জন্মদিন-মধুসূদনের অন্তিম দিনগুলি by কাজী শওকত শাহী

এই দিনে জন্মেছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যশোরের সাগরদাঁড়িতে, কপোতাক্ষের তীরে। জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে, কিন্তু জীবন কাটল তাঁর দীনতার চরম কষ্টে। বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে নিয়ে এসেছিলেন তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, কিন্তু মৃত্যুতে তাঁকে ঘিরে রইল করুণ ও কঠিন দুঃখ। এত দুঃখ খুব কম মানুষকেই সইতে হয়েছে।


জীবন শেষের সে রকমই এক দিন: বাল্যবন্ধু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট গৌরদাস বসাক কবিকে দেখতে এসেছেন। সেটাই সম্ভবত মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর শেষ সাক্ষাৎ।
তিনি দেখলেন, মধ্যাহ্নের সূর্য যেন ঢলে পড়েছে। আত্মম্ভরি কবি ম্লানভাবে বিছানায় শুয়ে রোগযন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ওদিকে মেঝেতে শুয়ে প্রচণ্ড জ্বরে কাতরাচ্ছেন স্ত্রী হেনরিয়েটা। গৌরবাবুকে দেখে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমাকে দেখতে হবে না, ওঁকে দেখুন, ওঁর পরিচর্যা করুন। মৃত্যুকে আমি পরোয়া করিনে।’ গৌরদাসকে অনেক কষ্টে ভাঙা গলায় মধুসূদন বললেন, ‘যা হয়েছে, এর চেয়ে আর কী হতে পারে? শরীরে জল হয়েছে, গলায় ঘা হয়েছে, রক্তবমি করছি, এখনো তো হোমারের মতো অন্ধ হয়ে যাইনি।’ গ্রিক হোমারও মহাকবি, বাংলার মাইকেলও মহাকবি।
মাত্র ৪৫ বছর বয়সে গলায় ঘাসহ অনেক জটিল রোগ বাসা বাঁধে মধুসূদনের দেহে। প্রৌঢ়ত্বকে বরণ করে নিয়েছিলেন তিনি, হেনরিয়েটার স্বাস্থ্যও ভালো নয়। এরই মধ্যেও অতিমাত্রায় মদ পান করে মৃত্যুকে যেন টেনে আনছিলেন মধুকবি। নাবালক ছেলেমেয়ের কথা ভেবে তাঁর মন কেঁপে ওঠে। ছেলে মিলটন ও অ্যালবার্ট নেপোলিয়ন কি তাহলে অভুক্ত অবস্থায় মারা যাবে! আদরের দুলালি শর্মিষ্ঠার কী হবে! অবশেষে কন্যাদায়গ্রস্ত কবি ১৩ বছর বয়সী কন্যাকে পাত্রস্থ করলেন দ্বিগুণ বয়সী অর্ধবেকার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের সঙ্গে। শর্মিষ্ঠার বিয়ের পর তিনি এসে উঠলেন জয়কেষ্ট মুখার্জির উত্তরপাড়ার লাইব্রেরির দোতলায়। ১৮৭২ সালে বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসেন হাওড়া জেলায়। এ সময় তিনি নিয়তই অসুস্থ বন্ধুকে দেখার জন্য তাঁর উত্তরপাড়ার বাসায় যেতেন।
গৌরদাস মধুকে কলকাতায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাইলেন, কিন্তু মধুসূদন নিজেই সে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ২১ জুন ১৮৭৩ সালে মধুসূদন পরিবারসহ রোগজীর্ণ শরীরটাকে বয়ে নিয়ে এলেন কলকাতায়। হেনরিয়েটা উঠলেন জামাই উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের ‘লিন্ডসে স্ট্রিট’-এর বাড়িতে আর কবি মধুসূদন আশ্রয় নিলেন আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে। এই হাসপাতালে কবি আট দিন জীবিত ছিলেন। দীর্ঘদিন অনিয়ম আর বিনা চিকিৎসায় তাঁর শরীর আগে থেকেই জীর্ণ হয়ে পড়েছিল। হাসপাতালের চিকিৎসায় একটু উপশম হলেও ক্রমাগত গলার ব্যথা, হূদরোগসহ বিভিন্ন জটিল ব্যাধি তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
মধুসূদন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন। মহাকবির জীবনসূর্য যতই দ্রুত অস্তমিত হয়ে আসছে, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে ততই বিভেদ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে লাগল। মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও পাদরিরা তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিষ্টান বলে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। মধুসূদনকেও বলতে শোনা যায়, ‘আমি মনুষ্য নির্মিত গির্জার সংস্রব গ্রাহ্য করি না।’
এ রকম সময়েই এল হেনরিয়েটার মৃত্যুর সংবাদ। অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু তাঁর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে শোকাশ্রু। মধুসূদনের শারীরিক অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হয়ে উঠতে লাগল। ২৯ জুন সকাল থেকে কবির আত্মীয়-পরিজন এবং কবিভক্ত অনেক হিতাকাঙ্ক্ষীই তাঁকে দেখতে এলেন। দেখতে এলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ঘোষ, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের মধ্যে মধুসূদনের ভ্রাতুষ্পুত্র ত্রৈলোক্যমোহন দত্তকেও দেখা গেল। মধুসূদন তাঁকে বললেন, ‘ত্রৈলোক্যমোহন! জীবনের কোন আশা পূর্ণ হয় নাই, অনেক আক্ষেপ লইয়া মরিতেছি, এখন বলিবার শক্তি নাই। তুমি আরেক সময় আসিও, অনেক কথা বলিবার আছে। তোমায় বলিব।’ কিন্তু সে কথা আর বলা হলো না—সে কথাই মধুসূদনের জীবনের শেষ কথা।
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন রোববার মহাকবি মধুসূদন দুপুর দুইটার সময় জামাতা, পুত্র-কন্যাপরিবেষ্টিত আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মধুসূদনের মৃত্যুসংবাদ দ্রুতগতিতে কলকাতা শহরের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ল। কবিকে একনজর দেখার জন্য আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোক এসে ভিড় জমাতে লাগল। তৎকালীন খ্রিষ্টান সম্প্রদায় পরিচালিত জনপ্রিয় ইংলিশম্যান পত্রিকায় মধুসূদনের মৃত্যুসংবাদ ছাপা না হলেও বাংলার সব পত্রপত্রিকায় তা প্রচারিত হয়।
মহাকবির মৃতদেহ মৃতাগারে ফেলে রেখে খ্রিষ্টান পাদরিরা তাঁর শেষকৃত্য নিয়ে বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। মধুসূদনের বন্ধু ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শবদেহ শ্মশানে নেওয়ার যাবতীয় আয়োজন করেছিলেন, কিন্তু মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে সে পথ তিনি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
কৃষ্ণমোহন মধুকে খ্রিষ্টান কবরস্থানে সমাহিত করার অনুমতির জন্য লর্ড বিশপ রবার্ট মিলমানের কাছে ধরনা দিয়েও ব্যর্থ হলেন। ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত গ্রীষ্মের ভাপসা গরমে কবির মরদেহ মর্গে পড়ে থেকে যখন গন্ধ ছড়াতে লাগল। তখন সংস্কারমুক্ত সাহসী পাদরি রেভারেন্ড ডক্টর পিটার জন জার্বো বিশপের অনুমতি ছাড়াই কবির মরদেহ সমাহিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।
১৮৭৩ সালের ৩০ জুন সোমবার অপরাহ্নে টমার্স অ্যান্ড কোম্পানির শকটে মহাকবির মরদেহ তুলে নিয়ে ভক্তরা লোয়ার সার্কুলার রোডের পাশে খ্রিষ্টান কবরস্থানের দিকে এগিয়ে চললেন।
যেখানে চার দিন আগে জীবনসঙ্গী হেনরিয়েটাকে সমাহিত করা হয়েছিল, তার পাশে শোয়ানো হলো কবিকে। অলক্ষে উচ্চারিত হলো যেন কবির শেষ সংলাপ:
‘জীবনের কোন আশা পূর্ণ হয় নাই, অনেক আক্ষেপ লইয়া মরিতেছি... অনেক কথা বলিবার আছে।’ এই নিষ্ঠুর কিন্তু ভালোবাসার পৃথিবীকে কীবলবার ছিল তাঁর? কোন আক্ষেপ তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল? কে জানবে, কে দেবে উত্তর?
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.