চরাচর-গুরুদুয়ারা নানক শাহী by আলম শাইন
যত দূর জানা যায়, বাংলাদেশে শিখ সম্প্রদায়ের লোকজনের বাস খুব একটা নেই। বলা যায় তাঁদের সংখ্যা একেবারেই সীমিত। যাঁরা বাস করছেন তাঁদের বেশির ভাগই শহরকেন্দ্রিক আবাস গড়েছেন। এর অবশ্য বিবিধ কারণ রয়েছে। প্রধান কারণটি হচ্ছে নিরাপত্তাজনিত বিষয়।
দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় পুরান ঢাকায় তাঁদের অবস্থান কিঞ্চিৎ পরিমাণ বেশি। শিখ সম্প্রদায়ের প্রধান উপাসনালয়টিও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেটের ভেতর অবস্থান করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে অদ্যাবধি অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই উপাসনালয়টি। এটি কবে নির্মাণ করা হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও ইতিহাসবিদদের ধারণা, ১৬০৬-১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময় উপমহাদেশের শাসনভারের দায়িত্বে ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। তিনি তখন পূর্ববাংলা শাসনভারের দায়িত্ব দেন ষষ্ঠ শিখগুরু হরগোবিন্দ সিংকে। তাঁর প্রচেষ্টায় বর্তমান 'গুরুদুয়ারা নানক শাহী' নামের শিখ সম্প্রদায়ের উপাসনালয়টি গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন গুরুদুয়ারা পরিত্যক্ত থাকার পর ১৮৩৩ সালের দিকে সংস্কার করা হয়। বেশ মনোরম স্থাপনা এটি। পূর্বমুখী করে বর্গাকার ড্রামের ওপর স্থাপিত গম্বুজবিশিষ্ট। উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বদিকের দেয়ালে পাঁচটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। রয়েছে কেন্দ্রীয় কক্ষের চারদিকে পাঁচ ফুট প্রশস্ত বারান্দাও। বারান্দার প্রতিটি কোনায় রয়েছে একটি করে মোট চারটি কক্ষ। উল্লেখ্য গুরুদুয়ারার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য বাইরের দিকে ৩০ ফুট। শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতি শুক্রবার এখানে জমায়েত হয়ে বিশেষ প্রার্থনায় রত হন। এ ছাড়া প্রতিদিন তাঁরা পবিত্র গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে পূজা-অর্চনাও করে থাকেন। তাঁদের পূজা-অর্চনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ওই গ্রন্থখানি। এই পবিত্র গ্রন্থখানির নাম 'গ্রন্থসাহেব'। অপরদিকে গুরুদুয়ারার প্রার্থনার কক্ষকে বলা হয় 'দরবার সাহেব'। এখানে বসে নারী-পুরুষ উভয়ে প্রার্থনাদি সেরে নেন। প্রার্থনার পাশাপাশি তাঁরা নানা ধরনের বাদ্য-বাজনাও বাজিয়ে থাকেন। তার পর 'গুরুকা লঙ্গর' নামের ভোজনালয়ে পূজারিরা সবাই মিলে পেট পুরে খেয়ে নেন। সবাই মিলে একত্রে খেলে সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায় বলে তাঁরা মনে করেন। উল্লেখ্য, দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এখানে এসে প্রার্থনায় সমবেত হন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বশেষ ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এখানে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের স্ত্রী গুরুশরন কাউর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাড়াও রাজধানীতে আরো কিছু শিখ সম্প্রদায়ের উপাসনালয় রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাবাজারে 'গুরুদুয়ারা নানক কুয়ান', উর্দুবাজারে 'গুরুদুয়ারা সুতারা শাহী'। আর বিলুপ্তির পথে রয়েছে ইংলিশ রোডের 'গুরুদুয়ারা বাবা মোহন সিং'। এটি সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করছি আমরা। তৎসঙ্গে কামনা করছি 'গুরুদুয়ারা নানক শাহী' যেন যুগ যুগ ধরে অক্ষতভাবে টিকে থাকে। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তাই এমন একটি পুরাকীর্তি ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার ওপরই বর্তায় বলে মনে করছি।
আলম শাইন
No comments