কালের পুরাণ-আসন কমল, বাঁচল গণতন্ত্র! by সোহরাব হাসান
কয়েক দিন আগে ‘কালের পুরাণ’-এ আওয়ামী লীগের ভোটে ভাটার টান লেখার কারণে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কাছ থেকে কড়া গালি খেয়েছিলাম। তাঁরা বলতে চেয়েছেন, ‘এত দিন লোকটার আসল চেহারা বের হয়েছে। মাঝেমধ্যে বিএনপির সমালোচনা করলেও মূল টার্গেট আওয়ামী লীগ।
’ এরপর যখন বিএনপির সংসদ বর্জন নিয়ে লিখলাম, বিএনপির সমর্থকেরা এই বলে নিন্দামন্দ করলেন, ‘ব্যাটা পাঁড় আওয়ামী লীগার। বিএনপিকে একদম দেখতে পারেন না, তাই সুযোগ পেলেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে কটাক্ষ করেন।’
রাজনৈতিক বিষয়ে লেখার বিপদ হলো, যখন যাঁদের পক্ষে যায়, তাঁরা বাহবা দেন, ধন্যবাদের জোয়ার বইয়ে দেন, আর বিপক্ষে গেলেই লেখক ও পত্রিকার মুণ্ডুপাত করেন। আমাদের নেতা-নেত্রীরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না; প্রশংসা পছন্দ করেন। তার চেয়েও বেশি পছন্দ করেন স্তুতি। হুমায়ুন আজাদ একবার লিখেছিলেন, ‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু পছন্দ করে গাধা।’ গাধা না হওয়া পর্যন্ত নেতা-নেত্রীদের সুনজরে আসা যায় না।
তবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও লেখার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা যে একেবারে নেই, তা বলব না। ‘আওয়ামী লীগের ভোটে ভাটার টান’ কলামটি লেখার পর দৈনিক জনকণ্ঠ-এ এর একটি সমালোচনামূলক লেখা লিখেছেন অগ্রজ সাংবাদিক মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। তিনি লিখেছেন ‘আমি নাকি খুব খেপে লেখাটি লিখেছি।’ আমি খেপে লিখিনি। বরং জনগণ যাতে আরও বেশি খেপে না যায়, সে সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছি। আওয়ামী লীগের যেসব দোষ ও দুর্বলতার কথা আমি বলেছি, তাঁর চেয়ে বেশি দুর্বলতার কথা তিনি লিখেছেন। আর আওয়ামী লীগই যে আওয়ামী লীগের শত্রু—এ কথা তাঁর চেয়ে বেশি কে জানেন? অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিত্তশালী আওয়ামী লীগারদের ষড়যন্ত্রে তাঁকে দুই দুইবার নির্বাচনে হারতে হয়েছে। একটি লেখার জবাবে শফিক ভাই আরেকটি লেখা লিখেছেন; অন্যদের মতো লেখকের মাথায় মুগুর মারতে যাননি—এ জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আওয়ামী লীগের ভোটে যে ভাটার টান পড়েছে, তা প্রমাণ করতে জরিপ বা গবেষণার প্রয়োজন হয় না। পর্বতপ্রমাণ সমস্যার দেশে দুই বছরের মাথায় একটি সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে পূর্ববর্তী বিএনপি কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে তুলনা করলে আওয়ামী লীগের অবস্থান বিপৎসীমার বাইরেই আছে বলতে হবে। সেই অবস্থান কত দিন থাকবে তা নির্ভর করবে পুরোপুরি সরকারের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার ওপর। আওয়ামী লীগ সরকার যেমন মধ্য মেয়াদের কাছাকাছি আছে, তেমনই ভোটারারও অপেক্ষায় আছেন আগামী আড়াই-তিন বছরে সরকার কী করে, তা দেখার জন্য। এই সময়ে দলীয় সন্ত্রাস ঠেকাতে এবং বিদ্যুৎ ও বাজার-পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলে ভোটে ভাটার টান রোধ করা কঠিন হবে না, আর যদি অহংকার এসে কাঁধে ভর করে, দলীয় সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি চলতে থাকে, তাহলে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।
২.
উপনির্বাচন নিয়ে এলাকায় ভোটারদের মনে যতটা না উত্তেজনা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল জাতীয় রাজনীতিতে। সবার প্রশ্ন ছিল, উপনির্বাচনের ফল কী হবে? দুটিতেই আওয়ামী লীগ জিতবে? দুটিতেই হারবে? তারচেয়েও জরুরি প্রশ্ন ছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে, না আরেকটি মাগুরা সৃষ্টি হবে? না, মাগুরা হয়নি। এ জন্য নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন না করেও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা সম্ভব। সব নির্বাচনে যেমন হয়ে থাকে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নির্বাচনে হারলেই মানি না, মানব না। কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি খামোকা হরতাল করল। অভিযোগ, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তদন্তে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ৪০ হাজার ৫১০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন এবং হবিগঞ্জ আসনে বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া জয়ী হয়েছেন এক হাজার ২৮৫ ভোটে। বিএনপি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঁচটি কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছে। ওই পাঁচটি কেন্দ্রের মোট ভোটের পরিমাণ কি ৪০ হাজারের বেশি? না হলে নির্বাচনী ফল বাতিলের দাবিতে কেন তারা হরতাল করল? সেটি কি জনগণকে বোকা বানানোর জন্য? ভোটারদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে তাদের উচিত ছিল নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়া।
নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী জয়ী বা পরাজিত হলেন, সেটি দেখার বিষয় নয়। দেখার বিষয় হলো, নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে কি না। নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আর হয়নি। এই দাবি অমূলক নয়। অতীতে নির্বাচন বলতে ছিল সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, কালো টাকার ছড়াছড়ি, ‘কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই’ বলে সংখ্যালঘু ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো। সেই সব দৃশ্য এ উপনির্বাচনে ছিল না। তারা একটি ‘রউফ মার্কা নির্বাচন’ করেনি কিংবা ‘আজিজ মার্কা’ ভোটার তালিকাও দেশবাসীকে উপহার দেয়নি।
গতকাল প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘একটি আসন হারাল আওয়ামী লীগ।’ এই আসন হারানোয় আওয়ামী লীগের তেমন ক্ষতি হয়েছে বলা যাবে না। নির্বাচনে তারা একটি আসন হারালেও বিরোধী দলের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনেও যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। আর হবিগঞ্জেও বিএনপি বা ভোটাররা আওয়ামী লীগকে হারায়নি, হারিয়েছে মহাজোটের শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ হবিগঞ্জ আসনে মাত্র এক হাজার ২৮৫ ভোটে হেরেছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী পেয়েছেন ২২ হাজার ভোট। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মিলিত ভোট বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। আসলে এরশাদ বুঝতে পেরেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জাপার প্রার্থী দিয়ে আওয়ামী লীগকে হারানো যাবে না, কিন্তু হবিগঞ্জে যাবে। এ কারণেই এরশাদ হবিগঞ্জে দলীয় প্রার্থী খাড়া করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি কথা বেশ চালু আছে, ‘আমেরিকা যার বন্ধু, তার শত্রুর দরকার হয় না।’ দেশীয় রাজনীতিতেও ‘এরশাদ যার বন্ধু, তার শত্রুর দরকার হয় না।’ আওয়ামী লীগের যেসব নেতা জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের চর হিসেবে আবিষ্কারের নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা একবার এরশাদ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন। একাত্তরে পাকিস্তান সরকার বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য যে আদালত করেছিল, এরশাদ ছিলেন সেই আদালতের প্রধান।
৩.
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে। বৃহস্পতিবার ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্রাব) বার্ষিক সাধারণ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সন্ত্রাসীরা মারা গেলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো শুধু তাদের পক্ষ নেয়। কিন্তু কোনো পুলিশ মারা গেলে তাদের পক্ষে তারা কোনো কথা বলে না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা যত ভালো কাজই করি না কেন, সাংবাদিকদের কাছ থেকে তার জন্য খুব কমই ধন্যবাদ পেয়ে থাকি। কিন্তু প্রতিবেদনে ভুলভ্রান্তি থাকলে আমরা কষ্ট পাই। গত দুই বছরে ভুল প্রতিবেদনের জন্য অনেকে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
সাংবাদিকেরা ভুল প্রতিবেদনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি নিজের ভুলের জন্য কার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন?
সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা ফজলুল হক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাসপাতালে তাঁর লাশ দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, এটি অনেকে ভালো চোখে দেখছে না। তাই পরিকল্পিতভাবে তাঁরা হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাচ্ছে। কারা করছে? এই প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে চায়।’ গতকালের পত্রিকায় দেখলাম, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক হত্যার অভিযোগে একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ হাজিকে (৬৫) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন (সেই গুলির ঘটনাও সাজানো বলে দাবি করেছেন নিহত ফজলুল হকের স্বজনেরা)।
এই খুনের হোতা ও শিকার দুজনই আওয়ামী লীগের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য হলে মেনে নিতে হয়, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে চান। এ রকম ঘটনা কেবল ঢাকায় ঘটছে না, সারা দেশেই। ঢাকার আওয়ামী লীগের কর্মী ইব্রাহিম কার পিস্তলের গুলিতে মারা গেছেন, কুষ্টিয়ায় সাংসদের বাড়িতে যিনি বোমা ফাটিয়েছিলেন, তিনিই বা কোন দলের কর্মী, দয়া করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানাবেন কি? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনেক আগেই ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন সেখানে কারা সন্ত্রাস চালাচ্ছে? কারা শিক্ষকদের ওপর হামলে পড়ছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিতীয় অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের আগে তিনি আওয়ামী লীগের একজন মেঠো নেত্রী ছিলেন। ড্রয়িংরুম রাজনীতি করতেন না। আইন ব্যবসায় নিয়োজিত থেকে দলের বহু কর্মীকে পুলিশ ও সরকারের জুলুম থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন তিনি যে পুলিশের পক্ষে প্রায় প্রতিদিন সাফাই গাইছেন, বিরোধী দলে থাকতে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। তখন মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সেই নির্যাতনের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিল। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিকেরা বদলালেও সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বদলাতে পারে না। তাদের অবস্থান বরাবরই সত্যের পক্ষে। বিরোধী দলে থাকতে সাহারা খাতুনও জোরালো ভাষায় ক্রসফায়ার তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ করেছেন। তখন আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও লুৎফুজ্জামান বাবররা বলতেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে না। আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ গুলি ছুড়েছে এবং সন্ত্রাসী মারা গেছে।’ সে সময় তাঁদের বক্তব্য ও বিবৃতি সত্য না হলে আজ সাহারা খাতুনের বক্তব্য সত্য হতে পারে না। পৃথিবীর কোনো দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে অইনশৃঙ্খলার উন্নতি করা কিংবা অপরাধ দমন করা যায়নি। বাংলাদেশেও যাবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুলিশ ও র্যাবকেও আইন মাফিক চলতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের ১০ জন সদস্য মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু এর জন্য নিশ্চয়ই কোনো মানবাধিকার সংগঠন বা সাংবাদিক দায়ী নন। বেপরোয়া যানবাহন চালানো বন্ধের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন হাইওয়ে বা ট্রাফিক পুলিশেরই। তারা সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করলে হয়তো পুলিশের ১০ জন সদস্যকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
রাজনৈতিক বিষয়ে লেখার বিপদ হলো, যখন যাঁদের পক্ষে যায়, তাঁরা বাহবা দেন, ধন্যবাদের জোয়ার বইয়ে দেন, আর বিপক্ষে গেলেই লেখক ও পত্রিকার মুণ্ডুপাত করেন। আমাদের নেতা-নেত্রীরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না; প্রশংসা পছন্দ করেন। তার চেয়েও বেশি পছন্দ করেন স্তুতি। হুমায়ুন আজাদ একবার লিখেছিলেন, ‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু পছন্দ করে গাধা।’ গাধা না হওয়া পর্যন্ত নেতা-নেত্রীদের সুনজরে আসা যায় না।
তবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও লেখার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা যে একেবারে নেই, তা বলব না। ‘আওয়ামী লীগের ভোটে ভাটার টান’ কলামটি লেখার পর দৈনিক জনকণ্ঠ-এ এর একটি সমালোচনামূলক লেখা লিখেছেন অগ্রজ সাংবাদিক মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। তিনি লিখেছেন ‘আমি নাকি খুব খেপে লেখাটি লিখেছি।’ আমি খেপে লিখিনি। বরং জনগণ যাতে আরও বেশি খেপে না যায়, সে সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছি। আওয়ামী লীগের যেসব দোষ ও দুর্বলতার কথা আমি বলেছি, তাঁর চেয়ে বেশি দুর্বলতার কথা তিনি লিখেছেন। আর আওয়ামী লীগই যে আওয়ামী লীগের শত্রু—এ কথা তাঁর চেয়ে বেশি কে জানেন? অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিত্তশালী আওয়ামী লীগারদের ষড়যন্ত্রে তাঁকে দুই দুইবার নির্বাচনে হারতে হয়েছে। একটি লেখার জবাবে শফিক ভাই আরেকটি লেখা লিখেছেন; অন্যদের মতো লেখকের মাথায় মুগুর মারতে যাননি—এ জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আওয়ামী লীগের ভোটে যে ভাটার টান পড়েছে, তা প্রমাণ করতে জরিপ বা গবেষণার প্রয়োজন হয় না। পর্বতপ্রমাণ সমস্যার দেশে দুই বছরের মাথায় একটি সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে পূর্ববর্তী বিএনপি কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে তুলনা করলে আওয়ামী লীগের অবস্থান বিপৎসীমার বাইরেই আছে বলতে হবে। সেই অবস্থান কত দিন থাকবে তা নির্ভর করবে পুরোপুরি সরকারের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার ওপর। আওয়ামী লীগ সরকার যেমন মধ্য মেয়াদের কাছাকাছি আছে, তেমনই ভোটারারও অপেক্ষায় আছেন আগামী আড়াই-তিন বছরে সরকার কী করে, তা দেখার জন্য। এই সময়ে দলীয় সন্ত্রাস ঠেকাতে এবং বিদ্যুৎ ও বাজার-পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলে ভোটে ভাটার টান রোধ করা কঠিন হবে না, আর যদি অহংকার এসে কাঁধে ভর করে, দলীয় সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি চলতে থাকে, তাহলে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।
২.
উপনির্বাচন নিয়ে এলাকায় ভোটারদের মনে যতটা না উত্তেজনা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল জাতীয় রাজনীতিতে। সবার প্রশ্ন ছিল, উপনির্বাচনের ফল কী হবে? দুটিতেই আওয়ামী লীগ জিতবে? দুটিতেই হারবে? তারচেয়েও জরুরি প্রশ্ন ছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে, না আরেকটি মাগুরা সৃষ্টি হবে? না, মাগুরা হয়নি। এ জন্য নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন না করেও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা সম্ভব। সব নির্বাচনে যেমন হয়ে থাকে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নির্বাচনে হারলেই মানি না, মানব না। কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি খামোকা হরতাল করল। অভিযোগ, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, তদন্তে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ৪০ হাজার ৫১০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন এবং হবিগঞ্জ আসনে বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া জয়ী হয়েছেন এক হাজার ২৮৫ ভোটে। বিএনপি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঁচটি কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছে। ওই পাঁচটি কেন্দ্রের মোট ভোটের পরিমাণ কি ৪০ হাজারের বেশি? না হলে নির্বাচনী ফল বাতিলের দাবিতে কেন তারা হরতাল করল? সেটি কি জনগণকে বোকা বানানোর জন্য? ভোটারদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে তাদের উচিত ছিল নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়া।
নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী জয়ী বা পরাজিত হলেন, সেটি দেখার বিষয় নয়। দেখার বিষয় হলো, নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে কি না। নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আর হয়নি। এই দাবি অমূলক নয়। অতীতে নির্বাচন বলতে ছিল সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, কালো টাকার ছড়াছড়ি, ‘কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই’ বলে সংখ্যালঘু ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো। সেই সব দৃশ্য এ উপনির্বাচনে ছিল না। তারা একটি ‘রউফ মার্কা নির্বাচন’ করেনি কিংবা ‘আজিজ মার্কা’ ভোটার তালিকাও দেশবাসীকে উপহার দেয়নি।
গতকাল প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘একটি আসন হারাল আওয়ামী লীগ।’ এই আসন হারানোয় আওয়ামী লীগের তেমন ক্ষতি হয়েছে বলা যাবে না। নির্বাচনে তারা একটি আসন হারালেও বিরোধী দলের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনেও যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। আর হবিগঞ্জেও বিএনপি বা ভোটাররা আওয়ামী লীগকে হারায়নি, হারিয়েছে মহাজোটের শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ হবিগঞ্জ আসনে মাত্র এক হাজার ২৮৫ ভোটে হেরেছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী পেয়েছেন ২২ হাজার ভোট। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মিলিত ভোট বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। আসলে এরশাদ বুঝতে পেরেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জাপার প্রার্থী দিয়ে আওয়ামী লীগকে হারানো যাবে না, কিন্তু হবিগঞ্জে যাবে। এ কারণেই এরশাদ হবিগঞ্জে দলীয় প্রার্থী খাড়া করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি কথা বেশ চালু আছে, ‘আমেরিকা যার বন্ধু, তার শত্রুর দরকার হয় না।’ দেশীয় রাজনীতিতেও ‘এরশাদ যার বন্ধু, তার শত্রুর দরকার হয় না।’ আওয়ামী লীগের যেসব নেতা জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের চর হিসেবে আবিষ্কারের নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা একবার এরশাদ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন। একাত্তরে পাকিস্তান সরকার বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য যে আদালত করেছিল, এরশাদ ছিলেন সেই আদালতের প্রধান।
৩.
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে। বৃহস্পতিবার ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্রাব) বার্ষিক সাধারণ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সন্ত্রাসীরা মারা গেলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো শুধু তাদের পক্ষ নেয়। কিন্তু কোনো পুলিশ মারা গেলে তাদের পক্ষে তারা কোনো কথা বলে না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা যত ভালো কাজই করি না কেন, সাংবাদিকদের কাছ থেকে তার জন্য খুব কমই ধন্যবাদ পেয়ে থাকি। কিন্তু প্রতিবেদনে ভুলভ্রান্তি থাকলে আমরা কষ্ট পাই। গত দুই বছরে ভুল প্রতিবেদনের জন্য অনেকে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
সাংবাদিকেরা ভুল প্রতিবেদনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি নিজের ভুলের জন্য কার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন?
সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা ফজলুল হক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাসপাতালে তাঁর লাশ দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, এটি অনেকে ভালো চোখে দেখছে না। তাই পরিকল্পিতভাবে তাঁরা হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাচ্ছে। কারা করছে? এই প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে চায়।’ গতকালের পত্রিকায় দেখলাম, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক হত্যার অভিযোগে একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ হাজিকে (৬৫) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন (সেই গুলির ঘটনাও সাজানো বলে দাবি করেছেন নিহত ফজলুল হকের স্বজনেরা)।
এই খুনের হোতা ও শিকার দুজনই আওয়ামী লীগের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য হলে মেনে নিতে হয়, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে চান। এ রকম ঘটনা কেবল ঢাকায় ঘটছে না, সারা দেশেই। ঢাকার আওয়ামী লীগের কর্মী ইব্রাহিম কার পিস্তলের গুলিতে মারা গেছেন, কুষ্টিয়ায় সাংসদের বাড়িতে যিনি বোমা ফাটিয়েছিলেন, তিনিই বা কোন দলের কর্মী, দয়া করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানাবেন কি? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনেক আগেই ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন সেখানে কারা সন্ত্রাস চালাচ্ছে? কারা শিক্ষকদের ওপর হামলে পড়ছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিতীয় অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের আগে তিনি আওয়ামী লীগের একজন মেঠো নেত্রী ছিলেন। ড্রয়িংরুম রাজনীতি করতেন না। আইন ব্যবসায় নিয়োজিত থেকে দলের বহু কর্মীকে পুলিশ ও সরকারের জুলুম থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন তিনি যে পুলিশের পক্ষে প্রায় প্রতিদিন সাফাই গাইছেন, বিরোধী দলে থাকতে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। তখন মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সেই নির্যাতনের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিল। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিকেরা বদলালেও সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বদলাতে পারে না। তাদের অবস্থান বরাবরই সত্যের পক্ষে। বিরোধী দলে থাকতে সাহারা খাতুনও জোরালো ভাষায় ক্রসফায়ার তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ করেছেন। তখন আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও লুৎফুজ্জামান বাবররা বলতেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে না। আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ গুলি ছুড়েছে এবং সন্ত্রাসী মারা গেছে।’ সে সময় তাঁদের বক্তব্য ও বিবৃতি সত্য না হলে আজ সাহারা খাতুনের বক্তব্য সত্য হতে পারে না। পৃথিবীর কোনো দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে অইনশৃঙ্খলার উন্নতি করা কিংবা অপরাধ দমন করা যায়নি। বাংলাদেশেও যাবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুলিশ ও র্যাবকেও আইন মাফিক চলতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের ১০ জন সদস্য মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু এর জন্য নিশ্চয়ই কোনো মানবাধিকার সংগঠন বা সাংবাদিক দায়ী নন। বেপরোয়া যানবাহন চালানো বন্ধের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন হাইওয়ে বা ট্রাফিক পুলিশেরই। তারা সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করলে হয়তো পুলিশের ১০ জন সদস্যকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments