মানব পাচার-মানুষের মূল্য কত by মশিউল আলম

আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের সিয়াটল শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে সামোয়া আর্কিপেলাগো। এর একটি ছোট্ট অংশ আমেরিকান সামোয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীন। সেখানে কিল সু লি নামের এক দক্ষিণ কোরীয় ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন তৈরি পোশাক কারখানা ‘দায়ুসা সামোয়া লিমিটেড’-এ কাজ করতেন প্রায় ৩০০ ভিয়েতনামি ও চীনা নারী-পুরুষ।


খেলাধুলার পোশাক, জ্যাকেট, সাঁতারের পোশাকসহ নানা ধরনের পোশাক তৈরি হতো তাঁদের শ্রমে। সেগুলো জাহাজে করে চলে যেত আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে, উচ্চ মূল্যে বিক্রি হতো বড় বড় আমেরিকান শহরের ‘জে সি পেনি’ ও ‘টার্গেট’-এর মতো দামি রিটেইল স্টোরগুলোতে।
কিন্তু দায়ুসা সামোয়া কারখানাটি এখন বন্ধ, এর মালিক কিল সু লি দেউলিয়া এবং ৪০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কয়েদ খাটছেন।
কারণ? সে এক বিভীষিকার গল্প। কৃষিপ্রধান দরিদ্র দেশ ভিয়েতনাম থেকে দরিদ্র নারীরা কাজ করতে গিয়েছিলেন আমেরিকান সামোয়ার ওই কারখানায়। তাঁরা দরিদ্র, কোনো কোনো সংসারে গড় বার্ষিক আয় সাকল্যে ২০০ মার্কিন ডলারও নয়। তাঁদের লোভ দেখানো হয়েছিল, সামোয়ায় গেলে তাঁরা এক মাসেই বেতন পাবেন ৪০০ মার্কিন ডলার, তিন বছরের চুক্তি। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরে দেশে স্বজনদের কাছে পাঠাতে পারবেন প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার মার্কিন ডলার। তাঁদের দারিদ্র্য দূর হবে। এই স্বপ্নে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে কর্জ নিয়ে, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে, বাড়িঘর বন্ধক রেখে ভিয়েতনামের নারীরা আট হাজার মার্কিন ডলার খরচ করে গিয়ে পৌঁছেন আমেরিকান সামোয়ায়। কিন্তু দায়ুসা সামোয়া লিমিটেড নামের কারখানায় পৌঁছেই তাঁরা হয়ে পড়েন দাসশ্রমিক। একেকটি ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয় ১৮ জনকে। দিনরাত খাটানো হয়, কিন্তু ঠিকমতো খেতে দেয় না, কথায় কথায় চলে পিটুনি, চলে যৌন নির্যাতন। সশস্ত্র প্রহরাবেষ্টিত কারখানা চত্বরের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না কখনো। তাঁরা কাজ ছেড়ে স্বদেশে ফিরতেও পারেন না; কারণ তিন বছরের আগে চুক্তি ভঙ্গ করলে জরিমানা দিতে হবে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার। গভীর রাতে মেয়েদের কান্নার ধ্বনিতে ভারী হয়ে ওঠে তাঁদের কথিত ডরমিটরির বাতাস, আসলে যা শ্রমশিবির। মেয়েরা ঘুমের ঘোরেও ফোঁপান। তাঁদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে।
১৯৯৯ সালের বসন্তে দুই নারী শ্রমিক কারখানাটি থেকে পালিয়ে কারও সাহায্যে কোনো বন্ধুকে নিজেদের শোচনীয় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ই-মেইল বার্তা পাঠান; তাঁরা উদ্ধার পেতে সহযোগিতা চান। কিন্তু অচিরেই সেই দুই নারীর আর কোনো খোঁজ মেলে না। আমেরিকান সামোয়ার পুলিশ পরে জানায়, তাঁরা পানিতে ডুবে মারা গেছেন, কিন্তু তাঁদের লাশ কেউ পায়নি। তাঁদের লেখা সেই ই-মেইল বার্তাটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে হাই-ত্রি লি নামের এক ভিয়েতনামি-আমেরিকান ভদ্রলোকের হাতে, যিনি মাইক্রোসফট কোম্পানিতে কাজ করতেন। তিনি ছুটে যান আমেরিকান সামোয়ায়, স্বচক্ষে দেখেন ওই কারখানার শ্রমিকদের শোচনীয় অবস্থা। সেখান থেকে তিনি ১২ জন ভিয়েতনামি নারীকে উদ্ধার করে নিয়ে যান সিয়াটল শহরে। কারখানাটির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়; আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং কেস’ বা ‘লার্জেস্ট স্লেভারি প্রসিকিউশন’ হিসেবে পরিচিত সে মামলায় কারখানার মালিক কিল সু লির ৪০ বছর কারাদণ্ড হয়।
এই নিষ্ঠুর বর্বর শোষক, নির্যাতনকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীকে কারাগারে ঢোকানোর আইনি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাটর্নি জেনারেলস ডিশটিংগুইশড অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত হয়েছেন, এমন একজন মহান মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি লুই সিডিবাকা, মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের অন্যতম খ্যাতিমান ফেডারেল প্রসিকিউটর ছিলেন; এখন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীন অফিস টু মনিটর অ্যান্ড কমব্যাট ট্রাফিকিং ইন পারসনসের পরিচালক। ২০০৯ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে মানব পাচারবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করেন। দুই দিনের সফরে তিনি সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন; গত মঙ্গলবার বনানীর আমেরিকান সেন্টারে তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ হলো। আগের দিন তিনি সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সঙ্গে। বিভিন্ন এনজিও, নাগরিক সমাজের নেতারা এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) নেতাদের সঙ্গেও তাঁর বৈঠক হয়েছে, সব ধরনের মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিরাপদ শ্রমিক অভিবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সহযোগিতামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে।
আলাপের শুরুতে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের একটি উক্তির বরাতে বললাম, বাংলাদেশে এখন অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতারিত হওয়ার ঘটনাগুলোকে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, মানব পাচার বলতে যা বোঝায়, সঠিক অর্থে তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রও নিরাপদ শ্রমিক অভিবাসন বা সেফ লেবার মাইগ্রেশন নিয়ে কাজ করছে। মিস্টার সিডিবাকা বললেন, ‘অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতারণা শোষণের একটা বড় দৃষ্টান্ত, এটা নিয়েও আমরা কাজ করছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রাফিকিং ইন পারসনস বলতে আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞায় যা বোঝায়, তা আসলে মানুষের স্থানান্তরের (মুভমেন্ট) সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। মানুষের সঙ্গে দাসের মতো আচরণ করা, মানুষকে দাসশ্রমে বাধ্য করাও ট্রাফিকিংয়ের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলেই শুধু মানব পাচার ঘটবে, বিষয়টি তা নয়। নিজের দেশে, নিজের গ্রামে বা শহরেও ট্রাফিকিং ঘটতে পারে, ঘটছে। একজন মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে গিয়ে দাসশ্রমের মধ্যে পড়ে যেতে পারে, এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও সত্য, একজন মানুষ এই বাংলাদেশেই কোনো কৃষি গৃহস্থালিতে বা কারখানায় দাসের মতো অবস্থায় পড়ে যেতে পারে। আমরা দেখতে পাচ্ছি মানব পাচার সমস্যার মূলে মানুষের স্থানান্তর নয়, সমস্যাটির মূলে আছে মানুষকে দাসে পরিণত করার প্রবণতা (এনস্লেভিং, হোল্ডিং ইন সার্ভিচুড)। হিউম্যান ট্রাফিকিং হচ্ছে একটি আমব্রেলা টার্ম, এর আওতায় মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাচার করা, বিক্রি করা, জোর করে কাজে খাটানো, আটকে রেখে কাজ করানো—সবকিছুই পড়ে।’
মানব পাচার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহযোগিতা করছে জানতে চাইলে মিস্টার সিডিবাকা জানালেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও ইউএসএআইডির অর্থায়নে বেশ কিছু প্রকল্প ও কর্মসূচি চলছে। ‘অ্যাকশনস ফর কমব্যাটিং ট্রাফিকিং ইন পারসনস’ নামে চার বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে ইউএসএআইডির অর্থায়নে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সচেতনতা বাড়ানো, প্রশিক্ষণ দেওয়া, পাচারের শিকার মানুষদের মধ্যে উদ্ধারপ্রাপ্তদের নিরাপদ আশ্রয়, সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরামর্শ, প্রশিক্ষণ, আয়ের সুযোগ ও পুনর্বাসনের কাজ চলছে এই কর্মসূচির আওতায়। সরকারি কৌঁসুলি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা, আইনজীবী ও আইনি সহায়তা দানকারী এনজিওগুলোর কর্মীদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। ইউএসএআইডি ও উইনরক ফাউন্ডেশন নামের একটি মার্কিন সংস্থার এক যৌথ প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য, বিদেশে যারা লোক পাঠায়, তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, সততার সঙ্গে যেন তারা ব্যবসাটা করতে পারে, তাদের পাঠানো মানুষেরা যেন বিদেশে গিয়ে প্রতারিত না হয়। মিস্টার সিডিবাকা বললেন, যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি বায়রার সদস্য, তাদের জবাবদিহি চাওয়ার বা অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে। তাদের একটা আচরণবিধিও আছে। কিন্তু এরা ৬০ শতাংশ। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ৪০ শতাংশই অনিবন্ধিত। সমস্যা বেশি তাদের নিয়েই, কারণ তারা অনিয়ন্ত্রিত, আনরেগুলেটেড। এরা হয়তো প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও কাজ করে না। তারা গ্রামের সাধারণ মানুষকে কোনো দেশের ট্যুরিস্ট ভিসা পাইয়ে দিয়ে অর্থ আয় করে; আর সেই ভিসা নিয়ে একজন মানুষ বিদেশে গিয়ে কাজ পান না, সর্বস্বান্ত হয়। এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
আলাপের একপর্যায়ে মিস্টার সিডিবাকা জানালেন, বাংলাদেশে একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে, সেই কাজে তাঁরাও সহযোগিতা করেছেন। ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১১’ নামের আইনটি শিগগিরই মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। খসড়াটির একটি কপিতে দেখলাম, ‘দাসত্ব’ ও ‘সার্ভিচুড’ শিরোনামে দুটি সংজ্ঞা রয়েছে। মিস্টার সিডিবাকা বলছিলেন, বাংলাদেশের আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানের করার লক্ষ্যে তাঁরা এর খসড়া প্রণয়নে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক আইন ও নানা সনদে দাসত্ব বা দাসশ্রমকে মানব পাচারসংক্রান্ত অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করা হয়েছে। এ দেশে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ নামের একটি আইন (২০০২ সালে সংশোধিত) রয়েছে, কিন্তু মানব পাচারের সব ধরনের অপরাধ বিচারের জন্য এ আইন যথেষ্ট নয়। কথা প্রসঙ্গে মিস্টার সিডিবাকা বলছিলেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণে গত কয়েক বছরে এ দেশে মানব পাচার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এর একটি কারণ পর্যাপ্ত আইনি হাতিয়ারের অভাব এবং ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচির অভাব। আইনি হাতিয়ারের অভাবটির এক বড় অংশ পূরণ হতে পারে নতুন আইনটি গৃহীত হওয়ার পর। কিন্তু কর্মকাণ্ড বাড়ানোর কাজ তার পরও রয়ে যাবে। শুধু পাচার হওয়া বা দাসত্বের শিকার হওয়া ঠেকানো নয়, অপরাধীদের বিচার করা, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের সমাজে ও পরিবারে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা খুব কঠিন কাজ। এখানে শিক্ষা ও সচেতনতার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মিস্টার সিডিবাকা। শিশু-কিশোরদের পাচার, বিক্রি হওয়া বা দাসত্বের কবলে পড়া ঠেকানোর লক্ষ্যে তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্ধারপ্রাপ্তদের স্থায়ী পুনর্বাসন নিশ্চিত হবে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে; এ জন্য তাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বাড়ানো প্রয়োজন।
মিস্টার সিডিবাকার কথায় ঘুরেফিরে আসছিল মানুষের মর্যাদার বিষয়টি। মানুষের মর্যাদাকে কেন্দ্রে রেখে আইন প্রণীত হলে, মানুষকে মর্যাদার চোখে দেখলে তার প্রতি অন্যায়-অবিচার করা যাবে না। তাকে দাস বানানো যাবে না, জবরদস্তিমূলকভাবে খাটানো যাবে না, বিক্রি করা যাবে না, শোষণ করা যাবে না। হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের সমস্যাটিকে দেখার এ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। আমেরিকান সামোয়ার ওই কোরীয় কারখানাটির শ্রমিকদের নির্মম দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে ভিয়েতনামের ১২ জন নারীকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করে মিস্টার সিডিবাকা ও তাঁর সহকর্মীরা মানুষের মর্যাদাই প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিল সু লি নামের ওই মানবতার শত্রুর (মানব পাচার মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবেও স্বীকৃত) মতো কয়েক ডজন অপরাধীকে বিভিন্ন মামলায় তিনি কারাগারে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেছেন মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.