্টিফিকেটগুলো যাচাই করার জন্য। অল্প কিছু আসল সার্টিফিকেট পাওয়া গেলেও বেশির ভাগই ছিল জাল। এর মধ্যে এমবিবিএস পাস করার সার্টিফিকেটও আছে। ইতিমধ্যে ওই কর্মকর্তা ঢাকা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সফর করে এসেছেন। সেখানেও তাঁর অভিজ্ঞতা একই রকম। মনে মনে ভাবলাম, এটি বাংলাদেশি প্রতারণার একধরনের আন্তর্জাতিকীকরণ।
আরেকটি ঘটনা বলি। ১৯৯৩ সালে আমি পেশাগত কাজে কয়েক দিনের জন্য সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে অবস্থান করছিলাম। এক রাতে ফোন করে আমার হোটেলে দেখা করতে এলেন সে দেশের একজন নারী মানবাধিকারকর্মী; সঙ্গে বেশ কিছু কাগজপত্র। ওই নারী আমাকে জানালেন, এক বাংলাদেশি তরুণ সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে আবেদন করেছেন এবং কিছু কাগজপত্র দাখিল করে দাবি করেছেন, তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ওই নারী এ বিষয়ে আমার মতামত চাইলেন। যেহেতু আমার পক্ষে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করা সম্ভব ছিল না, তাই তাঁকে অনুরোধ করলাম, তিনি যদি কাগজপত্রের কপি আমার কাছে রেখে যেতে পারেন, তাহলে দেশে ফিরে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে তাঁকে জানানোর চেষ্টা করতে পারি। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। কাগজপত্রে ছিল হাইকোর্টের একজন আইনজীবীর স্বাক্ষরিত একটি জামানত বন্ড। দেশে ফিরে সেই আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুরো বিষয়টা তাঁকে খুলে বলতেই তিনি যা বললেন, তার মূল কথা হচ্ছে, ওই তরুণ মতিঝিল এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে বঙ্গভবনের একটি গাড়ি ছিনতাই করেছিলেন। পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। অনেক দিন হাজতবাসের পর উচ্চ আদালতে রিট করে তিনি এই আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন নেন এবং একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান। আমার কাছ থেকেই সেই আইনজীবী প্রথমে জানলেন, ওই তরুণ এখন সুদূর সুইজারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আমি মানবাধিকারকর্মীকে অবহিত করি। তারপর কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই।
এবার বিদেশি প্রতারণার বাংলাদেশে প্রবেশের দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলাদেশি ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেতে গিয়ে কী নির্দয়ভাবে প্রতারিত হচ্ছে, তা নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারও মাঝেমধ্যে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কাজ তেমন একটা হয়েছে বলে মনে হয় না। এসব শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে গিয়ে নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছে। কিন্তু এর পাশাপাশি বেশ কিছুদিন ধরে একেবারে ‘বিদেশি’ পিএইচডি ডিগ্রি এই বাংলাদেশে ঘরে বসেই পাওয়া যাচ্ছে। হাজার পঞ্চাশেক টাকা খরচ করলেই হলো। লাখ খানেকও হতে পারে। বলা হয় অনলাইন ডিগ্রি। মানে ডিজিটাল ডিগ্রি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে বর্তমানে প্রায় ৪০টি নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন আছে। খোদ মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, এ বছর গোটা আটেককে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। মঞ্জুরি কমিশন থেকে একটি দল গেল এমন প্রস্তাবিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলতে এবং সরেজমিনে সবকিছু পরিদর্শন করতে। সেখানে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, হবু উপাচার্য, ডিন, বিভাগীয় প্রধানসহ আরও বেশ কিছু ব্যক্তি প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন। পরিচয় পর্বে দেখা গেল, সবাই ‘ডক্টর’। মঞ্জুরি কমিশনের যিনি দলনেতা, তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। দীর্ঘদিন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, শিক্ষা বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। এত সব ‘ডক্টর’ এক জায়গায় সমবেত হতে দেখে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এঁদের মধ্যে একজন আবার কয়েক মাস আগে মঞ্জুরি কমিশন থেকে অবসর নিয়েছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হলো, কোথা থেকে তিনি পিএইচডি করেছেন। চোখের পলক না ফেলেই বললেন, ‘কেন, আমেরিকা থেকে।’ ‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়?’ এবার একটু আমতা আমতা করে মাথা চুলকে বললেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।’ ‘আমেরিকায় কত দিন ছিলেন?’ ‘না, মানে আমেরিকা যাইনি।’ ‘বাংলাদেশে বসে পড়ালেখা করেছি।’ এবার মঞ্জুরি কমিশন থেকে সদ্য অবসর নেওয়া কর্মকর্তাকে প্রশ্ন। ‘আপনি কখন এমন একটা কাজ করলেন?’ ‘করেছি স্যার, অবসর সময়ে।’ ‘একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?’ ‘না, আমারটা নিউপোর্ট।’ পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ট্রাস্টি বোর্ডের সেই চেয়ারম্যান স্রেফ বিএ পাস। বাংলাদেশে আর কিছুদিন পর এই নিউপোর্ট, হনলুলু, প্রেস্টন (মালিক আবদুল বাসিত নামের এক পাকিস্তানি) ইত্যাদি অনেক নামের তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কিসিমের ডিগ্রিধারী রাস্তাঘাটে কিলবিল করবে। পাঠক জানতে চাইতে পারেন, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা কি বাংলাদেশের বাইরেও হয়? সহজ উত্তর, হয়। তবে তা একাধারে ব্যবসা ও প্রতারণা। ওয়েবসাইটে উইকিপিডিয়ায় গিয়ে যে কেউ এসব ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ সম্পর্কে খোঁজ নিতে পারেন। যে কটির নাম করলাম, সে সম্পর্কে ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য হচ্ছে, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এসবের দেওয়া ডিগ্রি যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও উল্লেখ করা বেআইনি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরে এমন একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ দেখতে গিয়েছিলাম। একটি কক্ষে কয়েকটি কম্পিউটার, জনা চারেক লোক। তারা সারা বিশ্বে (বাংলাদেশসহ) যাঁরা অনলাইনে নানা ধরনের ডিগ্রির জন্য আবেদন করছেন, তাঁদের খেদমতে নিয়োজিত। যুক্তরাষ্ট্রে আগে এগুলোকে বলা হতো ব্রিফকেস বিশ্ববিদ্যালয়; এখন বলা হয় অ্যাপার্টমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়। খোদ বাংলাদেশেও বেশ কটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে একজন অন্যজনের থিসিস বা গবেষণাকর্ম নকল করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে বহাল তবিয়তে আছেন। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পর্যন্ত হয়েছেন। ধরা পড়লে এক-দুই দিন হইচই হয়, তারপর সব চুপচাপ। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কারও যদি এমন সব ডিগ্রি থাকে, তাতে আমার কী সমস্যা? না, আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু সাধারণ মানুষকে হরেক রকমের প্রতারণা সম্পর্কে অবহিত করা এবং সচেতন থাকতে বলা।
আরেক ধরনের প্রতারণার মুখোমুখি যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁরা অবশ্যই হয়েছেন। একদিন একটি মেইল এল হল্যান্ডের আমস্টারডাম শহরে শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিতে সাকাই ফাউন্ডেশন (Sakai Foundation) নামক একটি সংস্থা আমাকে মনোনীত করেছে। সব খরচ তাদের, শুধু আমাকে হোটেলে থাকাখাওয়া বাবদ ২৫০ ডলার পাঠাতে হবে। নিচে একটা ঠিকানাও আছে। এমন একটি লোভনীয় প্রস্তাব পেলে যে কেউ আনন্দিত হবেন। দীর্ঘদিন এই শহরে বসবাসরত আমার প্রাক্তন ছাত্র মিন্টুকে ফোন করি। মিন্টুকে বলি দেখে আসতে, আসলে সেই ঠিকানায় কী হচ্ছে? মিন্টু খবর দেয়, ওই ঠিকানায় একটি ছোট রুটির দোকান আছে। এখানে সাকাই নামের কিছুই নেই। তারা একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে বলেছিল ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে ডলারটা ওই নম্বরে পাঠাতে। নিশ্চয় কেউ না কেউ এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিদিন কত কোটি ডলার লটারি পাওয়ার খবর যে আসে! তাদের শুধু চাই আমার ঠিকানা, পাসপোর্ট ও ব্যাংক হিসাব নম্বর, আর সবকিছু প্রসেস করার জন্য ২৫০ ডলার। ইন্টারনেটে সুদানের আয়েশা ওবাচার নামের একজনের একটা মেইল। তাঁর স্বামীকে সরকারি লোকজন হত্যা করেছে। স্বামীর মৃত্যুর আগে তিনি পাশের দেশের ব্যাংকে এক বিলিয়ন ডলার রেখে যান। এটি তিনি আমার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করতে চান। সহায়তা করলে অর্ধেক আমার। শুধু আমার নাম-ঠিকানা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং প্রসেসিং ফি হিসেবে ২০০ ডলার পাঠাতে হবে। এসব লটারি আর প্রস্তাব যদি আসলে সত্যি হতো, তাহলে সারা বিশ্বে আমার চেয়ে বেশি ধনী লোক খুব বেশি পাওয়া যেত না। বাংলাদেশে জিনের বাদশারা এখনো প্রতারণার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহারটা রপ্ত করতে পারেনি। পারলে তাদের ধরা এত সহজ হতো না। প্রতারণা এখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃত শিল্প বা আর্ট। ধরা না পড়লে দিব্যি টু পাইস কামানো যায়। সমাজে বোকা মানুষের তো আর অভাব নেই।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।
১৯৯৯ সালে তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালনরত। একদিন সুদূর নিউজিল্যান্ড থেকে উড়ে এসে আমার দপ্তরে হাজির হলেন সে দেশের অভিবাসন (immigration) দপ্তরের এক কর্মকর্তা। তিনি আগেই আমার কাছে থেকে সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর হাতে সে দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসন-প্রত্যাশী ব্যক্তিদের একগাদা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে আছে শ দেড়েক। এই সার্টিফিকেটের জোরে তাঁদের অনেকে সে দেশে দীর্ঘদিন ধরে চাকরিও করছেন। সবাই এখন সে দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন। সেই কর্মকর্তা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সফর করছেন সার্টিফিকেটগুলো আসল না নকল, তা যাচাই করার জন্য। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে পাঠানো হলো সার্টিফিকেটগুলো যাচাই করার জন্য। অল্প কিছু আসল সার্টিফিকেট পাওয়া গেলেও বেশির ভাগই ছিল জাল। এর মধ্যে এমবিবিএস পাস করার সার্টিফিকেটও আছে। ইতিমধ্যে ওই কর্মকর্তা ঢাকা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সফর করে এসেছেন। সেখানেও তাঁর অভিজ্ঞতা একই রকম। মনে মনে ভাবলাম, এটি বাংলাদেশি প্রতারণার একধরনের আন্তর্জাতিকীকরণ।
আরেকটি ঘটনা বলি। ১৯৯৩ সালে আমি পেশাগত কাজে কয়েক দিনের জন্য সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে অবস্থান করছিলাম। এক রাতে ফোন করে আমার হোটেলে দেখা করতে এলেন সে দেশের একজন নারী মানবাধিকারকর্মী; সঙ্গে বেশ কিছু কাগজপত্র। ওই নারী আমাকে জানালেন, এক বাংলাদেশি তরুণ সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে আবেদন করেছেন এবং কিছু কাগজপত্র দাখিল করে দাবি করেছেন, তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ওই নারী এ বিষয়ে আমার মতামত চাইলেন। যেহেতু আমার পক্ষে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করা সম্ভব ছিল না, তাই তাঁকে অনুরোধ করলাম, তিনি যদি কাগজপত্রের কপি আমার কাছে রেখে যেতে পারেন, তাহলে দেশে ফিরে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে তাঁকে জানানোর চেষ্টা করতে পারি। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। কাগজপত্রে ছিল হাইকোর্টের একজন আইনজীবীর স্বাক্ষরিত একটি জামানত বন্ড। দেশে ফিরে সেই আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুরো বিষয়টা তাঁকে খুলে বলতেই তিনি যা বললেন, তার মূল কথা হচ্ছে, ওই তরুণ মতিঝিল এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে বঙ্গভবনের একটি গাড়ি ছিনতাই করেছিলেন। পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। অনেক দিন হাজতবাসের পর উচ্চ আদালতে রিট করে তিনি এই আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন নেন এবং একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান। আমার কাছ থেকেই সেই আইনজীবী প্রথমে জানলেন, ওই তরুণ এখন সুদূর সুইজারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আমি মানবাধিকারকর্মীকে অবহিত করি। তারপর কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই।
এবার বিদেশি প্রতারণার বাংলাদেশে প্রবেশের দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলাদেশি ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেতে গিয়ে কী নির্দয়ভাবে প্রতারিত হচ্ছে, তা নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারও মাঝেমধ্যে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কাজ তেমন একটা হয়েছে বলে মনে হয় না। এসব শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে গিয়ে নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছে। কিন্তু এর পাশাপাশি বেশ কিছুদিন ধরে একেবারে ‘বিদেশি’ পিএইচডি ডিগ্রি এই বাংলাদেশে ঘরে বসেই পাওয়া যাচ্ছে। হাজার পঞ্চাশেক টাকা খরচ করলেই হলো। লাখ খানেকও হতে পারে। বলা হয় অনলাইন ডিগ্রি। মানে ডিজিটাল ডিগ্রি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে বর্তমানে প্রায় ৪০টি নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন আছে। খোদ মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, এ বছর গোটা আটেককে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। মঞ্জুরি কমিশন থেকে একটি দল গেল এমন প্রস্তাবিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলতে এবং সরেজমিনে সবকিছু পরিদর্শন করতে। সেখানে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, হবু উপাচার্য, ডিন, বিভাগীয় প্রধানসহ আরও বেশ কিছু ব্যক্তি প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন। পরিচয় পর্বে দেখা গেল, সবাই ‘ডক্টর’। মঞ্জুরি কমিশনের যিনি দলনেতা, তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। দীর্ঘদিন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, শিক্ষা বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। এত সব ‘ডক্টর’ এক জায়গায় সমবেত হতে দেখে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এঁদের মধ্যে একজন আবার কয়েক মাস আগে মঞ্জুরি কমিশন থেকে অবসর নিয়েছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হলো, কোথা থেকে তিনি পিএইচডি করেছেন। চোখের পলক না ফেলেই বললেন, ‘কেন, আমেরিকা থেকে।’ ‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়?’ এবার একটু আমতা আমতা করে মাথা চুলকে বললেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।’ ‘আমেরিকায় কত দিন ছিলেন?’ ‘না, মানে আমেরিকা যাইনি।’ ‘বাংলাদেশে বসে পড়ালেখা করেছি।’ এবার মঞ্জুরি কমিশন থেকে সদ্য অবসর নেওয়া কর্মকর্তাকে প্রশ্ন। ‘আপনি কখন এমন একটা কাজ করলেন?’ ‘করেছি স্যার, অবসর সময়ে।’ ‘একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?’ ‘না, আমারটা নিউপোর্ট।’ পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ট্রাস্টি বোর্ডের সেই চেয়ারম্যান স্রেফ বিএ পাস। বাংলাদেশে আর কিছুদিন পর এই নিউপোর্ট, হনলুলু, প্রেস্টন (মালিক আবদুল বাসিত নামের এক পাকিস্তানি) ইত্যাদি অনেক নামের তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কিসিমের ডিগ্রিধারী রাস্তাঘাটে কিলবিল করবে। পাঠক জানতে চাইতে পারেন, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা কি বাংলাদেশের বাইরেও হয়? সহজ উত্তর, হয়। তবে তা একাধারে ব্যবসা ও প্রতারণা। ওয়েবসাইটে উইকিপিডিয়ায় গিয়ে যে কেউ এসব ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ সম্পর্কে খোঁজ নিতে পারেন। যে কটির নাম করলাম, সে সম্পর্কে ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য হচ্ছে, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এসবের দেওয়া ডিগ্রি যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও উল্লেখ করা বেআইনি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরে এমন একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ দেখতে গিয়েছিলাম। একটি কক্ষে কয়েকটি কম্পিউটার, জনা চারেক লোক। তারা সারা বিশ্বে (বাংলাদেশসহ) যাঁরা অনলাইনে নানা ধরনের ডিগ্রির জন্য আবেদন করছেন, তাঁদের খেদমতে নিয়োজিত। যুক্তরাষ্ট্রে আগে এগুলোকে বলা হতো ব্রিফকেস বিশ্ববিদ্যালয়; এখন বলা হয় অ্যাপার্টমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়। খোদ বাংলাদেশেও বেশ কটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে একজন অন্যজনের থিসিস বা গবেষণাকর্ম নকল করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে বহাল তবিয়তে আছেন। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পর্যন্ত হয়েছেন। ধরা পড়লে এক-দুই দিন হইচই হয়, তারপর সব চুপচাপ। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কারও যদি এমন সব ডিগ্রি থাকে, তাতে আমার কী সমস্যা? না, আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু সাধারণ মানুষকে হরেক রকমের প্রতারণা সম্পর্কে অবহিত করা এবং সচেতন থাকতে বলা।
আরেক ধরনের প্রতারণার মুখোমুখি যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁরা অবশ্যই হয়েছেন। একদিন একটি মেইল এল হল্যান্ডের আমস্টারডাম শহরে শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিতে সাকাই ফাউন্ডেশন (Sakai Foundation) নামক একটি সংস্থা আমাকে মনোনীত করেছে। সব খরচ তাদের, শুধু আমাকে হোটেলে থাকাখাওয়া বাবদ ২৫০ ডলার পাঠাতে হবে। নিচে একটা ঠিকানাও আছে। এমন একটি লোভনীয় প্রস্তাব পেলে যে কেউ আনন্দিত হবেন। দীর্ঘদিন এই শহরে বসবাসরত আমার প্রাক্তন ছাত্র মিন্টুকে ফোন করি। মিন্টুকে বলি দেখে আসতে, আসলে সেই ঠিকানায় কী হচ্ছে? মিন্টু খবর দেয়, ওই ঠিকানায় একটি ছোট রুটির দোকান আছে। এখানে সাকাই নামের কিছুই নেই। তারা একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে বলেছিল ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে ডলারটা ওই নম্বরে পাঠাতে। নিশ্চয় কেউ না কেউ এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতিদিন কত কোটি ডলার লটারি পাওয়ার খবর যে আসে! তাদের শুধু চাই আমার ঠিকানা, পাসপোর্ট ও ব্যাংক হিসাব নম্বর, আর সবকিছু প্রসেস করার জন্য ২৫০ ডলার। ইন্টারনেটে সুদানের আয়েশা ওবাচার নামের একজনের একটা মেইল। তাঁর স্বামীকে সরকারি লোকজন হত্যা করেছে। স্বামীর মৃত্যুর আগে তিনি পাশের দেশের ব্যাংকে এক বিলিয়ন ডলার রেখে যান। এটি তিনি আমার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করতে চান। সহায়তা করলে অর্ধেক আমার। শুধু আমার নাম-ঠিকানা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং প্রসেসিং ফি হিসেবে ২০০ ডলার পাঠাতে হবে। এসব লটারি আর প্রস্তাব যদি আসলে সত্যি হতো, তাহলে সারা বিশ্বে আমার চেয়ে বেশি ধনী লোক খুব বেশি পাওয়া যেত না। বাংলাদেশে জিনের বাদশারা এখনো প্রতারণার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহারটা রপ্ত করতে পারেনি। পারলে তাদের ধরা এত সহজ হতো না। প্রতারণা এখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃত শিল্প বা আর্ট। ধরা না পড়লে দিব্যি টু পাইস কামানো যায়। সমাজে বোকা মানুষের তো আর অভাব নেই।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।
No comments